জান্নাহ্,পর্বঃ২৫,২৬

0
1339

জান্নাহ্,পর্বঃ২৫,২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ২৫

প্রায় দুই ঘন্টা ধরে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছে ইহতিশাম।পুরো ক্যাফে নিথর,নিস্তব্ধ।দু’দুটো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আজকের জন্য ক্যাফে বন্ধ করে দেয় ম্যানেজার।ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে বাকিরা।জসিমের অবস্থা ভয়ংকর।পুরো শরীর ফুলে গিয়ে একটা আলুর বস্তা তৈরি হয়েছিলো।দ্রুত তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়।ভাগ্য ভালো সুপ্রসন্ন বলে এ যাত্রায় বেঁচে যায় জসিম।কিন্তু সম্পূর্ণ প্যারালাইজড সে।জসিমের শরীরে বিষাক্ত সাপের বিষ ইনজেক্ট করা হয়।যাতে করে তার হৃদযন্ত্র স্পন্দন কমিয়ে দিতে থাকে।

ক্যাফেতে বসে ঈগল চোখ দুটি আবদ্ধ করে রেখেছে ইহতিশাম সামনে রাখা মনিটরে।ক্যাফের সিসি টিভির ফুটেজ প্লে করা।ক্যাফের সামনেই প্রশ্বস্ত মহাসড়ক।এমন একটা জায়গায় হঠাৎ করে ঝামেলা করা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়।কেউ তো আর সাথে করে পয়জন নিয়ে ঘুরে না।
ইহতিশাশ চোখ তুলে ক্যাফের পশ্চিম দিকে তাকায়।একদম কোনার দিকটায় ক্যামেরা লাগানো।এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পুরো ক্যাফে।ইহতিশাশ হেলান দিয়ে আছে চেয়ারে।চিবুকের নিচটায় হাত ঠেকিয়ে গম্ভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।সারহান!সারহানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।কিন্তু তার সাথের মেয়ের চেহারা নয়।ইহতিশাম আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলো।তার সিক্স সেনস বলছে এইটা জান্নাহ্।ক্যামেরা যেখানে লাগানো জান্নাহ্ এর পিঠ টা ঠিক সেদিকে।তাই তার চেহারা বোঝার উপায় নেই।কিন্তু যেহেতু ইহতিশাম জান্নাহ্কে আগে দেখেছে তার চিনতে বেশি বেগ পেতে হলো না।

গোলযোগের মাঝেই জসিম আসছে।ইহতিশামে তীক্ষ্ম দৃষ্টি জসিমের অঙ্গভঙ্গিতে।ভীতসন্ত্রস্ত জসিমের শরীরের পরিবর্তিত মুখভঙ্গি ধরতে পারে ইহতিশাম।জান্নাহ্কে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট সে।কিন্তু কেন?টনটন করে উঠে ইহতিশামের মস্তিষ্ক।ফুটেজটা পজ করে উঠে দাঁড়ায়।চতুর্থবারের মতো ক্যাফেতে চক্কর লাগায় ইহতিশাম।ক্যাফের বিশাল থাই বন্ধ।তাই বাইরের কোলাহল ভেতরে আসছে না।ইহতিশাম ছাড়া কেউ নেইও।ইহতিশাম সারহানের টেবিলের কাছে আসে।খাবারগুলো এখনো তেমন করে পড়ে আছে।মুচকি হাসে ইহতিশাম।এইটুকু মেয়ে কতো খাবার অর্ডার করেছে।জান্নাহ্ মেয়েটার চেহারাটা বড্ড মায়াবী।বেশ লাগে ইহতিশামের কাছে।ষোড়শী হলেও নবযৌবনা।জান্নাহ্কে দেখলে ইহতিশামের তার প্রিয়তমার কথা মনে পড়ে।মেয়েটাকে অনেকদিন হলো দেখা হয় না।আর এই ঝামেলাটাও শেষ হচ্ছে না।যত দ্রুত এই কেস সলভ হবে তত দ্রুত ইহতিশাম তার প্রিয়তমার কাছে ফিরে যাবে।

আবার এসে বসে ইহতিশাম চেয়ারে।উন্মুখ হয়ে এই নিয়ে দশবার দেখছে পনেরো মিনিটের এই ফুটেজ।ইহতিশাম খেয়াল করে সেই হুডি ওয়ালা লোক জান্নাহ্দের আগেই এসেছে।কিছু একটা ভেবে অন্যদিনের ফুটেজগুলোও দেখে।আচম্বিত হয় ইহতিশাম।এই লোক আরও এসেছে এখানে।কিন্তু কখনই তার চেহারা ক্যামেরাতে আসেনি।চকচক করে উঠে ইহতিশামের দুই চোখ।তাহলে কেউ না কেউ তো তার চেহারা দেখেছে।জসিমের দ্বারা আর কিছু বলা সম্ভব নয়।কারণ আপাতত সে কথা বলতে পারবে না কয়েক বছর।
কিন্তু ইহতিশামের মস্তিষ্ক জুড়ে টগবগ করছে এক বিদঘুটে প্রশ্ন।জান্নাহ্ কোনোভাবে জড়িত এই খুনের সাথে!
নাহ সারহান?সামিরা আর তিথির সাথে কিছু একটা ছিলো সারহানের তা সে সেদিন সারহানের গ্রামে গিয়েই বুঝতে পেরেছে।শুধু সামিরার কেস দেওয়া হলেও সিমিলার বলে তিতির কেসটাও নিজ দায়িত্বে হাতে নিয়েছে ইহতিশাম।
সামিরা আর তিথির নাম্বারে যে অচেনা নাম্বালগুলো থেকে কল আসতো তার বেশিরভাগ সারহানের বাড়ির কাছ থেকে।সামিরা সারহান যেই পত্রিকার জার্নালিস্ট তার চেয়ারম্যানের মেয়ে।ইহতিশামের মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে।সারহান কী এখনো সেই নেশায় আসক্ত!তা কী করে হয়!যদি তাই হয় তাহলে সারহান কিছুতেই বিয়ে করতো না।আর জান্নাহ্ এর মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে বিয়ে করার পর অন্য কোন মেয়ে!
ইহতিশাম নিজের ভাবনাকে চড় লাগায়।কী ভাবছে এইসব সে!
কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে কী এই খুন সারহান করছে!জান্নাহ থেকে কোনো কিছু লুকানোর জন্য!তাহলে জসিম জান্নাহ্কে দেখে ভয় পেলো কেন?এমন নয়তো সারহানের বিষয়ে জান্নাহ্কে কিছু বলতে চেয়েছে।কারন যে বা যারা খুন করেছে তারা সাধারণ খুনি হয়।এতো সহজভাবে সবটা সামলানো সবার পক্ষে সম্ভব না।যেখানে সারহান তুখোড় বুদ্ধি নিয়ে চলে।কিন্তু যদি সারহান এইসব করে থাকে তাহলে অন্য কাউকে ইনভলব সে কখনই করবে না।এই ধরনের রিস্ক নেওয়ার মতো ছেলে সে নয়।

বিশ্রি শব্দ বেরিয়ে আসে ইহতিশামের মুখ থেকে।কিছু বুঝতে পারছে না সে।কিছু করার আগে সারহানের সাথে কথা বলা জরুরি।একবার ভুল করে নিষিদ্ধ গলিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে সারহানকে দ্বিতীয়বার নয়।আর এখন সারহান একা নয়।তার সাথে আরো একজন জড়িয়ে আছে।কেনো যেনো মেয়েটাকে আপন মনে হয় ইহতিশামে।কোথাও সে দেখেছে জান্নাহ্কে।সত্যিইকে এই সে যাকে সে দেখেছিলো?
যদি তাই হয় তাহলে জান্নাহ্ এর কোনো ক্ষতি সে হতে দিবে না।
,
,
,
গুমোট অন্ধকারে এক চিলতে কৃত্রিম আলো হয়ে জ্বলছে নীল রঙের ডিম লাইট।ছোট্ট ছোট্ট দম ফেলছে জান্নাহ্।আকাশে জটলা মেঘ ডাকছে।ঝড় শুরু হবে বলে।জান্নাহ্ এর শরীরটা বড্ড ক্লান্ত।শুয়ে আছে সে বিছানায়।তার পাশেই বসে আছে সারহান।শীতল গলায় বললো—

“খেতে যখন পারবেন না অর্ডার কেন করলেন?আমাকে থালা ধরানোর ফন্দি!

জান্নাহ্ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।সারহান অসহিষ্ণু গলায় আবেগ মিশ্রন করে বললো–

“হঠাৎ এমন হলো কেন?

জান্নাহ্ ক্ষীন গলায় বললো—

“জানি না।”

ফোঁস করে দম ফেলে সারহান।মোলায়েম গলায় বললো—

“এখন কেমন লাগছে?

“ভালো।”

চকিতে ফিচেল হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর নাকের সাথে নাক ঘষে রসালো গলায় বললো–

“বমিটিং হলো কেন আপনার?এই আপনি প্রেগন্যান্ট না তো?অবশ্য তা হওয়ার কথা না।”

ঠোঁট গুঁজ করে জান্নাহ্।মৃদু ছন্দে হেসে উঠে সারহান।বেশ মজা পেলো নিজের কথায় সে।স্বাভাবিক গলায় বললো–

“ঘুমান।আজ আর রাতে কিছু খেতে হবে না আপনাকে।আমাকে পথে বসানোর পরিকল্পনা চলছে আপনার।দু’দুবার হসপিটালে দৌঁড়াতে হয়েছে আজ।”

সারহান উঠে দাঁড়ায়।তার হাত আকড়ে ধরে জান্নাহ্।অত্যন্ত কোমল গলায় বললো—

“আজ এখানেই শুয়ে পড়ুন।”

চোখে হাসে সারহান।শক্ত গলায় বললো—

“নারী দেহের উষ্ণতায় তো বরফও গলতে শুরু করে আর পুরুষজাতি তো হিংস্র হায়েনা।আপনার এখন রেস্টের প্রয়োজন রজনীগন্ধা।”

নিঃশব্দে তার হাত ছেড়ে দেয় জান্নাহ্।সারহান শুনবে না তার কথা।ড্রয়িং রুমে এসে পরিচিত সেই কাউচেই ধপ করে শুয়ে পড়ে সারহান।সারাদিনের ক্লান্ত দেহ কাউচের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই আরো ভার হয়ে আসে।চোখ বুজে নেয় সারহান।তার সেই মুদিত চোখে ভেসে উঠে সেই কিশোরী দুই চোখ।সে হাসছে।শুধু হাসছে।মৃদু গলায় বলে উঠে সারহান–

“আমার বোকা রজনীগন্ধা।”

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বসন্তের শেষ সপ্তাহ।বাংলা মাসের ভয়াল মাস শুরু হলো বলে।হুটহাট কালবৈশাখী ঝড়।দলিয়ে ফেলে সব।একটু আগেই সেই বার্তা দিয়েছে প্রকৃতির বায়ু।আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে।গর্জন করে সেই মেঘের ফাঁকে জ্বলে উঠে এক চিলতে আলোর স্ফুলিঙ্গ।সাথে শুরু হয় তেজস্বি পবন।বারান্দার পাশে থাকা মেহগনি গাছ যেনো আঁছড়ে পড়ছে ভেতরে।সেই দমকা বাতাসের সাথে উড়ে আসছে বালুরাশি।বাতাসের তীক্ষ্ম শোঁ শোঁ আওয়াজ কোনো হিংস্র বাঘের চেয়ে কম না।সেই বাতাস ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে রাফাতের অস্থিমজ্জায়।

বাইরের এই ভয়ংকর প্রকৃতির তান্ডব থেকে আরো বড় ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়েছে তার বুকের মাঝে।এই তান্ডবের কাছে প্রকৃতির তান্ডব নিতান্ত অমূলক মনে হলো রাফাতের কাছে।বাতাসের নগ্ন রাগের সাথে বর্ষণ শুরু হয়েছে।পবনের তোড়ে সমান্তরাল বৃষ্টি তেরছা হয়ে ঢুকে যাচ্ছে বারান্দার ভেতর।রাফাতের চোখ বন্ধ হয়ে আসে ধূলো জড়ানো সেই বৃষ্টির শীতল জলে।তবুও মেঘ ফুঁড়ে উঁকি দেওয়া সেই চাঁদকে দেখছে রাফাত।আঁকাবাঁকা চাঁদেশ্বরী যেনো থমকে গিয়ে তাকেই দেখছে।সে হাসছে।কিন্তু বিষন্ন রাফাতের চোখ।কারণ তার চাঁদ যে আজ বহুদূরে।শ্রাবণধারায় ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে রাফাত।তাই তার চোখের নোনতা জল আর বৃষ্টির শীতল জল আলাদা করা যাচ্ছে না।

ঘরভর্তি বালু আর ভারি পর্দা উড়িয়ে আসা বাতাসে ঘরের অবস্থা এলোথেলো।ওয়াশরুমে থাকায় কোনো কিছু টের পায়নি ইশাক।বের হয়েই রাফাতকে না পেয়ে বারান্দায় আসে।দিকভ্রান্তের মতো উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে আছে রাফাত।আজ ঝড় বাইরে নয় তার হৃদয় গহ্বরে উঠেছে।প্রকৃতির এই ভয়ংকর ধ্বংসলীলা তার হৃদয়ের কৃত্রিম ধ্বংসলীলার কাছে কিছুই নয়।রাফাতের এই বৈরি আচরণ আর সহ্য হচ্ছে না ইশাকের।টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে আসে।দরজা জানালা সব বন্ধ করে দেয়।একটা প্রস্তরখণ্ডের মতো বসে আছে রাফাত।তার দেহ তো আছে কিন্তু প্রাণের অস্তিত্ব নেই।ধপ করে বন্ধুর পাশে বসে ইশাক।অসহিষ্ণু গলায় বললো—

“এইসব কী শুরু করেছিস?কালই ঢাকা ফিরবো আমরা।”

রাফাত কথা বললো না।বুকের অথৈ ঢেউ তার পাড় খুঁজে পাচ্ছে না।সে উত্তাল,বেসামাল,বেপরোয়া।ধাক্কা দিয়ে উঠে ইশাক।মৃদু কম্পন হয় রাফাতের শরীরে।কাতর চোখ দুটো ফিরিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো—

” ও আবার আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।পালিয়ে গিয়েছে আমাকে ছেড়ে।”

রাফাতের সেই শীতল কন্ঠে হিম হয়ে আসে ইশাকের শরীর।রাফাতকে দুই হাতে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়।রাফাত নিরুত্তাপ।ইশাক কোমল গলায় বললো—

“দেখ দোস্ত,জীবন নদীর মতো।থেমে থাকার নয়।তুই কেন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিস?মেনে নে বর্তমান।ভুলে যা অতীত।ভবিষ্যতকে নিয়ে ভাব।”

রাফাতে চোখ বুজলো।গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল।অতি মাত্রায় শীতল গলায় বললো–

“আমার অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ সব তো আমি ওকে নিয়েই ভেবেছি।কিন্তু ও তো নেই।তাহলে আমি এইসব দিয়ে কী করবো!

রাফাতকে সোজা করে ইশাক।থমথমে গলায় বললো–

“তুই কেন ভেঙে পড়ছিস?ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে।ভাগ্য বদলানোর ক্ষমতা আমাদের কারো নেই।”

রাফাত অস্ফুট স্বরে বললো—

“আমি তো চাইনি বদলাতে।কেন বদলে গেলো?

ইশাক তপ্ত শ্বাস ফেলে।রাগান্বিত গলায় বললো—

“এইবার তুই বাড়াবাড়ি করছিস!ভালোবাসা জোর করে পাওয়ার জিনিস নয়।জান্নাহ্ তোকে কখনো ভালোবাসেনি।”

“কী বলছিস।”

রাফাতের কন্ঠ মর্মাহত।কিন্তু তা বেশ তপ্ত শুনালো।ইশাক গম্ভীর গলায় বললো—

“ঠিক ই বলছি।তুই যা ফিল করেছিস তা জান্নাহ্ কখনো ফিল করে নি তোর জন্য।এইটা ঠিক যে তোর আর ওর সম্পর্ক বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি ছিলো।কিন্তু একজন লাইফ পার্টনার হিসেবে তোকে ও কখনো দেখেনি।”

রাফাত সরু চোখে তাকায়।প্রশ্নবিদ্ধ সেই চোখ।
ইশাক অধৈর্য গলায় রাগ মাখিয়ে বললো—

“ঠিক ই বলছি।বারো বছরের একটা মেয়ের মধ্যে সেই ফিলিং জন্ম নেয় নি যা তুই ফিল করিস।কিন্তু বর্তমান বদলেছে।জান্নাহ্ সারহানকে ভালোবাসে।তোকে নয়।”

উঠে দাঁড়ায় রাফাত।উগ্র গলায় বললো–

“আমি বিশ্বাস করি না।”

ইশাখ ধমকে উঠে বললো–

“করতে হবে তোকে।জান্নাহ্ নিজে আমাকে বলেছে।”

তাড়া দিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে রাফাত–

“কী বলেছে তোকে?

জান্নাহ্ স্কুল শেষে ইশাকের সাথে দেখা করে রাফাতের প্রতি তার সকল অব্যক্ত অনুভূতির কথা বলে।বারো বছরের কিশোরী জান্নাহ্ এর রাফাতের প্রতি কখনো এই ধরনের অনুভূতি ছিলো না যাতে সে তাকে তার জীবনসঙ্গি ভাবে।তবে রাফাত সিরিয়াস ছিলো।নিজের হাতে যাকে সে গড়েছে অন্যকে কেন দিবে সে তাকে!নিজের মায়ায় জড়াবে।নিজের ভালোবাসায় সিক্ত করবে তার হাজার রজনীতে গড়ে উঠা পবিত্র ভালোবাসাকে।কিশোরী জান্নাহ্ একজন পথের দিশারী,একজন ভালো বন্ধু,একজন সহযোগী হিসেবে রাফাতকে চেয়েছে।এর বেশি নয়।

ইশাকের কথায় জ্বলে উঠে রাফাত।খলবলিয়ে উঠে বললো—-

“তাহলে কেন ও বললো ও আমাকে বিয়ে করবে?কেন বললো আমার জন্য অপেক্ষা করবে?কেন আমাকে বাধ্য করলো ওকে নিয়ে ভাবতে?

ইশাক তীব্র হতাশার শ্বাস ফেলে বললো–

“এইটা তোর বোঝার ভুল।জান্নাহ্ তো বুঝতোই না এইসব।আর তুই নিজেই বলেছিলি তুই জাপান যেতে চাইছিলি না।শুধুমাত্র জান্নাহ্ বলেছিলো যে ওর ডক্টর বর চাই তাই তুই জাপান গিয়েছিস।তো?

“হ্যাঁ বলেছি।ও বলেছে বলেই আমি গিয়েছি।ওকে এও বলেছি ফিরে এসে আমি ওকে বিয়ে করবো।ওকেও ডক্টর বানাবো আমি।একসাথে থাকবো সারাজীবন।
ও বাচ্চা নয় রাফাত।স্বামী নিয়ে সংসার করছে।দেড় বছরে ও এতোটাও বড় হয়ে যায়নি যে আমার ভালোবাসা না বুঝলেও সারহানকে ভালোবাসে।”

শেষের কথাগুলো বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো রাফাত।তার দুই চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।অগ্নি বিচ্ছুরণ হচ্ছে সেই চোখে।গমগমে গলায় বললো–

“ওকে।আমিও অপেক্ষা করবো।ফিরবে তো ও নিশ্চয়ই।আমার প্রশ্নের জবাব ওকে দিতেই হবে।আমার খামতি ওকে দেখাতেই হবে।নাহলে ছাড়বো না ওকে আমি।”
,
,
,
“তুমি আমারে মাফ কইরা দিছতো বউমা?

জান্নাহ্ এর কান্না পেলো।কিন্তু সে তা দমন করে সহজ গলায় বললো—

“এইসব কী বলছেন আম্মা!সন্তানের কাছে মা কী কখনো অপরাধি হয়!

অন্তরা অনুযোগের সুরে বললো—

“নাগো বউমা।কারনে অকারণে তোমার গায়ে আমি হাত তুলছি।কী করমু কও।পোলাডারে কইলজাত রাইখা পালছি।কী জানি অইলো!গত বারোডা বছর ধইরা আমারে আপনে কইরা কয়।ঠিক মতো কথাও কয় না।”

জান্নাহ্ এর চোখ ভরে আসে।সারহান কখনো কারো কথা শোনে না।নিজে যা বোঝে তাই করে।জান্নাহ্ অনেকবার বলতে গিয়েও সাহস করে উঠাতে পারেনি।অন্তরা আবারও কান্না মিশ্রিত গলায় বললো—

“আমি জানি সারহান তোমারে খুব ভালোবাসে।তুমি তো জানোই সে বিয়া করতে চায় নাই।কিন্তু তোমারে দেইখাই তার পছন্দ হইছে।তাই ভাবছি বিয়া হইলে সে ফিরা আইবো বাড়ি।কিন্তু এই একবছরেও বদলাইনো না পোলাডা আমার।তাই তোমার উপর সেই রাগ ঝাড়তাম।মাফ কইরা দিউ আমারে।”

জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে তার কান্না রোধ করে।ধরা গলায় বললো—

“নাহ আম্মা।এইসব বলবেন না।আমার কোনো রাগ নাই আপনার উপর।আমার মা থাকলেও তো ভুল করলে আমাকে শিখিয়ে দিতো।”

অন্তরা মিনমিনে গলায় বললো—

“তা দিতো।কিন্তু আমি তো তোমার গায়ে হাত তুলছি।”

“থাক আম্মা।ভুলে যান এইসব।আমি কিছু মনে রাখিনি।”

অন্তরা আশ্বস্ত হলেন।খুশি খুশি গলায় বললেন–

“তয় এইবার আবার কথাটা রাইখো।আমি যেমনে শিখাইয়া দিছি ওমনেই কইরো।”

জান্নাহ্ একটু শক্ত হলো।সরস গলায় বললো–

“আম্মা সে যদি জানতে পারে!তাহলে আমার সাথে খুব রাগ করবে।আপনি তো জানেন সে কেমন।”

অন্তরা আত্নবিশ্বাসী গলায় বললো–

“তুমি চিন্তা কইরো না।আমি যেমন কইছি তেমনে কইরো।পরে আমি তারে বুঝামু।দেখবা একখান বাচ্চা হইলে সে বাড়ি ফিরা আইবো।তুমি ভয় পাইয়ো না।”

আরো কিছুক্ষন বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিয়ে লাইন কাটে জান্নাহ্।মানুষটার কথায় বড্ড মন খারাপ হলো জান্নাহ্ এর।মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিশ্চল হয়ে বসে রইলো ডিভানে।তার পাশেই এসে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর ভেজা অক্ষিপল্লব দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে–

“কাঁদছেন কেন?

জান্নাহ্ নির্মল গলায় বললো—

“বাড়ির কথা মনে পড়ছে।”

সারহান বাঁকা হাসে।ডিভানে হেলান দিয়ে বললো—

“আপনারা মেয়েরা ননীর পুতুল।একটু তাপেই গলে যান।”

জান্নাহ্ আওয়াজে গভীরতা টেনে বললো–

“মেয়েরা মায়ের জাত জানেন তো।তারা একবার যাকে হৃদয়ে স্থান দেয় তাকে সেখান থেকে সরাতে পারে না।”

সারহান অধর ছড়িয়ে হা হুতাশ করে হেয়ালি গলায় বললো—

“এতো নরম হৃদয় নিয়ে বাঁচা যায় না রজনীগন্ধা!

সারহানের কথার তোয়াক্কা না করে জান্নাহ্ হুট করে বললো—

“আপনার আমাকে মনে পড়বে না সারহান?

ঝট করে সারহান ডিভানের কোনার সাথে ঠেসে ধরে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর গাল দুটো চেপে ধরায় তার ওষ্ঠাধর গোলাকার রূপ ধারণ করে।জান্নাহ্ এর চোখে চোখ রেখে তীক্ষ্ম স্বরে বললো—

“তার প্রয়োজন পড়বে না।আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে আমি আপনার নিঃশ্বাসও বন্ধ করে দিবো রজনীগন্ধা।”

সারহান গভীর চুমু খায় জান্নাহ্ এর বলয়াকৃতি ঠোঁটে।হতভম্বের মতো চেয়ে থাকে তার দিকে জান্নাহ্।ফিক করে হেসে ফেলে সারহান।স্বাভাবিক গলায় বললো–

“জাস্ট কিডিং।ভয় পাবেন না।”

সারহান তার ঘাড় হেলিয়ে দেয় ডিভানে।সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বেখেয়ালিপনায় বললো—

“মনে পড়বে কি না জানি না।তবে আমার অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি আপনার সাথেই থাকবো।যদি কখনো ছেড়ে যেতে চাই তাহলে না হয় নিজের হাতেই এই প্রাণটা কেড়ে নিবেন।সেই অধিকার আমি আপনাকে দিলাম রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ এর ভাবিত নয়ন স্থির রইলো সারহানের সেই মসৃণ চেহারায়।দুই উদ্ভাসিত চোখে।মৃদু গলায় জিঙ্গেস করে জান্নাহ্—

“মেডিসিন কতোদিন খেতে হবে সারহান?

সারহান ঘাড় সোজা করে তীর্যক দৃষ্টি দেয়।নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

“এতোদিনে প্রেসক্রিপশন দেখিন নি!এক মাসের কোর্স।রেগুলার মেডিসিন নিবেন।ঠিক না হলে বলবেন এর চেয়ে বড় গাইনোকলোজিস্টের কাছে নিয়ে যাবো আপনাকে।”

জান্নাহ্ দুটো ঢোক গিললো।সারহান ব্যস্ত হয়ে বললো–

“আজ রাতে কিন্তু আমি ফিরবো না।”

জান্নাহ্ চোখ ছোট ছোট করে ভীত গলায় বললো–

“কেন?

“কাজ আছে আমার।আপনাকে আজকে একাই থাকতে হবে।”

জান্নাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত গলায় ধীরে ধীরে বললো—

“কিন্তু সারহান..।”

সারহান উঠে দাঁড়ায়।শক্ত গলায় বললো–

“কিছু করার নাই রজনীগন্ধা।আমার জরুরি কাজ আছে।আর শায়িখকে আমি আপনার সাথে রেখে যেতে পারছি না।পুরুষ মানুষের শরীরে অসুর ভর করতে সময় লাগে না।ইউ নো দ্যাট।”

জান্নাহ্ কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে।সারহান জান্নাহ্ এর কপালে উষ্ণ চুম্বন করে নির্বিকার গলায় বললো–

“দরজা ভালো করে লক করে রাখুন।আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলেই আমাকে কল করবেন।”

হালকাভাবে এক হাত নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে জান্নাহ্কে।তার চুলে আলতো চুমু খেয়ে বললো–

“মাই নর্থ স্টার।”

পার্কিং লজে নিজের গাড়ি তে বসতে গেলেই সারহান দেখলো উগ্রমূর্তি ধারণ করে হনহন করে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে ধেয়ে আসছে শ্রীজা।তাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে আসে সারহান।শ্রীজার হাত ধরে বললো—

“কী হলো তুমি এখানে?

শ্রীজা গজরাতে গজরাতে বললো–

“আমার কল কেন রিসিভ করছিলে না?

সারহান সহজ গলায় বললো–

“ব্যস্ত ছিলাম।”

বিদ্রুপপূর্ণ হাসে শ্রীজা।তাচ্ছিল্য গলায় বললো—

“বউকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলে?বউ পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে!

সারহান ফোঁস করে দম ফেললো।সশব্দে বললো–

“চলো এখান থেকে।কাজ আছে আমাদের।”

শ্রীজা ঝটকা মেরে হাত সরায় সারহানের।ভেতরের দিকে যেতে গেলেই সারহান তার সামনে থমকে দাঁড়ায় তপ্ত গলায় বললো–

“কোথায় যাচ্ছো?

শ্রীজা ফুঁসলে উঠে বললো–

“তোমার বউকে দেখতে।আমার চেয়ে কতোটা সুন্দরী ওই ষোড়শী আমি দেখতে চাই।”

সারহান গনগনে গলায় বলে উঠে–

“বাজে কথা কম বলো।চলো এখান থেকে।”

শ্রীজাকে জোর করে গাড়িতে বসায় সারহান।ছয়তলার জানালা দিয়ে তা স্পষ্ট দেখতে পায় জান্নাহ্।চুপসে আসে তার মুখ।নরম পায়ে ডিভানে এসে বসে।পা দুটো উঠিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে।মনে মনে ভাবে,”ঘরের বিরিয়ানি বাসি হলে বাইরের ডাল ভাতও অমৃত মনে হয়।”
চোখ বন্ধ করে জান্নাহ্।তার মুদিত অক্ষিযুগল দিয়ে ঝরতে থাকে শ্রাবণের শীতল প্রস্রবণ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here