২য় থ্রিলার বই ‘জলদানব’
#গল্প১২৫
#জলদানব (পর্ব ১)
পরী আজ একটা গোলাপি রঙের শিফন শাড়ি পরেছে, ঠিক যেন সত্যিকারের পরীর মতোই লাগছে ওকে। মারুফের সাথে আজ দেখা হবার কথা আছে, মারুফের কথা মনে হতেই পরীর মনটা প্রজাপতির মতোই হয়ে ওঠে। বিকেল হয়ে আসছে, পরী বাসা থেকে বের হয়েই একটা রিক্সা নেয়। ব্রম্মপুত্র নদটা ময়মনসিংহ শহর থেকে কাছেই, পৌঁছাতে বেশিক্ষন লাগে না। রিক্সা থেকে নামতেই দেখে মারুফ দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই হাত নাড়ে। কাছে আসতেই মারুফ ফিসফিস করে বলে, “ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে। কিন্তু এত দেরি করে আসলে, সবগুলো নৌকা তো বুকড।”
বর্ষা শেষে শরতের শুরু, ব্রম্মপুত্রের দুই পাড়ে কাশফুলের মেলা, একটা ভেজা বাতাস বইছে। দূরে কোথাও হয়ত বৃষ্টি হয়েছে। নদীতে অনেকগুলো নৌকা, সবগুলোতেই মানুষের ভীড়। এসময়টাতে অনেকেই ঘুরতে আসে এখানে। তাই মারুফ কাল যখন ওকে জানাল ব্রম্মপুত্র নদে একটু ঘুরবে তখন থেকেই মনে একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল পরী। কিন্তু বের হতেই দেরি হয়ে গেল, একটা দুটো নৌকা আছে, কিন্তু এরা পণ্য পরিবহন করে।
মারুফ পরীকে ইশারা করে দাঁড়াতে, তারপর ও দ্রুত পায়ে পাড়ের দিকে যায়। দুই তিনটা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে, কেউ যেতে রাজি হয় না। এদের দূরের গন্তব্যে যেতে হবে। মারুফ মন খারাপ করে এসে বলে, “নাহ, এরা যাবে না। চলো পাড় ধরে একটু সামনের দিকে হেঁটে যাই, দেখি কেউ যদি রাজি হয়।”
মারুফ পরীর হাতটা ধরে, একটা ভীষণ ভালো লাগায় মনটা ছুঁয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটু সামনে যেতেই দেখে সুন্দর একটা ছইওয়ালা নৌকা, মাঝবয়েসী একজন মাঝি আনমনে বসে বিড়ি খাচ্ছে। কী মনে করে মারুফ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ও মাঝি ভাই, আমাদের নিয়ে একটু নদীতে ঘুরতে পারবেন? ভাড়া একটু বেশিই দেব।”
গফুর কাজ শেষ করে বিড়ি খাচ্ছিল, কিছুদিন আগেই এখানে এসেছে। ভৈরব থেকে কাপড়ের কিছু চালান নিয়ে আসছিল ময়মনসিংহ। বেশিরভাগ কাপড়ই বিক্রি হয়ে গেছে, অল্প কিছু কাপড়ের বান্ডিল রয়ে গেছে। আজই ভৈরব রওনা দেবার কথা। মারুফের ডাকে ঘুরে তাকায়, তারপর পরীর দিকে চোখ পড়তেই চোখটা স্থির হয়ে যায়। পুরো শরীরে একবার চোখ বোলায়, তারপর বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলে, “যামু, পাঁচশ টাকা লাগব।”
মারুফ মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, যাক ব্যাটা কমই চাইছে। ইশ, এই নৌকাটা না পেলে তো পরী খুব মন খারাপ করত। মারুফ এবার পরীর হাত ধরে টান দিয়ে চটুল গলায় বলে, “চলো, আজ ভেসে যাব অজানায়।”
পরী নড়ে না, জায়গায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, “মারুফ, লোকটার চাহনি আমার ভালো লাগছে না। কেমন করে যেন তাকায়।”
মারুফ একটু থমকায়, তারপর হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে, “কী যে বলো, ওই ব্যাটা মাঝি তোমার দিকে তাকাবে এই সাহস আছে? তোমরা মেয়েরা সবসময় বেশি বেশি। আর এইটা আমার শহর, এইখানে কারো সাহস আছে আমার পরীর দিকে কুনজর দেয়।”
পরীর তাই মনে হয়, ও আসলে বেশি বেশি ভাবছে। মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে পরী মারুফের হাত ধরে উঠে পড়ে নৌকায়। তার আগে অবশ্য গফুর ওর সহকারী রতনকে একটা পাটাতন ফেলে দিতে বলে, যাতে ওরা সহজেই নৌকায় উঠতে পারে।
নৌকায় উঠেই মারুফ বলে, “মাঝি ভাই, আমরা ঘন্টাখানেক ঘুরব। আপনি আর আপনার সহকারী খালি নৌকা চালাবেন, বুঝেছেন তো। আর ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন, বৈঠা দিয়া আস্তে আস্তে চালান।”
গফুর একটা বুঝদারের মতো হাসি দেয়, এই বয়সের পোলা মাইয়ারা কেন নৌকায় ঘুরতে আসে সেইটা গফুর জানে।
নৌকাটা চলতে শুরু করতেই পরীর মনটা ভালো হয়ে যায়, কী সুন্দর চারপাশ। অন্যান্য সময় নদীটায় পানি কম থাকে, কিন্তু এখন যেন নদীর ভরা যৌবন। পরী মারুফকে ধরে কয়েকেটা সেল্ফি তুলে ফেলে। কিন্তু মারুফের যেন ছবিতে মন নেই, শুধু জড়িয়ে ধরার তালবাহানা করছে। পরীও চোখ পাকিয়ে বার বার পেছনে বসে থাকা মাঝিদের দিকে ইশারা করে। মারুফ অসহায় চোখে একবার মাঝিদের দিকে তাকায়, ব্যাটারা আড়চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে। নাহ, এরা তো শান্তি মতো প্রেমও করতে দেবে না। কী মনে হতে মারুফ এবার পরীকে নিয়ে নৌকার অন্যপ্রান্তে চলে যায়। তারপর একটু উঁচু হয়ে দু’হাতে ভর দিয়ে নৌকার ছইয়ের উপর উঠে পড়ে। পরী বাচ্চাদের মতো আবদার করে, “আমিও উঠব, ইশ, উপরে তো অনেক মজা হবে। প্লিজ আমাকে উঠাও।”
মারুফ দুষ্ট একটা হাসি হেসে লাফ দিয়ে নামে, তারপর হঠাৎ করেই পরীকে দু’হাতে শুন্যে তুলে ধরে ছইয়ের উপর বসিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় পরী লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মারুফ এবার ওর পাশে উঠে বসতেই পরী ওর গা ঘেঁষে বসে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায় মারুফ, পরীর চুলের। উপরে উঠে বসাতে এখন আরো সুন্দর লাগছে চারপাশ। মারুফ কয়েকটা সেল্ফি তোলে। পরীও ওর মোবাইলটা বের করে সেল্ফি তুলতে যেতেই মুখটা একটু বিরক্তিতে ভরে যায়, পেছনের মাঝবয়েসী মাঝিটা এদিকেই তাকিয়ে আছে। পাত্তা না দিয়ে কয়েকটা ছবি তোলে পরী। তারপর মারুফকে জড়িয়ে ধরে বসে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে।
গফুরের চোখটা বার বার মেয়েটার উপর চলে যাচ্ছিল, পাতলা শাড়ি পরেছে মেয়েটা, শরীরের ভাঁজ বোঝা যায়। শাড়ির ফাঁকফোকড় দিয়ে মাঝে মাঝেই শরীর দেখা যাচ্ছে, একটা শিহরণ টের পায় গফুর। পেছন থেকে লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে গফুর, মনের ভেতর পুরনো একটা সাপ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।
পরী বার বার তাড়া দিচ্ছে ফিরে যাবার জন্য, সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এল মারুফ যেন শুনছেই না। বার বার বলছে, আরেকটু থাকি। আসলে পরীকে এমন করে কাছে পাওয়া হয়নি আগে, তাই ছাড়তে মনই চাচ্ছে না। কিন্তু মাগরিবের আজানটা পড়তেই মারুফের হুশ ফেরে, চারদিকটা কেমন নিরিবিলি হয়ে পড়েছে। আশেপাশে কোনো নৌকাও দেখা যাচ্ছে না। মারুফ পেছন ঘুরে মাঝিকে বলে নৌকা ঘুরিয়ে ওদের পাড়ে নামিয়ে দিতে। অনেকটা দূর চলে আসছে ওরা।
গফুর এবার হাতের বৈঠাটা রেখে রতনকে বলে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে। ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই গফুর ধীরে ধীরে নৌকাটা ঘুরিয়ে নেয়। তারপর সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। গফুর আড়চোখে দেখে ছেলেটা মেয়েটার মুখ কাছে টেনে নিচ্ছে। কী যেন হয় গফুরের ভেতর, ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায়, ইশারায় ওর সহকারী রতনকে বলে নৌকার হাল ধরতে। রতন বুঝতে পারে না, উস্তাদের হঠাৎ কী হইল।
গফুর নৌকার পাটাতনের উপর রাখা লম্বা একটা বাঁশ আলগোছে তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে ছইয়ের কাছে আসে। ছেলেটার কোনো হুঁশই নাই, পেছনের দিকে। গফুর এবার বাঁশটা দিয়ে সজোরে ছেলেটার মাথায় বাড়ি দিতেই একটা ভোঁতা শব্দ হয়, কাৎ হয়ে ছেলেটা নদীতে পড়ে যায়।
একটা আর্তচিৎকার বের হয়ে আসে পরীর মুখ থেকে, মারুফ হঠাৎ করেই নদীতে পড়ে গেল। ও তো সাঁতার পারে না! ভয়ার্ত চোখে দেখে সেই মাঝবয়েসী মাঝিটার হাতে একটা লম্বা বাঁশ, চোখে হিংস্র দৃষ্টি। পরী কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা এক লাফে ছইয়ের উপর উঠে বসে। হিংস্র শ্বাপদের মতো পরীর কাছে এসেই হ্যাঁচকা টানে ওকে নিচে নামিয়ে ফেলে। তারপর একটানে ছইয়ের ভেতরে নিয়ে ফেলে। পরী এত বেশি ভয় পেয়েছে যে ওর হাতে পায়ে যেন কোনো শক্তিই নেই, কেমন একটা অবশ হয়ে আছে। ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখে লোকটা একটা বিশ্রী হাসি হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। পরীর শুধু মনে হয় মারুফ কী এতক্ষণে নদীতে তলিয়ে গেছে? মারুফ মরে গেলে ওর তো বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না।
রতন হতবাক হয়ে ওস্তাদের কাজ দেখছিল এতক্ষণ। লোকটা এমন নিষ্ঠুর আগে বোঝেনি। ছইয়ের ভেতরে কী হচ্ছে বুঝতে পারে রতন, কেমন একটা আনন্দও হয় ওর। কিছুক্ষণ পর গফুর যখন ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে তখন কেমন একটা ঘোর লাগা চোখে রতনের দিকে তাকিয়ে বলে, “যা, তুইও একটু ফূর্তি কইরা আয়।”
রতন আর কথা বাড়ায় না, নৌকার হালটা উস্তাদকে বুঝিয়ে দিয়েই দ্রুত ছইয়ের ভেতরে চলে আসে। ভেতরে ঢুকতেই দেখে মেয়েটার এলোমেলো শরীর, রতনের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তখনি মেয়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যেতেই হঠাৎ করে ও থেমে যায়। কী যেন একটা জিনিস অস্বাভাবিক লাগছে, মেয়েটা চোখ দুইটা বড় বড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকে নিঃশ্বাসের কোনো উঠানামা নেই। রতন এবার ভয় পায়, একটা হাত দিয়ে মেয়েটার নাকের কাছে ধরে, নিঃশ্বাস পড়ছে না, মেয়েটার গলায় হাত চেপে বসার চিহ্ন। রতন ছিটকে পাশে সরে আসে, মাইয়াটা তো মইরা গেছে। একটা ভয় গ্রাস করে এবার রতনকে। কোনোমতে ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে তোতলানো গলায় বলে, “উস্তাদ, মাইয়াটা তো মইরা গেছে!”
গফুর একটা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর ভাবলেশহীন গলায় বলে, “রাইত বাড়ুক, লাশটা নদীতে ফালাই দিমু তখন। তুই এক কাজ কর, মাইয়াটারে কাপড় দিয়া ঢাইকা রাখ, আর ছইয়ের পর্দাটা টাইনা দে ভালো কইরা।”
রতন আর কথা বাড়ায় না, ভাবে কী ভয়ংকর মানুষ ওর এই গফুর উস্তাদ। কী যে এক প্যাঁচে পড়ল ও। রতন এবার ছইয়ের ভেতরে ঢুকে মেয়েটারে একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। ছইয়ের পর্দাটা টেনে দিয়ে বের হতে যেতেই মেয়েটার ব্যাগের দিকে নজর পড়ে। দ্রুত হাতে ব্যাগটা খোলে, ভেতরে কিছু টাকা আছে। পকেটে ভরে নেয় রতন। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, মাইয়াটার মোবাইলটা কই? খুঁজতে খুঁজতে নৌকার শেষ মাথায় পাটাতনের উপর মোবাইলটা পেয়ে যায়, দামি মোবাইল। রতন মোবাইলটা বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে ঢুকাই ফেলে। উস্তাদরে বলা যাবে না।
ত্রিশালের কাছে যখন এসে পৌঁছে তখন গফুর নৌকাটা থামায়। তারপর রতনকে ইশারা করে ছইয়ের ভেতরে আসতে। দুইজনে মিলে পরীর লাশটা টেনে নৌকার কিনারে নিয়ে আসে। তারপর আশেপাশে আরেকবার ভালো করে দেখে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে লাশটা ফেলতে যেতেই রতন নিচু গলায় বলে, “উস্তাদ, মাইয়াটার পায়ে ওই কলসিটা বাইন্দা দেই। তাইলে সহজে লাশ ভাইসা উঠব না।”
কথাটা মনে ধরে গফুরের, মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই রতন কলসিটা পানি দিয়ে ভরে ফেলে। তারপর পরীর পায়ে বেঁধে আস্তে করে পানিতে ছেড়ে দেয়। পরীর লাশটা দ্রুতই ডুবে যায় নদীর অতল জলে। গফুর মনে মনে ভাবে, যাক, নিশ্চিন্ত এখন। কেউ কোনোদিন জানতেই পারব না কে এই কাজ করেছে।
নৌকাটা আবার চলা শুরু করে, নিঝুম নদীতে অন্ধকারে শুধু নৌকার সামনে হারিকেনের টিমটিমে আলো দেখা যায়। আর সেইসাথে গফুরের মুখে বিড়ির আগুনটা উঠানামা করতে থাকে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২২/০৯/২০২১