জান্নাহ্,পর্বঃ২১,২২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ২১
ইহতিশাম বসে আছে তার ক্যাবিনে।সামনে থাকা ল্যাপটপে একটা ইমেল আসার কথা।টেবিলের উপর ফ্লাওয়ার ভাসে রাখা গোলাপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে সে।রেড রোজ তার পছন্দ না।কিন্তু কেউ একজন আছে যার রেড রোজ দুর্বলতা আর সে ইহতিশামের।সেই মায়াবী মুখটাকে দেখে না হাজার দিবস পার হয়েছে।কিন্তু ইহতিশামের মনে হচ্ছে যেনো হাত বাড়ালেই তার রেশম কালো চুলে হাত গলাতে পারবে।ছুঁয়ে দিতে পারবে তার কমলার কোষার মতো ওষ্ঠাধর।চোখের সেই কাজল দিয়ে টিকা পড়িয়ে দিবে তার কানে।মৃদু হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলবে–
“নজর না লাগে যেনো চাঁন্দেরও গায়।”
ইহতিশামের ব্ল্যাক রোজ আর হোয়াইট রোজ পছন্দ।ইহতিশাম মানব জীবনকে সাদা আর কালো রঙের সাথে তুলনা করে।ভালো তো সাদা আর খারাপ তো কালো।মানুষ তার পুরো জীবনে সাদাটাকেই চায়।কিন্তু তারা জানে না কালো আছে বলেই সাদা এতো প্রিয়।আঁধার আছে বলেই আলোর এতো মূল্য।দুঃখ আছে বলেই সুখের স্বর্ণকাঠি পেতে চায় সবাই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইহতিশাম।স্বগতোক্তি করে বললো,,”আদৌ কী সারহান সেই কালো দিনের কথা ভুলতে পেরেছে।”নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে সাদায় পরিণত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছে ইহতিশাম।কিন্তু সেই সুযোগ আর সারহান দেয় নি।ইহতিশাম জানে না এই জন্মে সে সত্যিই সারহানের সেই কালো অতীত কে সাদা তে রূপান্তর করতে পারবে কিনা!
নিজের ভাবনার অবসান ঘটায় সে।চোখে হাসে ইহতিশাম।প্রিয়তমাকে মনে করে ব্যথাতুর হয় তার মন।সামান্য ভুল বোঝাবুঝি জীবনের সবচেয়ে বড় মর্মান্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।তাতে মৃত্যু তো ঘটে না কিন্তু যন্ত্রণা হয় তারচেয়েও বেশী।
দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বসে ইহতিশাম।কাঙ্ক্ষিত বার্তা পেয়ে গেছে।ইমেলটা প্রিন্ট আউট করে ইহতিশাম।সামিরার মোবাইল পাওয়া যায় নি।কিন্তু তার নাম্বার থেকে সকল ইনকামিং এবং আউটগোয়িং নাম্বারের লিস্ট পুলিশরাই বের করেছে।কিন্তু তাতে সাসপেশিয়াশ কিছু পায় নি।ইহতিশাম সামিরার এফ বি অ্যাকাউন্টের তেমন কিছু পায় নি।কিন্ত ইহতিশাম খুঁজছে অন্য কিছু।সামিরার মোবাইলে বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা নাম্বার থেকে কল এসেছে।কিন্তু তা ঢাকার নয়।বাইরের কোনো গ্রামের।পুলিশ গিয়েছিলো সেখানে।কিন্তু তেমন কিছুই করে উঠতে পারে নি।কারণ নাম্বারগুলো একটাও এক্টিভ ছিলো না।কিন্তু পুলিশ একটা জিনিস মিস করেছে।আর সেটাই ইহতিশাম করবে এইবার।হয়তো নাম্বারধারী ব্যক্তি এই খুনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িত।আবার তার ধারণা ভুলও হতে পারে।প্রিন্ট আউট করা কপিটি সযত্নে রাখে ইহতিশাম।ধীরপায়ে ক্যাবিনের পূর্ব পাশে যায় সে।তার জরুরি সব ফাইল সেখানে সারিবদ্ধ।ফাইলের তাক থেকে একটা ফাইল নিয়ে তার ভেতর থেকে একটা কয়েকমাস পুরোনো খবরের কাগজ বের করে।চকিতে জানালার দিকে তাকায় ইহতিশাম।দক্ষিনমুখী জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস ঢুকছে।পটপট করে উড়ছে শুভ্র পর্দা।ইহতিশাম নরম পায়ে জানালার পাশে গিয়ে ঠেস মেরে দাঁড়ায়।পর্দাটা হাত দিয়ে গুঁজে একপাশ করে দেয়।ফট করে বাইরের ঝলমলে আলো ক্যাবিনে প্রবেশ করে।ইহতিশাম চোখ বুজে নেয় আলোর অতর্কিত হামলায়।আবার ধীরেসুস্থে চোখের পাল্লা খুলে বাইরে তাকায়।আজকের বিকেল টা অদ্ভুত রকম সুন্দর।রোদের তাপটা আজ ম্রিয়মান।সূর্য যেনো আজ তার ক্রোধিত রূপ পাল্টে মিষ্টি হেসে দিনকে ধারণ করেছে তার বুকের মাঝে।চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় ইহতিশাম।কয়েকটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি।একটা ঠান্ডা বাতাস এসে চোখে লাগে ইহতিশামের।বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় ইহতিশাম।এই মিষ্টি বিকেলে তার প্রিয়তমা পাশে থাকলে বিকেলটা আরো মোহনীয় হয়ে উঠতো।মিচকি হাসে ইহতিশাম।কেসটা সলভ হলেই সে ফিরে যাবে তার সেই প্রিয় মানুষটির কাছে।
পর্দাটা ঠিক করে ভেতরে এসে বসে ইহতিশাম।পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে আশ্চর্য হলো না সে।তিথির খুনটাও একই পদ্ধতিতে।তবে একটা অমিল।তিথির শরীরটা মৃত অবস্থায় কাটা হলেও সামিরার দেহে তখনো প্রাণ ছিলো।কাটা দিয়ে উঠে ইহতিশামের শরীর।মানুষ আজকাল কতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে।কিন্তু ইহতিশামের মনে একটা প্রশ্ন জাগে,”দুটো খুন ই একই উদ্দেশ্য করা নাকি দুটো খুনের খুনি একজন?
,
,
,
কয়েকটা কষে চড় বসিয়ে দিলেন অন্তরা জান্নাহ্ এর ফর্সা টলটলে গালে।কিঞ্চিৎ অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সে।পাশে দাঁড়ানো জাবিন ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে উঠে–
“আরেকবার জান্নাহ্ এর গায়ে হাত দিবে না নানুমা।ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
অন্তরা খেটখেটে গলায় বললেন–
“যা এহান তে।বড়গো মুখে মুখে তর্ক।তোরে না কইছি এইসবে তুই নাক গলাবি না।এই মাইয়ারে আমি আইজই বিদায় করমু।রাখমু না ওরে।”
আওয়াজ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।ফোলা গালে হাত দিয়ে অানম্র গলায় বললো—
“আম্মা,আপনি ভুল বুঝছেন।স্যার শুধু বাবার কথা জিঙ্গেস করেছে..।”
অন্তরা দাঁতখামটি মেরে উঠলেন।জান্নাহ্কে বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন–
“একদম মিছা কথা কবি না।এই কথায় এতো হাসার কী আছে!রাস্তায় খাড়াইয়া পরপুরুষের লগে এতো রঙ ঢঙ কেন?
জাবিন প্রদৃপ্ত গলায় বলে উঠে–
“জান্নাহ্ ঠিকই বলছে।স্যার নানাভাইয়ার কথাই জিঙ্গেস করেছে।”
অন্তরা খেকরি দিয়ে উঠে দারাজ গলায় বললেন–
“তুই যা এইহান তে জাবিন।”
জান্নাহ্কে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলো অন্তরা।জমির কিছুতেই থামাতে পারছিলেন না।দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে ফোঁস ফোঁস করছে জাবিন।শরীরের শিরা যেনো ফেটে যাচ্ছে রাগে।কম্পন শুরু হয়েছে তার দেহে।হাত দিয়ে চিবুক আর ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে তীব্র ক্ষোভের সাথে।বিছানার কার্নিশে চোখ পড়তেই জমিরের মোবাইল দেখতে পায় জাবিন।অতি সন্তর্পনে তা নিয়ে সারহানের নাম্বারে ডায়াল করে সে।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই তা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে গটগট করে রুম থেকে বের হয় জাবিন।
ক্ষুব্দ গলায় সেরাজকে শাসিয়ে যাচ্ছে শুভ্রা।রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাফাতের সাথে কথা বলার সময় সেই ছবি তুলে অন্তরার কানে বিষ ঢালে সেরাজ।গমগমে গলায় শুভ্রা বললো–
“পাগল হয়েছো তুমি?এইসব কেন করলে?সারহান যদি জানে তোমার জন্য মা জান্নাহ্ এর গায়ে হাত তুলেছে তাহলে তোমার কী অবস্থা করবে জানো!
সেরাজ দরজার অভিমুখে মুখ করে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।শুভ্রার কোনো কথায় তার ভাবাবেশ হলো না।শুভ্রা আবারো রাগাম্বিত গলায় বললো–
“কথা বলছো না কেন?
সেরাজ শান্ত গলায় বললো–
“মিথ্যে কিছু বলিনি।”
শুভ্রা তেড়ে এসে বললো–
“সত্য মিথ্যার ফারাক তোমাকে করতে হবে না।সারহান জানলে কী হবে ভেবে দেখছো।দুধ থেকে যেমন মাছি উঠিয়ে ফেলে দেয় ঠিক সেইভাবে ফেলে দিবে তোমাকে।আর তুমি ভালো করেই জানো সারহান তা করার ক্ষমতা রাখে।”
সেরাজ দমদমে গলায় বললো–
“ভয় দেখাচ্ছো?
“নাহ,সতর্ক করছি তোমাকে।আর তুমি কী ভেবেছো!রাফাত তোমার ওই বোনকে বিয়ে করবে!রাফাত একজন ভবিতব্য ডাক্তার।কতো উচ্চ বংশ।আর তোমার বোন!
সেরাজ হিনহিনে গলায় বললো—
“বাজে কথা বলবে না।আমিও কম করিনি এই পরিবারের জন্য।এমনি এমনি তো আর তোমার বাবা আমাকে এই বাড়ির জামাই করেনি।”
শুভ্রা চাপা কন্ঠে বললো–
“সময় থাকতে সাবধান।তোমাকে এইসব ঝামেলায় জড়াতে হবে না।সারহান ক্ষেপা নেকড়ে।ওর রাগ সম্পর্কে তুমি যা জানো তা অনেক কম।নিজের আত্নসম্মানে লাগবে এমন কিছু কোনোদিনও ও সহ্য করবে না।সব গুঁড়িয়ে দিবে।
হাতি মরলেও লাখ টাকা বাঁচলেও লাখ টাকা।”
সেরাজ উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।শুভ্রার কোনো কথাই তার মস্তিষ্ক আলোড়িত করতে পারলো না।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ২২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
উগ্রমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে সারহান।ঘরের সমস্ত জিনিস এলোমেলো।তার অরুনলোচন আঁখি দিয়ে অগ্নি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।মস্তিষ্কের দুই পাশের রগ ফুলে আছে।গলার রগগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর চোখে।অধর ছড়িয়ে শ্বাস নেয় সারহান।তার প্রতিটি ঢোক গেলার সাথে সাথে শ্বাসনালি অর্ধেক দেবে যায় ভেতরে।বামহাতের তালুর মাঝ বরাবর চিরে সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।সেদিকে বিন্দুমাত্র ভাবাবেশ নেই সারহানের।তার হিংস্র দুই চোখ নিবদ্ধ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা অন্তরার দিকে।
অন্তরা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ক্ষীন শ্বাস ফেলছে নৈঃশব্দে।নিজের অজান্তে পদযুগল কম্পিত হচ্ছে তার।ভীতসন্ত্রস্ত তিনি।সারহান দুই কদম সামনে এসে ক্ষুব্দ গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললো—
“আপনার সাহস কী করে হলো জান্নাহ্ এর গায়ে হাত দেওয়ার?
অন্তরা থরথরিয়ে উঠে।তার গা গুলিয়ে আসছে ভয়ে।বড় বড় ঢোক গিলে নিচ্ছে সে।সারহানের গলার আওয়াজেই হাপরের মতো উঠানামা করছে তার বুক।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।শুকনো গলায় ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে তার।মুখ থেকে একদলা থুথু জমিয়ে তা আবার গিলে নেয়।
সারহান ধমকে উঠে।সংক্ষোভিত গলায় বললো–
“আমি আপনাকে আগেও বলেছি,জান্নাহ্ এর গায়ে হাত দিবেন না।আপনি বারবার আমাকে বাধ্য কেন করেন?
সারহানের হিংস্রতায় কেঁপে উঠে অন্তরা।তার তাতানো কন্ঠ নেতিয়ে যায়।মিনমিনে গলায় বললো–
“আমার কথা শোন বাপ।ওই মাইয়া…।”
সারহান হাতের সাহায্যে তাকে থামতে বলে।নাক ফুলিয়ে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে ঠোঁট কামড়ে ধরে।কড়া গলায় বললো—
“এই বাড়ির ছেলের ট্যাগ আমার গায়ে আছে বলে আমি আপনাকে এখনো মা বলে ডাকি।জান্নাহ্ আপনাকে আম্মা বলে ডাকে বলে আমি আজ পর্যন্ত তার গায়ে করা কোনো আঘাত আপনাকে ফিরিয়ে দেই নি।”
সারহান সেন্টার টেবিলে থাকা পাতলা কাঁচের শো পিসের উপর চাপড় মারে।ক্ষত জায়গায় আঘাত লাগতেই সেখান থেকে গলগলিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।অন্তরা শশব্যস্ত হয়ে দৌঁড়ে এসে সারহান হাত ধরে উদ্বেলিত গলায় বললো–
“এইটা কী করতাছোস বাপ আমার!তোর রক্তসব তো বাইর হইয়া যাইতাছে।”
এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয় সারহান।দমদমে গলায় বললো–
“একদম ছোঁবেন না আপনি আমাকে।আপনাকে আমি..।”
নিজের অশান্ত রাগ দমন করতে কর্ণার শো কেসে এক লাথি মারে সারহান।ঝনঝন করে তা ভেঙে পড়ে।জমির,শুভ্রা বাকি সবাই থাকলেও নেই জান্নাহ্।তাকে ঘরবন্দি করে এসেছে সারহান।কেউ কিছু বললো না।ভয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।এখন সারহানকে কিছু বললেই বিপদ।এই বাড়ির মুখী হবে না সে আর কখনো।কিন্তু অন্তরা নিজের ছেলেকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না।সারহানকে মাথায় করে রেখে বড় করেছে অন্তরা।জেদটা সারহানের ছোট কাল থেকেই বেশি।কিন্তু বিগত কয়েক বছরে তা তিক্ততায় ভরে উঠেছে যার দরুন অন্তরার সাথে সারহানের সম্পর্ক নড়বড়ে।কিন্তু তার কারণ আজও উদঘাটন করতে পারেনি অন্তরা।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললো সারহান—
“আমার রক্ত দেখলে কষ্ট হয় আপনার!ওই মেয়েও কারো সন্তান।”
অন্তরা ক্রন্দনরত গলায় বললো–
“বিশ্বাস কর বাপ।আমি তোর ভালা চাই।ওই মাইয়া রাস্তায়…।”
অন্তরার কথা টেনে নিয়ে সারহান বললো–.
“আমার স্ত্রীকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।আর যাই করুক আপনাদের মতো ধোঁকা সে আমাকে দিবে না।
আমি কালই তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।আজকের পর যদি আর কোনোদিন আপনি জান্নাহ্ এর গায়ে হাত তোলার দুঃসাহস করেন তাহলে সারাজীবনের জন্য ভাববেন আপনার কোনো ছেলেই ছিলো না।”
আঁতকে উঠে মুখে হাত দেয় অন্তরা।আর্দ্র গলায় বলে উঠলেন–
“এমন কথা কইস না বাপ।মায়ের মনে কষ্ট দিস না।তুই তো আমার সাত রাজার ধন।আমার আঁধার ঘরের মানিক।”
আওয়াজ করে হেসে উঠে সারহান।তার সেই হাসিতে বিদ্রুপ।উপহাসমিশ্রিত গলায় বললো—
“ঠিক বলেছেন।আমি সত্যিই আপনার সাত রাজার ধন।তাই না বাবা?
জমির ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।অন্তরার বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছে।তার ছেলেটা এমন কেন হয়ে গেলো?
,
,
,
বিছানায় বসে আছে জান্নাহ্।তার সামনে আসন পেতে বসেছে সারহান।সারহানের দুই চোখ অনুতপ্ত।জান্নাহ্ স্থির,নত,শান্ত।নৈঃশব্দ চারপাশ।জান্নাহ্ এর নিঃশ্বাস শুনতে পারছে সারহান।প্রতিটি নিঃশ্বাস যেনো সারহানকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে তীব্র অপরাধে।জান্নাহ্কে অভিমানী বলা চলে না।মেয়েটা অভিমান করতেই জানে না।কাঁদতে জানে শুধু।কিন্তু সে কান্নায়ও কেমন জড়তা।প্রানখুলে কাঁদতেও যেনো ভয় পায় জান্নাহ্।সারহান যখন থেকে জান্নাহ্কে দেখছে অবাক নয় সে চরম অবাক হয়।এমনও মানুষ হয়!মেয়েরা তো একটু পান থেকে চুন খসলেই অভিযোগের থালা নিয়ে বসে।কিন্তু জান্নাহ্ তার আশেপাশেও নেই।মাঝে মাঝে সারহানের মনে হয় সে মেয়ে মানুষ নয় কোনো ভিন্ন গ্রহের প্রাণিকে বিয়ে করেছে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে সারহান।মোলায়েম গলায় বললো–
“মায়ের হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।ক্ষমা করবেন আমাকে?
ঝট করেই সারহানকে হতভম্ব করে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জান্নাহ্।ঝুমঝুমিয়ে বর্ষণ শুরু হয় তার জলপুকুরে।ধরা গলায় বললো–
“বিশ্বাস করুন সারহান আমি…।”
জান্নাহ্কে দুই হাত দিয়ে নিজের সাথ পিষে ধরে সারহান।আবেগী গলায় বললো—
“কিছু বলতে হবে না আপনাকে।আমি নিজের চেয়েও বেশি আপনাকে বিশ্বাস করি।আমি জানি আমার নিঃশ্বাস আমাকে ধোঁকা দিলেও আপনি আমাকে ধোঁকা দিবেন না।”
ফুঁফাতে থাকে জান্নাহ্ সারহানের বুকের মধ্যে।ফ্যান চলছে তীব্র গতিতে।তার শো শো আওয়াজ কানে বিঁধছে।চাঁদ মধ্য গগনে এখনো পদার্পণ করেনি।জানালা দিয়ে আচমকা ভেসে আসে ঝিঁঝিঁর ডাক।অবশ্য কাঠেল গাছের ফাঁক দিয়ে আসা চন্দ্রকিরণে কয়েকটা ঝিঁঝিঁও দেখতে পায় সারহান।জান্নাহ্কে সোজা করে বসায়।তার দিকে তাকাতেই তপ্ত হয় সারহানের দেহ।চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে।টসটসে গালে এখনো হাতের ছাপ।সারহান ফ্লোরে হাঁটু ঠেকিয়ে উঁচু হয়ে জান্নাহ্ এর গালে হাত রাখে।জান্নাহ্ ঘোলা চোখে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো–
“হাত কাটলেন কেন আপনি?
ঘরে ঢোকার আগেই একটা কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছে সারহান নিজের হাতে।যাতে জান্নাহ্ এর সামনে রক্ত না আসে।সারহান নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ম্লান গলায় বললো–
“আমার চেয়ে ব্যাথা কী কম পেয়েছেন আপনি?
কেন সহ্য করেন এইসব?শুধু আমাকে ভালোবাসেন বলে?আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোটাই ভালোবাসতেন তাকে?কেন এলেন আপনি আমার জীবনে ?আমি তো আপনার যোগ্য নই।পঁচা নর্দমা আমি।চলে যান আমাকে ছেড়ে।”
“যেতে চাইলে চলে যাও,নাহলে মায়া বেড়ে যাবে
থেকে গেলে থেকে যাও,ছায়া হয়ে রবে।”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।সারহানকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো—
“‘আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না,কোথাও না।যে স্ত্রীর মৃত্যু তার স্বামীর আগে হয় সে ভাগ্যবতী।আমিও সেই ভাগ্যবতী হতে চাই।আমার অন্তিম নিঃশ্বাস যেনো আপনার বুকেই নিঃসরণ হয়।”
বিগলিত হাসে সারহান।থমথমে গলায় বললো-
“তা কী করে হয় রজনীগন্ধা!তাহলে তো আপনার চেয়ে আমাকেই বেশি প্রার্থনা করতে হবে উপর ওয়ালার কাছে। যেনো আপনার সুবাসেই আমার শেষ নিঃশ্বাস প্রলীন হয়ে যায়।আমার রজনীগন্ধার সুবাস ছাড়া তো আমি এক মুহূর্তও নিঃশ্বাস নিতে পারবো না।”
জান্নাহ্কে বুকে জড়িয়ে সেভাবেই কিছুক্ষন বসে থাকে সারহান।সারহানের হৃপকম্পন শুনছে জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর পরম চাওয়া এই হৃদয়ের কম্পন যেনো তার জন্যই কম্পিত হয়।
মৌনতা ভেঙে নির্বিকার গলায় সারহান বললো–
“সারাদিনে কিছু খেয়েছেন নাকি শুধু মারই খেয়েছেন?
জান্নাহ্ বার কয়েক নাক টেনে নেয়।শুষ্ক ঠোঁটে টান লাগতেই সারহানের বুকের মধ্যে মুখ ঘষতে থাকে।সারহান নরম গলায় বললো–
“বসুন।আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
রান্নাঘরে আগে থেকেই খাবার গুছাতে ব্যস্ত শুভ্রা।সারহানকে দেখে ত্রস্ত হয়ে বললো–
“মায়ের উপর রাগ করিস না।বয়স হয়েছে তাই..।”
সারহান একটা প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে স্বাভাবিক গলায় প্রত্যুত্তর করে–
“তোমাদের কারো উপর আমার কোনো রাগ নেই।কারণ আমার সে অধিকার নেই।”
শুভ্রা চোখের পাল্লা প্রসারিত করে বিচলিত গলায় বললো–
“এইসব কী বলছিস!এইসব কিছুইতো তোরই।”
সারহান কোমল গলায় বললো–
“জানি।কিন্তু আমি শুধু চাই আমার জান্নাহ্ এর উপর তোমরা কেউ আঙুল তুলবে না।”
শুভ্রা ব্যস্ত গলায় বললো—
“তুই ভুল বুঝছিস।এই বাড়ির সবাই জান্নাহ্কে ভালোবাসে।শুধু মা ই মাঝে মাঝে..।”
সারহান খাবার প্লেট নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।দৃঢ় গলায় বললো—
“তোমাদের কারো কোনো কিছুতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।তাই আমার জিনিসেও কেউ হাত দিবে না।তোমার স্বামীকে বলবে সে যেনো তার চোখ ঠিক রাখে।নাহলে আমি সেই চোখ তুলে নিবো।কাল ই জান্নাহ্কে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি।আশা করি এইবার তোমরা ভালো থাকবে।”
,
,
,
জান্নাহ্কে খাইয়ে দিচ্ছে সারহান।সারহানের দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।সেই আহত চাহনিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারহান।সারহানের মোবাইলে রিং বেজে উঠে।ইশারা করে জান্নাহ্কে তা রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিতে বলে।কারণ সারহানের এক হাতে প্লেট আর অন্য হাত খাবারে মাখানো।কল রিসিভ হতেই বিচলিত কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রন করে শ্রীজা বললো–
“সারহান!তুমি গ্রামে কেন গেছো?আমাকে জানালেও না।শায়িখ থেকে জানলাম।”
সারহান অতি স্বাভাবিক গলায় বললো–
“ইমার্জেন্সী ছিলো তাই।”
“আর আমাদের প্ল্যানের কী হবে?
সারহান নিরুত্তেজ গলায় বললো–
“আপাতত পোস্টপন্ড।”
শ্রীজা উদ্বিগ্ন গলায় বললো–
“সারহান! এইসব কী বলছো!কতগুলো মেয়ের জীবনের ব্যাপার তুমি জানো!দেরি হয়ে গেলে কী হবে?
সারহান জান্নাহ্ এর দিকে নরম দৃষ্টি দিয়ে বললো–
“আপাতত অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার।আমার রজনীগন্ধাকে নিয়ে ব্যস্ত আমি।আর মন্ত্রী সাহেবও এখন আউট অফ ক্রান্টি।সো বি কোয়াইট।বাই।”
“বাট,সারহান..।”
সারহানের চোখের ইশারায় লাইন ডিসকানেক্ট করে জান্নাহ্।সরু গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে —
“কে উনি।”
জান্নাহ্ এর ঠোঁটে লেগে থাকা খাবার সরিয়ে হেয়ালি গলায় সারহান বললো–
“আমার গার্লফ্রেন্ড।”
জান্নাহ্ এর তীক্ষ্ম চোখের চাহনিতে ফিচেল হাসে সারহান।সরব গলায় বললো–
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন! আপনাকে শ্রীজার কথা বলেছি না!
“কিন্ত সে তো আপনার এনজিওর লোক।”
“হুম।”
“তাহলে কীসের প্ল্যানের কথা বললো?
সারহান সরস গলায় বললো—
“আমার একটা অ্যাসাইমেন্টেওকে প্রয়োজন।কাল যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু আপনার জন্য তা আর হলো না।”
বিরসমুখে জান্নাহ্ বললো–
“আমি আর খাবো না।”
“ওকে।”
সারহান সেই প্লেট থেকে নিজে খাওয়া শুরু করতেই তার হাত ধরে জান্নাহ্।বিস্মিত গলায় বললো–
“কী করছেন!ঝুটা খাচ্ছেন কেন?
সারহান মৃদু হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো—
“ঝুটা হবে কেন?আপনাকে তো আমিই হাত দিয়ে খাইয়েছি।আর ঝুটা খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে।আপনার ভালোবাসার চাপে আমি মরে যাই।”
হা হা করে হেসে উঠে সারহান।তার দিকে এক আকাশ আকুলতা নিয়ে নির্নিমেখ তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।খাওয়া শেষ করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসে সারহান।জান্নাহ্কে উদ্দেশ্য করে বললো–
“সকালেই ব্যাগ গুছিয়ে নিবেন।আমরা কাল বিকেলেই ঢাকা যাবো।এখন থেকে আপনি আমার সাথেই থাকবেন।”
জান্নাহ্ মৃদু গলায় বললো–
“কিন্তু আমার পরীক্ষা?
“চিন্তা করবেন না।পরীক্ষার আগেই আমি আপনাকে নিয়ে আসবো।আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার সকল ইচ্ছেই আমি পূরণ করবো।”
কাতর গলায় বলে উঠে জান্নাহ্–
“সারহান!বারবার একই কথা কেন বলেন?
সারহান জান্নাহ্ এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।তার হাত দুটোতে অধর ছোঁয়াতে থাকে।নির্মল গলায় বললো—
“শুনেছি কারো মৃত্যু আসন্ন হলে নাকি তার বারবার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে।”
সারহানের কথায় দমবন্ধ হয়ে আসে জান্নাহ্ এর।এই মানুষটার কোনো ক্ষতি সে দেখতে পারবে না।কিছুতেই না।তাইতো উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা এই মানুষটার দেহের উষ্ণতায় যেনো তার দেহ শীতল হয়ে যায়।তার নিঃশ্বাস থমকে যায়।হঠাৎ করে সারহান বলে উঠে—
“রজনীগন্ধা,
আমি মরলে আপনার সুবাস নেওয়ার তো কেউ থাকবে না!
চলবে,,,