জান্নাহ্,পর্বঃ১৭,১৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১৭
লাগাতার রিং বেজে যাচ্ছে জান্নাহ্ এর মোবাইলের।কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।অসহনীয় গরম আরো অসহনীয় হয়ে উঠলো সারহানের জন্য।ঝিমঝিম করছে তার শরীর।রুমজুড়ে পায়চারী করছে সে।প্রশ্বস্ত দুই চোখের পাতায় যেনো অগ্নি ঝরছে।কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সারহানের।
অবাক দৃষ্টিতে সারহানকে দেখছে শ্রীজা।অস্থিরতা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সারহানকে।দাঁত মুখ খিঁচে বিড়বিড় করে যাচ্ছে।ওপাশে কল রিসিভ হতেই খিস্তি মেরে উঠে সারহান–
“কোথায় ছিলেন আপনি?কল কেন রিসিভ করছিলেন না?
ছোট্ট দম নেয় জান্নাহ্।নরম গলায় প্রত্যুক্তি করে বললো–
“সরি,তিতির শরীরটা ভালো নেই।সকাল হতেই গা গরম ছিলো।কিছুই খেতে চাইছিলো না।দুপুরে একটু জোর করে খাইয়েছিলাম।আর তারপরই গরগর কর সব উগরে দেয়।খুব কাঁদছিলো।কারো কাছেই যাচ্ছিলো না।ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়েই দেরি হয়ে গিয়েছে।”
সারহান কপাল ভাঁজ করে উদ্বেলিত গলায় বললো–
“এখন কী অবস্থা?ডক্টরের কাছে নিয়েছে?
জান্নাহ্ নিরুদ্বেগ গলায় বললো-
“নাহ।এখন ঘুমোচ্ছে।আপু বললো ঘুম থেকে উঠলে যদি খারাপ কিছু দেখে তাহলেই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।তার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে শ্রীজা।অপ্রস্তুত হয়ে সারহান।ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের প্রাঙ্গনে আসে।তপ্ত সূর্য তার আগুন যেনো উগরে দিচ্ছে।কোমল গলায় প্রশ্ন করে সারহান—
“আপনি খেয়েছেন?
“জ্বী।”
আরো বেশ কিছু সময় কথা চলতে থাকে তাদের।নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে চেয়ে থাকে শ্রীজা।সারহান গরম সহ্য করতে পারে না।কিন্তু গনগনে মধ্য দুপুরের প্রভাকরের হিংস্র তাপে সারহানের কপাল বেয়ে ঝরছে ঘাম।এডাম’স অ্যাপেলের নিচটায় জমেছে মুক্তোর দানার মতো নোনতা জল।ফোল্ড করা লোমশ হাত দুটোর মধ্যে চিকচিক করছে সেই ঘাম।লালচে আভায় রাঙিয়ে যায় সারহানের ফর্সা মুখ।চোখের পাতায় টপকে পড়া উষ্ণ জল মুছে নেয় হাতের উল্টো পাশ দিয়ে।নাকে চোখে ব্যক্ত হয় অস্বস্তি।অধরের কোণ প্রসারিত করে এক চোখ ক্ষীন করে সূর্যের দিকে তাকায় সারহান।চোখ বুজে আসে তার।একটা ঠান্ডা বাতাস আসতেই বেখেয়ালিভাবে নিজের শার্টের কলারটা পেছন দিকে ছড়িয়ে দেয় সারহান।তবুও মুখে উচ্ছল হাসি।নিচের দিকে তাকাতেই দেখে ধূলো উড়ানো প্রাঙ্গনে তার ছায়ামূর্তি।সারহান সেদিকে দৃষ্টি ক্ষেপন করে জান্নাহ্ এর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।নিজের ছায়া দেখে স্মিত হাসে সারহান।পৃথিবীর সবাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেও এই ছায়া কখনো তার মালিককে ছেড়ে যায় না।
শ্রীজার ধমনীতে বহমান রক্তকণিকা সরব হয়ে উঠে মুহুর্তে।একটু পরই র্্যাশ দেখা দিবে সারহানের।এই উত্তপ্ত সূর্যের সরাসরি বেগুনি রশ্মি বেশিক্ষন হজম করতে পারে না সারহান।কিন্তু আজ দিব্যি সেখানেই দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে।ভীত হয় শ্রীজা।তাহলে কী সারহান সত্যি সত্যিই জান্নাহ্কে ভালোবাসে!
রুমে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে সারহান।পানির ঝাপটা মেরে শীতল করে নিজেকে।তার দিকেই নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রীজা।আয়নায় সামনে দাঁড়াতেই দেখে গলার আর মুখের বিভিন্ন জায়গা লাল লাল হয়ে আছে।বিগলিত হাসে সারহান।রজনীগন্ধার জন্য এইটুকু কষ্ট তো সহ্য করাই যায়।শ্রীজা হেয়ালি গলায় অভিমান নিয়ে বললো–
“জান্নাহ্ এর প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছো তুমি।”
বিক্ষিপ্ত হাসে সারহান।সরব গলায় বললো–
“এইটাতো হওয়ারই ছিলো।আমার রজনীগন্ধা সে।”
শ্রীজা দমদমে গলায় বললো–
“ভালোবাসো ওকে?
স্মিত হাসে সারহান।রহস্যচ্ছলে বললো—
“ভালো তো আমি তাকে বেসেছি যার চোখের ধারালো চাহনিতে আমি খুন হয়েছি।”
পরম আবেশে চক্ষু মুদন করে সারহান।তার মানসপটে ভেসে উঠে দুটো চোখ।হাস্যোজ্জ্বল চেহারার সেই চঞ্চলা কিশোরীর দুই চোখ।তার চোখে কিছু একটা ছিলো।নব যৌবনা সেই কিশোরী বারবার ফিরে দেখছে শ্রান্ত,ঘামার্ত, চিন্তিত সারহানের দিকে।তার পরনের বাদামী আর নীলের মিশেলের চেক শার্টের মাঝে থোকা থোকা রক্তের ছাপ।কিশোরীটি তার নরম কিশলয়ের মতো ওষ্ঠাধর কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে হাসছে।কোমরে ছড়ানো রেশম কালো চুল নড়ছে তার বারবার ফিরে চাওয়াতে।একটা হাঁটু ছাড়ানো ফ্রক পরা।মোজাবিহীন দুই ফর্সা পায়ে স্কেকার্স পরা।বেখেয়ালিভাবেই সারহান তাকায় সেই কিশোরীর দিকে।কিশোরী হাসছে।তার হাসিতে মুক্তো ঝরছে।সারহান সেই হাসিতে ঘায়েল হয়।ক্লান্ত চোখ আর পরিশ্রান্ত দেহে কিশোরীর দিকে তাকাতেই সারহানের হৃদকম্পন থেমে যায়।কিশোরীটি তার পাশে থাকা বলিষ্ঠ মানুষটির হাত চেপে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।আর সারহানকেই দেখে যাচ্ছে।চোখের আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত সেই চোখেই হারিয়ে যায় সারহান।তার মৃত্যু দেখে সে ওই চোখে।এক ভয়ংকর,তৃপ্তিকর ঐশ্বরিক মৃত্যু।
,
,
,
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে জান্নাহ্ আর রাফাত।জান্নাহ্ দ্বিধান্বিত হয়ে তাকায় রাফাতের দিকে।রাফাত সোজা দৃষ্টি রেখে আনমনে হেঁটে চলছে।নিরুদ্বেগ,নিরুত্তাপ।গরমে টিশার্ট গায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে।তবুও ভাবলেশহীনভাবে হেঁটে চলছে সে।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ধীরপায়ে তার সাথেই এগিয়ে চলছে জান্নাহ্।আকাশ ভেসেছে ফিকে নীলাভ রঙে।দূরের আকাশে উড়ে চলছে নীড়ে ফেরা পাখি।কেউ কথা বলছে না।
রহস্য হাসলো রাফাত।দুলে দুলে চলছে সে।তার এই অবস্থা দেখে ভ্রু ক্রুটি করে জান্নাহ্।থম মেরে দাঁড়িয়ে যায় সে।কপট রাগ নিয়ে বললো–
“হাসছো কেন?
আওয়াজ করে হেসে উঠে রাফাত।দাঁত কিড়মিড় করে জান্নাহ্।জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললো—
“হাসি বন্ধ করো মিয়া খলিফার চামচা।”
হাসি বন্ধ করে ড্যাবড্যাব করে তাকায় রাফাত।পদযুগল তার স্থির হয়েছে আগেই।কপট বিস্ময় নিয়ে বললো–
“ছিঃ!কী বললে তুমি?
জান্নাহ্ প্রাণখুলে হাসে।সেই হাসিতেই উৎফুল্ল হয় রাফাতের হৃদযন্ত্র।অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে জান্নাহ্ বললো–
“তুমি হাসি বন্ধ করলে না ক্যান!
“বড্ড পেকে গেছো তুমি।”
“তা তো অবশ্যই।”
রাফাত মিচকি হেসে ফিচেল গলায় বললো–
“হ্যাঁ।লাল টসটসে।”
জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে বললো–
“বেহুদা রাফাত।”
গা দুলিয়ে হেসে উঠে রাফাত।ছোটবেলা থেকেই একদম বন্ধুর মতো সম্পর্ক রাফাত আর জান্নাহ্ এর।জান্নাহ্ যতটা না নিজের দেহ সম্পর্কে অবগত তার চেয়ে বেশি রাফাত তা নিয়ে তটস্থ।শিশু থেকে কিশোর জীবনে পদার্পনের প্রথম ধাপ অতিক্রম করে জান্নাহ্ রাফাতের হাত ধরে।তার প্রথম মান্থলির সময়টাও রাফাত ছিলো জান্নাহ্ এর সাথে।তাকে বুঝিয়েছে তার শারীরিক পরিবর্তনের কারণ,তার প্রয়োজনীয়তা।তাই তাদের মধ্যে সম্পর্কটা অন্যান্য বন্ধুত্বের থেকেও গভীর।তাদের সম্পর্কের গভীরতা বোঝার আগেই নতুন সম্পর্ক তৈরি হয় যা সম্পর্কে রাফাত সপ্রতিভ থাকলেও জান্নাহ্ ছিলো অজান্তা।সেই সম্পর্কের মানে তখন বুঝতে পেরেছে জান্নাহ্ যখন তার জীবনে সারহান আসে।
বিরসমুখে রাফাত বললো–
“বড্ড বেখেয়ালি ছিলে ।কিন্তু এখন!
নিজেকে সামলে নিয়েছো।বড় হয়ে গেছো তুমি।ছোট্ট রেড চেরি আজ…।”
ফোঁস করে এক শ্বাস ফেললো রাফাত।তার রেড চেরি আজ অন্য কারো।ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে তার।ভালোবাসা তো ছিলো না তাদের মধ্যে।তবুও ছিলো কিছু একটা।ছিলো একে অন্যের সাথে পথ চলার অঙ্গীকার,ছিলো পাশাপাশি থাকার চেষ্টা,ছিলো এক জনের সুখে অন্যজন হাসার আর এক জনের দুঃখে অন্যজন কাঁদার।আজ সব বদলে গেলো।বুকটা ভারি হয়ে আসে রাফাতের।চোখ ভরে আসে তার।নিজেকে দোষী মনে হয়।কেন গেলো সে তার রেড চেরি কে ছেড়ে?কেন গেলো সে?
দূরে দাঁড়ানো জাবিন কে দেখতে পায় জান্নাহ্।তাকে দেখেই এগিয়ে আসে জাবিন।হালকা গলায় বললো-
“তুমি এখানে?
জান্নাহ্ নির্মল গলায় রাফাতকে দেখিয়ে বললো–
“উনি আমাদের স্যার।”
সরস হাসে জাবিন।রাফাতকে সালাম দেয়।মোলায়েম গলায় তার প্রত্যুত্তর করে রাফাত।কিন্তু জান্নাহ্ এর দিকে তাকিয়ে রাগাম্বিত গলায় বললো—
“তোমাকে না রিক্সা করে আসতে বলেছি।সারহান টাকা দিয়ে যায়নি?
জাবিনের কথায় বিরক্ত হয় জান্নাহ্।তপ্ত গলায় বলে উঠে–
“জাবিন!
জাবিন অনুতপ্তের সুরে বললো–
“সরি।”
কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেও তা সম্পর্কে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না রাফাত।শীতল গলায় বললো–
“ওকে।আমি যাচ্ছি তাহলে।”
রাফাত যেতেই কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে জাবিন—
“ওই স্যার তোমার সাথে আসলো কেন?
জান্নাহ্ অতি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়–
“স্যার হ্যায়ার ম্যাথের টিচার।কিন্তু পেশায় কী জানো?ডক্টর।”
মিটমিটিয়ে হাসে জান্নাহ্।ভ্রু নাচিয়ে জাবিন বললো–
“হাসার কী?সাইন্স নিয়ে পড়লে যদি হ্যায়ার ম্যাথ না পড়ে তাহলে পড়ার দরকারটা কী!
“আই সী।তুমি এখানে কেন?কোচিং নাই?
জাবিন নির্বিঘ্ন গলায় বললো–
“যাইনি।পড়ালেখা করে কী হবে?শেষে তো ওই নানাভাইয়ার আড়তে বসতে হবে।সারহানের মতো তো আর দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারবো না।”
দূর্বল হাতে এক চাটা মারে জাবিনের মাথায় জান্নাহ্।ভারি গলায় বললো–
“তুমি দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো জাবিন।মামার নাম ধরে কেন বলো তুমি?
জাবিন ফিচেল হেসে রসালো গলায় বললো–
“তাহলে তুমিও আমাকে আপনি করে বলো।আমি তো বয়সে তোমার থেকে বড় ই।”
“ইশশ!এসেছেন বুড়ো খোকা।ভাগো।”
খলখল করে হেসে ফেলে জাবিন।কথাবার্তায় প্রায় বাড়ির কাছে চলে আসে তারা।জাবিন জান্নাহ্কে একাই যেতে বলে।কারণ অন্তরা তাদের একসাথে দেখলে আবার ক্ষেপে যাবে।
বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই দৌঁড়ে আসে তিতি।উচ্ছলিত সে।জান্নাহ্ মাথা থেকে নেকাবটা খুলতেই ঝরা হাসে তিতি।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে টুপ করে চুমু খায় সে।অতি উৎসাহের সাথে বললো–
“পরীমা,এসো এসো।”
জান্নাহ্কে হাত ধরে ভেতরের দিকে নিয়ে আসে তিতি।তাকে দেখেই মুখ বাঁকায় অন্তরা।তার কঠিন চেহারা দেখে জান্নাহ্ এর উজ্জ্বল চেহারা মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়।একটা চিকন সুরে চোখ তুলে তাকায় জান্নাহ্।
“কেমন আছো জান্নাহ্?
ভ্রু জোড়া চড়িয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় জান্নাহ্ বললো–
“তুমি!
তুমি কখন এলে?
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো–
“এইতো একটু আগেই।”
জান্নাহ্ জড়িয়ে ধরে শক্ত করে মেয়েটিকে।প্রফুল্ল কন্ঠে বললো–
“অনেক ভালো হয়েছে তুমি এসেছো।এইবার খুব মজা হবে।”
“হুম।”
নিধি,সেরাজের ছোট বোন।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় হোস্টেল থেকে ফিরে এসেছে।এখন এখানেই থাকবে।সবাই খুশি হলেও জমির বেশি খুশি হতে পারলেন না।সারহানের সাথে নিধির বিয়ে দিতে চেয়েছিলো অন্তরা।কিন্তু সারহান রাজি হয়নি।অবশ্য এতে করে তাদের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসে নি।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সারা বিছানায় বই খাতা ছড়িয়ে বসে আছে জান্নাহ্।মাথাটা টনটন করছে।কিচ্ছু ঢুকছে না।রসায়নের যৌগমৌল পড়তে পড়তে ত্যানা ত্যানা জীবন।সাবানের যৌগ সংকেত,গ্লিসারিনের যৌগ সংকেত উফ!অসহ্যকর।রসহীন রসায়ন।এর চেয়ে পদার্থ ঢের ভালো।
গরমে উসখুস করছে জান্নাহ্ এর মস্তিষ্ক।ছড়ানো চুল টেনে উঁচু করে পনিটেল করে নেয়।গায়ের ওড়নাটা পাশে রেখে বিছানার উপর ঝুঁকে ইলেকট্রন বিন্যাসে মনোযোগ দেয়।চোখের সামনে যেনো হাইড্রোজেন,নাইট্রোজেন,ক্লোরিন ইত্যাদি হেঁটে হেঁটে চলছে।
“আহ্!
অস্ফুট আওয়াজ করে জান্নাহ্।কিলবিল করছে সবগুলো মাথার নিউরনে।কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না।বেজায় রাগ হচ্ছে জান্নাহ্ এর নিজের উপর।কেন যে সাইন্স নিয়ে পড়তে গেলো!অবশ্য সবটা তার বাবার ইচ্ছে পূরণের জন্য।রাফাত অবশ্য বলেছে ডক্টর বরের ডক্টর কনে প্রয়োজন।অন্যথা হলে চলবে না।ভাবতেই জান্নাহ্ এর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে অমসৃন হাসি।বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তার দু’চোখ।জান্নাহ্ ভাবে সত্যিই কী বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু ছিলো রাফাত আর তার মধ্যে?
“পরীমা,পরীমা,পরীমা।”
তিতির উচ্ছ্বাসিত গলার আওয়াজে সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।ঝুঁকে বসা থেকে উঠে বসে সে।তিতি দৌঁড়ে তটস্থ হয়ে বিছানায় উঠে।তিতির এমন ব্যস্ততায় জান্নাহ্ কিছু ভাবার সময়ই পায় না।তিতির চোখে মুখে খেলে যাচ্ছে অকৃত্তিম উচ্ছলতা।তার ছোট ছোট লম্বা পাঁপড়ি ওয়ালা চোখ দুটো হাসছে।দুই হাতে জান্নাহ্ এর গলা জড়িয়ে ধরে তার গালের সাথে মিশে থাকে।এই এক টুকরো সুখ যেনো জান্নাহ্ এর তপ্ত হৃদয়কে শীতল করার জন্য যথেষ্ট।প্রায় মিনিট খানেক জান্নাহ্ এর শরীরের উষ্ণতায় মিশে থাকে তিতি।তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় জান্নাহ্।শান্তি পায় সে।তার খালি খালি বুকটা যেনো এক পসলা সুখে ভরে উঠে।তিতির ছোঁয়ায় মাতৃত্বের স্বাদ পায় জান্নাহ্।মাঝে মাঝে তিতির কথায় সত্যিই জান্নাহ্ এর মা হতে ইচ্ছে হয়।একটা নরম মাংসপিন্ডকে নিজের জঠোরে ধারণ করার তীব্র বাসনা জন্মে।তাকে বুকে আগলে রাখতে ইচ্ছে হয়।ইচ্ছে হয় তার আর সারহানের অংশ নিয়ে আসতে ধরায়।
বিয়ের মাধ্যমে দুটি পরিবার,দুটি মানুষ একে অন্যের সত্তায় মেশে।কিন্তু তাদের এই সম্পর্কের ভীত শক্ত হয় যখন তাদের ভালোবাসার অস্তিত্ব তাদের ঘর আলো করে আসে।
তিতির দিকে গভীর আবেশে তাকায় জান্নাহ্।মাঝে মাঝে তার মন খারাপ হয়।কারণ তিতির বাম চোখের পাশের একটা কাটা দাগ।এমনটা জান্নাহ্ এর মায়ের ছিলো।তিতিকে দেখলেই জান্নাহ্ এর মায়ের কথা মনে পড়ে।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।হয়তো একেই ভয়ংকর নিয়তি বলে।
তিতির গালে জবরদস্ত একটা চুমু খেয়ে হেসে হেসে জিঙ্গেস করলো–
“আমার তিতিসোনার কী হয়েছে?
তিতি ফিক করে হেসে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো–
“তুমি পড়ছো পরীমা?আই এম ছরি।”
জান্নাহ্ তিতির নরম গাল দুটো টিপে বললো–
“আমার মিষ্টি মা।ছরি না সরি।”
তিতি দৃঢ়তার সুরে বললো–
“আচ্ছা।”
জান্নাহ্ জোর হাতে তিতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে বললো–
“কিছু বলবে আমার তিতি সোনা?
তিতি বারকয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো–
“হুম,হুম।”
“বলো।”
ফট করে উঠে দাঁড়ায় তিতি।জান্নাহ্ এর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললো।অনেক মজা নিয়ে হাসলো জান্নাহ্।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে গালে হাত দিয়ে কপট বিস্ময় নিয়ে বললো–
“ওমা তাই নাকি!
“হুম,হুম।”
তিতি আবারো মাথা ঝাঁকায়।বিগলিত হাসে জান্নাহ্।সরব গলায় বললো—
“আচ্ছা আমার মা।দাঁড়াও।”
লাফিয়ে উঠে তিতি।দুই হাতে তালি মেরে বলতে থাকে—-
“ইয়েএএএ।”
চোখে হাসে জান্নাহ্।ড্রয়ার থেকে একটা ওড়না নিয়ে বিছানায় বসে।নিজের ওড়না আর বাড়তি ওড়নাটা দিয়ে তিতিকে শাড়ির মতো পরিয়ে দেয়।তিতি বউ সাজতে চেয়েছিলো।তাই জান্নাহ্ হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দেয় তিতির ফিকে গোলাপি ঠোঁটে।একগাল হাসে তিতি।খুশি যেনো উপচে পড়ছে তার চোখে মুখে।কোনো মেয়ের জীবনে প্রথম শাড়ি পরা হয়তো এই ওড়নার সাহায্যেই হয়।কিন্তু জান্নাহ্ এর জীবনে এমনটা হয়নি।বিয়ের আগেও সে প্রথম বার তার প্রাণের জন্যই শাড়ি পরেছিলো তাও একদম ঠিকঠাক করে।জান্নাহ্ মিষ্টি গলায় বললো–
“একদম বউ বউ লাগছে আমার মিষ্টি পরীটাকে।”
“ইয়েএএএ।”
তিতির খুশিতেই যেনো জান্নাহ্ এর সারাদিনের ক্লান্তি মুছে গেল।মোবাইলে রিং বেজে উঠে জান্নাহ্ এর।সারহান ভিডিও কল করেছে।তা রিসিভ করেই তিতির কাছে দেয়।তিতি তার আধো আধো গলায় গদগদ হয়ে বললো–
“দেখো মামা,বউ।”
সারহান স্মিত হেসে বললো–
“বাব্বাহ!আমার তিতি সোনা বউ সেজেছে।”
“হু।”
“কেমন আছো তুমি?
তিতি জান্নাহ্ এর দেয়া চুড়িগুলো দেখিয়ে নাড়াতে নাড়াতে প্রত্যুক্তি করে বললো–
“ভালো।”
সারহান ঝরা হেসে প্রশ্ন করে–
“বউ সাজতে ভালো লাগে আমার তিতিসোনার?
তিতি বেখেয়ালিপনায় উত্তর দেয়–
“হা মামা।আমিও পরীমার মতো বউ হবো।”
একগাল হাসে সারহান,চার বছরের তিতির এই অদ্ভুত অভিলাষের কথা শুনে।তিতি তার হাত দুটো উঁচু করে হাতে পরা জান্নাহ্ এর চুড়িগুলো যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।হাত উঁচু করতেই তা কনুইয়ের উপরে চলে আসে।কৃত্রিমভাবে পরা শাড়ির আঁচল চিবুক দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে।তিতি আবারো গম্ভীর মুখে একরাশ অভিমান নিয়ে বললো—
“পরীমার চুড়ি ভালো না।”
সারহান চোখে হেসে বললো–
“তাই!
“হু।দেখোনা পড়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে কী আমার তিতিপাখির জন্য চুড়ি নিয়ে আসবো?
খলখলিয়ে হেসে উঠে তিতি।হাসফাস করে বললো–
“হা মামা।লিপততিকও আনবে।”
জান্নাহ্ মৃদু হেসে বললো–
“তিতি লিপস্টিক।”
তিতি দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে ফিক করে হেসে দেয়ে।সারহান স্মিত গলায় বললো–
“সব নিয়ে আসবো তিতি মামুনির জন্য।”
সারহান কল কেটে নাম্বারে ডায়াল করে।তিতি নিজেকে দেখায় ব্যস্ত।বিছানার উপর দুই পা আসন দিয়ে বসে কথা বলছে জান্নাহ্।তার কপাল আর গলায় ঘাম জমে আছে।তা তৃপ্তি নিয়ে দেখছে সারহান।কিন্তু তা সম্পর্কে অবগত নয় জান্নাহ্।ওপাশ থেকে কাটখোট্টা গলায় সারহান বললো—
“তিতিকে এইসব কে শিখিয়েছে!ওই ইউজলেস নিধি?
জান্নাহ্ শান্ত গলায় বললো–
“জানি না।আপনি নিধি আপুকে ইউজলেস বললেন কেন?আম্মা তো তার সাথেই আপনার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।”
“তো!
গাধি একটা।আর ওকে বিয়ে করলে আপনি হাত ছাড়া হয়ে যেতেন তো।”
“ইশ!
দুর্বোধ্য হাসে সারহান।কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো–
“এতো রাত হয়েছে জেগে আছেন কেন?
“পড়ছিলাম।যে টেস্টগুলো দিতে পারিনি তা এখন তো দিতে হবে।”
সারহান গাঢ় গলায় বললো–
“তাই বলে রাত জেগে থাকবেন!একদম না।ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে আপনার চোখে।”
জান্নাহ্ দুষ্টমির ছলে বললো–
“ইশ!মিথ্যুক।”
“আপনি বড্ড বেরসিক রজনীগন্ধা।”
জান্নাহ্ অভিমানী গলায় বললো–
“তাই বুঝি আমাকে ছেড়ে থাকতেই ভালো লাগে!
সারহান শীতল গলায় বললো–
“কে বললো আপনাকে ছাড়া ভালো আছি?
জান্নাহ্ অনুরক্তির সুরে বললো–
“তা নয়তো কী!
সারহান ফোঁস করে দম ফেললো।নরম গলায় বললো—
“বউ পালা কী এতো সোজা!টাকা ছাড়া তো আজকাল মা,বাবাও কেউ না।সেখানে বউ থাকবে কী করে?
জান্নাহ্ কপট অভিমান করে বললো–
“আমি কী আপনার কাছে কখনো টাকা চেয়েছি?
“আমি তো আপনার কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি।নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশি দিয়েছি সবসময়।”
“আপনার কী আমাকে লোভী মনে হয়?
“উঁহু।ফুল কী করে জানেন?সুবাস বিলায়।বিনা স্বার্থে।আপনিও তো আমার ফুল।আমার রজনীগন্ধা।”
জান্নাহ্ এর মনে বসন্তের শীতল হাওয়া বইতে থাকে।রজনীগন্ধা।হ্যাঁ,এই একটা শব্দ তার খুব পছন্দ।সারহানের মুখে রজনীগন্ধা শুনতেই জান্নাহ্ এর সকল বিষন্নতা,অবসাদ এক নিমিষেই উবে যায়।ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় সব কিছু ঝরঝরে হয়ে যায়।
মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর জন্য খুঁজতে থাকে শুভ্রা।কোথাও না পেয়ে জান্নাহ্ এর কাছে আসে।তিতির এই সাজ দেখে শুভ্রা হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো–
“এতো রাতে সাজতে ইচ্ছে হলো কেন আমার মামুনির?
তিতি চটপটে গলায় বললো–
“বউ।”
“আমার লক্ষীসোনা।”
তিতির চোখ যায় দরজার দিকে।সেরাজ কে দেখে অধৈর্য হয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলে পায়ের বেড়িতে ওড়না লেগে নিচে পড়ে যায়।জান্নাহ্ শশব্যস্ত হয়ে তিতিকে উঠায়।নিজের গায়ের ওড়নার কথা বেমালুম ভুলে যায়।আর সেই সুযোগে সেরাজ তার লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জান্নাহ্ এর দিকে।হতভম্ব হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় জান্নাহ্।শুভ্রা মেয়ের শরীর থেকে ওড়না খুলে জান্নাহ্কে দেয়।বিরক্তিকর গলায় প্রশ্ন করে সেরাজকে–
“তুমি এখানে কেন?
সেরাজ মিইয়ে গলায় বললো–
“তোমাকে খুঁজছিলাম…।”
শুভ্রা রেগে গিয়ে বললো—
“আমাকে খুঁজলে এখানেই আসতে হবে তোমার!
মেয়ের হাত ধরে টেনে নিতেই জান্নাহ্ বাঁধা দেয়।নরম গলায় বললো–
“তিতি আমার কাছেই আজ থাক আপু।”
শুভ্রা না করতে গেলেও জান্নাহ্ এর কথায় চকচক করে উঠে সেরাজের দুই চোখে।আনন্দে গদগদ হয়ে বললো–
“জান্নাহ্ ঠিক ই বলছে।তিতি আজ ওর কাছেই থাক।”
শুভ্রার মুখ জুড়ে বিরক্তি ছেয়ে যায়।সেরাজ কেন এমন চাইছে তা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।তাই নিজের ইচ্ছে না থাকলেও তিতিকে রেখে যায় জান্নাহ্ এর কাছে।
বই খাতা সব গুছিয়ে তিতিকে নিয়ে শুয়ে পড়ে জান্নাহ্।তিতি তার ছোট ছোট দুই হাতে কী যেনো গুনছে।আনমনেই বলে উঠে–
“পরীমা,কামড় দিলে ব্যথা পাওয়া যায় না?
ভ্রু কুঁচকায় জান্নাহ্।এইটা কেমন প্রশ্ন!জান্নাহ সরল গলায় বললো–
“কেন তিতি সোনা?
তিতি তার দুই হাত জান্নাহ্ এর দুই গালে চেপে ধরে মিষ্টি করে বললো–
“মামা তোমাকে কামড় দেয়?ব্যাথা?
জান্নাহ্ লজ্জিত হয়।বাচ্চাদের মস্তিষ্ক আসলেই ঝকঝকে আয়নার মতো।এরা যা দেখে তা সহজে ভোলে না।জান্নাহ্ এর বুকের কাছে সেই দাগ সেদিন দেখেছিলো।কিন্তু তিতি কী করে বুজলো তা কামড়ের দাগ!
জান্নাহ্ নরম গলায় বললো–
“এইসব বলতে নেই তিতি সোনা।কামড় দিবে কেন!মামা কী পঁচা!পঁচারা কামড় দেয়।”
তিতির দুই চোখ তার নিজের হাতে।চুড়ি গুলো ভীষন জালাচ্ছে।সেদিকে মনোযোগ দিয়েই বললো–
“তাহলে বাবা পঁচা।বাবা মামুনিকে কামড় দেয়।”
জিভ কাটে জান্নাহ।তার আশঙ্কাই ঠিক।তিতি এমন কিছু দেখেছে যা তার ছোটক মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।জান্নাহ্ আলগোছে তিতির হাতে নিজের ঠোঁট বসায়।মিষ্টি গলায় বললো–
“এই যে না ঘুমালে এইভাবে কামড় দেয়।ঘুমাও।”
খিলখিল করে হাসে তিতি।জান্নাহ্ আদুরে গলায় আবার বললো–
“আর কখনো এইসব বলবে না তিতি।এইসব পঁচা কথা।আমার তিতিসোনা কী পঁচা?
“না।”
“এখন ঘুমাও।”
তিতি দুই হাতে জড়িয়ে ধরে জান্নাহ্কে।তার নাক ঘষতে থাকে জান্নাহ্ এর গলার দিকটায়।জান্নাহ্ এর সুড়সুড়ি লাগে।কোমল গলায় বললো–
“এমন করছো কেন তিতি?
“গন্ধ।”
“কী?
“হুম।মা,মা গন্ধ।”
প্রাণখোলা হাসে জান্নাহ্।তিতিকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললো–
“ওরে আমার দুষ্ট।ঘুমাও।”
জান্নাহ্ সিদ্ধান্ত নেয় তিতিকে মাঝে মাঝে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করবে এতে করে শুভ্রা আর সেরাজ হয়তো নিজেদের জন্য একটু সময় বের করে নিতে পারবে।
,
,
,
চোখে রোদচশমা লাগিয়ে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।নিজের পাজেরো জীপের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বিরক্তি নিয়ে হাতের ঘড়িতে বারবার চোখ বুলাচ্ছে।প্রায় এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট কলোনিতে।ছোট ছোট আধপাকা দেয়ালের ঘর।একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে।হাঁটার রাস্তাও নড়বড়ে।ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইট,পাথর।একদম নিম্ন শ্রেণীর মানুষের বসবাস এখানে।ময়লা স্তুপ থেকে বিশ্রি গন্ধ এসে নাকে লাগছে ইহতিশামের।তবুও দৃঢ়চিত্তে অপেক্ষমান কারো জন্য।কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে তাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে।ইহতিশাম হাসে।তাতেই লজ্জায় কুটি কুটি হয় বাচ্চাগুলো।
যে ঘরটার সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে ইহতিশাম দাঁড়িয়ে আছে কয়েক মুহূর্ত পর সেখানে একটা ছেলে প্রবেশ করে।ইহতিশাম গাড়ি লক করে সেদিকে পা বাড়ায়।বাম হাতের তর্জনী দিয়ে কাঠের ভঙ্গুর দরজায় আঘাত করতে একটা ছেলে দরজা খুলে দাঁড়ায়।ইহতিশাম কে দেখেই দরজা লাগাতে গেলেই ইহতিশাম নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে একরকম জোর করেই ভেতরে ঢুকে পড়ে।ঘুনে ধরা দরজা,বেতের সিলিং থেকে ঝরঝর করে কিছু ঘুন পড়লো ইহতিশামে সাদা শার্টে।চোখ থেকে রোদচশমাটা খুলে পকেটে নেয়।একরাশ বিরক্তি নিয়ে শার্ট ঝাড়তে থাকে।হেয়ালি গলায় বললো—
“ইউজলেস ফেলো।এইটা কী করলি?
ছেলেটি থরথর করে কাঁপছে।চোখের নিচে কালি।সমস্ত মুখ জুড়ে অবসাদ।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।চুলগুলো উসকোখুসকো।ইহতিশাম ছেলেটির দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে সম্পূর্ণ ঘর পর্যবেক্ষণ করে।বসার মতো কিছুই পেলো না।ফোঁস করে এক দম ফেলে ইহতিশাম।তীক্ষ্ম গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে —
“একটা চেয়ারও নেই?
ছেলেটা এখনো কাঁপছে।ইহতিশাম এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত গলায় বললো–
“রিল্যাক্স ডুড,আই এম নট রয়েল বেঙ্গল টাইগার।”
ছেলেটির তার কাঁপা কাঁপা গলায় বললো—
“বিশ্বাআআস করুউউউন স্যার।আমি কিচ্ছুইই করিনি।”
ইহতিশাম বিগলিত হাসলো।ফুরফুরে গলায় বললো–
“আই নো।”
ছেলেটি দুম করে ইহতিশামের পায়ের কাছে পড়ে ঝমঝমিয়ে কাঁদতে লাগলো।ছিটকে সরে আসে ইহতিশাম।হতভম্ব গলায় বললো–
“আরে,আরে কুল ম্যান,কুল।চোখের চাহনিতে মানুষ চিনতে পারি আমি।আই নো,ইউ ডিড নট কিল দ্যাট গার্ল।বি ক্লাম।”
ছেলেটির দু’চোখে শীতল জল ঝরছে।ফোলা দুই চোখ জ্বালা শুরু করে।ইহতিশামকে চেনে সে।তাই ভেবেছে তাকে ধরতে এসেছে।ইহতিশাম নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেললো।ফিকে গলায় বললো—
“একটু বসতে দেরে ভাই।তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয় হয়ে গেলো।”
ইহতিশামের কথায় ছেলেটি একটু ধাতস্থ হয়ে চৌকির পাশে থাকা এক পায়া ফাটা জলচৌকি এনে দিলো।ইহতিশাম হালকা চাপ দিয়ে বসলো।ছেলেটি ইহতিশামের সামনে অপরাধি মুখ করে থম মেরে বসে রইলো।ইহতিশাম দুই হাতের আঙুল ভাঁজ করে ছোট্ট করে জিঙ্গেস করলো–
“নাম কী?
ছেলেটি চট করে বললো–
“জসিম।”
নাম বলে শ্বাস ফেললো জসিম।জসিমের চোখ দুটো দেখেই ইহতিশাম বুঝলো সারারাত নেশা করে এসেছে।জসিমের দিকে কিছুক্ষন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে—
“কোথায় ছিলি রাতে?
জসিম চোরা চোখে তাকায়।গলাটা কাঁপছে তার।চোখ দুটিও প্রস্ফুরিত হচ্ছে।দুই হাতের বেঁড়ে আটকে রেখেছে পা দুটো।তার উপর চিবুক দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে।ইহতিশামের প্রশ্নে মিনমিনে গলায় অনেকটা ভয় নিয়ে বললো-
“কাআআজে।”
ইহতিশাম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের মোবাইল হাতে নেয়।তাতে অক্ষি নিবদ্ধ করে বললো–
“কাজ টা কী?
জসিম বড় বড় কয়েকটা ঢোক গিললো।কিন্তু উত্তর দিলো না।ইহতিশাম স্বাভাবিক গলায় বললো—
“মিথ্যে বলিস না।তাহলে কিন্তু…।”
জসিম ঝপ করে এসে ইহতিশামের হাত চেপে ধরে অধৈর্য গলায় বললো–
“আমি খুন করি নি স্যার,আমি খুন করি নি।”
ইহতিশাম বিরক্তি নিয়ে বললো–
“বললাম তো করিস নি খুন তুই।এখন পুরো ঘটনা খুলে বল।একচুল ও মিথ্যে নয়।”
জসিম সরে বসলো।তার সামনে ভেসে উঠতে থাকলো সেই দুর্বিষহ দিনগুলো।স্থির হয় সে।নিষ্কম্প গলায় বলতে শুরু করে—
“সেদিন যখন আমি পিজ্জা ডেলিভারি করতে যাই তখন দরজা খুলে একজন পুরুষ।লোকটির চোখে চশমা,মাথায় ক্যাপ আর গায়ে কালো জ্যাকেট।বাংলোর বাইরে লাইট থাকা সত্ত্বেও তার চেহারা আমি ভালো করে বুঝতে পারি নি।কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছি,সে যখন পিজ্জা নিচ্ছিলো আমার কাছ থেকে তখন তার বৃদ্ধা আঙুল কাঁপছিলো।আমি তাকে জিঙ্গেসও করেছিলাম।অর্ডার কোনো আপুর ছিলো।লোকটি বললো সে ভেতরে আছে।আমি ভেতর থেকে একটা আওয়াজও শুনছিলাম।লোকটার দিকে তাকাতেই তিনি হাসলেন।বললেন,ঘরে পার্টি হবে আর আওয়াজটা ব্ল্যান্ডার মেশিনের।কিন্তু আমার কাছে অদ্ভুত লাগলো।”
ইহতিশাম ভ্রু নাচিয়ে বললো–
“কেন?
জসিম ভীত গলায় বললো–
“আমি ব্ল্যান্ডারের আওয়াজ চিনি।”
শীতল শ্বাস ফেললো ইহতিশাম।সরু গলায় বললো–
“তারপর?
জসিম ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো।ইহতিশাম শক্ত চোখে তাকাতেই কান্না গিলে বললো–
“সেদিন সেই অর্ডার পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিলো সাগরের।ওর মা অসুস্থ হওয়ায় ও ছুটি নিয়ে চলে যায়।তাই আমাকেই অর্ডার ডেলিভারি করতে যেতে হয়।কিন্তু পরদিন সকালে যখন পত্রিকায় খবর বের হয় আর পুলিশ জানতে পারে আমি পিজ্জা ডেলিভারি করেছি।আর তখন আমাকেই সন্দেহ করে।বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিছুই জানি না।”
আর কিছু বলতে পারলো না জসিম।অঝোরে কাঁদতে লাগলো।খুনি সন্দেহ করে জসিমকে তিন দিনের রিমান্ডে বেধড়ক মারে।কিন্তু পরে কোনো প্রমান না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়।পুলিশের খাতায় এন্ট্রি পাওয়ায় তার পার্ট টাইম জবটাও হাতছাড়া হয়।পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়।কোথাও কোনো কাজও পায় না।
ইহতিশাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।কথায় আছে,শ’খানের অপরাধি মুক্তি পেয়ে যাক কিন্তু একজন নিরঅপরাধি সাজা না পাক।ইহতিশাম উঠে দাঁড়ায়।নিরুদ্বেগ গলায় বললো–
“তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।”
জসিম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো–
“স্যার একটা কথা বলবো?
“হুম।”
জসিম সাহস নিয়ে চাপা কন্ঠে বললো—
“সেদিন আমি একটা মেয়েকেও সেখানে দেখেছিলাম।গায়ে টপস আর কালো জিন্স পরা।আমি ভেবেছি সেই হয়তো সামিরা ম্যাম।কিন্তু পত্রিকায় যখন তার ছবি দেখলাম তখন বুঝেছি সে অন্য কেউ ছিলো।লোকটি বলেছিলো ঘরে পার্টি।হয়তো তার কোন বান্ধবী হতে পারে।”
ইহতিশাম সন্দিগ্ধ গলায় বললো–
“পুলিশকে কেন এই কথা বলোনি?
“স্যার,এই কথা বললে আমাকে আরো ফাঁসিয়ে দিতো।আমি তো মেয়েটাকে একটুখানিই দেখেছি।দেখলে হয়তো মনে পড়বে।কিন্তু ওই মেয়ে যদি জানতে পারে এই কথা তাকে ধরার আগেই তাহলে তো…।”
ইহতিশাম মাথা ঝাঁকালো।গম্ভীর গলায় বললো–
“রাইট,ইউ আর ইন্টিলিজেন্ট।”
ইহতিশাম একটা কার্ড দেয় জসিমকে।আর একটা ঠিকানা।এখানে গিয়ে ইহতিশামের কথা বললে তার কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।আর লেখাপড়া আবার শুরু করতে বলে।ইহতিশাম চলে যেতেই হতাশ শ্বাস ফেলে জসিম।যদি আর কয়েকটা দিন আগে এই মানুষটা তার জীবনে আসতো তাহলে তার বাবা আজ বেঁচে থাকতো।
চলবে,,,