জান্নাহ্,পর্বঃ৩১,৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৩১
জান্নাহ্ এর কোমল মুখে আলতো হাত দিয়ে তাকে ছুঁয়ে দেখছে শ্রুতি।এতোটা সন্তর্পনে যেনো কোনো মাখনে হাত লাগাচ্ছে যাতে একটু উষ্ণতার আঁচ লাগতেই গলে যাবে।ভোলা ভোলা দৃষ্টিতে জান্নাহ্কে দেখছে শ্রুতি।জান্নাহ্ এর ঠোঁট,চোখ,মুখ একটু একটু করে ছুঁইছে সে।শ্রুতির কাছে মনে হচ্ছে সে কোনো জীবন্ত পুতুলকে দেখছে।বাড়ন্ত বয়সের সাথে সাথে জান্নাহ্ এর রূপ খেলে উঠছে।
জান্নাহ্ মিষ্টি গলায় বললো–
“কেমন আছো শ্রুতি?
শ্রুতি কথা বললো না।দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে ঠোঁটের পাল্লা দুটো ফাঁক করে মিষ্টি করে হাসলো।যেমন করে আচমকা খুশিতে দুই তিন বছরের বাচ্চারা হাসে।এক মুহূর্তের জন্য জান্নাহ্ এর তিতির কথা মনে পড়লো।শ্রুতি চোখ ছোট ছোট করে হাসছে।কোনো কথা বলছে না।আজ কমলা রঙের একটা ফ্রক পড়েছে শ্রুতি।বয়সের তফাৎ না হলেও জান্নাহ্ আর শ্রুতির মধ্যে বিস্তর ফারাক।অবশ্য হওয়ারই কথা।যে মানুষকে আমরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি সেই মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষত বিক্ষত করে।শ্রুতির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।গ্রামের এক ছেলেকে ভালোবেসেছে সে।তার হাত ধরে কিশোরী শ্রুতি ভালোবাসার টানে পালিয়ে এসেছে।ভেবেছিলো ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ছোট্ট সংসার হবে।হয়েছিলো কিন্তু তা হিংস্র দানবদের নিয়ে।যারা তাকে খুবলে খেয়েছে।শ্রুতি স্বাভাবিক হলেও মেন্টাল ট্রমা এখন তাকে একটা বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছে।
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে শ্রুতি।গোল গোল চোখ করে জান্নাহ্কে দেখে।ভালো লাগে তার।জাদুর কাঠির মতো আঙুল দিয়ে আলগোছে ছুঁয়ে দেয় জান্নাহ্কে।আপ্লুত হয় সে।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াতে থাকে।জান্নাহ্ অধর প্রসারিত করে হেসে হেসে বললো—
“এইটা পছন্দ তোমার?
শ্রুতি মাথা উপর নিচ করে সম্মতি দেয়।জান্নাহ্ তার পার্স থেকে দুটো লিপস্টিক নিয়ে শ্রুতির হাতে দেয়।সারহান বলেছিলো শ্রুতির পছন্দ অনেকটা তিতির মতো।খুশিতে ঝুমঝুমিয়ে হাসে শ্রুতি।যেনো সে অনেক আকাঙ্ক্ষীত বস্তু পেয়েছে।জান্নাহ্ ধীর গলায় আবার বললো–
“আর কী চাই তোমার?
শ্রুতি তার গলা থেকে চিবুকটা একটু আলগা করে চোখ দুটোকে বড় বড় করে ইশারা করে।জান্নাহ্ বোঝে না।তাই সে নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখায়।শ্রুতি না করে।জান্নাহ্ তার কানের কাছে হাত নিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ফিক করে হেসে ফেলে শ্রুতি।জান্নাহ্ নির্মল হাসে।কান থেকে হোয়াইট পার্লের দুলটা খুলে শ্রুতির কানে পড়িয়ে দেয়।দুই কানে হাত দিয়ে উচ্ছল হাসে সে।জান্নাহ্ও হাসে।
শ্রুতির পায়ের কাছেই অনেকগুলো আর্ট পেপার আর রঙ।পেন্সিল রঙের পাশাপাশি পেস্টাল রঙও আছে।শ্রুতি ভালো ছবি আঁকতে পারে।এনজিও তে হাঁটার সময় যখন যা দেখে তার মধ্যে কিছু ভালো লাগলেই তা আঁকে।জান্নাহ্ সেই ছবিগুলো দেখতে থাকে।কিন্তু একটা ছবিতে তার চোখ আটকে যায়।কেউ একজন কাউকে জড়িয়ে ধরে আছে।জান্নাহ্ এর চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত হতে থাকে।আর জমতে থাকে প্লাবন।কারণ ছবিটা আর কারো নয় সারহানের।সারহান যাকে জড়িয়ে ধরে আছে তার পিঠের উপর যেই হাত তাতে ব্রেসলেট পড়া।আর ব্রেসলেট টা সারহানের।যেখানে ব্রেসলেটের সাথে একটা লেটার এস এর মাঝে জেড।আগে যা সারহান জেইদি নামে থাকলেও এখন তা সারহান জান্নাহ্ নামে আখ্যায়িত।কিন্তু মেয়েটা জান্নাহ্ নয়।কারণ জান্নাহ্ কখনো টপস আর ল্যাগিন্স পড়ে না।এই ড্রেস পড়ে শ্রীজা।ছলছল চোখ নিয়ে উঠে যায় জান্নাহ্।তার প্রাণআত্না যেনো বের হয়ে যেতে চাইছে।দরজার কাছে যেতেই শ্রুতি শীতল গলায় বললো—
“তুমি কী কষ্ট পেয়েছো?এই ছবিটা তোমার ভালো লাগেনি?তাহলে ফেলে দেই?
জান্নাহ্ অবিশ্বাস্য আচরণ করলো।ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–
“নাহ।ছবিটা তোমার সারহান ভাইয়াকে দেখাবে।”
,
,
,
বিছানায় বসে নিজের মোবাইলে জান্নাহ্ এর ছবি দেখছে সারহান।কাল রাতেই উঠিয়েছে এই ছবিগুলো।গাঢ় লাল গাউনে যেনো রক্তজবা লাগছে জান্নাহ্কে।কাল অনেকদিন পর জান্নাহ্ আর সারহান এক মিষ্টি সময় কাটিয়েছে।জান্নাহ্ এর দেহের সুবাসে অদ্ভুত মাদকতা যা সারহানের পৌরষসত্তাকে ক্ষনকালেই উন্মাদ করে তোলে।
সারহানের দিকেই তীক্ষ্ম নজরে চেয়ে আছে শ্রীজা।থমথমে গলায় বললো–
“তুমি শুনতে পারছো আমি কী বলছি?
সারহান মোবাইলটা পকেটে রেখে রসালো গলায় বললো–
“রজনীগন্ধাকে দেখছিলাম।শুনতে পাই নি।এইবার বলো।”
তেতে উঠে শ্রীজা।গমগমে গলায় বললো–
“বিয়ে করো আমাকে।”
এক মুখ হাসে সারহান।হেয়ালি গলায় বললো–
“মাথার নিউরণ কী ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে নাকি তোমার!
শ্রীজা চেতে গিয়ে বললো–
“সারহান!
সারহান বিগলিত গলায় বললো—
“হঠাৎ বিয়ে করার ইচ্ছে জাগলো কেন তোমার!তোমার তো এইসবে বিশ্বাস নেই।”
“তুমি আমাকে এভয়েড করছো।গত দেড় মাস ধরে তুমি আমাকে সময় দিচ্ছো না।যখন থেকে জান্নাহ্ এখানে এসেছে তোমার কাছে আমার কোনো চাহিদাই নেই।”
সারহান নরম গলায় বললো–
“স্বাভাবিক।ব্যস্ত আমি এখন।”
“আমারো সেই অধিকার চাই যা জান্নাহ্ এর।”
সারহান অধর কোণে হেসে বললো—
“অধিকার!কিসের অধিকার!আমাদের সম্পর্কটা
কমিটমেন্ট।তোমার আমাকে প্রয়োজন আমার তোমাকে।দ্যাটস ইট।”
শ্রীজা তপ্ত গলায় বলে উঠে—
“তাহলে বিয়ে কেন করলে?তুমি তো কখনো বিয়ে করতে চাওনি।জান্নাহ্কে দেখার পর কী হলো তোমার?
সারহান শক্ত কন্ঠে প্রত্যুক্তি করে—
“তার জবাব আমি তোমাকে দেবো না।”
বিছানায় আলগোছে শুয়ে পড়ে সারহান।মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।শ্রীজা দমদমিয়ে বললো–
“কী এমন পেলে তুমি ওর মধ্যে!
সারহান বাঁকা হাসলো।স্বশব্দে বললো–
“তোমার মতো বিয়ের আগে রাত কাটায় নি আমার সাথে।সে আমার রজনীগন্ধা।”
সারহান চোখটাকে তেরছা করে শোয়া অবস্থায় শ্রীজার দিকে তাকিয়ে ক্ষেপা গলায় বললো—
“আজকের পর আর কোনোদিন জান্নাহ্ এর সাথে নিজের তুলনা করবে না।তাহলে আমাকে হারাবে সারজীবনের মতো।”
ধম করে উঠে শ্রীজার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সারহান।তার পশ্চাতে শ্রীজা ভাঙচুর শুরু করে।
করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিড়ালপায়ে এগিয়ে আসছে সারহান।খয়েরি পাড়ের সাদা শাড়ি পড়েছে জান্নাহ্।মাথায় হাত খোপা করে তাতে আর্টিফিসিয়াল বেলি ফুলের গাজরা গুঁজেছে।চোখের পানি বাঁধা মানছেই না।গরগর করে গড়িয়ে পড়ছে।হাতের উল্টো পাশ দিয়ে যতবারই মুছে ততবারই গড়িয়ে পড়ে তা।চোখে দেওয়া মোটা কাজলের আঁচড়টাও লেপ্টে যায়।পাশে এসে দাঁড়ায় সারহান।ডেকে উঠে–
“রজনীগন্ধা।”
পাশ ফেরার আগে নিজের চোখটা ভালো করে মুছে নেয় জান্নাহ্।সারহান বিগলিত হাসে।সরস গলায় বললো—
“আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি ষোড়শী।”
বিনা সময় ব্যয়ে আর্দ্র গলায় বলে উঠে জান্নাহ্–
“মানুষের উপরটা দেখে কখনো ভেতরটা বোঝা যায় না।ভেতরটা কতটা নিকৃষ্ট আর কুচকুচে কালো।”
ভ্রু বাকায় সারহান।হতভম্ব গলায় বললো–
“কী হয়েছে আপনার?
“কিছু না।বাসায় যাবো আমি।”
সারহানকে রেখেই হাঁটা ধরে জান্নাহ্।সারহানের কোনো ডাকই তার কর্ণকুহর হলো না।
গাড়িতে কোনো কথা বললো না জান্নাহ্।রাগ হচ্ছে তার।চোখগুলোও বড় বেহায়া।কাঁদতে চায় না তাও নোনতা জল ছেড়েই চলছে।স্টেয়ারিং হাত থাকলেও সারহানের বিক্ষিপ্ত নজর জান্নাহ্ এর দিকে।ব্যস্ত গলায় বললো–
“কী হয়েছে বলবেন তো!
সারহানের কন্ঠে আর থামাতে পারলো না নিজেকে।ঝমঝমিয়ে কাঁদলো জান্নাহ্।হতচকিত সারহান ব্রেক কষে।দারাজ গলায় বললো–
“কী হয়েছে বলবেন প্লিজ!সে কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছেন।”
জান্নাহ্ তীক্ষ্ম গলায় বলে উঠে—
“ধমকাচ্ছেন কেন!একদম ধমকাবেন না আমাকে।”
সারহান ফোঁস করে এক শ্বাস ফেললো।অনুযোগের সুরে বললো—
“সরি।প্লিজ বলুন কী হয়েছে?
“আপনার মোবাইল দিন।”
সারহান বিস্মিত নয়নে তাকায়।জান্নাহ্ ফের জোর গলায় বললো–
“কী হলো দিন।”
সারহান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।এতে যদি তার রজধীগন্ধা খুশি হয় তাহলে তাই হোক।সারহানের মোবাইল নিতেই দেখে তা লক করা।শক্ত গলায় জান্নাহ বললো–
“পাসওয়ার্ড?
সারহান নির্বিকার গলায় বললো–
“আপনি।”
জান্নাহ্ রজনীগন্ধা লিখতেই স্ক্রিন আনলক হয়।কল লগস থেকে খুঁজে শ্রীজার নাম্বারে গিয়ে মেসেজ করে।কিছুক্ষন পর শ্রীজা রিপ্লাই করতেই তা সারহানকে দেখায়।জান্নাহ্ লিখেছিলো,”আজ তোমার সময় হবে?
শ্রীজা রিপ্লাই করে,”তোমার জন্য আমি সবসময় ই ফ্রি।”
আগুন জ্বলে উঠে সারহানের মাথায়।সে কিছু না বলেই গাড়ি ঘোরায়।এনজিওর গেটেই দাঁড়ানো শ্রীজা।সারহানকে দেখে খুশি হলেও তার পাশে জান্নাহ্ক দেখে চটে যায়।তার কাছে গিয়েই মোবাইলটা দেখিয়ে গর্জে গিয়ে সারহান বললো—
“এইসব কী?
শ্রীজা কিছুক্ষন চুপ থেকে মিনমিনে গলায় বললো—
“তুমি না বললে সেদিন পুরাণ ঢাকায় একটা ড্রাগস গ্যাং ঢুকেছে।তাই আমি ভাবলাম আজ হয়তো যাবে।”
সারহান জান্নাহ্ এর দিকে চেয়ে সরব গলায় বললো–
“আর কিছু শুনতে চান আপনি?
জান্নাহ্ চেয়ে থাকলো।সারহান থমথমে গলায় বললো-
“যদি ইচ্ছে হয় তাহলে আসুন নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”
গাড়িতে গিয়ে বসে সারহান।কয়েক কদম গিয়ে পেছন ফিরে জান্নাহ্।তার ঘোলা চোখে শ্রীজার গম্ভীর মুখটা দেখছে।কিছু বলতে চায় শ্রীজা।কিন্তু কী?
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
খাবারের ঘ্রাণে উতলা হয়ে উঠছে ইহতিশাম।ঝকমকে হেসে বললো–
“আই সয়ের,আমার যদি একটা জাদুর ছড়ি থাকতো তোমাকে পৃথিবীর বেস্ট শেফের খেতাবটা দিয়ে দিতাম।”
ঝুমঝুম করে ইহতিশামের কথায় হেসে উঠে জান্নাহ্।মুখে এক লোকমা দিয়েই আগ্রহী গলায় ইহতিশাম বললো—
“এতো ভালো রান্না কোথায় শিখলে তুমি?
জান্নাহ্ স্বাভাবিক গলায় বললো—
“আমার বাবার কাছ থেকে।”
ইহতিশাম ভ্রু নাচিয়ে বিস্মিত গলায় বললো–
“তাই নাকি!আঙ্কেল কী মাস্টার শেফ ছিলো নাকি!
জান্নাহ্ নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়।মৃদু গলায় বললো–
“উঁহু।”
“তাহলে?
জান্নাহ্ স্বশব্দে বললো—
“মাম্মা,রান্না করতে পারতো না।তাই বাবাই করতো।সাথে আমাকেও শেখাতো।”
ইহতিশাম ভ্রু কুঁচকে ক্ষীন চোখে তাকায়।মাম্মা ডাকটা বড় অদ্ভুত শুনালো তার কাছে।সে নিরুত্তাপ গলায় বললো—
“তোমার বাবা কী করতেন?
নিজের কথায় হোচল খায় জান্নাহ্।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।সারহান কোনোরকম ভনিতা ছাড়ায় দৃঢ় কন্ঠে ঘোষনা করলো—
“জান্নাহ্ এর বাবা কী করে তা তোর না জানলেও চলবে।খেতে আসছিস,খেয়ে বিদায় হ।”
মুক্ত চোখে তার দিকে তাকায় জান্নাহ্।ফেরার পর থেকে একটা কথাও বলেনি একে অপরের সাথে।ইহতিশাম তার স্থির চোখ দুটো দিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার আভাস আন্দাজ করতে চাইছে।কিন্তু পারছে না।তার মাঝে গো গ্রাসে গিলে যাচ্ছে শায়িখ।নিজের অসুস্থ মায়ের হাতের রান্না কবে খেয়েছে বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে।তাই এ সুযোগ হাতছাড়া করা করতে তার মস্তিষ্ক তীব্র প্রতিবাদ করেছে।
সারহান খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জান্নাহ্কে দেখছে।সে খাচ্ছে তো ঠিকই কিন্তু তা তার গলা থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ দেখলো না।ইচ্ছে করছে না তার।সে চায় না তার সামনে হঠাৎ উদিত সত্য তার পরিশুদ্ধতা পাক।তার মানুষটা তারই থাক।আর কী করার আছে তার!আর কতো সইবে সে!
সারহানের নজর সরলো না।অপ্রস্তুত হয় জান্নাহ্।বিরসমুখটা কোনোরকম আড়াল করলো সে।সারহান বিক্ষিপ্তচিত্ত তাকিয়ে আছে এখনো।এতো কিসের রাগ!কে বলেছে এই মেয়েকে আসতে তার জীবনে!ভালোবাসার পুষ্পভরা ডালা নিয়ে।সে তো অনেক আগেই মৃতভূমিতে পরিণত হয়েছে।সেই ভূমিতে ভালোবাসার ফুল ফুটাতে কে বলেছিলো এই মেয়েকে!প্রথবারই সে নিজেকে থমকে নিয়েছে।তাহলে দ্বিতীয়বার কেন আসলো এই মেয়ে!আমি তো চাইনি।সে নিজে এসে করা নেড়েছে আমার দ্বারে।তাহলে এখন!
সুযোগ দিয়েছি আমি।কেন যাইনি সে!কিন্তু আজ আর আমি দিবোনা।কোথাও যেতে দিবোনা।শেষ শ্বাস পর্যন্ত আমার কাছেই থাকতে হবে।হয় মারবো না হয় মরবো।
ঝট করে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে সারহান।তার দিকে তিনজোড়া চোখ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ইহতিশাম কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে–
“উঠলি যে?
সারহান সহজ গলায় রোষ নিয়ে বললো–
“খেতে ইচ্ছে করছে না।তুই খেয়ে বিদায় হ।আর শায়িখ তুমি খেয়ে আমার রুমে আসো।”
সারহান যেতেই ইহতিশামের বিষন্ন দুই চোখ আবদ্ধ হয় জান্নাহ্ এর দিকে।ম্লান গলায় বললো—
“কিছু হয়েছে?
ইহতিশামের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে শায়িখ বললো—
“তেমন কিছু নয়।আসলে নতুন একটা কেস নিয়ে স্যার একটু চিন্তিত।”
ইহতিশাম ভ্রু ক্রুটি করে।সংক্ষেপিত তার দৃষ্টি কিছু একটা বুঝতে পেরেও কিছু বললো না।জান্নাহ্ বিভ্রান্ত চোখ তাকায়।তার চাহনিতে অপ্রস্তুত হয় শায়িখ।অপরাধি মুখটা নিচু করে খাওয়ায় অভিনিবেশ করে।
বাটিতে থাকা চিংড়ির মালাইকারি মুখে দিতেই ইহতিশাম সরস গলায় বললো–
“এতে লবণ কম।”
জান্নাহ্ চোখ পিট পিট করে যেইনা লবণ দেখার জন্য বাটিতে হাত দিতে যাবে উদ্বেলিত গলায় বলে উঠে শায়িখ–
“ম্যাম,আপনার চিংড়িতে অ্যালার্জি।”
রুদ্ধশ্বাসে একে অপরকে দেখছে তারা।ইহতিশাম মুখ ফুলিয়ে দাঁতের কোনায় জীভ গুঁজে ধরে।চোখের কোণ ক্ষীন করে অনেকটা প্রশ্নসূচক অভিপ্রায়ে হেয়ালি গলায় বললো–
“আর ইউ সিরিয়াস?
বৃহৎ ঢোক গিলে শায়িখ।তার দীপ্ত মুখটা হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে যায়।মিনমিনে গলায় ভাঙা ভাঙা করে বললো–
“আসসসলে স্যাএএর বলেছিলো।”
ইহতিশাম প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো।মসৃণ কপালটায় ঠিক মাঝ বরাবর কয়েকটা লম্বালম্বি রেখা ফেলে বললো–
“তোমার ব্রেইন তো খুবই শার্প।জিনিয়াস।স্যারের সাথে সাথে স্যারের ওয়াইফের প্রতিও তোমার দারুণ আনুগত্য।”
লজ্জা পেলো শায়িখ।তার নিষ্কম্প চোখ অবনত করে মিষ্টি হাসলো।জান্নাহ্ চোখে হেসে বললো–
“সরি তিশাম ভাইয়া।আসলে লবণ চেক করা হয়নি।সারহান বললো আপনার নাকি চিংড়ি মাছ পছন্দ।”
ইহতিশাম ভারি গলায় বললো–
“সারহানেরও।হোস্টেলে থাকতে কতো কাড়াকাড়ি করে খেয়েছি।”
বিরস হাসে জান্নাহ্।ক্ষীন গলায় বললো–
“সারহান এখন আর চিংড়ি মাছ খায় না।”
ইহতিশাম অধর ছড়িয়ে মুক্ত শ্বাস ফেলে।আবেগী গলায় বললো–
“সারহান সত্যিই তোমায় ভালোবাসে।”
জান্নাহ্ কিছু চিন্তা করার আগেই তার চোখের সামনে শ্রুতির আঁকা সেই ছবি ভেসে উঠে।চকিতে ইহতিশাম বলে উঠে—
“তোমার কোনো বোন টোন আছে নাকি?
জান্নাহ্ তার পাতলা ঠোঁটের কোণ একটু ফাঁক করে হাসলো।ঝলমলে গলায় বললো–
“কেন?
ইহতিশাম ভারি মজা নিয়ে বললো—
“ভাবছি বিয়ে করে নিবো।সারহান খেতে পছন্দ করে না।আমি কিন্তু খেতে ভীষন পছন্দ করি।তাই ভাবছি তোমার বোন থাকলে তাকেই বিয়ে করে নিবো।রান্না করাবো আর খাবো।”
কলকলিয়ে হেসে উঠে উপস্থিত তিন নরনারী।নিজের ঝর্ণার প্রবাহমান হাসিকে দমিয়ে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জান্নাহ্ বললো–
“আছে তো।কিন্তু আপু এখন বাইরে।আপু ফিরলেই আমি আপনার কথা বলবো।”
ফুরফুরে হাসলো ইহতিশাম।বাম হাত দিয়ে বুক পকেট থেকে নিজের কার্ড বের করে দিয়ে অতি মাত্রায় আনন্দিত গলায় বললো–
“কৃতজ্ঞ কিউটি।এই নিন আমার কার্ড।আপনার আপুর সাথে দেখা হলেই তাকে এইটা দিয়ে আমাকে বউ খোঁজার এই ভয়াল যুদ্ধ থেকে রক্ষা করবেন।”
ইহতিশাম আরেকটু চেপে নেয় গলা।জান্নাহ্ এর একটু কাছে এসে হুসহুসে বললো–
“আমি কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ না।আপনার বোনকে বলবেন।”
খলখলিয়ে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার সেই মুক্তো ঝরা হাসিতে বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ইহতিশাম।সে চায় এভাবেই যেনো হাসি খুশিতে ভরা থাকে তার কিউটির জীবন।
,
,
,
নিমগ্নচিত্তে বসে আছে সারহান।পাশেই মুখ ভার করে বিভ্রান্ত চাহনিতে শায়িখ আবদ্ধ করে রেখেছে সারহানকে।নিরুত্তাপ গলায় বললো–
“স্যার।”
সারহান কিছু একটা ভাবছে।তাই শায়িখের কথা তার কর্ণকুহর হলো না।সে ঠাঁই সেভাবেই উদাস হয়ে বসে রইলো।জান্নাহ্ এর ক্রন্দনরত চেহারা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সারহান।তার ওই চোখ ই তার জীবন।আজ তার জন্য সেই চোখেই জল।
শায়িখ কোমল গলায় ফের ডেকে উঠে–
“স্যার।”
শুনলো না সারহান।শায়িখ এইবার গলার স্বর উঁচু করে বললো–
“স্যার!
সারহান সপ্রতিভ হয়েই দিকভ্রান্তের মতো শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলো।শায়িখ যে তার পাশেই বসা বেমালুম ভুলে গেছে সারহান।বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় সারহান বললো–
“কিছু বলবে?
শায়িখ ফাইলটা হাতে দেয় সারহানের।প্রভু ভক্ত ভৃত্যের মতো বললো—
“মন্ত্রী সাহেব সব ব্যবস্থা করেছেন।আগামী শুক্রবারই আপনার ফ্লাইট।সব ব্যবস্থা করেছেন তিনি।এই খানে সব ঠিকানা আছে।আর একটা টোকেনও আছে।এইটা দেখালেই তারা আপনাকে চিনে নিবে।”
সারহান বিরসমুখে বললো—
“থ্যাংকস।”
শায়িখ গাঢ় গলায় বললো—
“আপনি আজও বললেন না কাকে খুঁজছেন আপনি!আজ এতো বছরেও কী তিনি আদৌ বেঁচে আছেন?
সারহানের ঠোঁট উল্টে কান্না পায়।নাকের পাল্লা মৃদু তালে ফুলতে থাকে।নিজের ঠোঁটকে কামড়ে ধরে বললো—
“আই উইশ মৃত্যুর আগে হলেও যেনো সে একবার আমাকে দেখতে পারে।”
গম্ভীর শ্বাস ফেলে শায়িখ।সারহানকে আজকাল বেশ বিধ্বস্ত দেখায়।কিছু একটা ভেতর থেকে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।যেখানে আগে সময় পেলেই নারীসঙ্গী খুঁজে বেড়াতো সে, আজকাল সময় পেলেই শহরের বিভিন্ন পূনর্বাসন কেন্দ্র,ব্রোথেলে ঘুরে বেড়ায়।বিভিন্ন সময় হাসপাতালের মর্গেও যায়।কোথাও কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে।অবশ্য এইসব তাকে শ্রীজা বলেছে।কারণ সারহান কে কল করে না পেয়ে এনজিওতে গিয়ে জানতে পারে আজকাল সে এখানেও তেমন আসে না।শ্রীজার সাথেও সম্পর্ক ভালো নেই।হয়তো শ্রীজার সময়ও শেষ হয়ে এসেছে তার জীবনে।একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়িখ।
মৃদু ছন্দে শায়িখ বললো—
“একটা কথা বলবো স্যার?
সারহান অস্পষ্ট কন্ঠে বললো–
“বলো।”
“আমার মনে হয় ইহতিশাম স্যারের হাতে কিছু একটা লেগেছে।”
সারহান উঠে দাঁড়ায়।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো–
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
শায়িখ অতি নির্ভয়ে ক্ষীন গলায় বললো–
“আপনার কী মনে হয় স্যার যারা আপনার প্রিয় মানুষগুলোকে খুন করেছে তারা আপনার শত্রু না শুভাকাঙ্ক্ষী?
দুর্বোধ্য হাসলো সারহান।ক্ষেপা সুরে শক্ত কন্ঠে বললো—
“ওরা কেউই আমার প্রিয় মানুষ নয়।”
“সরি স্যার।”
সারহান স্বগতোক্তি করে বললো—
“আমার জীবনে যারা এসেছে তারা সবাই নিজেদের স্বার্থে এসেছে।আমার রজনীগন্ধাও আমাকে নিজের স্বার্থে বেছে নিয়েছে।কিন্তু এতো মানুষের ধোঁকার মাঝে আমি শুধু একজনকেই ভালোবেসেছি।”
সারহানের অশ্রুসিক্ত অক্ষিযুগল নিবদ্ধ হয় প্রায় বিয়াল্লিশ ইঞ্চির জান্নাহ্ এর সেই পোট্রেটে।যাতে জান্নাহ্ সে চোখ দুটো চেয়ে আছে সারহানের দিকে।
সারহানের মৌনতায় শায়িখ আবার বললো–
“আপনি গেলে ভাবীজানের কী হবে?
সারহান সহজ হয়।জান্নাহ্ থেকে চোখ ফিরিয়ে ঝরা হেসে বললো–
“সামনেই তার পরীক্ষা।বাড়িতে রেখে আসবো তাকে।ইন্ডিয়া থেকে ফিরলে আবার নিয়ে আসবো।”
নিজের উত্তর পেয়ে আশ্বস্ত হয় শায়িখ।সারহান ঝরঝরে গলায় বলে উঠে–
“জিঙ্গেস করলে না যারা ওদের খুন করেছে তারা আমার কী!
শুভাকাঙ্ক্ষী।সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী।”
রহস্য হাসে সারহান।তার সেই ভয়ংকর নৈঃশব্দের হাসিতে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠে শায়িখ।
চলবে,,,