#গল্প১২৫
#জলদানব (পর্ব ৫)
গফুর কালির বাজার থেকে দশমিনিট পথ যেতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। তারপর মূল রাস্তা থেকে নেমে কোণাকুণি নদীর পাড়ের দিকে এগোতে থাকে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাতে গফুরের চলতে সমস্যা হয় না। কিছুক্ষণের মাঝেই একটা ছোট ঘাটের কাছে এসে পৌঁছে। গফুর সরাসরি ঘাটের কাছে না যেয়ে তার আগে বড় পাকুড় গাছটার নিচে গিয়ে বসে। এই জায়গাটায় একটু ঝোপঝাড় আছে। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে, এতদিনের পুরনো নাওটা বেচে দিতে হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ লাইট বের করে। এটা আসার সময় নৌকা থেকে নিয়ে আসছিল। গফুর মনে মনে সময়ের হিসেব করে নেয়। আর ঘন্টা দুই পরে এই ঘাটের পাশ দিয়েই করিম সওদাগরের নাওটা যাবার কথা। গফুরের সাথে একটা পুরনো দোস্তী আছে করিম সওদাগরের।
নির্দিষ্ট সময়টা আসতেই গফুর এবার টর্চ লাইটটা বের করে নদীর একদম পাড় ঘেঁষে দাঁড়ায়। একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে। দূরে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পায় গফুর, টর্চ লাইটের বুতাম টিপে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে আলো জ্বালে আর নেভায়। গফুর আশা করে করিম সওদাগরের মাঝিরা ঠিক এই সংকেত বুঝতে পারবে। নদীতে চলতে গেলে মাঝে মাঝেই বিপদ আপদ হয়, তখন মাঝিরা এমন সংকেত দেয়।
সওদাগরের বড় নাওটা যতই কাছে আসে গফুরের বুকটা ততই ধকধক করতে থাকে, নৌকাটা থামবে তো। নৌকার গতি কমেছে, কিন্তু থামছে না কেন? গফুর বার বার আলোর সংকেতটা জ্বালাতে থাকে। অবশেষে নৌকাটা থামে, তবে ঘাট থেকে একটু দূরে। নৌকাটা থেকে এবার পালটা আলোর সংকেত ফেলা হয়। গফুর বোঝে এরা একটু সতর্কতা অবলম্বন করতেছে, দেখতে চাচ্ছে আবার ডাকাত কি না। গফুর এবার পানিতে নেমে পড়ে, সাঁতরে নৌকার কাছে আসতেই মাঝিরা ওকে চিনতে পেরে টেনে নৌকায় ওঠায়।
*********************
রাহাত মন খারাপ করে ভাবছে কেসটা অনেক কঠিন হয়ে গেল। অপরাধীর শুধু কয়েকটা ছবি আছে, আর কিছু জানা নেই। মোবাইল নাম্বারটা ছিল তাও এখন সেটা কোনো কাজে আসবে না। কালির বাজার থেকে অফিসার গুলজার জানিয়েছে যে তারা কুমিল্লা বা ঢাকাগামী কোনো বাসেই গফুরের মতো কাউকে পায়নি। রাহাতের নির্দেশে দেশের সবগুলো থানায় গফুরের ছবি পাঠিয়ে হাই এলার্ট জারি করা হয়েছে। সব জায়গায় কঠিন নজরদারি চলছে গফুরের খোঁজে। আরেকটা দুঃখজনক ঘটনা হলো গফুরের সহকারী রতনের লাশ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে গফুর এখলাসপুর বাজার থেকে বের হয়েই কাজটা করেছে। হয়ত ও কোনোভাবে বুঝে ফেলেছিল রতন পরীর মোবাইলটা লুকিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল। রাহাত ভাবে কী নিষ্ঠুর একটা মানুষ এই গফুর, মন চাইলেই খুন করে ফেলছে!!
গফুর পালিয়েছে আজ কয়েকদিন হলো, এর মাঝে রাহাত গফুরের মোবাইল সিমের নিবন্ধনের তথ্য থেকে গ্রামের ঠিকানা পেয়েছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে গফুর অনেক বছর আগে গ্রাম ছেড়েছে। গ্রামে শুধু গফুরের বড় ভাই থাকে।
এদিকে গফুরের মোবাইল নাম্বারের কললিস্ট থেকে যে নাম্বারগুলোই পাওয়া যায় সবাইকেই ক্রসচেক করা হয়। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় না, বেশিরভাগই ছোট ব্যবসায়ী। একটা ফোন নাম্বার অবশ্য সন্দেহজনক, একজন মহিলার, নাম কুলসুম। খোঁজ নিয়ে জানা যায় কুলসুম গফুরদের পাশের গ্রামেই থাকে।
রাহাত ভাবে, গফুরকে ধরতে হলে গফুর সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। আর সেটা জানতে হলে গফুরের জন্মস্থান, ওর গ্রামের বাড়িতেই যেতে হবে। দেখা যাক কিছু পাওয়া যায় কি না।
*************
টাঙ্গাইল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম আটবরুহা, যমুনা নদীর পারেই অবস্থিত। গ্রামের একপাশে যমুনার চরে মৌসুমে বাদাম, তরমুজের চাষ হয়। আগে শহর থেকে আসার রাস্তা কাঁচা ছিল, এখন অবশ্য ইট বিছানো রাস্তা হয়ে গেছে। একটা অটোরিকশা করে রাহাত আটবরুহা গ্রামে এসে যখন পৌঁছে ততক্ষনে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ইচ্ছে করেই গাড়ি নিয়ে আসেনি যাতে অযথা মানুষের নজরে না পড়ে। টাঙ্গাইল থানার এসআই ফরিদ এসেছে ওর সাথে।
গফুরদের গ্রামের বাড়িতে এসে রাহাত পৌঁছাতেই গফুরের বড় ভাই আরফান এসে সালাম দেয়। রাহাত সালামের উত্তর দিয়ে বলে, “আপনাকে থানাতেই ডাকতে পারতাম, কিন্তু আমার খুব কৌতুহল হলো গফুরের জন্মস্থানটা দেখার। এখানে এমন কী আছে যা তাকে এমন অমানুষ করে তুলেছে।”
আরফান মাথা নিচু করে বলে, “স্যার, আমরা খুবই শরমিন্দা। আমার চিন্তা করতেই ঘিন লাগে যে গফুর আমার ভাই। এমন জঘন্য অপরাধ ও করেছে যে মাঝি বংশ হিসেবে গ্রামে আমাদের মাথা কাটা গেছে। অথচ বিয়ার আগ পর্যন্ত ও খুব শান্ত ছেলে ছিল, রাগটা একটু বেশি ছিল। একটা পা খাটো ছিল তাই একটু ঝুঁকে হাঁটত। সবাই ছোটবেলাতে ল্যাংড়া বলে খেপাত, কইত তোর কপালে সুন্দর বউ নাই। তাই অনেক হাউশ কইরা সুন্দর একটা মাইয়ারে বিয়া করাইলাম, বউ বলতে পাগল ছিল।
কিন্তু এক রাইতে ওর বউরে আমাগো পাশের গ্রামের এক পোলার সাথে দেইখা ফেলে। পারলে তখনই বউরে গলা টিপা মাইরা ফেলে। আমরা দশ বারোজন মিলাও ছাড়াইতা পারি না, এত জোর। পরে বিয়া আর টিকে নাই, ওই পোলার সাথে নাকি আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। মাইয়ার বাপ মা জোর কইরা বিয়া দিছিল।
এই ঘটনার পর গ্রামের মানুষ বউ নিয়া নানান কথা কইয়া ওরে খেপাইত, হাসাহাসি করত। ওর সহ্য হইত না, প্রায়ই মারামারি লাইগা যাইত। আমরা এরপর অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু একদম রাজি হয় নাই।
পরে একদিন রাইতে কাউরে না কইয়া আমাগো পুরান নৌকাটা নিয়া গ্রাম ছাইড়া চইলা যায়। এরপর অনেকদিন গ্রামে আসে নাই, যোগাযোগও ছিল না। পরে অবশ্য বছরে এক দুইবার কইরা আইত।”
এখানে এসে এমন একটা গল্প শুনবে এর জন্য অবশ্য রাহাত মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তারমানে মেয়েদের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা রয়েছে গফুরের! এই ঘৃণাটাই ওকে পশু বানিয়ে দিয়েছে, আর এজন্যই বুঝি ও এমন পাশবিক কাজগুলো করছে!?
কী মনে হতে রাহাত জিজ্ঞেস করে, “কুলসুম নামে কাউকে চিনেন যার সাথে গফুরের প্রায়ই কথা হইত?”
আরফান মাঝি অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, “কুলসুমের লগে গফুর কথা কইত? কই আমি জানি না তো। এইটা তো বেসম্ভব ঘটনা।”
রাহাত কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন, কে এই কুলসুম?”
আরফান তিক্ত গলায় বলে, “এই তো সেই গফুরের বউ, যে পরে পাশের গ্রামে ওই পোলার সাথেই বিয়া বইছে। কিন্তু গফুর তো তার সাথে কথা কওয়ার কথা না।”
রাহাত মনে মনে ভাবে, গফুর তো মাঝে মাঝে গ্রামে আসত, তখন কোনোভাবে হয়ত যোগাযোগ হয়েছে। বউকে ভুলতে পারেনি। হঠাৎ করেই রাহাতের একটা কথা মনে হয়, এই কুলসুম মেয়েটাই ওকে নিয়ে যাবে গফুরের কাছে। এত অপমানিত হবার পরও যখন বউরে ভুলতে পারে নাই, তাহলে গফুর কুলসুমের সাথে যোগাযোগ করবেই।
এরপর কথা দ্রুত শেষ করে রাহাত পাশের গ্রামে কুলসুমের বাড়ি যায়। বয়স হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বয়সকালে যে সুন্দরী ছিল সেটা স্পষ্ট। বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না, বোঝায় যায় কষ্টে দিন চলে। রাহাতের পরিচয় পেতেই একটু সংকুচিত হয়ে বসে কুলসুম।
রাহাত হালকা গলায় বলে, “গফুর যে এমন একজন খুনী, তা আপনি জানতেন? আপনার সাথে তো মাঝে মাঝেই কথা হইত।”
কুলসুম একটু কেঁপে ওঠে, কাঁপা গলায় বলে, “না, আমি একদমই জানতাম না। হেই আমারে ফোন দিত। অবশ্য দুষটা আমার। বছর কয়েক আগে খুব অভাবে পড়ছিলাম, গফুর তহন গ্রামে আসছিল। কেমনে জানি খবর পাইছিল আমার খুব বিপদ যাইতাছে। তহন নিজে আইসা আমারে দশ হাজার টেকা ধার দিছিল। সেই ধার অবশ্য শোধ দিবার পারি নাই। পারমু কেমনে, আমার জামাইটা একটা নেশাখোর, কাম কাজই করে না। এদিকে তখন কোলে দুইটা বাচ্চা। তাই লাজ শরমের মাথা খাইয়া যার ঘর করি নাই তার কাছ থেকেই টেকা ধার নিছি। এরপর মাঝে মাঝেই আইত, টেকা দিত। আইতে না পারলে বিকাশ করত। তাই ইচ্ছা না হইলেও কথা কইতে হইত।”
রাহাত এখানে জীবনের আরেকটা পিঠ যেন দেখে। অভাব মানুষকে কোনো আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে দেয় না। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই এই মেয়েটা গফুরের দেওয়া টাকাটা নিত। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে রাহাত বলে, “আপনি আগের মতোই গফুরের সাথে সম্পর্ক রাখবেন। ও এখন পালিয়ে আছে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস গফুর আর কারো সাথে না হলেও আপনার সাথে যোগাযোগ করবেই। ভুলেও আমাদের কথা বলবেন না। আপনাকে ফোন করার পর আমাদের শুধু ওর ফোন নাম্বারটা জানিয়ে দেবেন। আর ও যদি কখনো আপনার সাথে দেখা করতে আসে তাহলে দ্রুত আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। মনে রাখবেন, গফুর কিন্তু একজন ভয়ংকর খুনী।”
কুলসুমের কেমন শীত শীত লাগতে থাকে, ভয় পাওয়া গলায় কোনোমত বলে, “আইচ্ছা স্যার। আমি লগে লগে আপনাগো জানামু।”
সেদিন রাতে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে রাহাত গভীরভাবে চিন্তা করছিল গফুর এখন কোথায় আছে, কী করছে?
**************-****
ঢাকার গুলশান লেকের ওপারে দেশের সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল। সরু সরু গলি, ছোট ছোট টিনের বাড়ি, চারদিকে নোংরার ছড়াছড়ি। ছোট ছোট হাজারটা রুম এখানে, ভাড়াও কম না। এর একটা রুম হাফসা বেগম ভাড়া দিছে কয়েকদিন আগে। পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম চাইছিল, লোকটা কোনো কথা না কইয়া একবারে পুরা টাকাটাই দিয়ে দিছে। লোকটার নাম আবু নছর, কথা কম কয়, ছোট্ট খুপরি ঘরে ঢুইকা এমুন ঘুম দিল দুই দিন, হাফসা বেগম তো চিন্তায় পইড়া গেছিল। ভালো কইরা জিজ্ঞেস করতে বলেছে নদী ভাঙনের কবলে পড়ছে। ঢাকা শহরে আইছে কামের খোঁজে। হাফসা বেগম তহন বলছিল রিক্সা চালাইতে পারে। তা লোকটার দেমাগ বেশি, কইল কাপড়ের ব্যবসা করব।
সেদিন হাফসা কামে বাইরে গেছে, এমন সময় ওর মোবাইলে জরুরি ফোন আসে, ওর আট বছরের পোলা হাসুর উপর নাকি গরম পানি পইড়া গেছে। কইলজাটা যেন কেউ ছিঁড়া নেয়। দৌড়াইয়া যখন আসে তখন দেখে আবু নছর পাঁজাকোলে নিয়া ময়নার বাপের সিএনজিতে উঠতেছে। হাফসা পাগলে মতো আবু নছরের সাথে সিএনজিতে উঠে।
ময়নার বাপ বুদ্ধি করে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসে হাসুকে। ডাক্তাররা গুরুত্ব দিয়ে দ্রুতই ভর্তি করে নেয়। কয়দিন পর ডাক্তাররা বলে, জানে বেঁচে গেছে। মুখটা খুব বেশি পুড়ে নাই, তা না হলে চেহারাই চেনা যেত না।
এই ঘটনার পর থেকে হাফসা বেগম আবু নছরের উপর একটা আলাদা টান অনুভব করে।
এদিকে আবু নছর পরিচয় দেওয়া গফুর একটা জিনিস ভাবতে থাকে। আচ্ছা, পুলিশ তো ওকে ধরার জন্য পাগল হয়ে আছে। খুব বেশিদিন লুকিয়ে থাকা যাবে না। ওর ছবি দিয়ে নিশ্চয়ই থানাগুলো ভরে গেছে। সবাই ওর মুখটা চিনে গেছে। সেদিন গফুর কেরোসিনের চুলার সামনে বসে ছিল, হাফসা সাবধানে পানি গরম করছিল। পানিটা কেমন টগবগ করে ফুটতেছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গফুর একটা ভয়ংকর চিন্তা করতে থাকে।
সেদিন গভীর রাতে কড়াইল বস্তির হাফসার ভাড়া দেওয়া একটা ছোট্ট খুপরি থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসে। হাফসার বুকটা ভয়ে খামচে ধরে কেউ, ধড়ফড় করে উঠে দেখে আবু নছর উরফে গফুর পশুর মতো চিৎকার করছে, পুরো মুখ গরম পানিতে ঝলসে গেছে।
হাফসা এবার কয়দিন আগে ওর পোলার কথা মনে করে জান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটা সিএনজি করে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গফুরকে নিয়ে যায়।
গফুরের ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে, মুখটা যেন গলে গলে পড়ছে। এর মাঝেও একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে, আজকের পর থেকে কেউ ওর চেহারাটা চিনতে পারবে না। ওর আগের চেহারাটার সাথে আর মিল থাকবে না। পুলিশ চট করে চিনতেও পারবে না। আজ থেকে ওর পালিয়ে থাকার দিন শেষ হলো।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৬/০৯/২০২১