জান্নাহ্,পর্বঃ১৯,২০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১৯
সূর্য ঢলতে শুরু করেছে।তবুও ঝলমলে রোদ।খানিক আগেই বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে।বৃষ্টির ছটা মুছে যেতেই যেনো সূর্য হাসতে শুরু করেছে যদিও এখন তার গোমড়া মুখ করে বাড়ি ফেরার পালা।তবুও সে দীপ্ত,উজ্জ্বল।
ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে।তার সাথে শীতল জলের ছটা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।বৃষ্টিতে ভেজা বাড়ন হলেও তা উপভোগ তো করা যায়।জান্নাহ্ এর চোখের পাতা কাঁপছে মৃদুমন্দ বাতাসে।শিরশির করে শরীর।প্রকৃতি যেনো সতেজ হয়ে উঠেছে।মিইয়ে পড়া বড়ই গাছের পাতাটাও খিলে উঠেছে।তার সাথে জড়িয়ে থাকা লাউয়ের ডগা থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে।গ্রীল বেয়ে পড়া ফোটা ফোটা পানি নিয়ে ঠোঁটের উপর দেয় জান্নাহ্।
বাইরের ঘর থেকে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ আসতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।বিছানার উপর থেকে ওড়না নিয়ে তা মাথায় জড়িয়ে অগোছালো পায়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসে।কাউকে না দেখলেও অন্তরার রুম থেকে আসা কলকাকলি শুনতে পায় জান্নাহ্।ত্রস্ত পায়ে শাশুড়ির ঘরে গিয়ে আচম্বিত হয়।জমির বিছানায় শুইয়ে আছে।গায়ে কাঁদা মাখানো।চোখ দুটো বুজে আছে সে।অন্তরা সমানতালে কেঁদে চলছে।বাড়ির সবাই সেখানে এমনকি চার বছরের তিতিও।কিন্তু জান্নাহ্ এর বিস্ময় আকাশ ছোঁয় রাফাত কে দেখে।তবুও নিজেকে শক্ত রেখে ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে জান্নাহ্–
“কী হয়েছে বাবার?
কেউ কিছু বলার আগে মুখ খুলে রাফাত।শান্ত ও নির্বিকার গলায় বললো–
“প্রেশার বেড়েছে।তাই পড়ে গিয়েছিলো।”
জমির নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে।কোনো হেলদোল নেই।তার জামার কাঁদা পরিষ্কার করছে শুভ্রা।জান্নাহ্ ভীত গলায় বললো—
“তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলুন।”
রাফাত নিরুদ্বেগ গলায় বললো–
” আপাতত প্রয়োজন নেই।আই থিংক হি ইজ টেনশড।তাই এমনটা হয়েছে।আমি কয়েকটা ঔষধ লিখে দিচ্ছি নিয়ে আসুন।যদি প্রেশার না কমে একটা টেস্ট লিখে দিচ্ছি সেইটা না হয় করিয়ে নিবেন।আশাকরি খারাপ কিছু হবে না।”
জান্নাহ্ আশ্বস্ত হয়।কারণ রাফাত এইসব সম্পর্কে জানে।অন্তরাকে থামতে বলে রাফাত।কিন্তু সে কেঁদেই যাচ্ছে।তাই বাধ্য হয়ে শুভ্রা নিধিকে বললো অন্তরাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে।বাবার মাথায় হাত বুলাচ্ছে শুভ্রা।কোমল গলায় বললো–
“এখন কেমন লাগছে বাবা?
জমির কোনো কথা বললো না।কিছুক্ষন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে।রাফাত নরম গলায় বললো–
“তাকে রেস্ট করতে দিন।”
জমিরকে রেখে বাইরে আসে সবাই।রাফাত সরল গলায় সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো–
“আমি তাহলে আসি।”
শুভ্রা ব্যস্ত হয়ে বললো–
“তা কী কথা!তুমি আমাদের এতোবড় উপকার করলে।বসো চা খেয়ে যাও।”
রাফাত মৃদু আপত্তি করে বললো–
“তার দরকার হবে না আপু।মানুষই তো মানুষের উপকার করবে।আর একজন ডক্টর হয়ে তো কাউকে রাস্তায় ফেলে আসতে পারি।এতোটা কুহৃদ সম্পন্ন মানুষ তো নই।”
রাফাতের রাগি আর অভিমানি কথা জান্নাহ্ এর জন্য।গত কয়েকদিন ধরে রাফাতকে এড়িয়ে যাচ্ছে জান্নাহ্।ঘন্টা ধরে লাইব্রেরি বসে থাকার পরও জান্নাহ্ এর দেখা সে পায় না। শুভ্রা তাল মিলিয়ে মৃদু গলায় বললো–
“তা ঠিক।আজকাল স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে এক গ্লাস পানি দিতেও দ্বিধায় ভোগে।তুমি বুঝি ডাক্তার?
দুর্বোধ্য হাসে রাফাত।দুষ্টমিমিশ্রিত গলায় বললো–
“ডক্টর নই।হাতুড়ি ডক্টর বলতে পারেন।”
ঝরা হাসে শুভ্রা।রাফাতকে বসতে বলে জান্নাহকে চা আনতে বলে।জাবিন জানায় সেও রাফাতকে চেনে।জান্নাহ্ এর স্কুলের টিচার সে।জান্নাহ্ চা নিয়ে এসে দেখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে রাফাত।জান্নাহ্কে দেখেই সরব হয়।সেন্টার টেবিলে চা রাখে জান্নাহ্।কেউ আশেপাশে না থাকায় থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কেন এসেছো?
রহস্য হাসে রাফাত।মৃদু ছন্দ তুলে বললো–
“আবার ধোঁকা দিতে চাইছো?
তপ্ত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্–
“রাফাত!
যা শেষ তা আর কখনো শুরু হবে না।”
রাফাত মৃদু হেসে বিগলিত গলায় বললো–
“শেষ থেকেই না হয় শুরু হোক।”
পিরিচে রাখা বিস্কুটগুলো ডান হাতের মুঠো ভর্তি করে চায়ের কাপে পুরে দেয় রাফাত।চায়ের ছোঁয়ায় গলতে থাকে বিস্কুট।সেই দিকেই তাকিয়ে রাফাত বললো–
“দেখলে চা আর বিস্কুটের ভালোবাসা।একে অপরের মাঝে সমাহিত হয়ে গেলো।আমিও হয়েছি।”
রাফাত পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে কাপের পাশে রাখে।সেদিকে জ্বলন্ত চোখে জান্নাহ্ তাকাতেই উঠে দাঁড়ায় রাফাত।সামনের দিকে পা বাড়াতেই নিজের রুম থেকে চঞ্চল পায়ে এগিয়ে আসে নিধি।আমোদিত গলায় বললো-
“ডাক্তার সাহেব কী চলে যাচ্ছেন?
রাফাত মিষ্টি গলায় বললো–
“পেশেন্ট যেহেতু সুস্থ চলে তো যেতেই হবে।”
নিধি মৃদু কন্ঠে চাপা স্বরে বললো-
“ডাক্তার সাহেব কী শুধু প্রেশারের রোগীই দেখেন!
দুর্বোধ্য হাসে রাফাত।ফিচেল গলায় বললো—
“আপাতত সব রোগীকেই দেখি।এক্সপেরিয়েন্সের প্রয়োজন আছে তো তাই।”
রাফাতের কথার সলজ্জ হাসে নিধি।আদুরে গলায় বললো–
“তো আবার কবে আসবেন?
রাফাত বাঁকা চোখে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।রহস্যচ্ছলে বললো–
“পেশেন্ট পেলেই আসবো।চলি আজ।”
রাফাত যেতেই একশ প্রজাপতি উড়ে যায় নিধির মনের ঘরে।যেনো আঁধার কালো মেঘ সরে উঁকি দেয় মিষ্টি রোদের সূর্য।খরা হৃদয়ে এক পশলা বর্ষণ।সলজ্জ আঁখি দুটো অবনত করে গুনগুনিয়ে গান গাইতে থাকে নিধি।টেবিলে পড়ে থাকা চিরকুট তুলে নেয় জান্নাহ্।তাতে রাফাতের মোবাইল নাম্বার।ক্ষুব্দ হয় জান্নাহ্।মোবাইল নিয়ে ছাদে আসে।কল করতেই ওপাশের ব্যক্তির মোহনীয় কন্ঠ–
“কেমন আছো রেড চেরি?
জান্নাহ্ সংক্ষুব্দ গলায় বললো–
“এইসবের মানে কী রাফাত?কেন করছো এইসব?
রাফাত মৃদু হাসলো।তার হাসির আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পায় জান্নাহ্।তেঁতে উঠে সে।নিরুদ্বেগ গলায় রাফাত বললো–
“পেছনে তাকাও।”
কোনো কিছু না ভেবেই পেছনে তাকায় জান্নাহ্।জান্নাহ্দের বাড়ির পাশেই একটা পাঁচতলা দালান।মফস্বলে শহরে অনেক মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজ করতে আসে।অনেকে একা আসে তো অনেকে পরিবার নিয়ে।এইসব দালানে তারা ভাড়া থাকে।যদিও এই এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতেই মালিক স্বয়ং থাকে।
রাফাতকে দেখে নিঃশ্বাসের গতি বাড়তে থাকে জান্নাহ্ এর।রাফাতের হাসি হাসি মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে।দারাজ গলায় জান্নাহ্ বললো–
“তুমি!কী পাগলামি শুরু করলে?এখানে?
রাফাত শান্ত কিন্তু ভারি গলায় বললো–
“হুম।এই বাড়ির দোতলায় ভাড়া নিয়েছি।রোজ দেখা হবে এখন থেকে।”
জান্নাহ্ শক্ত গলায় বললো—
“ফিরে যাও রাফাত।”
রাফাত ঝরঝরে হাসলো।মেকি কঠোর গলায় বললো–
“আমার প্রশ্নের জবাব না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছি না।কেন ধোঁকা দিলে আমাকে তুমি?কেন সারহানকে বিয়ে করলে?এমনকি হলো তুমি আমাকে ভুলে গেলে?আমি ছাড়া তো অন্য কেউ ছিলো না তোমার জীবনে!সেখানে সারহান কী করে এলো?এই গ্রামে কী করে বিয়ে হলো তোমার?সব কিছুর উত্তর আমার চাই।”
ভারি নিঃশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।এই সকল প্রশ্নের কোনো উত্তর সে দিতে পারবে না।ফিচেল হাসে রাফাত।সরস গলায় বললো–
“মেয়েটা কে হয় তোমার?
জান্নাহ্ কয়েকটা ঢোক গিলে রাগি গলায় বললো–
“শুভ্রা আপুর ননদ।”
নরম গলায় রাফাত বললো–
“শী ইজ কিউট।সাবধানে রেখো।বাই রেডি চেরি।”
লাইন ডিসকানেক্ট করে রাফাত।ফিরতি ডায়াল করে জান্নাহ্।কিন্তু রিসিভ করলো না রাফাত।নেমে যায় সে ছাদ থেকে।আড়াল হয়ে যায় জান্নাহ্ এর দৃষ্টি থেকে।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।পশ্চিমাকাশের কমলা রঙে ছেয়ে যাওয়া আকাশ ধীরে ধীরে রক্তিমবর্ণ ধারণ করছে।আর একটু পরই মিলিয়ে যাবে সূর্য ধূসর আকাশে।জান্নাহ্ দিকভ্রষ্টের মতো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
,
,
,
হাতে থাকা রহমালাইয়ের বাটি থেকে একটু একটু করে শ্রুতির মুখে দিচ্ছে সারহান।আর তা সাদরে গ্রহন করছে শ্রুতি।তার নিরুত্তেজ চোখ দুটি বাটিতেই আবদ্ধ।শ্রুতি এখন অনেকটা স্বাভাবিক।কাউন্সিলিং চলছে তার।এনজিওতে আসার পর রাতে একদম ঘুমাতো না।বিকট চিৎকার দিয়ে উঠে সারারাত কান্নাকাটি করতো।বলতো,কেউ তাকে আঘাত করছে,ব্যাথা দিচ্ছে,কামড়ে দিচ্ছে।অবর্ণনীয় সেই দিনগুলোকে ভুলতে অনেক সময় লেখেছে শ্রুতির।এনজিওর কোনো পুরুষ সদস্যের সাথে কথা বলে না শ্রুতি,এমনকি হাজার কথা বললেও টু শব্দ করে না।পুরুষ জাতিটাকে হায়েনা মনে হয় তার কাছে।সারহানকে সমীহ করে সে।সারহান পাশে থাকলে স্বস্তি পায়।কোনো ধরনের ভয়,সংশয়,দ্বিধা থাকে না।এই একটা মানুষকে সে খুব বিশ্বাস করে।কিন্তু তবুও কথা বলে না সে সারহানের সাথে।শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
খাওয়ানোর ফাঁকে শ্রুতিকে ভালো করে অবলোকন করে সারহান।মেয়েটার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা।কিন্তু যখন এসেছিলো তখন তা চাপা পড়ে ছিলো ওই হিংস্র পশুদের নোংরা থাবায়।চোখের পাঁপড়িগুলো ফিকে হলেও বেশ লম্বা।একটা অদ্ভুত মায়া খেলে শ্রুতির চেহারায়।সারহান স্বশব্দে বললো–
“কেমন?
শ্রুতি সারহানের কথা শুনেই উদ্ভ্রান্তের মতো খপ করে চামচ মুখে পুরে নেয়।চোখ তুলে সারহানের দিকে তাকায়।কিন্তু কোনো শব্দ করে না।ঝরা হাসে সারহান।তিতির মতো আচরণ করে শ্রুতি।সারহান হাসতেই নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে।দেয়ালের সাথে মিশে বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সারহানের হাতে একটা বক্স।সেইটা এগিয়ে দেয় শ্রুতির দিকে।শ্রুতি কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সে ভীত।পেছনে দাঁড়ানো শ্রীজা ভ্রু কুঞ্চি করে ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো–
“কি হলো নাও।”
শ্রুতি আনম্র চাহনি উপরে তুলে।হাত দিয়ে নাক ঘষা দেয়।চোখে মুখে বিরক্ত করা উড়ন্ত চুল গুলো সরিয়ে আবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।শ্রীজা আবারো জোর গলায় কিছু বলতে গেলে তাকে হাতের ইশারায় থামতে বলে সারহান।শ্রুতির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় বললো–
“প্রিন্সেস ফ্রক।আমার তিতিরও অনেক পছন্দ।ওর জন্য কিনলাম।ভাবলাম তোমার জন্যও নেই।”
শ্রুতি কাঁপা কাঁপা হাত দুটো বাড়িয়ে বক্সটা নেয়।হালকা অধর প্রসারিত করে ম্লাণ হাসে।উঠে দাঁড়ায় সারহান।তার চোখ পড়ে জানালার পর্দায়।গমগমে গলায় ডেকে উঠে—
“তানিয়া,তানিয়া।”
তানিয়া রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়ে আসে।চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত করে কিছু বলতে গেলেই সারহান ক্ষীপ্ত গলায় বললো–
“পর্দাগুলো চেঞ্জ করোনি কেন?আর ঘরের এই অবস্থা কেন?এখানেও এসে যদি ওদের এই নোংরা পরিবেশে থাকতে হয় তাহলে তো ওই পতিতাপল্লীতে থাকাই ভালো।”
সারহানের ধমকে আঁতকে উঠে তানিয়া।মিনমিনে গলায় বললো–
“এখনি বদলে দিচ্ছি।”
“সব ঘর যেনো সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।নেক্সট টাইম যদি এইসব আমাকে বলতে হয় তা কিন্তু একদম ই ভালো হবে তোমার জন্য।”
তানিয়া কম্পিত গলায় বললো–
“জ্বীঈ স্যাসসসর।”
শ্রীজার ঘরে এসে বসে সারহান।বিক্ষিপ্ত তার দৃষ্টি।স্থির তার দেহপিঞ্জর।নরম করে বললো–
“শ্রুতি এখনো ওইসব ভুলতে পারেনি।”
আলগোছে সারহানের কাঁধে হাত রাখে শ্রীজা।ক্ষুব্দ দৃষ্টিতে তাকায় সারহান।সারহানের অগ্নি দৃষ্টিতেই তার শরীর থেকে হাত সরিয়ে নেয় শ্রীজা।সারহানের এই একটা অভ্যাস মনেপ্রাণে ঘৃণা করে শ্রীজা।এতোটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হওয়ার পরও তার গায়ে হাত ছোঁয়ানো যায় না।এ যেনো বিষাক্ত তীরের ফলা যা সারহানকে ক্ষত বিক্ষত করে।
পাশে দাঁড়িয়েই নির্মল গলায় শ্রীজা বললো–
“শ্রুতির বয়সটা খুব কম।তার উপর যে অবস্থা ওর হয়েছে এতো সহজে তার ভোলার নয়।”
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।গম্ভীর গলায় বললো–
“মেয়েরা আজও সেফ নয় আমাদের সমাজে।দুই মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে চল্লিশ বছরের নারী পর্যন্ত আজ ধর্ষনের স্বীকার হয়।কবে পাবে তারা যোগ্য সম্মান?
ফোঁস করে দম ফেলে শ্রীজা।বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সে।সারহানের এই অ্যাটিটিউটেই ফিদা সে।হঠাৎ কিছু একটা ভেবে থমথমে গলায় বললো–
“আজকাল তো দশ বছরের বাচ্চা মেয়েদেরও পনেরো বছরের কিশোরী তে তৈরি করে।তোমার মনে আছে গত বছর তুমি যে অার্টিক্যালটা করে ছিলো!খাগড়াছড়িতে একটা পাচারকারী ধরা পড়েছিলো।যারা মেয়েদের কৃত্রিম উপায়ে শারীরিক বৃদ্ধি ঘটায়।তারপর তাদের বাইরের কান্ট্রিতে পাচার করে দেয়।”
সারহান নিরবে মাথা ঝাঁকায়।সেইখানে সে নয় বছরের একটা মেয়েকে পেয়েছিলো।মেয়েটাকে বাঁচাতে পারেনি।তাকেও সেই মেডিসিন দেওয়া হয়।কিন্তু ওভারডোজ হওয়ায় মেয়েটা মারা যায়।ব্যস্ত হয়ে সারহান তার পকেট থেকে একটা টোকেন বের করে।শ্রীজা উৎসুক গলায় বললো–
“এইটা কোথায় পেলে?
স্মিত হাসে সারহান।বিগলিত গলায় বললো—
“কালেক্ট করলাম।”
“আর ইউ শিউর?
সারহান এক ভ্রু নাচিয়ে বললো–
“ডেম শিউর না হলেও অনেকটা।তবে লোক লাগিয়েছি।সত্যি হয় আব তো গ্যায়া মন্ত্রী সাহেব।”
বাঁকা হাসে সারহান।শ্রীজাও একটু নড়ে উঠে।সারহান তার পেশার বাইরেও অনেক ঝামেলার সাথে জড়ায়।এতেই তার ভীষন ভয়।কোনো বিপদ না হয়ে যায় সারহানের।
ম্নান হাসে শ্রীজা।সারহানের কানের কাছে গিয়ে চাপা কন্ঠে বললো—
“আজ কী আপনার একটু সময় হবে জাহাঁপনা,আমাকে দেওয়ার মতো?
সারহান উঠে দাঁড়ায়।শ্রীজার কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়।দুই হাতের বন্ধনে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে হিসহিসিয়ে বললো–
“জরুর রাণীসাহেবা।আজকে রাত আপকে নাম।”
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ২০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ঝকঝকে কাঁচ ভেদ করে ঝলমলে মিষ্টি হলুদ রোদ গলিয়ে পড়ছে রেস্তোরাঁর ভেতরে।এসি নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাইরের গুমোট তপ্ত আবহাওয়ার আঁচ বোঝা যাচ্ছে না।একটা কমলা রঙের থ্রি পিস পরেছে নিধি।হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বেশ চনমনে।হাসলো রাফাত।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে নিধি–
“ডাক্তার সাহেব হাসলেন যে?
“তেমন কিছু নয়।ইচ্ছে হলো।”
নিধি আলতো হেসে চাপা স্বরে বললো—
“অকারনে হাসলে তাকে পাগল বলা হয়।”
বিগলিত হাসে রাফাত।ঠান্ডা গলায় বললো–
“নো প্রবলেম।ডক্টর দেখিয়ে নিবো।”
ফিকে হাসে নিধি।রাফাত কিছুক্ষন থম মেরে বললো–
“কোন ডিপার্টমেন্টে?
নিধি কোনোরকম সংকোচ ছাড়াই বললো–
“বাংলা।”
স্মিত হাসে রাফাত।রসালো গলায় বললো–
“তাহলে তো সাহিত্যপ্রেমী মনে হয়।”
নিধি ঘোর আপত্তি করে বললো–
“মোটেও না।ভাইয়া বললো অন্য ডিপার্টমেন্টে আমাকে নেবে না তাই বাংলা।”
মুচকি হাসে রাফাত।স্বশব্দে বললো—
“মেয়েদের বুদ্ধি নাকি হাঁটুতে থাকে!
নিধি চটপটে গলায় বললো–
“আমার কোথাও নেই তাই।”
মৃদু ছন্দে হেসে উঠে দুজন।রাফাত নিধির মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য গলা খেঁকরি দিয়ে বললো–
“জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড এখানে আসে না?
রাফাতের মুখে জান্নাহ্ এর নামটা শুনে খানিক চমকালো নিধি।তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্লান গলায় বললো—
“আসে তো।যখন ইচ্ছে হয়।”
রাফাত আগ্রহী গলায় বললো—
“ঠিক বুঝলাম না।”
নিধি ঝরঝরে গলায় বললো–
“সারহান বরাবরই এমন।মাঝে মাঝে তো কয়েকমাস নিরুদ্দেশ থাকে।ইচ্ছে হলে আসে।দু একদিন থাকে আবার চলে যায়।ঘরের কেউ কিছু বললে তার সাথে কথা বলাতো বন্ধ করেই আর বাড়িতেও আসে না।তাই কেউ তেমন টু করে না।”
রাফাত নিরুদ্বেগ গলায় বললো–
“এখনো এমন?
কপট হাসে নিধি।গম্ভীরভাব ধরে বললো–
“হঠাৎ এইসব জিঙ্গেস করছেন?
রাহাত নড়ে উঠে।একটু ধাতস্থ হয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো–
“একচুয়েলী,জান্নাহ্ এর বয়স তো অনেক কম।আর এই বয়সেই বিয়ে..।”
নিধি রাফাতের কথা টেনে নিয়ে বললো–
“খালাম্মা সবসময় চেয়েছেন সারহান যেনো তার আশেপাশে থাকে।ছেলেকে ভীষণরকম ভালোবাসেন তিনি।তাই চেয়েছেন বিয়ে দিলে হয়তো ছেলে ঘরমুখী হবে।তাই কচি মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়েছেন।কিন্তু সারহান আগের মতোই।নিজের ইচ্ছের মালিক।আমার সাথেও তেমন কথা হয় না।ভার্সিটি বন্ধ থাকলে যখন আসতাম তখন মাঝে মাঝে দেখা হতো।কিন্তু কথা হতো না।”
রাফাত উৎকর্ণ হয়ে নিধির কথা শুনছে।কোনো পাল্টা প্রশ্ন করলো না।নিধি আবার বললো–
“কিন্তু সারহান আসলেই অদ্ভুত এক মানুষ।”
রাফাতের সরু ভ্রু জোড়া মুহূর্তেই কুঁচকে যায়।চিন্তিত গলায় বললো–
“কেন?
নিধি ছোট্ট দম নিয়ে বললো–
“সারহান কখনো বিয়ে করতে চায়নি।খালাম্মা একবার আমার সাথে বিয়ের কথা বলতেই ছয় মাস বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয় সারহান।কিন্তু…।”
রাফাত নিধির দিকে আরেকটু ঝুঁকে উদগ্রীব হয়ে কম্পিত গলায় বললো–
“কিন্তু কী?
“জান্নাহ্কে দেখেই বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিলো।মানছি জান্নাহ্ যথেষ্ট সুন্দরী।বাট এতোটাও না।”
রাফাত নাক মুখ কুঁচকে অস্বস্তি নিয়ে বললো–
“আমি আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।”
নিধি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো–
“সারহান অনেক বছর ধরেই শহরে থাকে।সেখানে হাজারো মেয়ের সাথে তার উঠাবসা।এমনকি নিজের ডিপার্টমেন্টেও জান্নাহ্ এর চেয়ে হাজারগুন ভালো মেয়ে থাকা সত্ত্বেও বিয়ের ঘোর বিরোধী সারহান জান্নাহ্কে প্রথম দেখায় কেন রাজী হলো!
রাফাত ভাবলো।তার ভাবাবেশ বুঝতে পারলো নিধি।সরু কপালটা হঠাৎই ভাঁজ হয়ে এলো রাফাতের।ফিক করে হেসে ফেলে রাফাত।ফিচেল গলায় বললো–
“আপনার হিংসে হচ্ছে।আই মিন আপনাকে রিজেক্ট করে অন্যকে বিয়ে করলো।”
নিধি প্রতিবাদ করে বললো–
“একদম না।সারহান আর আমার মাঝে কখনো তেমন কিছু ছিলো না।সারহানকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই।কিন্তু তার জন্য ফিদা হওয়ার মতো এমন কিছু আমি কখনো অনুভব করি নি।হয়তো তার সাহচার্য আমি তেমনটা পাই নি বলে।কিন্তু সারহানের মতো একজন পুরুষ জান্নাহ্ এর মতো একটা বাচ্চা মেয়ে তার উপর গরীব,এতিম মেয়েকে কেন বিয়ে করলো!বিষয়টা আমাকে ভাবায়।শুধুই জান্নাহ্ এর রূপ?
রাফাতের দমবন্ধ হয়ে আসছে।তবুও সে শুনতে চায়।বুকের ভেতরটায় জান্নাহ্ নামের ঝড়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।নিজের অনুভূতি বস্তা চাপা দিয়ে সরস গলায় বললো–
“এখানে অবাক হওয়ার কী?হয়তো সারহানের পছন্দ হয়েছে তাই।”
নিধি জোর গলায় বললো–
“আমিও তাই ই জানতে চাই।জান্নাহ্ কী আসলেই এতোটাই সুন্দরী যে তার রূপের সামনে সারহানের সমস্ত ব্যক্তিত্ব ধ্বসে গেলো!বিয়ে বিরোধী পুরুষ বিয়ের পর বৌয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলো!খালাম্মাও কম না।জান্নাহ্ এর মামার কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা যৌতুক নিয়েছে।অবশ্য সারহান তা জানে না।ভাইয়া আমাকে বলেছে।”
রাফাত অস্থির হয়ে উঠে।জান্নাহ্ এর মামা!তার মানে এই বিয়ের পেছনে জান্নাহ্ এর মামার হাত আছে।রাফাত অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করে–
“কোথায় থাকে জান্নাহ্ এর মামা?
“তাতো জানি না।কখনো জানা হয়নি।তবে জান্নাহ্ মেয়েটাও অদ্ভুত।এই যে আমার সাথে সারহানের বিয়ের কথা শুনেও কোনো ধরনের ভাবান্তর নেই তার।অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।এই ছোট বয়সেই কতো ম্যাচিউর।কথাবার্তা,চালচলনে কে বলবে ষোড়শী সে!সবাইকে আগলে রাখে।বাড়ির সবাই তাকে পছন্দ করে।শুধু খালাম্মা মাঝে মাঝে চটে যায়।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও জান্নাহ্ এর ব্যবহারে দাম্ভিকতার ছোঁয়া,তার ব্যবহার প্রাচুর্যময়।সব মিলিয়ে বলা যায় একটা পুতুল।যাকে কেউ নিজ হাতে সমস্ত গুন দিয়ে তৈরি করেছে।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে রাফাত।ভাবে,তার মানে জান্নাহ্ এর আসল পরিচয় কেউ জানে না!দাম্ভিক তো হবেই।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে জান্নাহ্।কোটি টাকার সম্পত্তির একমাত্র সম্রাজ্ঞী সে।আর হ্যাঁ,পারফেক্ট তো সে হওয়ারই ছিলো।জান্নাহ্ এর বাবা ছোটবেলা থেকেই তাকে সেভাবে গড়ে তুলেছে।নিজ হাতে গড়েছেন তিনি তার মেয়েকে।সাথে রাফাতও ছিলো।জান্নাহ্ এর বাবা আদর করে জান্নাহ্কে শ্বেত পাথরের বারবি ডল বলতো।শী ইজ গট গিফ্টেড।বিয়ের দশ বছর পর জান্নাহ্ এ জন্ম হয়।তাই তার বাবাও তাকে রাজকুমারীর মতো করে রেখেছিলো।কিন্তু এমন কী হলো জান্নাহ্ এমন একটা পরিবারে বউ হয়ে এলো!
,
,
,
মলিন মুখে বসে আছে তিল।ম্যাথ ক্লাসে আজ বীজগনিত করিয়েছে।কিন্তু তার মাথায় কিছুই ঢুকেনি।তার ভাবনার রাজ্যের রাজা আজ কয়েকদিন ধরেই তাকে তাচ্ছিল্য করছে।শীতল নিঃশ্বাস ফেললো তিল।তাকে দুর্বল হাতে ধাক্কা মেরে সরব গলায় জান্নাহ্ বললো-
“মুখটা এমন চিরতার মতো করে রেখেছিস কেন?
তিল গলিত বরফের মতো শীতল গলায় বললো—
“আমার জীবন হইলো বৃথা,বলেছে সে মিছা,এখন আমি কইবো আর কী কথা!
কপাল ভাঁজ করে ভেঙচি কাটে জান্নাহ্।সিক্ত গলায় বললো–
“কী হয়েছে বলতো?
তিল দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বললো—
“আর বলিস না।ওই আমার হবু রসিকনাগর গেলো আমায় ছাড়িয়া।”
জান্নাহ্ চোখ,মুখ খিঁচে বিতৃষ্ণা গলায় বললো–
“দুত,কী আবোলতাবোল শুরু করলি।ঠিক করে বল কী হয়েছে?
তিল এইবার মুখটা পাংশুটে করে বললো–
“স্যার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।”
জান্নাহ্ সন্দিগ্ধ গলায় বললো–
“কোন স্যার?
তিল জ্বলে উঠে বললো—
“আরে ধের,হ্যায়ার ম্যাথ স্যার।”
জান্নাহ্ এক পলকেই অবাক হয়ে বললো–
“রাফাত চলে গেছে?
তিল ঠোঁট গুঁজ করে চোখ পিটপিট করে তাকায়।কপট গোয়েন্দা সুরে বললো–
“তুই স্যারকে নাম ধরে বললি কেন?
জান্নাহ্ থতমত খেয়ে বললো—
“না,মানে।হঠাৎ বেরিয়ে এলো।”
তিল কোমল গলায় অভিমান করে বলতে লাগলো—
“এইভাবে ধোঁকা দেওয়া কী ঠিক হলো।কালই ফেসিয়াল করিয়েছি।দেখ ভ্রু প্লাগও করিয়েছি।চুলগুলোও টাইটানিকের নায়িকার মতো করে রোজ কাট দিয়েছি।ভাবলাম এবাই ডাল গলবে।কিন্তু তার আগেই পাখি ফুড়ুৎ।”
জান্নাহ্ চুপ করে শুনছে।গম্ভীর সে ভাবনা।এক আকাশ কষ্ট নিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠে তিল–
“দেখবি ওই রাফাত না তফাৎ,ওর কোনোদিন বিয়েই হবে না।সারাজীবন কুমার থাকবে।শুধু অন্যের বউয়ের দিকে তাকিয়েই জীবন পার করবে।ও তো জানে না,মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান।”
মেকি আওয়াজ তুলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে তিল।জান্নাহ্ এর বুক জুড়ে ভারি পাথর চাপা পড়ে।নাহ,এভাবেই আর নয়।তাকে কিছু করতে হবে।ইশাকের সাথে কথা বলতে হবে।ইশাক যেনো যে করেই হোক রাফাতকে এখান থেকে নিয়ে যায়।
চলবে,,,