জলদানব (পর্ব ২)

0
404

#গল্প১২৫

#জলদানব (পর্ব ২)

শীতলক্ষ্যা নদীর কাছেই যে থানাটা রয়েছে রাহাত সেখানে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি। জায়গাটা অপরাধপ্রবণ, প্রায়ই কোনো না কোনো ঝামেলা লেগেই থাকে। বাইরের লোকের আনাগোনা বেশি বলেই এরা অপরাধ করে পালিয়ে যায়। প্রথম ক’টা দিন বেশ ছুটোছুটির মাঝেই গেছে। এখন মোটামুটি একটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে সবকিছু। সেদিন সন্ধ্যায় রাহাত একটু রিল্যাক্স মুডে বসে ছিল, ভাবছিল কী করা যায়। বহুদিন কোনো চ্যালেঞ্জিং কেস হাতে নেই। কেস কঠিন না হলে মজা নেই। ভাবতে ভাবতে রাহাত ওর সহকারী হাফিজকে ডাকে, “আচ্ছা হাফিজ, এই থানাতে এমন কোনো ভয়ংকর কেস আছে যেটা কিনা কেউ মীমাংসা করতে পারে নাই?”

হাফিজের মুখে একটা হাসি দেখা যায়, স্যারের আবার সেই পুরনো রোগ দেখা দিয়েছে, মাথা নেড়ে বলে, “স্যার, ভয়ংকর কেস বলতে আমরা মার্ডার কেস বুঝি। আর যদি বলেন আরো ভয়ংকর, তাইলে রেপ কেস সাথে মার্ডার। আমি আপনারে কয়েকটা কেসের ফাইল দিয়ে যাচ্ছি, এগুলো সবই অমীমাংসিত।”

রাহাত টেবিলে একটা খাতায় কিছু আঁকিবুঁকি করছিল, মুখ না তুলেই ছোট্ট করে বলে, “দিয়ে যাও।”

আজ বার বার যাদুকর চিত্রকর আহমেদ নকিবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কী ভয়ংকর একটা লোক ছিল, তাকে ধরতে কত কষ্টই না হয়েছিল। এই যখন ভাবছে হাফিজ তখন কয়েকটা ফাইল এনে ওর সামনে রাখে। রাহাত এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে টানটান হয়ে বসে ফাইলগুলো তোলে, প্রথমটা একটা খুনের মামলা। কয়েক বছর আগে হয়েছে, খুনের মোটিভ জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবারের কেউই হয়ত করেছে, কিন্তু কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ।

এরপরের কেসগুলোও খুনের তবে সেখানে আসামি চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু পলাতক। ফাইলগুলো উল্টাতে উল্টাতে শেষ একটা ফাইলে চোখটা আটকে যায়। নিলুফার নামে একটা মেয়ের রেপ কেস, সাথে খুনের কেস। রাহাত কেসের তারিখটা দেখে, ঠিক বছরখানেক আগের ঘটনা, এমনই এক শরতের শুরুর দিকে। শীতলক্ষ্যা নদীতে মেয়েটার লাশ পাওয়া যায়, ময়নাতদন্তে দেখা যায় মেয়েটা রেপ হয়েছে, গলা চেপে ধরার ফলে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। কিন্তু এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার সামান্যতম ক্লু পাওয়া যায়নি। যেটুকু জানা গেছে মেয়েটা একটা গার্মেন্টসে কাজ করত, নদীর ওই পাড়ে বাড়ি। গার্মেন্টস শেষ করে ফিরতে প্রায়ই রাত হতো, নৌকা দিয়ে নদী পার হলে শর্টকাট হতো। ধারণা করা হয়, সেরাতে মেয়েটা কোনো ভবঘুরের পাল্লায় পড়েছিল, যে কিনা রেপ করে মেরে নদীতে লাশ ফেলে দেয়।

রাহাতের মনটা বিষন্ন হয়ে যায়, কোন মায়ের বুকটা খালি হয়ে গেল। অপরাধী ঠিক ফূর্তিতে জীবন কাটাচ্ছে, হয়ত আরেকটা রেপ করার সুযোগ খুঁজছে। নাহ, ভাবতে পারে না আর, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। এই কেসটা নিয়ে ও আবার তদন্ত শুরু করবে। এ ধরনের অপরাধীরা ধরা না পড়লে এরা বার বার একই অপরাধ করবে।

পরদিন সন্ধ্যার পর রাহাত হাফিজকে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সেই জায়গাটায় যায় যেখান দিয়ে নিলুফার নামের মেয়েটা নিয়মিত যাতায়াত করত। পুরাতন কয়েকজন মাঝির সাথে কথা হয়, নিলুফারের ছবিটা দেখে চিনতে পারে। সেসময় পুলিশ খুব ঝামেলা করেছিল এই এলাকার মাঝিদের সাথে। অনেকে ভয়ে ঘাট ছেড়ে চলেও গেছিল তখন। রাহাত আশেপাশে খেয়াল করে, নদীর পাড়ে অনেক ভবঘুরেই থাকে, আজও আছে। রাত বাড়লে জায়গাটা আর এত নিরাপদ থাকার কথা না। মেয়েটার হয়ত সেদিন দেরি হয়ে গেছিল, ঘাটে নৌকা ছিল না। অপেক্ষা করতে যেয়েই হয়ত কোনো ভবঘুরের পাল্লায় পড়েছিল। নাহ, যে এই কাজ করেছে সে নিশ্চয়ই এখানে নেই। উম, আবার ফিরেও আসতে পারে, কারণ কেসটা নিয়ে তো আর নাড়াচাড়া হয়নি। দেখা যাক, একটা পুলিশের সোর্স লাগিয়ে রাখতে হবে এই এলাকাটায়।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেয়ে রাহাত মাত্রই টিভিতে জিওগ্রাফি চ্যানেলটা খুলেছে সাথে সাথে করবী এসে চ্যানেল চেঞ্জ করে একটা বাংলা খবরের চ্যানেল খোলে। গম্ভীরমুখে বলে, “দেখেছ, ব্রম্মপুত্র নদে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। জেলেদের জালে নাকি লাশটা ভেসে উঠেছে। কী সুন্দর মেয়েটা, কে মারল মেয়েটাকে।”

রাহাতের মনটা খারাপ হয়, নিলুফার নামের মেয়েটার কথা মনে হয়ে যায়। আচ্ছা, এই মেয়েটার লাশও নদীতে পাওয়া গেছে? একটু চিন্তা করে, তারপর মনোযোগ দিয়ে খবরটা দেখে। সুইসাইড কেস? নাকি এটাও একটা খুন? ঘটনাটা ত্রিশাল থানার অধীনে। একটু ভাবতেই মনে পড়ে যায় ওখানে তো ওর জুনিয়র মনোরঞ্জন আছে। রাহাতকে খুব শ্রদ্ধা করে। কী মনে হতে রাহাত ফোন দিতেই ওপাশ থেকে একটু ব্যস্ত গলা পাওয়া যায়, “রাহাত ভাই ঝামেলায় আছি। টিভিতে নিশ্চয়ই দেখছেন। কোনো জরুরি কিছু ছিল?”

রাহাত বোঝে, মনোরঞ্জন এখন দৌড়ের উপর আছে। তাই দ্রুতই কথা সারে, “মনোরঞ্জন, খোলা চোখে কী মনে হয়েছে? খুন না আত্মহত্যা? ”

মনোরঞ্জন ওপাশ থেকে নিশ্চিত গলায় বলে, “এটা খুন, ১০০%। কারণ মেয়েটার গলায় জোরে চেপে ধরার চিহ্ন আছে, দেখে মনে হচ্ছে রেপও হইছে। সাংবাদিকরা পাগল করে ফেলবে কাল।”

রাহাতের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, বলে, “আচ্ছা, তুমি চাপ সামলাও। আর আমাকে সময় পেলে আপডেট জানিও।”

ফোনটা রেখেই হঠাৎ রাহাতের মনে হয় এই মেয়েটার গলাতেও চেপে ধরার চিহ্ন??? এই মেয়েটার লাশও পাওয়া গেছে নদীতে, মনে হচ্ছে রেপও হইছে। পুরোটা যেন নিলুফার মেয়েটার কেস!!

পরদিন রাহাত অফিসে যেয়েই নিলুফারের কেসটা ডিটেইলস পড়ে। ভিকটিমের ছবিগুলো দেখে, গলায় কালচে দাগ, চোখ দুটো খোলা। রাহাত একটা রাগ টের পায় মনের ভেতর। একবার যদি পশুটাকে ধরতে পারত! এই কেসটার ফরেনসিক রিপোর্টে অবশ্য ধর্ষণকারীর ডিএনএ সনাক্ত করা গেছে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই রাহাত ত্রিশাল থানার ওসি মনোরঞ্জনকে ফোন দিয়ে বলে, “মনোরঞ্জন, তুমি কষ্ট করে তোমার ওই খুন হওয়া মেয়েটার ছবিগুলো পাঠাতে পারবা? আমার একটা কেসের সাথে মিলে যাচ্ছে প্যাটার্নটা।”

ওপাশ থেকে বিস্ময়ের সাথে ওসি মনোরঞ্জন বলে, “রাহাত ভাই, কী বলেন! তাহলে তো আপনার সাহায্য লাগবে কেসটা সলভ করতে।”

রাহাত মাথা দোলায়, বলে, “আমি বেশিদূর আগাতে পারিনি। আচ্ছা, শোন মেয়েটার ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে আমাকে দিও। রেপ হলে কিন্তু অপরাধীর স্পার্ম পাওয়া যাবে।”

ওপাশ থেকে মনোরঞ্জন একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “রাহাত ভাই, এই মেয়েটারে নদীতে ফেলছে তাও মনে করেন চার পাঁচদিন আগে। নদীর পানিতে কী আর কিছু আছে প্রমাণ? সব তো ধুয়ে মুছে গেছে।”

রাহাত হেসে বলে, “ছোট ভাই, একটু পড়াশোনা করো। যদি রেপ হয় তাহলে মেয়েটার ইন্টারনাল অরগানে স্পার্ম থাকবেই, একটা পরীক্ষায় দেখা গেছে নদীর পানিতে ডুবিয়ে রাখলেও দুই সপ্তাহ পরেও তার চিহ্ন পাওয়া যায়। এমনকি পরনের কাপড় যদি শিফন বা পলিস্টার হয় তাহলে তাতে লেগে থাকলে তারও চিহ্ন পাওয়া যাবে ১৬ দিন পর্যন্ত। ”

মনোরঞ্জন এবার একটু লজ্জা পায়, ও ভুলেই গেছিল রাহাত ভাই কত উঁচু মানের পুলিশ অফিসার। অনেক পড়াশোনা করেন। লজ্জিত গলায় বলে, “আপনি তো গুরু মানুষ। কত কিছু শিখলাম। আচ্ছা আমি ফরেনসিক রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব। আর ভিকটিমের ছবি।”

এর কিছুদিন পর মনোরঞ্জন যখন পুরো রিপোর্টটা পাঠায় তখন রাহাত চমকেই ওঠে। এই ভিকটিমের নাম পরী, পরীর মতোই সুন্দর ছিল মেয়েটা। মেয়েটার গলার দাগটা হুবহু যেন নিলুফার নামের মেয়েটার গলার দাগের সাথে মিলে যাচ্ছে। এই মেয়েটাও রেপড হয়েছে, এবং গলা চাপার ফলে শ্বাসরোধ করেই মারা হয়েছে। একদম একই প্যাটার্নের খুন!!!

রাহাত এবার একটু একটু করে বুঝতে পারে কী ভয়ংকর এক সাইকোপ্যাথ ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বাধীনভাবে। পরী খুনের অপরাধীর ডিএনএ রিপোর্টটা এখনো হাতে আসেনি। নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না খুন দু’টি একই মানুষ করেছে কি না।
যদি দুটো খুন এই একই লোক করে থাকে তাহলে না জানি এর আগে আরো কতগুলো খুন হয়েছে। নাহ, এরপর আর একটা খুনও হতে দেবে না রাহাত, একে ধরেই ছাড়বে।

সেদিন রাহাত এসপি অফিসে বিশেষ একটা অনুমতি চায়। কেসটা তদন্ত করতে ও ত্রিশাল যাবে। এই কেসটা এখনো তাজা, ভালোমতো তদন্ত করলে নিশ্চয়ই খুনী সম্পর্কে কিছু না কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।

রাহাত অনুমতিটা পায়। এদিকের কাজ আপাতত হাফিজকে বুঝিয়ে দিয়ে রাহাত ত্রিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যেতে যেতে ও ভাবতে থাকে নিলুফার মেয়েটা না হয় কাজের প্রয়োজনে নদীটা পার হতো, তাই তার খুনটা নদীর আশেপাশে হতে পারে। কিন্তু এই পরী মেয়েটার লাশ ত্রিশালের এমন একটা জায়গায় পাওয়া গেছে যেখানে তার আসার কথা না। নাহ, মনোরঞ্জনের সাথে বসতে হবে, ও এতক্ষণে নিশ্চয়ই মেয়েটার পরিচয় খুঁজে পেয়েছে।

রাহাত যখন ত্রিশাল এসে পৌঁছে ততক্ষনে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাইওয়ের পাশেই থানাটা। ঢুকতে যেতেই একজন কন্সটেবল ওর পথ আটাকাতেই ও মৃদু হেসে আইডি কার্ড দেখাতেই ব্যাটা একটা জোর সালাম ঠুকে। রাহাত ভেতরে ঢুকতেই মনোরঞ্জন চেয়ার ছেড়ে হাসিমুখে উঠে আসে, বলে, “রাহাত ভাই, আপনি আসাতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাদের তো ময়মনসিংহ যেতে হবে। এই পরী মেয়েটা ময়মনসিংহ শহরে থাকত। ঘটনার দিন মেয়েটা তার বয়ফ্রেন্ড মারুফের সাথে ব্রম্মপুত্র নদে ঘুরতে এসেছিল। তারপর থেকে এরা নিখোঁজ। রাহাত ভাই, মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড মারুফও খুন হয়েছে, তার লাশও কয়দিন আগে পাওয়া গেছে। দু’জনের ফোন নাম্বার নদীর আশেপাশেই একটিভ ছিল, ছেলেটার ফোন আগে বন্ধ হয়। মেয়েটার ফোনের ঘন্টাখানেক পরে। তারমানে ওরা মেয়েটাকে রেপ করে পরে মেরে নদীতে ফেলে দেয়।”

রাহাতের পিঠ বেয়ে একটা শীতল স্রোত বেয়ে যায়, ডাবল মার্ডার!! আর এই ঘটনাটাও নদীর কাছে!? রাহাতের মনে সন্দেহ বাড়তে থাকে, নিলুফার আর এই ডাবল মার্ডারের খুনী একই মানুষ। কী মনে হতে রাহাত ঢাকায় হাফিজকে ফোন করে একটা কাজ দেয়। দেখা যাক সন্দেহটা সত্যি হয় কি না।

রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, “মনোরঞ্জন, যেটুকু শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে ছেলে মেয়ে দুটো হয়ত কোনো খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়েছিল। এরা ছেলেটাকে মেরে মেয়েটাকে রেপ করে। পরে নৌকায় করে লাশটা ত্রিশালে এনে ফেলে। তার মানে যে নৌকাটা এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে তার মাঝিও জড়িত। আবার এমন হতে পারে পুরো কাজটা নৌকার মাঝিই করেছে, কিন্তু এটা অবিশ্বাস্য। একজন মাঝি এমন করার কথা না। আমাদের কালই ময়মনসিংহ যেতে হবে, ব্রম্মপুত্র নদীর পাড়ে। আর তুমি পরী আর মারুফের ফোনের কল লিস্টটা চাও। দেখা যাক, এদের কোনো বন্ধু এই কাজে জড়িত আছে কি না।”

মনোরঞ্জন মিটিমিটি হাসে, রাহাত ভাই যে কতটা কাজপাগল মানুষ ও জানে। আসা অবধি এক কাপ চাও খায়নি। মনোরঞ্জন চায়ের অর্ডার করে বলে, “রাহাত ভাই, আপাতত এক কাপ চা খান, সাথে গরম সিংগারা দিচ্ছি।”

চায়ের কথায় রাহাতের মনে হয়, আসলেই তো চায়ের দারুণ তেষ্টা পেয়েছে। চা আসতেই রাহাত চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, “আচ্ছা, ক্রাইম সিন থেকে পাওয়া আলামতগুলো একটু আনতে বলো তো।”

ওসি মনোরঞ্জন মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ হয়, আরে এই কেস তো ওর। রাহাত ভাই এমন করছে যেন ও এর আগে খুনের কেস সামলায়নি। মনোরঞ্জন দায়সারাভাবে একজনকে আলামতগুলো আনতে বলে। একটা এলুমিনিয়ামের কলসি, দড়ি বাঁধা, ভিকটিমের শাড়ি।

রাহাত চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ভালো করে কলসি আর দড়িটা দেখে, তারপর বলে, “মনোরঞ্জন, মানুষ কী খুন করার আগে কলসি সাথে নিয়ে ঘুরে?”

এই প্রশ্নে মনোরঞ্জন পুরোই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, এইটা তো মাথায় আসেনি। ওর বোকা বোকা চেহারার দিকে তাকিয়ে রাহাত আবার বলে, “তারমানে ভিকটিমকে কলসি সাথে রাখতে হয়। কারা কলসি রাখে সাথে? উম, আমি যতদুর জানি যারা দুধ বিক্রি করে তারা এই ধরনের কলসি নিয়ে দৌড়ে বেড়ায়। আর শীতের দিনে যারা খেজুরের রস বিক্রি করে। আমাদের আসলেই ময়মনসিংহ যেতে হবে সবটা জানতে।”
********

ময়মনসিংহ পুলিশ সুপারের অফিস। এসপি হারুনুর রশীদ সাহেব রাহাতকে নিজের কামরায় আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলেন, “রাহাত, তুমি এসেছ দেখে খুব ভালো লাগছে। তুমি তো আমাদের একটা গর্ব। এই ডাবল মার্ডার তদন্তে তোমাকে স্থানীয় পুলিশ সর্বাত্মক সাহায্য করবে। কোথাও কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে জানিও।”

রাহাত একটা চাপ অনুভব করে, ওর উপর মানুষটা এত ভরসা করছেন, কিন্তু এখনো ও জানেই না খুনী কে। রাহাত বিনয়ের সাথে বলে, “স্যার, আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”

এরপর রাহাত ময়মনসিংহ সদর থানার ওসি শাহাবুদ্দিন, আর ত্রিশালের মনোরঞ্জনকে নিয়ে বসে। পুরো ঘটনাটা ওরা ভালো করে সাজিয়ে নেয়। কিন্তু একটা জায়গায় এসে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, পরী আর মারুফ কী সেদিন কোনো নৌকায় উঠেছিল কি না, নাকি নৌকায় ওঠার আগেই ঘটনাটা হয়। ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে রাহাতের নির্দেশে সেদিন শহরের পাশে ব্রম্মপুত্র নদের পাড়ে সব মানুষ, নৌকার মাঝিদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থা করা হয়। কয়েকটা টিম পরী আর মারুফের ছবি নিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে কেউ ওদের দেখেছে কি না।

বিকেলের দিকে রাহাত ওসি শাহাবুদ্দিনকে বলে, “আমি একটু ব্রম্মপুত্র নদে ঘুরতে চাই। একটু ব্যবস্থা করতে পারবে?”

ওসি শাহাবুদ্দিন একটু বিরক্ত হয়, ইনি কী এখানে ঘুরতে আসছে নাকি? মুখে অবশ্য কিছু বলে না, এসপি সাহেব আবার ওনাকে খুব স্নেহ করে। সাব ইন্সপেক্টর রুখসানাকে ডেকে বলেন রাহাতকে নিয়ে বিকেলে একবার যেন ব্রম্মপুত্র নদের পাড়ে ঘুরে আসে। রুখসানা মনে মনে উত্তেজনা বোধ করে, রাহাত স্যারের এত নাম শুনেছে, এই ফাঁকে কিছু টিপস জেনে নিবে।

বিকেলে ওরা যখন ব্রম্মপুত্র নদের পাড়ে আসে ততক্ষণে চারদিক বেশ জমজমাট। একটা সুন্দর ছইওয়ালা নৌকায় রুখসানাকে নিয়ে রাহাত ওঠে। মাঝি নৌকাটা ছাড়তেই একটা ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা দেয়। রাহাত রুখসানার সাথে টুকটাক গল্প করে। মেয়েটার কথাবার্তায় বোঝা যায় যে ওকে খুব শ্রদ্ধা করে। রুখসানা মোবাইল বের করে আশেপাশের ছবি তুলতে থাকে। তারপর সাহস করে বলে, “স্যার, আপনার সাথে একটা ছবি তুলব।”

রাহাত সহাস্যে বলে, “অবশ্যই, আসো।”

রুকসানা কাছে এসে সেল্ফি মোডে কয়েকটা ছবি তোলে। তারপর রাহাতকে ছবিগুলো দেখাতেই হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা, পরী আর মারুফ যদি কোনো নৌকায় ওঠে ওরাও তো তাহলে ছবি তুলেছে। উম, ভাগ্য ভালো থাকলে নৌকায় অন্য যারা ছিল তাদেরও ছবি থাকতে পারে। এমন কী খুনীর ছবিও!!! ভাবনাটা আসতেই রাহাত একটা ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। গলাটা শুকিয়ে আসে হঠাৎ করেই, ভীষণ তেষ্টা পায়। রুখসানাকে পানির কথা বলতেই ও হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে। তারপর মাঝিদের জিজ্ঞেস করতেই একজন ছইয়ের ভেতর থেকে একটা পরিস্কার গ্লাসে পানি এনে দেয়। রাহাত পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে, একটা তৃপ্তি নিয়ে বলে, “পানিটা খেয়ে আরাম পেলাম।”

মাঝিটা গর্বের সাথে বলে, “আমাগো টিউবওয়েলের পানি, সক্কালে ভইরা আনছি কলসিতে, বুইজছুন।”

কলসি শব্দটা ভীষণ করে কানে লাগে রাহাতের, ভ্রু কুঁচকে বলে, “দেখি, কেমন কলসি।”

লোকটা ছইয়ের ভেতর থেকে কলসিটা বের করে আনতেই রাহাত চমকে তাকায়, ঠিক সেই এলুমিনিয়ামের কলসিটা, যেটা পরীর পায়ে বাঁধা ছিল। রাহাতের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, বলে, “আচ্ছা, সব নৌকাতেই তো এই পানির কলসি রাখতে হয়, তাই না?”

মাঝিটা মাথা নেড়ে বলে, “কলসি না রাখলে আমরা দূরের পথ গেলে পানি পাইতাম কই?”

রাহাত ঠোঁটটা জোরে কামড়ে ভাবে, ইশ, এই সহজ ভাবনাটাই আগে আসেনি মাথায়। এখন ও মোটামুটি নিশ্চিত পরী আর মারুফ নৌকাতে উঠেছিল আর সেখানেই খুন হয়। নৌকার মাঝি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। রাহাত এবার কিছুটা স্বস্তিবোধ করে, যাক একটা লিড পাওয়া গেল তদন্তে। এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই মনোরঞ্জনের ফোনটা আসে, উত্তেজিত গলা পাওয়া যায়, “রাহাত ভাই, কেস তো ক্লোজ কইরা ফেললাম। আসামি ধরা পড়ছে।”

রাহাত একটু থমকায়, তারপর শান্ত গলায় বলে, “বুঝি নাই, খুলে বলো।”

মনোরঞ্জন এবার উৎসাহের সাথে গর্বিত গলায় বলে, “ভিকটিম পরী মেয়েটার মোবাইল ট্র‍্যাক করেত পারছি। তার মোবাইল গফরগাঁও এর একজনের কাছে পাওয়া গেছে, তারে ধরা হইছে। কালকেই ময়মনসিংহ নিয়ে আসা হচ্ছে। আপনারে এইবার কিছুই করতে হইল না।”

রাহাত চিন্তিত গলায় বলে, “শোন মনোরঞ্জন, যার কাছে মোবাইল পাওয়া গেছে সে খুনী না আমি নিশ্চিত। তুমি দয়া করে পরীর মোবাইল পাওয়া যাওয়া সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু বইল না। তা না হলে আসল খুনী সতর্ক হয়ে যাবে।”

মনোরঞ্জন পাত্তা না দেবার ভঙ্গিতে বলে, “আমি অবশ্য ইতিমধ্যে বলে ফেলছি খুনী ধরা পড়েছে।”

রাহাত আফসোস করে বলে, “আচ্ছা, এরপর থেকে আর কিছু বইল না। আমি আসতেছি।”

রাহাতের মাথায় শুধু একটাই চিন্তা পরীর মোবাইলের ছবিগুলো কী আছে না ডিলিট করে ফেলছে।

পরদিন বিকেলে রাহাত যখন ময়মনসিংহ থানায় যায় তখন দেখে ওসি শাহাবুদ্দিন আর মনোরঞ্জন মিলে একটা বছর বিশ একুশের ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। চোখে মুখ ফোলা, তার মানে এরা একে মেরেছে। রাহাত বিরক্ত হয়, গম্ভীরমুখে বলে, “শাহাবুদ্দিন, এরে মেরে কোনো লাভ নেই। খুন এ করে নাই। এর দোষ হইল এ চোরাই মোবাইল কিনেছে। আচ্ছা, মোবাইলটা কই দেখি।”

মোবাইলটা হাতে নিয়েই রাহাত দ্রুত ইমেজ ফোল্ডারে চলে যায়, বুকটা ধুকপুক করছে। তন্নতন্ন করে খোঁজে, নাহ, পরীর একটা ছবিও নেই। ইশ, মনে হয় ডিলিট করে ফেলছে। রাহাত ছেলেটার দিকে ঝুঁকে বলে, “এই মোবাইলটা তুমি কার কাছ থেকে কিনেছ?”

ছেলেটা কান্না গলায় বলে, “স্যার, আমাগো গফরগাঁও বাজারে আলি ভাইয়ের দোকান থেকে কিনছি। তার কাছে মাঝে মাঝে কম দামে মোবাইল পাওয়া যায়।”

রাহাত এবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমরা বরং ওই দোকানদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। কে আসছিল মোবাইল বিক্রি করতে, আর দোকানের কোনো সিসিটিভি ছিল কি না। যদিও থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও ওই দোকানদার আমাদের একমাত্র সাক্ষী যে খুনীকে দেখেছে।”

ওসি শাহাবুদ্দিন বেজার চোখে তাকিয়ে থাকে, ভাবছিল কেস ক্লোজ, এই বেটারে পিটান দিয়া স্বীকারোক্তি নিত যে ওই খুন করেছে। কিন্তু এই রাহাত লোকটা তো তা হতে দেবে না।

পরদিন যখন দোকানদার আলিকে ধরে আনা হয়, বেচারা তখন ভয়ে আধমরা। সব স্বীকার করে, বলে, কয়েকদিন আগে একটা ১৬-১৭ বছরের ছেলে আসছিল মোবাইল বেচতে। দামি মোবাইল ছিল, তাই লোভে পইড়া কম দামে কিনছিল।

রাহাত আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার দোকানে সিসিটিভি আছে?”

লোকটা না সূচক মাথা নাড়ে। বলে ওয়াইফাই আছে, সিসিটিভি নাই। রাহাত বিরক্ত হয়, কই সিসিটিভি আর কই ওয়াইফাই!

রাহাত এবার জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, মোবাইলটা পাওয়ার পর কী তুমি সব ছবি ডিলিট করে দিছিলা? একবারও ভেতরে দেখো নাই কী আছে?”

দোকানদার ভয়ে ভয়ে বলে, “স্যার, চোরাই মোবাইল পাইলে সবার আগে এইগুলান ডিলিট করি। তয় কিছু ছবি দেখছি, একটা সুন্দর মাইয়ার অনেকগুলা ছবি ছিল।”

রাহাতের টেনশনটা বাড়ে, বলে, “আর কিছু? কোনো নৌকায় একটা ছেলের সাথে মেয়েটা ছিল, এমন ছবি?”

আলি এবার সাথে সাথে বলে, “স্যার, এই ছবিটা তো পত্থমেই ছিল। একটা পোলার সাথে নৌকায় অনেকগুলা ছবি। আমি স্যার সব ডিলিট কইরা ওর কাছে বেইচা দিছি।”

রাহাতের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, ইশ, ছবিগুলো পেয়েও পেল না। খুনীর দেখা হয়ত পাওয়া যেত অথবা নিদেনপক্ষে নৌকাটা চিহ্নিত করা যেত। রাহাত ওসি শাহাবুদ্দিনকে বলে আলির বর্ণনা অনুযায়ী একজন আর্টিস্টকে দিতে যতটুকু পারা যায় ওই মোবাইল বিক্রি করতে আসা ১৬-১৭ বছরের ছেলেটার ছবি আঁকতে।

সেদিন রাতে রাহাত সরকারি বাংলোতে বারান্দায় বসে বসে ভাবছিল, কী করা যায়। হঠাৎ একটা জিনিস মনে হতেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, পরীর মোবাইলের ছবি পাওয়া যাবে আর সেটা কোথায় এখন ও জানে!

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৩/০৯/২০২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here