জয়ী_১ রোকেয়া পপি।

0
468

#জয়ী_১
রোকেয়া পপি।

শিল্প কলা একাডেমীতে চলছে জয়ীর একক চিত্র প্রদর্শনী।
শুধু মাত্র জয়ী নামটা দেখেই আমি পাগলের মত ছুটে এসেছি শিল্প কলায়।

জয়িতা কে দেখার পর আমি স্ট্যাচু হয়ে গেছি। এক পা ও নড়তে পারছি না। ঐতো কি সুন্দর করে হেসে হেসে কথা বলছে সবার সাথে। ঠিক বিশ বছর আগে যেভাবে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলতো, ঠিক সেই ভঙ্গিতেই কথা বলছে। সেটা কিভাবে সম্ভব!
বিশ বছরে এতো টুকু চেঞ্জ হয়নি! যেন আরো বেশি সুন্দর হয়েছে। দেশের বাইরে থাকার কারণে গায়ের রং টাও খুলছে। আগেও স্মার্ট ছিল, এখন যেন আরো বেশি স্মার্ট।

অথচ এই আমি বিশ বছরে কতো রোগ শোক বাঁধিয়ে বুড়ো হয়ে গেছি। চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে লাঠির সাহায্য ছাড়া চলতে পারিনা। যে কেউ দেখলে ষাট বছরের বুড়ো ভাববে।
অথচ জয়ীতা কিভাবে নিজেকে এতো সুন্দর করে ধরে রেখেছে!
দেখে মনে হচ্ছে পনেরো ষোল বছরের উচ্ছল তরুণী!

জয়ী কে দেখার পর থেকে ওর সাথে কথা বলার লোভ কোন ভাবেই সামলাতে পারছি না।
অথচ ওর সামনে যাওয়ার মতো সৎ সাহস আমার নেই। কোন মুখে যাবো আমি ওর সামনে।

চরম বিপদের দিনে আমি ওর পাশে থাকতে পারিনি। কোন রকম সাপোর্ট দিতে পারিনি।
কতোটা যুদ্ধ করতে হয়েছে জয়ীকে একা একা নিজের সাথে, সমাজের সাথে। শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটা।

জয়ী আজ কতো বড়ো নাম করা চিত্র শিল্পী। দেশ বিদেশে জয়ীর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। সুদূর প্যারিস থেকে বাংলাদেশে এসে একক চিত্র প্রদর্শনী করছে!

জয়ী তোর সাথে যে আমার অনেক কথা বলার ছিল।কতো খুঁজছি আমি তোকে। আর আজ যখন তুই আমার সামনে, আমি চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। দেখ আমার পা দুটো কেমন ভারি হয়ে গেছে। আমি একটা ধাপ ও ফেলতে পারছি না।

অনেকক্ষণ ধরে তমাল খেয়াল করছে একজন ভদ্রলোক মিস জয়ীর দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। এক্সিবিশনে যারা আসে তারা সাধারণত ছবি দেখে, পছন্দ হলে কিনে ফেলে। আর জয়ীর আঁকা প্রতিটা ছবি অসাধারণ। প্রথম দিনেই অর্ধেক ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। তিন দিনের এক্সিবিশন। আজ দ্বিতীয় দিন। মাত্র লোকজন আসা শুরু করেছে। একটু পরেই মানুষের ঢল নামবে।
তমাল কোন ভাবেই বুঝতে পারছে না, উনি আসলে কি চায়। কেন ছবি দেখা বাদ দিয়ে জয়ীর দিকে এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই জয়ীর কোন আত্মীয় হবে।

এক্সকিউজ মি ।
মিস জয়ী আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?

জয়ী স্মিত হেসে বললো অবশ্যই তমাল ভাই।
বলুন কি বলবেন?

মিস জয়ী কিছু মনে করবেন না প্লিজ । পেছনে যে ভদ্রলোক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, উনি কি আপনার পরিচিত কেউ?

জয়ী খুবই অবাক!
বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, আমি তো উনাকে চিনতে পারছি না। তাছাড়া বাংলাদেশে আমি এই প্রথম এসেছি আপনাদের নিমন্ত্রণে। আমার পরিচিত কেউ এখানে কিভাবে আসবে?
কেন বলুন তো তমাল ভাই?

না মানে আমি প্রায় আধাঘণ্টা ধরে খেয়াল করছি, উনি আসার পর থেকে একটা ছবিও দেখেনি। একভাবে আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই ভাবলাম আপনার আত্মীয় বা পরিচিত কেউ হবে। আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি ভাববেন না। আমি দেখছি উনি কি চায়।

জয়ী তমালকে থামিয়ে দিল।
থাক তমাল ভাই, আপনি আপনার কাজ করুন।
আমি দেখছি, উনি কি চায়।

ঐ তো জয়ী আমার দিকে আসছে, কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে কলাপাতা রঙের জামদানী শাড়িতে। গালে টোল পড়া সেই মিষ্টি হাসি।
ও এখনো আমার পছন্দ গুলো মনে রেখেছে!
খোঁপায় বেলি ফুলের মালা আমি খুব পছন্দ করতাম। ও কি জানে আজ আমি আসবো! তাহলে কি আমাকে খুশি করার জন্য খোঁপায় বেলি ফুলের মালা, আমার পছন্দের জামদানি শাড়ি পড়েছে।

হ্যালো আঙ্কেল, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?

জয়ীর ডাকে আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে
আমি বাস্তবে ফিরে এলাম।
কিন্তু একি জয়ী আমাকে আঙ্কেল বলছে কেন? ও কি আমাকে সত্যিই চিনতে পারছে না!

কেমন আছিস জয়ী?
শেষ পর্যন্ত আমাকে আঙ্কেল বললি!
তোর সাথে যে অন্যায়গুলো হয়েছে তাতে আমাকে ভুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর জয়ী, সেই মুহূর্তে আমার কিছুই করার ছিল না, আমি তখন খুব অসহায় ছিলাম।

সরি আঙ্কেল, আমার মনে হয় আপনার কোন ভুল হচ্ছে। আমি আপনাকে চিনি না। আগে কখনো দেখেছি বলে ও মনে হয় না।

আমার তো এতো বড়ো ভুল হতে পারে না। সেই চোখ, সেই হাসি। কে তুমি? তোমার নাম জয়ীতা না?

সরি আঙ্কেল, আমি জয়ী। তবে আমি মনে হয় বুঝতে পারছি আপনার সমস্যাটা।
আমার মায়ের নাম জয়ীতা হক। খুব সম্ভবত আপনি আমার মায়ের বন্ধু।

কোথায় তোমার মা?
আমাকে এক্ষুনি তোমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো। তাকে আমার অনেক অনেক কথা বলার আছে।

আপনি শান্ত হোন প্লিজ।
আমার মা এখন আর মানুষ জন, হৈচৈ পছন্দ করেন না। বিশ বছর পর দেশে এসেছে। এখানে তার কতো স্মৃতি, অথচ হোটেলের রুমে একা একা সময় কাটাচ্ছে।
কোন ভাবেই মা কে এখানে আনতে পারলাম না।

আমাকে ঠিকানাটা কি দেওয়া যায়?
তোমার মাকে আমার খুব দরকার।

আপনার নামটা বলুন। আমি আগে মাকে আপনার কথা বলি। মা যদি দেখা করতে রাজি হয়, তাহলে কাল এখানে নিয়ে আসব। আপনি কাল কষ্ট করে একটু এখানেই আসবেন।

আমার নাম রেজা। এই আমার ভিজিটিং কার্ড। এখানে ফোন নাম্বর আছে। জয়ীতাকে বলো, আমি অপেক্ষা করবো তার ফোনের জন্য। ও যেন অবশ্যই ফোন দেয়।

এক্সিবিশনে আজকে জয়ী খুব দৌড়ের ওপর ছিল।
অনেক টায়ার্ড লাগছে। আর তাই রুমে এসে চেঞ্জ করেই শুয়ে পড়েছে।

জয়ীতা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জয়ীর প্রায় ঘুম চলে এসেছে মায়ের হাতের আদরের স্পর্শে।

জয়ীতা মেয়ের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে মমতা মাখা কন্ঠে বললো, কিরে মা এসেই শুয়ে পড়লি যে! খাবি না?

ইচ্ছে করছে না খেতে। কিন্তু তারপরও খাবো।
আমি জানি আমি না খেলে, আমার মা ও না খেয়ে ঘুমাবে।

তাহলে ওঠ। রুমে খাবার দিয়ে গেছে, গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নেই।

এদের রান্না কিন্তু বেশ ভালো তাই না মা?

হুম ভালোই তো।
তারপর তোর আজকের এক্সিবিশন কেমন চললো?

ওহ্ মা কি বলবো, দারুন দারুন।
সবাই খুব প্রশংসা করছিল।
মা তোমাকে তো একটা মজার ঘটনা বলতে ভুলেই গেছি।

কি ঘটনা?

আজকে একজন মধ্যবয়সি লোক, দেখতে অবশ্য বেশ হ্যানন্ডসাম। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল।
আমি জানতে চাইলাম আমার কাছে কোন দরকার কি না?
তারপর জয়ী জয়ী করে কি সব উল্টাপাল্টা কথা শুরু করলো, আমি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝিনি।
তোমার পরিচিত কেউ হবে হয়তো, কি যেন নাম বললো।
ও মনে পড়েছে রেজা।
ওয়েট একটা কার্ড দিয়েছে। দিচ্ছি তোমায়।
তোমার সাথে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
ফোন করে কথা বলে নাও।
এই নাও কার্ড।

কি ব্যাপার মা, তোমার হাত এমন কাঁপছে কেন?
চেহারা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

না মা আমি ঠিক আছি।
তুই খা। আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না।

জয়ী খেয়াল করেছে, রেজা নামটা শোনার পর মার মুখভঙ্গি চেঞ্জ !

মা, কে এই রেজা?
চিনতে পেরেছো?

হুম আমরা চারুকলায় একসাথে পড়তাম। আমার বন্ধু।

ও আচ্ছা।
ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়ো অথবা ফোন করে কথা বলতে পারো। উনি ওয়েট করবেন তোমার ফোনের জন্য। আমরা তো কালকের দিনটা আছি। পরশু চলে যাবো। আমি হাতের কাজ গুলো গুছিয়ে ফেলি। আমার একটু সময় লাগবে।

জয়ীতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু ঘুম যেন ওর চোখ থেকে হারিয়ে গেছে রেজা নামটা শুনে। ও মনে মনে ভাবছে,
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, যার জন্য মেয়েটার সাথে না গিয়ে চোরের মতো একা একা হোটেলের এই রুমটায় সময় কাটাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত তার কাছে ঠিক ধরা পড়ে গেলাম।
বিশটা বছর ধরে তোকে ভুলে থাকার এতো আপ্রাণ চেষ্টা। নিজ দেশে পর্যন্ত আসা বন্ধ করলাম। তারপরও কি পেরেছি তোকে ভুলতে!
না তুই আমাকে!
তোর নামটা যে আমার শরীরের প্রতিটা রক্ত কণিকার সাথে মিশে আছে। কিভাবে ভুলবো তোকে বলতে পারিস?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here