জয়ী_৩ কলমে রোকেয়া পপি।

0
380

#জয়ী_৩
কলমে রোকেয়া পপি।

জয়ীতা আজ শোকে, দুঃখে পাথর হয়ে গেছে। এখন আর কোন দুঃখ কষ্ট যেন ওকে স্পর্শ করতে পারছে না।
খাওয়া নেই, ঘুম নেই, ঘরের বাইরে ও বের হতে ইচ্ছে করে না।
আজ রেজা এসেছিল। জয়িতা ফিরিয়ে দিয়েছে।
ওদের কথোপকথন ছিল এমন।

রেজা: জয়ীতা তোর জীবনে এতো বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল, অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না। তোর বিপদের সময় আমি পাশে থাকতে পারলাম না। আমি তোর এতোটাই পর হয়ে গেছি, যে তিন দিনের দিন আমি জানলাম তাও অন্যের মুখে!

জয়ীতা: মোবাইল অফ করে রাখলে কিভাবে জানবি?
তাছাড়া নতুন বৌ নিয়ে বাসর রাত উপভোগ করছিস। আমাদের খোঁজ না পেলেই বা কি?

রেজা: জয়ীতা প্লিজ এভাবে বলিসনা। অনেক কষ্ট হচ্ছে ।
সেদিন আমি এতটাই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলাম যে, বিয়ে করা ছাড়া আমার সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিলো না ।
তোর সামনে কিভাবে মুখ দেখাবো তাই মোবাইল অফ করে রেখেছিলাম। একটু বোঝার চেষ্টা কর।

জয়ীতা: ভালো তো।
আমার তো কোন অভিযোগ নেই। বিয়ে করেছিস, নতুন বউয়ের সাথে সংসার শুরু করেছিস।
তা এখানে কি চাই? তুই এখন আসতে পারিস রেজা।
আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

রেজা: জয়ীতা আমি তোকে নিতে এসেছি। আমি বেঁচে থাকতে তোকে এভাবে একা থাকতে দিতে পারি না। তুই আমার সাথে চল।

জয়ীতা: কোথায়?

রেজা: আমাদের বাড়িতে।

জয়ীতা: সেটা হয় না।
সেদিন আন্টি আমার মাকে ঠিক কি বলেছে আমি জানি না। তবে এতো টুকু বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি যে, আন্টি এতোটাই অপমান করেছে যে, ফোনে কথা বলা অবস্থায় আমার মা স্টোক করেছে।

এই আমার জন্য আমার মাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। আমার আর কাউকে দরকার নেই।
তাছাড়া তোর এখন নতুন জীবন শুরু হয়েছে। ঐ মেয়েটা তো কোন অপরাধ করেনি। আমি যে কষ্ট পাচ্ছি ঐ মেয়েটাও কেন একিই কষ্ট ভোগ করবে?

রেজা: আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না ।
তোকে এভাবেই ধুকেধুকে কষ্ট পেতে দিতে আমি পারিনা‌। আমার চোখের সামনে তুই কষ্ট পাবি আর আমি কি ভালো থাকতে পারবো।
প্লিজ জয়ীতা আমার সাথে চল । যা হয় হবে।
আজ আর আমি কাউকে পরোয়া করবো না।
আমি সব সময় তোর পাশে আছি, ছিলাম, থাকবো।

জয়ীতা: আমার পাশে কাউকে প্রয়োজন নেই।
এই যুদ্ধটা আমার একার।
আমি জানি সামনে আমার জন্য অনেক কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। তারপর ও এই কঠিন পরিস্থিতি আমি একাই নিয়ন্ত্রণ করবো।

রেজা: জয়িতা আর একবার চিন্তা করে দেখ। সবকিছু নিয়ে জেদ করিস না। তাছাড়া তুই কিন্তু এখন আর একা না। তোর গর্ভে যে সন্তান বড়ো হচ্ছে, তার বাবার পরিচয় লাগবে।

জয়ীতা: রেজা তুই এখন যা। তোর সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। আর কখনো আসবি না আমার সামনে।
আমার সন্তান শুধু আমার। ওকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।
আমি একাই পারবো ওকে পৃথিবীর আলো দেখাতে, মানুষ করতে।

রেজা কে ফিরিয়ে দেওয়ার পর পর শুরু হলো জয়ীতার জীবনের চরম লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অপমানের দিন গুলো।
যেখানে যায় সেখানেই ওকে নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, মুখ টিপে হাসাহাসি।
কেউ কেউ সরাসরি এসে জিজ্ঞেস করে বাচ্চার বাবা কে?
অফিস কলিগ রাও এড়িয়ে চলতে শুরু করল ওকে।
একদিন বাড়িআলি খালাম্মা এসে ইনিয়ে বিনিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিতে বললে জয়ীতার মাথায় হঠাৎ করে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।

ও বিস্মিত হয়ে বললো, কি বলছেন খালাম্মা আমি বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবো?
আপনি তো জানেন ঢাকা শহরে আমার কোন আত্মীয় স্বজন নেই।

সে আমি কি জানি বাপু। এটা ভদ্র পাড়া। তুমি অবিবাহিত মেয়ে হয়ে পেট বাঁধিয়েছো, মহল্লার মানুষ ছি ছি করছে। তুমি ভালো চাকরি করো, ভেবেছিলাম ভদ্রলোক।
এখন তো আমাদের মান সন্মান নিয়ে টানাটানি। তুমি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও যাও বাপু।
আমার ঘরেও জোয়ান মেয়ে আছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে তো।

ঠিক আছে খালাম্মা, আমাকে দুই মাস সময় দিতে হবে। আমি চেষ্টা করব আরো আগে চলে যাওয়ার।

ঠিক আছে বাপু দুই মাস সময় লাগলে সময় নাও। কিন্তু কথাটা মনে থাকে যেনো। আমার আবার এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না।

চারদিক থেকে এতো অপমান সহ্য করতে না পেরে জয়ীতা শেষ পর্যন্ত স্কলার্শিপের জন্য আবেদন করলো।
অনেক দৌড় ঝাঁপ করে কাঙ্ক্ষিত কলারশিপ টি পেয়েও গেল। যেহেতু ওর রেজাল্ট খুব ভালো তাই খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ওকে।

মাসখানেকের মধ্যে বিশ্ব বিখ্যাত ইনভারসিটি ফাইন আর্টস এর টিচার হিসেবে প্যারিসে শুরু হল জয়ীতার নতুন জীবন। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে এসে জয়ীতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ওর সবচেয়ে বড় পাওয়া এখানে কেউ কারো বিষয়ে মাথা ঘামায় না।

একটা সময় ওর কোল আলোকিত করে জয়ী এলো এ পৃথিবীতে। ফুটফুটে পরীর মতো বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে ভাবতে লাগলো,
রেজা আমাকে জয়ীতা বলতো খুব কম। আদর করে জয়ী বলতো বেশি। একাকী জীবনে এসে এই নামটাকে আমি খুব মিস করছিলাম রেজা। তাই আমাদের ভালোবাসা ফসলের নামটাও রাখলাম জয়ী।

রেজাকে ভুলে থাকার এরকম ছেলে মানুষী টাইপের হাস্যকর প্রচেষ্টায় জয়ীতা একাই ফিক করে হেসে উঠলো।

রেজার কথা ভাবতে ভাবতে কখন রাত শেষ হয়ে ভোর হয়েছে টের পায়নি। শুরু হলো আরেকটি নতুন দিন। আজকের দিনটি অন্য দিনগুলোর মতো নয়। বিশবছর পর আবার রেজার মুখোমুখি হতে হবে!

চারদিকে মিষ্টি আলোয় ভরে গেছে। পাশে কোন মসজিদ থেকে আজানের সুমধুর সুর ভেসে আসছে। জয়ীতা উঠে হাত মুখ ধুয়ে অযু করে নামাজটা পড়ে ফেললা। তারপর বেলকোনিতে গিয়ে বসলো। শুরু হলো নিজের মনের সাথে এক চরম যুদ্ধ।

এতো গুলো বছর পর রেজার সাথে দেখা করাটা কি ঠিক হবে। জয়ী যদি কিছু বুঝে ফেলে।
জয়ী জানে ওর জন্মের আগেই ওর বাবা মারা গিয়েছে। আমি চাই না নতুন করে ও কিছু জানুক, বা কষ্ট পাক।

জয়ী ঘুম থেকে উঠে দেখে মা বিছানায় নেই। বেলকোনিতে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন । ও যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছি কিছুই টের পায়নি ।
রাতে যে একটুও ঘুমায়নি চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এক রাতে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওর মা কে।

জয়ী ওর মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মমতা মাখা কন্ঠে বললো, কি হয়েছে মা?
তুমি ঘুমাওনি?
তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

ও কিছু না মা। তুই তো জানিস মাঝে মধ্যে আমার ঘুম হয় না।

জয়ী কপট রাগ দেখিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাকে ডাকলে না কেন?
দুজনে মিলে সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দিতাম।

কি যে পাগলের মত কথা বলিস না।
এক্সিবিশন নিয়ে সারাদিন তোকে কত দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আবার শুধু শুধু রাত জেগে শরীর নষ্ট করবি কেন?

রেজাও আজ সারারাত ঘুমাতে পারেনি ।
মন থেকে বিশ্বাস ছিল রাতে জয়ীতা অবশ্যই ফোন দিবে । ফোনের অপেক্ষা আর পুরনো দিনগুলোর কথা চিন্তা করতে করতেই কখন সকাল হয়ে গেল।
জয়ীর কাছ থেকে কেন যে নাম্বারটা নেয়নি।
নিজের ভুলের জন্য মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর।

অফিসে বসেও কোন কাজে মন বসাতে পারছে না। তাহলে কি জয়ীতা আমার সাথে দেখা করবে না।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন এ রেজা ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসলো। আননোন নাম্বার।
হ্যালো কে বলছেন?

আমি রবীন্দ্র স্বরনীতে অপেক্ষা করছি। ইচ্ছে হলে আসতে পারিস। রেজা কে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলো জয়ীতা। বার বার অকারণে অবাধ্য চোখটা ভিজে উঠছে। আলতো করে চোখের পানি মুছে নিজেই নিজেকে শাসনের সুরে বলল
না আমি কাঁদবো না, আমাকে শক্ত হতে হবে।

দশ মিনিটের মাথায় রেজা হাজির। ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই যে ছুটে এসেছে বোঝা যায়।

জয়ীতার পাশে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, কেমন আছিস জয়ী?

জয়ীতা স্মিত হেসে বললো, যেমন দেখছিস।

তুই ঠিক আগের মতোই আছিস। শুধু চুলে একটু পাক ধরেছে আর চোখে চশমা।

হুম।
ডেকেছিস কেন?

হুট করে রেজা জয়ীতার হাত চেপে ধরে আবেগীয় কন্ঠে বললো, জয়ী তোকে আমার অনেক অনেক কথা বলার আছে। কিন্তু এখন সব কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি। মাথা কাজ করছে না।

হাত ছাড় রেজা।
এখন আর আমি সেই জয়ী নেই।
আমি এখন জয়ীতা হক।
জয়ী হকের মা।
একজন সিঙ্গেল মাদার।

আমাকে মাফ করে দে জয়ী।
আমি আমার মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে চাই।
চল আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করি।

জয়ীতার মুখ লাল হয়ে গেছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে।
রেজা একটা কথা মনে রাখিস। পৃথিবীতে কারো জন্য কারো দিন বসে থাকে না।
একটা মেয়ে হয়ে আমি যে যুদ্ধ করেছি, মানুষের যে কঠিন রুপ দেখেছি।
তুই তা অনুভব ও করতে পারবি না।
পৃথিবীটা অনেক কঠিন জায়গা। আমি সেটা নিজেকে দিয়েই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।
সব কঠিন পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে আমি আমার নিজের একটা শক্ত জায়গা তৈরি করে নিয়েছি। সেখানে রেজা নামের কারো কোন জায়গা নেই।

আর জয়ী জানে তার বাবা বেঁচে নেই। জয়ীকে আমি এমন ভাবে তৈরি করেছি, যে জয়ী কখনো যেন আমার মতো হেরে না যায়। ও সব জায়গায় জয়ী হয়ে আসে।

আমি চাই না বিশ বছর পর জয়ী নতুন করে একটা ধাক্কা খাক।

রেজার চোখ কষ্টের নীল জলে ভিজে যাচ্ছে।
জয়ী তুই এতো পাষাণী।
সেদিন ও আমার কোন কথা শুনিসনি। আমাকে না জানিয়ে দেশ ছেড়েছিস। শত চেষ্টা করেও তোর ঠিকানা বের করতে পারিনি।
আজোও তুই আমাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছিস না।
একবার ও কি ভেবেছিস, এই বিশটা বছর আমার কিভাবে কেটেছে?

পুষ্প খুব ভালো একটা মেয়ে। আমি সবসময় ওর প্রতি শুধু দায়িত্ব পালন করে গেছি। মন থেকে একটা দিনের জন্যেও ভালোবাসতে পারিনি।
আমার হৃদয় মন জুড়ে শুধু তোর বসবাস।
এতো দিন পরে তোকে পেয়েছি। আমাকে আর ফিরিয়ে দিস না জয়ী।
আমার প্রতি একটু দয়া কর প্লিজ।

আমার যা বলার আমি বলেছি।
আমি আসি।
জয়ী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার খুব ভালো লাগবে যদি তুই আমার সাথে যোগাযোগ করার কোন রকম চেষ্টা না করিস।
ভালো থাকিস। তোর জন্য শুভকামনা সবসময়।

জয়িতা কলাবাগানের লেকের পাড় ধরে একা একা হাঁটছে। রেজাকে শক্ত কথাগুলো বলতে পেরে খুব হালকা লাগছে নিজের কাছে। শত দুঃখের মাঝে ও আনন্দ লাগছে তার। মনে হচ্ছে পৃথিবীর মতো সুন্দর জায়গা আর কোথাও নেই। অনেক দুঃখের মধ্যে এখানে হঠাৎ হঠাৎ এমন সব সুখের ব্যাপার ঘটে যায় যে দুঃখ গুলো চাপা পরে যায়। জয়ীতা একা একা হাঁটছে আর অবাধ্য চোখের পানি মুছছে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here