জান্নাহ্,পর্বঃ১৫,১৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১৫
নিস্তব্ধ চারপাশ।অনবরত ঘুরতে থাকা ফ্যানের আওয়াজ।সময় চলছে বসন্তের শেষের দিনগুলোর।গরমে তিক্ত অনুভূতির মাঝেও একরাশ শঙ্কা।আর কয়েকমাস পরেই জান্নাহ্ এর পরীক্ষা।স্যারদের মুখে নিত্য নতুন সহায়িকা বইয়ের কথা শুনতে শুনতে ঝিমিয়ে উঠে মস্তিষ্ক।এতো বইও কী কেনা যায়!স্যারদের মুখেও সেই জৈনক মনিষীর বাণী,”বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না।”
তাই বলে সারাবছর বই কিনবো নাকি!সৃজনশীল হওয়ায় এখন তো আরো ঝামেলা।এত্তো এত্তো প্রশ্ন।উফ!অসহ্যকর!
জান্নাহ্ এখন সুস্থ।সে এখন স্কুলে আসে।সারহান চলে গেছে তার গতানুগতিক কাজে।একগাদা পড়া জমে রয়েছে জান্নাহ্ এর।স্যারদের দেওয়া সাজেশন্সের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সহায়িকা বইয়ের ধারস্ত হতে হয়।তাই লাইব্রেরিতে এসে বই খুঁজছে জান্নাহ্।পুরো লাইব্রেরিতে সারিবদ্ধ করে শেলফ রাখা।এবং নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট বই রাখা।জান্নাহ্ আলতো হাতে নিজের নেকাবটা উঠিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে নেয়।আগুন ঝরছে যেনো চারপাশে।বোরখার ভেতরে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে।কিন্তু তবুও নিজেকে এইসবে অভ্যস্থ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা জান্নাহ্ এর।একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে আবারও ব্যস্ত হয় বই খোঁজায়।কাঙ্খিত বইটা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বাসিত জান্নাহ্।এক পশলা আনন্দ নিয়ে পেছন ফিরতেই দমকে যায় সে।স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে রাফাত।গভীর থেকে গভীর হতে লাগলো রাফাতের চাহনি।জান্নাহ্ কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সে অতি মাত্রায় স্বাভাবিক আচরণ করলো।নিজের পাঠ্য লেখকের কেমিস্ট্রি বই ছাড়াও অন্য এক লেখকের বই খুঁজে নিলো।তা হাতে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় জান্নাহ্।
রাফাত দরজায় তার পথ আগলে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ নিরুদ্বেগ।বই দুটো বুকের সাথে চেপে ধরে নিঃশব্দে রুদ্ধশ্বাসটা ফেলে।রাফাতের কাছাকাছি যেতেই বেপরোয়া ছুটতে থাকা রাফাতের বক্ষস্পন্দন শুনতে পায় জান্নাহ্।তবুও সে নিজেকে সপ্রতিভ রাখলো।নম্র গলায় রাফাত বললো–
“কেমন আছো?
জান্নাহ্ এর মনে হচ্ছে কেউ তার শ্বাস চেপে ধরেছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে জান্নাহ্।তবুও তার নিঃশ্বাস সে গিলে নিতে চায়।নিজেকে স্বাভাবিক করে জান্নাহ্ বললো–
“যেতে দিন আমাকে।”
রাফাত পুনরায় একই ভঙিতে বললো–
“কেমন আছো?
জান্নাহ্ স্থির হয়।কিন্তু তার স্বরনালি কাঁপছে।সে কিছু বলতে চাইছে।কিন্তু তা আবার দমিয়ে নিচ্ছে।ভয় পাচ্ছে না জান্নাহ্।কারণ সে জানে এই মানুষটা তার কোনো ক্ষতি করবে না।তার জন্য প্রাণ দিয়ে দিবে।সে যে তার রেড চেরি।মুহূর্তেই নিজেকে অপরাধি মনে হলো জান্নাহ্ এর নিজের কাছে।চোখের কোনে জল এসেও ফিরে গেলে।এখন এইসবের কোনো মৃল্য নেই।
” অনুভূতিরা বড্ড বেহায়া
পোড়ায় হৃদয় প্রেমানলে
যতই তীব্র হয় তাকে পাবার আশা
ততই ঠেলে দেয় দূরে।”
নিজের অনুভূতির পিঞ্জিরায় তালা বদ্ধ করে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে জান্নাহ্–
“যেতে দিন আমাকে।”
রাফাত চমৎকার হাসলো।সে হাসিতে শব্দ হলো না।কিন্ত দৃঢ়চিত্তে থাকা জান্নাহ্ তা অনুভব করলো।চোখ তুলে তাকালো সে।রাফাত হাস্যোজ্জ্বল চোখে জান্নাহ্ কে দেখলো।এই চোখ দুটো আজ অনেকদিন পর কাছ থেকে দেখছে সে।এই চোখের পাঁপড়ি একদিন প্রশ্বস্ত হয়ে শুধু তাকেই দেখতো।সেখানে অন্যকেউ ছিলো না।কিন্তু আজ! আজ সব অতীত।
রাফাত স্বশব্দে বলে উঠে–
“কেমন আছো?
বড্ড রাগ হলো জান্নাহ্ এর।সে ক্ষীপ্ত হয়ে রাফাতের হাত সরাতে গেলেই রাফাত অন্য হাত দিয়ে তাকে লাইব্রেরির ভেতর দিকে ছুঁড়ে দেয়।দরজা লাগিয়ে এক পা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।তার চোখে মুখে অসংখ্য প্রশ্ন।যার উত্তর দিতে অপারগ জান্নাহ্।জান্নাহ্কে ছুঁড়ে দেওয়ায় সে বেঞ্চের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়।তা দেখেও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাফাত।কোমল গলায় সেই একই প্রশ্ন–
“কেমন আছো?
তেঁতে উঠে জান্নাহ্।তপ্ত গলায় বললো–
“ভালো।”
জান্নাহ্ জানে রাফাতের প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত সে একই প্রশ্ন করবে।তাই বাধ্য হয়ে সে প্রত্যুক্তি করে।নির্মল হাসে রাফাত।জান্নাহ্ এর শ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে।কম্পন শুরু হয়েছে তার শরীরে।রাফাত দুই হাত পকেটে গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।ধীর পায়ে আগাতে থাকে জান্নাহ্ এর কাছে।একদম জান্নাহ্ এর কাছে এসে দাঁড়ায়।প্রশান্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে রাফাতকে।তার সমস্ত শরীর,মন,মস্তিষ্ক আজ তৃপ্ত।জান্নাহ্ এর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো–
“রেড চেরি।”
নেকাবের ভেতর থেকেই কেঁপে উঠে জান্নাহ্ এর হৃদস্পন্দন।অধর ছড়িয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে সে।জান্নাহ্ কখনো এই মানুষটার মুখোমুখি হতে চায়নি।কিন্তু ভাগ্য বড় অসহায়।রাফাত কিছুক্ষন প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো জান্নাহ্ এর ওই প্রস্ফুরিত অক্ষিযুগলে।মিষ্টি হাসলো সে।মোলায়েম গলায় বললো-
“আমাকে ভুলে যাও নি তো রেড চেরি।”
জান্নাহ্ দেখলো না।একজন তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের প্রেমের তৃষ্ণা বুঝেও সে ভাবলেশহীন।লম্বা একটা চঞ্চল শ্বাস টেনে নেয় জান্নাহ্।কন্ঠে কঠোরতা টেনে জান্নাহ্ বললো–
“আমাকে যেতে দিন।”
রাফাত ম্লাণ গলায় বললো–
“তোমার আমার মাঝে তুই থেকে তুমি ছিলো।আপনি কখনো ছিলো না জান্নাহ্।”
জান্নাহ্ নিজেকে সংযত করে বিরসমুখে বললো–
“যেতে দাও আমাকে রাফাত।”
প্রসন্ন হাসলো রাফাত।তার রেড চেরি তার নাম উচ্চারণ করেছে।যা তীরের মতো এসে বিঁধলো তার বুকের ভেতর থাকা সেই কম্পিত নরম মাংস পিন্ডে।কিন্তু তাতে কী ছিলো!বিষ না অমৃত?
রাফাত নিরুদ্বেগ গলায় বললো—
“এতোটা পর কেন করলে জান্নাহ্?এই দেহে তো আমার অধিকার ছিলো।এই মনে আমার নাম ছিলো।এই চোখে আমার নামের কাজল ছিলো।তোমার ওই ঠোঁটে আমার হাসি ছিলো।আজ কেন তা অন্যের?
রাফাত থামলো।বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো সে।ইন করা শার্টের পেছনে কোমরে গুঁজে রাখা ছোট্ট ডাইরিটা বের করে তা খুলে জান্নাহ্ এর সামনে মেলে ধরে।জান্নাহ্ নিঃশব্দে তাকালো।বুকে চাপা পড়া অবুঝ অনুভূতিগুলো কেনো যেনো আঁছড়ে পড়ছে তার বুকের পাজরে।রাফাত নিরুদ্বেগ হাসলো।প্রসন্ন গলায় বললো—
“দেখো রেড চেরি,তোমার প্রিয় ফুল নিয়ে এসেছি আমি।চেরি ফুল।তোমার অপেক্ষায় দেখো শুকিয়ে গেছে।”
আবেগভরা চোখে জান্নাহ্ দেখলো।ফুলগুলো শুকিয়ে পাতলা কাগজের মতো হয়ে আছে।তার রস লেগে আছে ডাইরির পাতায়।তবুও তা সুন্দর।রাফাত মিষ্টি গলায় আবার বললো–
“তুমি না বলেছিলে তোমার জন্য ড্রিম ক্যাচার নিয়ে আসতে।আমি এনেছি।একটা নয় শ’খানেক।পুরো ঘর তোমার জন্য ড্রিম ক্যাচারে সাজিয়েছি আমি।তোমার টেডি বেয়ার তাও আমি এনেছি।সব এনেছি।কিন্তু তুমি কেন চলে গেলে?কেন হারিয়ে গেলে?
জান্নাহ্ এর বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ হয়।দুমড়ে মুছড়ে যাচ্ছে তার ভেতরটা।প্রমত্তা নদীর উত্তাল ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে অকুলপাথারে।জান্নাহ্ কাঁপছে।তার অক্ষিনীর বাঁধ ভেঙেছে।
রাফাত আবার তার অতি মাতায় শীতল গলায় বললো–
“তোমার জন্য রেড প্রিন্সেস গাউন নিয়ে এসেছি।পড়বে না তুমি?আমার রেড চেরি হতে চেয়েছিলে তুমি তবে আজ কেন আমায় তুমি পর করে দিলে জান্নাহ্?কী করে বদলে গেলে তুমি!আমি তো তোমার জন্যই তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম।তোমায় পাবো বলেই নিজেকে গড়তে গিয়েছিলাম।আজ দেখো কিছুই পাইনি আমি।না তোমাকে না নিজেকে।”
কেঁপে উঠে জান্নাহ্ রাফাতের মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি শব্দে।তার কিছু বলার নেই।রাফাতের তোয়াক্কা না করে সামনে পা বাড়াতেই ক্ষীপ্ত হয়ে জান্নাহ্ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রাফাত।পকেটে দু হাত রেখেই শক্ত কন্ঠে বললো—
“বাধ্য করো না তোমায় স্পর্শ করতে।আমার কথা এখনো শেষ হয় নি।”
জান্নাহ্ স্থির হয়।তার অতীত কেন ফিরে আসলো!কী করবে এখন সে।আর একটু সময় রাফাতের কাছাকাছি থাকলে সে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।কিন্তু এই মানুষটা তাকে বিক্ষিপ্ত হতে দিবে না।স্বহস্তে কুড়িয়ে নিবে তাকে।রাখবে তার সবচেয়ে মূল্যবান জায়গায়।যেখানে বহুকাল আগে তারই স্থান ছিলো।
পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় জান্নাহ্।সে স্থির,নিশ্চল,নিথর।আচমকা ফ্লোরে আসন পেতে বসে রাফাত।মৃদু গলায় বললো–
“বসো জান্নাহ্।”
জান্নাহ্ দ্বিরূক্তি করলো না।বসলো সে।স্মিত হাসলো রাফাত।ক্ষনকাল জান্নাহ্ এর দিকে অনিমেষ তাকিয়ে একরাশ অভিমান নিয়ে বললো–
“কী করে পারলে এতো স্বার্থপর হতে?আমার অধিকার অন্যকে কেন দিলে তুমি?আর তো কয়েকটা বছর বাকি ছিলো।আমি ফিরে আসতাম তোমার কাছে।যেমনটা তুমি চেয়েছিলো ঠিক তেমন হয়ে।”
জান্নাহ্ এর নিস্তব্ধতায় তোলপাড় শুরু হয় রাফাতের বক্ষপিঞ্জিরায়।অদ্ভুত কাজ করে ফেলে সে।একটা বিশ্রি কথা বলে ফেলে সে জান্নাহ্কে,বললো—
“এতোটা জ্বালা উঠেছিলো শরীরে আর অপেক্ষা করতে পারোনি?
জান্নাহ্ কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।শক্ত হয়ে বসে রইলো।রাফাতের প্রশ্নের বিপরীতে সে বললো—
“ভালো আছো তুমি?
তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসলো রাফাত।তার আবার ভালো থাকা!হাস্যকর!এই মেয়েটা কখনো ভেবেছে সে চলে গেলে তার কী হবে!ভাবে নি।স্বার্থবাদী।
তবুও সরস গলায় উত্তর করলো রাফাত–
“ভালো।আত্না ছাড়া দেহ যেমন থাকে তেমন টা।”
রাফাত হাসলো।তার হাসিতে তার কষ্ট বের হয়ে আসতে চায়।কিন্তু তা সে অবধমন করলো।অনুনয়ের সুরে বললো–
“নেকাবটা খুলবে?তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
জান্নাহ্ দ্বিধান্বিত হয়ে সময় ক্ষেপন করে।হালকা ঘাড় বাকিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো।সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে রাফাত—
“সে অধিকার নেই আমার?
জান্নাহ্ আলতো হাতে তার নেকাবটা খুলতেই ঘামার্ত ফর্সা মুখটা টলটল করে উঠে রাফাতের সামনে।প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকে দেখছে রাফাত।জান্নাহ্ অনুভূতিশূন্য হয়ে তাকিয়ে আছে।রাফাত প্রসন্ন হাসলো।তার চোখ জুড়িয়ে যায়।রাগ,অনুরাগ,জেদ,অভিমান আর এক পশলা ভালোবাসায় জান্নাহ্ এর চোখ ভরে আসে।তার দুচোখ আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে।ঘামার্ত মুখে লাইব্রেরির জানালা দিয়ে আসা এক চিলতে কুসুম রোদে ঝলমল করে উঠে জান্নাহ্ এর মুখমন্ডল।আবেগভরা দুই দৃষ্টি রাফাতের।তার মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।তার হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা আজ পাখা মেলে উড়তে চায়।কিন্তু আজ যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।যেই মনে শুধু তার রাজ হওয়ার কথা সেখানে আজ অন্যকেউ।যে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সে শিশুসুলভ চঞ্চলতা দেখেছে আজ তা নারীদেহে পরিণত হয়েছে।যে চোখের গভীরে সে টেডি বিয়ারের জন্য কান্না দেখেছে আজ সে চোখে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা।রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আবেগী গলায় বললো—
“এতোদিনে তোমার চুলও অনেক বড় হয়েছে তাই না?
মাথায় থাকা ইনারটা টেনে খুলে ফেলে জান্নাহ্।কিন্তু রাফাতের দিকে তাকালো না সে।পারছে না সে এই মানুষটার দিকে তাকাতে।ক্ষীন শ্বাস ফেলছে জান্নাহ্।তার মনে যন্ত্রণা হচ্ছে।এই মানুষটাকে সে ঠকাতে চায় নি।কিন্তু যা হয়েছে তা সময়ের খেল।যাতে কারো হাত নেই।মানুষ বদলায় না।সময়ের সাথে বদলে যায় তার অনুভূতি।
রাফাত এখনো গভীর দৃষ্টিতে দেখছে জান্নাহ্কে।তাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।কিন্তু পারবে না।তা ভাবতেই রাফাতের পুরুষমন কেঁদে উঠলো।তার সেই অশ্রুর সাথে সঙ্গী হলো তার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম।ব্যস্ত হাতে তা মুছে নিলো রাফাত।পুরুষ মানুষ প্রস্তরখণ্ড।ভেঙে চুরমার হলেও তা থেকে জল গড়াবে না।
মৃদু হাসলো রাফাত।সরল গলায় বললো–
“অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি।আর সুন্দরও হয়েছো।তোমার স্বামী নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে পূর্ণ করেছে তাই তো আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে তার হৃদয়ের রাণী হলে তুমি।”
জান্নাহ্ নিঃশব্দে কাঁদলো।কিন্তু তার চোখের পানি রাফাত দেখলো না।নাক টানতেই তা বুঝতে পারে রাফাত।মাথা হেলিয়ে জান্নাহ্কে পর্যবেক্ষন করে বললো–
“কাঁদছো রেড চেরি?
জান্নাহ্ শক্ত হলো।দৃঢ় হয়ে বসলো।রাফাতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো–
“আমার কষ্ট হচ্ছে রাফাত।”
রাফাত ঠোঁট চিপে কিছুক্ষন মাথা হেলায়।উঠে দাঁড়ায় সে।সেই সাথে জান্নাহ্।রাফাত আবারও জান্নাহ্ কাছে এসে দাঁড়ায়।ঘাড় হেলিয়ে জান্নাহ্ কানের কাছে গিয়ে বললো–
“যাও।কাল ঠিক এইসময়।এইখানে আবার কথা হবে আমাদের।জানো তো,তোমার কষ্টে যেমন আমি মরতে পারি তেমন আমার খুশির জন্য আমি মারতেও পারি।আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।গো নাউ।”
জান্নাহ্ দাঁড়ালো না।কিছু ভাবলোও না।চঞ্চল পা দুটো দ্রুত চালালো।বেরিয়ে আসলো লাইব্রেরি থেকে।লাইব্রেরির বাইরেই ইশাক দাঁড়ানো।ভ্রু কুঞ্চি করে মোটা ফ্রেমের চশমাটা নাকের ডগার দিকে নামিয়ে জান্নাহ্কে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখে লাইব্রেরিয়ান আঙ্কেল।জান্নাহ্ তোয়াক্কা করলো না।হনহন করে নিজের ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো।লাইব্রেরি থেকে বের হলো শ্রান্ত রাফাত।।চোখে মুখে অবিশ্বাস্য দীপ্ততা।ইশাক বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো।সরস গলায় বললো–
“এইবার তো শুধরে যা।”
বিরস হাসলো রাফাত।হন্তিদন্তি করে ক্লাসে ঢুকে জান্নাহ্।তাকে দেখেই তাজ্জ্বব বনে যায় তিল।বিস্মিত গলায় বললো–
“এই কী হয়েছে তোর?এই অবস্থা কেন?
ক্লাসের ছেলে মেয়েরা বিস্ফোরিত চোখে দেখছে জান্নাহ্কে।এই রূপে তাকে আগে কখনো দেখা যায়নি।খোঁপা করা চুল খুলে এলিয়ে রয়েছে পিঠে।সামনে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো চোখে মুখে লেপ্টে আছে।সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই জান্নাহ্ র।রক্তিম চোখ দুটো মেলে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে নাকের ডগা মুছে নেয়।ব্যস্ত হাতে ব্যাগ গুঁছাতে থাকে।তিল আবারো বিস্ময়কর কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে–
“কী হয়েছে বলবি তো?
জান্নাহ্ রাগি গলায় বললো-
“কিচ্ছু না।বাসায় যাবো আমি।”
“কিন্তু…।”
তিলের কথার কোনো ভাব প্রকাশ করলো না জান্নাহ্।গটগট করে বেরিয়ে আসে।করিডোর দিয়ে যেতেই দেখে রাফাত আর ইশাক নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।জান্নাহ্ চোখ ফিরিয়ে দ্রুত পা চালায়।দুর্বোধ্য হাসে রাফাত।চঞ্চল গলায় বললো–
“ভয় পেয়েছে আমার রেড চেরি।”
ইশাক শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।হেলতে হেলতে ক্লাসে গিয়ে ঢুকে রাফাত।মেঘনোলিয়ার মৃত্যুতে রাফাতকে খন্ডকালীন সময়ের জন্য শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।হায়ার ম্যাথের তিনজন টিচারের মধ্যে একজনের মৃত্যু আর অন্যজনের ছুটি থাকায় একার পক্ষে একজন শিক্ষকের ক্লাস সামলানো দায়।তাই নতুন শিক্ষক নিয়োগের আগ পর্যন্ত রাফাত নিবে কয়েকটা ক্লাস।
বাড়িতে এসে ব্যাগ,বোরখা সব বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে জান্নাহ্।ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে।ঝমঝমিয়ে ঝরতে থাকে তার চোখের শ্রাবণের অঝোর ধারা।চিৎকার করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার মস্তিষ্ক যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।ভেঙে যাচ্ছে তার বক্ষপিঞ্জর।কী করে পারলো এতো স্বার্থপর হতে সে!যে মানুষটা তাকে হাটতে শিখিয়েছে,দুনিয়া চিনতে শিখিয়েছে,তার একাকিত্ব দূর করে তাকে মুক্ত আকাশে উড়তে শিখিয়েছে কী করে পারলো তাকে ঠকাতে!নিজের মনে উদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতির মায়া বুঝতে শিখিয়েছে,তার ব্যাখ্যা বুঝিয়েছে কী করে তাকে একা করে দিলো সে!
নিজের গালে নিজেই চড় মারতে থাকে জান্নাহ্।এতোটা লোভী,এতোটা নিজেকে নিয়ে কবে বিভোর হলো সে!জান্নাহ্ এর কানে বেজে উঠে রাফাতের সে ডাক,”রেড চেরি”।
সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।নিজের অবাধ্য,এলোমেলো,মূল্যহীন চিন্তাগুলোকে জোর করে ঠাটিয়ে বললো–
“নাহ।আমি তোমার রেড চেরি নই।আমি শুধুই রজনীগন্ধা।শুধুই রজনীগন্ধা।”
ডুকরে উঠে জান্নাহ্।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ১৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিক্ষিপ্তচিত্তে বসে আছে সারহান।তার সামনে রাখা ধোঁয়া উড়ানো কফির উষ্ণ হাওয়া মিলিয়ে গেছে প্রকৃতির বাতাসে।জানালায় টাঙানো সফেদ রঙের পর্দা স্থির হয়ে আছে।তাতে কোনো হেলদোল নেই।সুনসান নিরবতা।এসির ভোঁতা শব্দে আরও চটে যায় সারহানের মস্তিষ্ক।টেবিলে রাখা পেপার ওয়েটটার দিকে তীক্ষ্ম ও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।ইচ্ছে করছে এইটা মেরেই সামনে থাকা সম্মানীয় ব্যক্তির মাথাটা ফাটিয়ে দেই।কিন্তু তা সম্ভব হলেও আপাতত নিজের বেখেয়ালি,ইউজলেস ইচ্ছেকে অবদমন করলো সারহান।সরু ভ্রু জোড়া কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে বললো–
“আর কতক্ষন ওয়েট করবো?
ও আদৌ আসবে!
সামনে থাকা ব্যক্তিটি চমৎকার হাসলেন।তার মোটা ভ্রু জোড়া নাচিয়ে তৎক্ষণাৎ গভীর অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন।মেজাজ বিঘড়ে যায় সারহানের।ঠোঁট গুঁজ করে বললো–
“চললাম আমি।টাইম ইজ ভ্যালুএবল রেদার দ্যান মানি।”
সারহান দুম করে উঠে দাঁড়াতেই দরজা স্লাইড করে ঢুকলো একজন শ্যামবর্ণে সুদর্শন পুরুষ।সাদা শার্টের সাথে কালো রঙের প্যান্ট।গলায় ঝুলছে কালো রঙের টাই।কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা হাতার বাম হাতে সিলভার রঙের হাতঘড়ি।ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের উপরিভাগে দুই ভ্রুয়ের সন্ধিস্থলে একটা তারকা চিহ্ন যা ইহতিশামের জন্মগত।এই চিহ্নের জন্যই তাকে তার আশেপাশের মানুষ অনেক স্পেশাল মনে করে।শ্যামবর্ণের হলেও তার বাচনভঙ্গি,দূরদর্শিতায় সে অন্যন্য।নিজের কাজের সাথে শরীরের যত্ন নেওয়াও একটা শখ বলা চলে ইহতিশামের।উচ্চ গ্রীবা,তীক্ষ্ম নাক,পুরু ওষ্ঠাধরে এক অদ্ভুত মোহনীয় পুরুষ।
দরজায় দাঁড়িয়েই নির্মল গলায় বললো–
“ম্যায় আই কাম ইন?
সরফরাজ প্রসন্ন হাসলেন।হাসি হাসি চোখে ইহতিশামকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন।ইহতিশাম ভেতরে এসে চেয়ার টেনে বসলো।অরুনলোচন আঁখি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সারহান।ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও সেদিকে কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ করলো না ইহতিশাম।সরফরাজের সাথে উষ্ণ ভাবের আদান-প্রদান করে সারহানের দিকে তাকালো।হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় ঝলমলে হেসে কোমল গলায় প্রশ্ন করলো–
“কেমন আছিস?
সারহান উত্তর করলো না।জ্বলন্ত চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তার মাথার দুই পাশের শিরা ফুলে উঠেছে।তা দেখে মৃদু হাসলো ইহতিশাম।শান্ত গলায় পুনরায় বললো–
“ট্র্যাফিক ছিলো।আমি কী করবো বল?নিয়ম মানতে তো তুই ই শিখিয়েছিস আমাকে।”
সারহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।কোনো কথা বললো না।ইহতিশাম কিঞ্চিৎ অধর প্রসারিত করে বললো–
“বললি না কেমন আছিস?
সারহান তপ্ত গলায় বললো–
“কেন ডেকেছিস?
চোখে হাসলো ইহতিশাম।ইহতিশাম সম্পূর্ণ সারহানের বিপরীত চরিত্রের মানুষ।কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের মিল ছিলো যা এখন আকাশ আর পাতালের মতো।ইহতিশাম কানে নিলো না সারহানের ক্ষীপ্ত কথা।নরম গলায় বললো–
“তোকে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই।আমি বললে তো আসতি না।”
সারহান নাকের পাটা ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।গনগনে গলায় বললো–
“তোর আর আমার মাঝে এমন কিছুই নেই যে তুই বললেই আমাকে আসতে হবে।”
চেয়ারটাকে জোর করে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।সরফরাজ চকিত হয় সারহানের ব্যবহারে।এর আগেও অনেক কেসে তারা দুইজন একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছে।সবসময়ই অস্বাভাবিক ব্যবহার সারহানের।ইহতিশাম যতই সবটা সফ্টলি হ্যান্ডেল করতে চায় সারহান তাদের সম্পর্কটা আরো জটিল করে ফেলে।দরজার কাছে গিয়ে থমকে যায় সারহান।তার চলে যাওয়ার অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ায় ইহতিশাম।দুই হাত পকেটে গুঁজে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায় সারহান।চোখ দুটো স্বাভাবিক রেখে তীর্যক গলায় বললো–
“নারকেল জিঞ্জিরার নারকেল তেল দেওয়া বন্ধ কর চুলে।এই গন্ধে ট্রাঞ্জেন্ডার তো দূরে থাক শীমেলও জুটবে না তোর।”
অনেকটা আক্রোশ নিয়ে থাই স্লাইড করে বের হয় সারহান।সারহানের উদ্ভট কথায় হতভম্ব সরফরাজ স্মিত গলায় বললো–
“এইসব কী বললো সারহান?
ইহতিশাম বিগলিত হাসলো।সরস গলায় বললো—
“মানুষের শরীরে দুইশ ছয়টি হাঁড়।সারহানের ঘাড়ের একটা হাঁড় বাঁকা যা ওর মা হাজার চেষ্টা করেও সোজা করতে পারেনি।”
এই কথায় হাসতে ইচ্ছে হলো সরফরাজের।কিন্তু সে হাসলো না।তার মনে পড়লো সামিরার কথা।সরফরাজের একমাত্র মেয়ে।যার খুনের রহস্য উদঘাটনের জন্য ইহতিশাম কে আনা হয়েছে।ইহতিশাম ফোঁস করে এক দম ছাড়লো।স্বগতোক্তি করে বললো–
“হয়তো আমার ওই একটা ভুলে সারহান আজ এতোটা বিপর্যস্ত !
ইহতিশাম দাঁড়ানো থেকে বসলো।নরম চোখে সরফরাজের দিকে তাকালো।তিনি একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন ইহতিশামের দিকে।ইহতিশাম শীতল গলায় বললো–
“ওয়েল।সামিরার মোবাইল আর এফ বি অ্যাকাউন্ট?
সরফরাজ মোলায়েম গলায় বললেন–
“মোবাইলটা পাওয়া যায়নি।আর বাকি সব এই ফাইলেই আছে।আমি চাই যত দ্রুত সম্ভব তুমি খুনি কে আমার সামনে নিয়ে আসবে।আমি তাকে একটা প্রশ্নই করবো কেন সে আমার মেয়েকে এতো নিষ্ঠুর মৃত্যু দিলো?
সরফরাজের গলা জড়িয়ে আসে।নিজের একমাত্র মেয়েকে নিজের চোখের সামনে ওইভাবে দেখার চেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সুখময়।
,
,
,
টেবিলের উপর দুই হাতের ভাঁজের উপর মাথাটা কাত করে দিয়ে জান্নাহ্ এর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে রাফাত।তার চোখ দুটো অদ্ভুদভাবে খেলছে।বোরখা পরা থাকলেও মুখটা আজ খোলা জান্নাহ্ এর।
দুপুরের এই সময়টা লাইব্রেরি অফ থাকে।লাইব্রেরিয়ান আঙ্কেল লাঞ্চ করতে যায়।আর এই সময়টাই রাফাত কাটায় তার রেড চেরির সাথে।তাদের থেকে চার পাঁচ বেঞ্চ পেছনে বসে আছে ইশাক।চোখের সামনে বই থাকলেও তার কান উৎকর্ণ হয়ে আছে রাফাত আর জান্নাহ্ এর কথোপকথনে।মাথার উপরেই ফ্যান।সেই বাতাসেই উড়ছে জান্নাহ্ এর কাটা কাটা সামনের ছোট চুল।লাইব্রেরির উত্তর পাশের জানালা দিয়ে ঈষৎ হলুদ রোদ আসছে।তাতে ঝলমল করছে সেখানকার ফ্লোর।
আড়চোখে রাফাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় জান্নাহ্ বললো–
“এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
রাফাতের মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না।সে চেয়ে রইলো।জান্নাহ্ সামনে থাকা বই থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে রাফাতের দিকে তাকায়।রাফাত রহস্য হাসে।মাথাটা উঠিয়ে দুই হাতের উপর চিবুক রেখে সহজ গলায় বললো–
“অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি।”
জান্নাহ্ স্মিত হাসলো।সরস গলায় বললো–
“সাড়ে তিনবছর।অনেকটা সময় রাফাত।”
রাফাত গম্ভীরভাবে মাথা দোলায়।আলতো হেসে বললো–
“অনেক সুন্দরও হয়েছো তুমি।এই তোমার নাকটা এতো চিকন হলো কী করে!আগে তো মোটা ছিলো।”
জান্নাহ্ হাসির ছলে ঘোর আপত্তি করে বললো–
“মোটেও না।”
রাফাত সোজা হয়। চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে।বিরসমুখে বললো–
“শুনেছি বিয়ের পর নাকি মেয়েদের রূপ খেলে উঠে।তোমাকে দেখে বিশ্বাস হলো।অবশ্য বয়সন্ধিকালের পর মেয়েরা এমনিতে সুন্দর হয়ে যায়।”
কপট রাগি চোখে তাকায় জান্নাহ্।গা দুলিয়ে হেসে উঠে রাফাত।জান্নাহ্ সরস গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–
“আঙ্কেল,আন্টি কেমন আছে?
রাফাত সোজা বললো–
“ভালো।”
“রোশনি আপু?
“ভালো।”
“পুঁচকোটা কতোবড় হয়েছে এখন?নিশ্চয়ই হাঁটতে পারে?
রাফাত আমুদে গলায় বললো–
“শুধু হাঁটতে না দৌঁড়াতেও পারে।”
সরস হাসে জান্নাহ্।আচমকা রাফাত থম মেরে যায়।কৌতুহলপ্রদ হয়ে বললো–
“তোমার পরিবারে কে কে আছে?
জান্নাহ্ অনেক আগ্রহ নিয়ে বললো–
“বাবা,আম্মা,শুভ্রা আপু,সেরাজ ভাইয়া আর তাদের ছেলে জাবিন,মেয়ে তিতি।”
বিরস হাসলো রাফাত।হতাশ গলায় বললো–
“সব তো একই।শুধু আমার জায়গায় অন্যকে বসালে।”
জান্নাহ্ থম মেরে যায়।কিছুক্ষন দুইজন কোনো কথা বললো না।জানালা দিয়ে কাকের ডাক শোনা যাচ্ছে।স্কুলের পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়ার গাছ থেকে একটা অজানা পাখির আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।মৌনতা ভেঙে জান্নাহ্ বললো–
“তোমার গার্লফ্রেন্ডের কী খবর?
রাফাত হাসলো।রসালো গলায় বললো–
“বিয়ে হয়েছে।টু মানথ প্রেগন্যান্ট।”
খিলখিল করে হেসে উঠে জান্নাহ্।ফিচেল গলায় বললো–
“ছ্যাকা খেলে আবার!ট্রু ছ্যাকা খোর তুমি।”
রাফাত নিরাশ গলায় বললো–
“সেইটার শুরু তো তুমিই করলে।”
ছোট্ট দম ফেললো জান্নাহ্।জান্নাহ্ যতই চাইছে রাফাতকে মোটিভেট করার ততই সে আরো ভেঙে পড়ছে।রাফাতের ক্লাসমেট অনিতা রাফাতকে পছন্দ করতো।কিন্তু এতো সিদ্ধ করার পরও যখন ডাল গললো না তাই একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ির গলায় মালাটা পড়িয়েই দিলো অনিতা।
রাফাত একটা ছোট্ট জার এগিয়ে দেয় জান্নাহ্ এর দিকে।ছোট্ট জারে লাল লাল চেরি।আপ্লুত হয় জান্নাহ।তা খুলেই একটা মুখে দেয়।উৎসুক গলায় প্রশ্ন করলো–
“তুমি এনেছো?
“উঁহু।আমার এক বন্ধুকে দিয়ে স্পেন থেকে আনিয়েছি।”
বন্ধুর কথা বলতেই ইশাকের দিকে তাকায় জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর চোখের আগত প্রশ্ন পড়ে ফেললো রাফাত।স্বাভাবিক কন্ঠে বললো–
“ইশাক আমার সাথেই পড়তো।ওর বাড়ি কুমিল্লা।জাপান গিয়েই আমাদের পরিচয়।রক্তের সম্পর্কবিহীন আত্নার সম্পর্ক।”
জান্নাহ্ ফিচেল হেসে বললো–
“এই জন্যই তোমার মতো পাগলের পাল্লায় পড়ে সব ছেড়ে ছুড়ে এখানে এসে পড়েছে।”
জান্নাহ্ এর কথার পেছনেই বলে উঠে রাফাত—
“”পাগল তো তুমি আমায় করলে।এখনো কিছুই বললে না আমাকে।বিয়ে কেন করলে তুমি?
জান্নাহ্ ছোট্ট দম নিয়ে বললো—
“যা হওয়ার হয়ে গেছে রাফাত।আমার ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে।”
“ভাগ্যকে দোষ দিয়ে নিজের অপরাধ ঢাকতে চাইছো?
জান্নাহ্ অপরাধি চোখে তাকায়।রাফাতের নিষ্প্রভ চোখ জোড়া ব্যথাতুর।কিন্তু জান্নাহ্ এর কিছুই করার নেই।তার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।লাইব্রেরিতে শুধু বইয়ের সমাগম সেই সাথে প্রাণহীন কাঠের টেবিল চেয়ার।নিঃশ্বাসের আওয়াজও যেনো কাঁপিয়ে দেয় একে অন্যকে।রাফাত আর জান্নাহ্ কেউ কথা বললো না।তাদের চোখ জোড়া বলে যাচ্ছে কথা প্রগাঢ়ভাবে একে অন্যের সাথে।নিস্তব্ধতায় ছন্দ তুললো রাফাত,বললো–
“তোমার হ্যাজবেন্ড কী করে?
“জার্নালিস্ট।”
“কোন পেপারের?
“জানি না।”
রাফাত কপট বিস্ময় প্রকাশ করে বললো–
“হাসালে।হ্যাজবেন্ড কোন পেপারের সাংবাদিক জানো না!
জান্নাহ্ কাঠখোট্টা গলায় বললো–
“প্রয়োজনবোধ করিনি।”
“সত্যিই কী আঙ্কেল আন্টি একে অপরকে…।”
ধক করে উঠে জান্নাহ্ এর বুক।নিজের বাবা মায়ের মৃত্যুকে সে ভুলতে চায়।ভুলতে চায় সে ভয়ংকর রাতের কথা।ভুলতে চায় সেই অবিশ্বাস্য সত্য।ভুলতে চায় তার ভয়ংকর অতীত।যা আজও তাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না।নিজেকে যথাসম্ভব অটোল রেখে শক্ত গলায় জান্নাহ্ বললো–
“মাম্মা অ্যাডিক্ট ছিলো।”
ফোঁস করে দম ফেললো রাফাত।গাঢ় গলায় বললো–
“আমি আগেই বলেছিলাম আন্টিকে ট্রিটমেন্ট করাতে।বাট আঙ্কেল..।”
একটা শক্ত ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।ব্যস্ত গলায় বললো–
“আমার কোচিং আছে।যেতে হবে।”
উঠে দাঁড়ায় রাফাত।নির্মল গলায় বললো–
“আচ্ছা যাও।”
কয়েক কদম গিয়ে ফিরে আসে জান্নাহ্।রাফাতের চোখে চোখ রেখে বললো–
“তিলকে দেখেছো?
রাফাত ভ্রু ক্রুটি করে গম্ভীর গলায় বললো–
“কোন তিল?
“আমার বান্ধবী তিল।”
“কেন?কী হয়েছে?
“ও তোমাকে পছন্দ করে।অনেক ভালো মেয়ে।”
ঝরা হাসে রাফাত।উপহাস করে বললো–
“মৃত নদীতে জোয়ার আসে না জান্নাহ্।”
রাফাতের কথায় প্রত্যুক্তি করে জান্নাহ্–
“মৃত নদী যদি খরস্রোতা নদীর সংস্পর্শে আসে তাহলে সে প্রাণ ফিরে পায়।”
“অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি।জটিল জটিল কথা বলতে শিখেছো।আফটার অল আমার ছোট্ট রেড চেরি এখন কারো বিবাহিত স্ত্রী।কিন্তু তাই বলে অন্যের দেওয়া প্রাণের আমার দরকার হবে না।তুমি ফিরবে আমার রেড চেরি হয়ে?
“তা সম্ভব নয় রাফাত।”
দুর্বোধ্য হাসলো রাফাত।বললো–
“তোমার হ্যাজবেন্ডের নাম টা বললে না রেড চেরি।আজকাল জিঙ্গেস না করলে কোনো কিছুই বলো না।পর হয়ে গেলে।”
জান্নাহ্ ভারি গলায় বললো–
“সারহান।সারহান জেইদি।”
চলবে,,,