জান্নাহ্,পর্বঃ৩৫,৩৬

0
1342

জান্নাহ্,পর্বঃ৩৫,৩৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৩৫

এলোথেলো বাতাস বইছে।তাতেও রাজ্যের উষ্ণতা।প্রকান্ড টিনের নিচে ঝুলানো ফ্যানের বাতাস যেনো প্রভাকরের রশ্মি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে।দ্রুতগতিতে ফ্যান ঘুরলেও তার বাতাসে শীতলতার চেয়ে উষ্ণতাই বেশি।

চৈত্রের শেষ হয়ে বৈশাখের শুরু।গুমোট গরমে হাঁসফাঁস করা জনজীবন।একটু প্রশান্তির জন্য বৈদ্যুতিক ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের নিচে বসে আরামের জন্য।তা কি সূর্য্যি মামার সয়!গনগনে লাভায় যেনো ধরণী রুদ্ধশ্বাস।

বিছানায় শুয়ে আছে হুসনা।তাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে জান্নাহ্।খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে দেয়।ক্লান্ত গলায় জান্নাহ্ বললো–

“আজ আমি চলে যাবো মামি।”

হুসনার কিছু বলার ক্ষমতা নেই।তার চোখ দুটোই তার সহায়।চোখের পাতা উঠানামা করে তার ব্যগ্রতা বোঝালেন।ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।আনন্দিত গলায় বললো–

“যেতেই হবে।দুদিন পর থেকে পরীক্ষা।পরীক্ষায় আন্ডা পেলে সারহান খুব রাগ করবে।”

হুসনা তার চোখ দিয়ে আবার কিছু বোঝাতে চাইলেন।জান্নাহ্ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো—

“রিসিভ করিনি তো।কেন করবো?সে যদি আমাকে ভুলে থাকতে পারে আমি কেন পারবো না!সে থাক তার কাজ নিয়ে।তোমার এইসব ভাবতে হবে না।আমি সামলে নিবো।”

হুসনা অনেক কষ্টে গলায় অস্ফুট আওয়াজ তুললো।চোখের পাল্লা নাড়াতে থাকলো।জান্নাহ্ সরব গলায় বললো–

“হুম,হুম।আপু কালই আসবে।এইবার আপু আসলে ধরে বিয়ে দিয়ে দিবো।আর তোমাকেও ইটালি পাঠাবো।তোমার মনে আছে বাবার বন্ধু সম্রাট আঙ্কেলের কথা!আমি কথা বলেছি তার সাথে।সে সব ব্যবস্থা করে দিবে।তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”

চোখ দিয়ে খুশির অশ্রু নির্গত করলেন হুসনা।জান্নাহ্কে দেখলেই তার সমস্ত কষ্ট যেনো খুশিতে পরিণত হয়।সে না হয় তার জীবন কাটিয়ে ফেলেছে।কিন্তু সেদিন যদি জান্নাহ্ এর সাথে কিছু হতো!
মোড়ার উপর বসা থেকে হালকা উঁচু হয় জান্নাহ্।দুই হাত আলতো করে হুসনার চোখের পানি মুছিয়ে কপট অভিমানি গলায় বললো—

“কাঁদছো কেন তুমি?একদম কাঁদবে না।কাঁদলে তোমাকে একদম ভালো দেখায় না।”

ঝকঝকে হাসে জান্নাহ্।হুসনার কানের কাছে গিয়ে নরম সুরে বললো—

“পরীক্ষা শেষ হলে আবার আসবো।আর সাথে গুড নিউজ নিয়ে আসবো।”

চমৎকার হাসে জান্নাহ্।হুসনার আগ্রহদীপ্ত চোখ দুটি যেনো চকচক করে হাসছে।পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকায় জান্নাহ্।শুক্তাকে রেখেছে হুসনার দেখাশোনা করার জন্য।তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয় জান্নাহ্।সরস হেসে শুক্তা বললো–

“টাকা লাগবো না আফা।চাচা আমারে বেতন দিয়া দিছি।”

জান্নাহ্ স্মিত হেসে বললো–

“এগুলো বেতন না।তোমার বোনাস।আমি দিলাম।মামিকে এতো যত্ন করে রাখার জন্য।আজ আমি চলে যাচ্ছি।মামির খেয়াল রেখো।তোমার কিছু দরকার হলে মামাকে বলো।”

শুক্তা উচ্ছল হাসলো।প্রসন্ন গলায় বললো–

“আফনে যদি আমার ছোডো না হইতেন তাইলে আমনেরে সালাম করতাম।আফনে টাকা না দিলে আমার মায় তো মইরাই যাইতো।”

জান্নাহ্ গাঢ় গলায় বললো–

“তুমি আমার মায়ের খেয়াল রাখছো তাই আমি তোমার মায়ের খেয়াল রেখেছি।শোধবোধ।এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।”

ঝকঝক করে হেসে উঠে শুক্তা।জান্নাহ্ তার মামির কপালে আলতো চুমু খায়।তার নিথর পা দুটো তে সালাম করে বিদায় নেয়।

,
,
,
দু’ধারে লম্বা লম্বা গাছ।সড়ক পথে ঝড়ো গতিতে চলছে গাড়ি।জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে বাতাসে শ্রীজার সিল্কি চুলগুলো উড়ছে।গাজীপুরে একটা কাজ আছে।সেই সূত্রে শ্রীজাকে জরুরি ভিত্তিতে যেতে হচ্ছে।তাই দেরি না করে শায়িখকে নিয়েই বের হয়।

স্বাভাবিক গতিতে চলছে শ্রীজার গাড়ি।হাতে থাকা জরুরি কাগজগুলো ভালো করে চেক করে নিচ্ছে যেনো কোনো ঝামেলা না হয়।গলাটা শুকিয়ে আসে শ্রীজার।খুসখুসে কাঁশি হতেই গলাটা কেমন জড়িয়ে আসে।শায়িখ সামনের সিটে থাকা পানির বোতলটা শ্রীজাকে এগিয়ে দেয়।খরা জমিনে বর্ষণের মতো ঝরলো তা।ঢকঢক করে পানি গিলে একটা বড় নিঃশ্বাসে নেয় শ্রীজা।মুহূর্তেই গা গুলিয়ে উঠে তার।মুখে হাত চেপে ধরে উ উ শব্দ করে গাড়ি থামাতে বলে শায়িখকে।শায়িখ গাড়িটাকে সাইডে চাপিয়ে ব্রেক লাগায়।দমদমিয়ে গাড়ি থেকে বের হয় শ্রীজা।মুখভর্তি বমি করে।ফোঁস ফোঁস করে দম ফেলছে।দাঁতখামটি মেরে পেছনে তাকিয়ে বললো—-

“শায়িখ,পানিতে কী মিশিয়েছো?

শায়িখের উত্তর শ্রীজার কানে পৌঁছানোর আগেই একটা মিষ্টি মেয়েলী সুর শুনতে পায় শ্রীজা।

“শ্রীজা।”

চকিতে পেছন ফিরে তাকায় শ্রীজা।কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই ধারালো কিছু একটা স্ষ করে চলে যায় শ্রীজার গলা ছুঁইয়ে।দুই হাতে গলা চেপে ধরে ছোট ছোট ঘাসের উপর বসে পড়ে সে।রাস্তার পাশে স্বল্পদৈর্ঘ্য জঙ্গল।বিকলে নেমেছে দিবসে।সূর্য্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে।কমলা রঙের আভায় ছেয়েছে আকাশ।নীলাভ আকাশ কালচে নীলাভে রূপ নিয়েছে।তাতেই বেশ স্পষ্ট করে মেয়েটিকে দেখছে শ্রীজা।

শ্রীজার দুই উদ্ভাসিত নজর সামনের সেই নীল চোখের মেয়েটির দিকে।চোখের পাতা ভিজে উপচে পড়ছে আর্তনাদের পানি ।শ্রীজার মুখ দিয়ে গরগর শব্দ বের হচ্ছে।গলার মাঝ বরাবর সে বিভক্ত জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরেছে সে।সেখান থেকে গলগলিয়ে বের হচ্ছে উষ্ণ,ঘন,নোনতা তরল।গলার দুই পাশের ব্যাকবোনের সন্ধিস্থলের জায়গাটুকু একবার দেবে যাচ্ছে তো আরেকবার ফেঁপে উঠছে।তার শ্বাস ধীরে ধীরে তার গতি কমিয়ে ভারি হয়ে যাচ্ছে।

সামনে হাঁটু ভাঁজ মেয়েটি নিরুত্তাপ চোখে শ্রীজাকে দেখছে।তার অধরে হিংস্রতার তাচ্ছিল্য হাসি।শ্রীজার নিঃশ্বাস ক্ষীন হতে থাকে।মেয়েটির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা হুডি পড়া লোকটির বৃদ্ধা আঙুল সমানতালে কেঁপে যাচ্ছে।মৃত্যুর সাথে লড়াই করে কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই শ্রীজার আত্না তার দেহ ত্যাগ করে।মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।কোমর পর্যন্ত ছড়ানো খোলা চুল,ভেতরে স্লিভলেস গেঞ্জি তার উপরে ফুল স্লিভের কালো জ্যাকেট।বুক পর্যন্ত জ্যাকেটের জীপার আনলক করা।একটা ব্রাশ জিন্স।উঁচু হাই হিল পড়া।
হাতের রক্ত মাখানো ছুরিটা ভাবলেশহীন ভাবে শ্রীজার নিথর দেহের উপর ছুঁড়ে ফেলে।

ফোঁস করে এক দম ফেলে মেয়েটি।চোখ দিয়ে পানি পড়ার আগেই দৃঢ়চিত্তে তা মুছে নেয়।সামনে এগোতে থাকে মেয়েটি।তার হাই হিলেও কোনোরূপ ছন্দপতন হলো না।ভেজা চোখ থেকে লেন্সগুলো খুলে রাস্তার উপর ছুঁড়ে ফেলে।গাড়িতে গিয়ে বসে মেয়েটি।ড্রাইভিং সিটে বসা অতি পরিচিত মানুষটি ফ্রন্ট গ্লাসে তাকাতেই মেয়েটির গম্ভীর মুখটি দেখতে পায়।মৃদুহাস্য অধরে তৃপ্তির চাহনিতে তাকায় মেয়েটির দিকে শায়িখ।

হুডিওয়ালা লোকটি শ্রীজার প্রাণহীন দেহটিকে জঙ্গলের একটু ভেতরের দিকে নিয়ে গেলো।তার ফর্সা মুখের উপর সামান্য এলকোহল ছিটিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।মানুষের মাংস পোড়ার অদ্ভুত,বিদঘুটে গন্ধটা এসে নাকে ঠেকে মেয়েটির।তার চোয়াল শক্ত হয়।শায়িখ নরম চোখে তাকিয়ে গাড়ির স্টেয়ারিংএ হাত দেয়।

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

শান্ত নদী বয়ে চলছে অবিরাম।তার পাড় ঘেঁষেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল আর সুপারি গাছ।তা মাঝে ছোট ছোট বুনো গাছ জড়িয়ে আছে দুই,তিন ফুটের বড়ই গাছে।তাল গাছের ছড়ানো পাতা দেখলে মনে হয় যেন জীবন্ত হাত পাখা ঝুলছে।সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেক বাকি।আজকের বিকেলটা চমৎকার।ভ্যাবসা গরমের পরিবর্তে একটা স্নিগ্ধ পবন মুড়ে রেখেছে তপ্ত পরিবেশকে।নদীর পানিতে ঢেউ খেলছে।সেই ঢেউয়ের তালে পানি সর্পিলকারের আঁছড়ে পড়ছে পাড়ে।তাতে মৃদু ছন্দ তুলছে।

সেই স্নিগ্ধ,শীতল,ফুরফুরে বাতাসে রাফাতের ঝাঁকড়া চুলগুলো উড়ছে।আবেগশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর পানে।নদীর মধ্যখানে একটা পালতোলা নৌকা।দুটো ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসে আছে।মৃদুহাস্য অধরে ভ্রু নাচায় রাফাত।তার পাশেই গম্ভীর চাহনিতে রাফাতকে পর্যবেক্ষণ করছে ইশাক।সন্তর্পনে রাফাতকে জিঙ্গেস করলো–

“কী ভাবছিস তুই?

রাফাত কিঞ্চিৎ অধরের কোণ বাঁকায়।ব্রাউন রঙের পোলোশার্টের কলারটা টানদিয়ে নামিয়ে নরম ঘাসের উপর হাতের ভর দিয়ে পেছনে হেলান দেয় রাফাত।নদীর পাড়ের সাথেই পাকা রাস্তা।দশ ফিটের প্রশ্বস্ত রাস্তার এই পাড়ে নদী আর ওই পাড়ে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত।রাস্তার দুই ধারের গাছের শীতলতায় প্রায়ই ডুবন্ত বিকেলে মানুষ নদীর পাড়ে এসে বসে সময় কাটায়।স্মিতহাস্য অধরে রাফাত প্রানবন্ত গলায় বললো—

“জান্নাহ্ ফিরেছে।”

চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত করে অতি উৎসুক গলায় ইশাক বললো—

“তুই কী করে জানলি?

রাফাত বিরস হাসে।ইশাকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সহজ গলায় বললো–

“নিধি বলেছে।”

ইশাক যেনো এটাই ধারণা করেছিলো।হেয়ালি গলায় বললো–

“ও।”

ইশাক নদীর দিকে তাকালো।সরস হাসলো সে।সোজা বললো–

“তাহলে এখন কী করবি?

রাফাত গাঢ় গলায় বললো–

“পরীক্ষা চলছে জান্নাহ্ এর।”

“তো?

রাফাত সাবলীলভাবে বললো–

“ওকে আমি কোনো টেনশন দিতে চাই না।ভালো করে পরীক্ষা দিক।তারপর কথা হবে ওর সাথে আমার।আমার প্রশ্নের উত্তর আমার চাই।”

থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে ইশাক—

“কী করবি তুই?

রহস্য হাসলো রাফাত।গম্ভীর গলায় বললো—

“সারহানের সাথে দেখা করবো আমি।”

ইশাক লাফিয়ে উঠে বললো—

“পাগল হয়েছিস!

একটা দমকা বাতাস মুখে লাগতেই রাফাতের ঝাঁকড়া চুলগুলো নড়ে উঠলো।চমৎকার হাসলো সে।খানিকক্ষন চুপ থেকে সরব গলায় বললো—

“জান্নাহ্ ওর পরিচয় লুকিয়ে রেখেছে।কেন বলতো?সারহানের মতো দশটা ছেলেকে কেনার ক্ষমতা আছে জান্নাহ্ এর।তবুও একটা অসহায় মেয়ের মতো কেন পড়ে আছে ওই বাড়িতে?জান্নাহ্ সারহানকে ভালোবাসে।কিন্তু সারহান কাউকে বিয়ে করতে চায়নি।কেন?
এমন তো নয় সারহানের বিয়ের বয়স হয়নি।জান্নাহ্কে দেখেই কেন বিয়েতে রাজী হলো?জান্নাহ্ তখন মাত্র ফিফটিন ছিলো।জান্নাহ্ কেন তার পরিচয় লুকিয়ে সারহানকে বিয়ে করলো?

উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে ইশাক।ঝট করেই বললো–

“হয়তো জান্নাহ্ এর পরিচয় জানলে ওরা জান্নাহ্কে সারহানের সাথে বিয়ে দিতো না।”

রাফাত নিরুত্তাপ গলায় বললো–

“তেমন নয়।সারহানের মা পাঁচলক্ষ টাকা যৌতুক নিয়েছে।আমার রেড চেরি কোনো দিক দিয়ে কম না যে তাকে টাকা দিয়ে বিয়ে করতে হবে।সারহান কী সত্যিই জানে না এই বিষয়ে?

ইশাক খেঁপে গিয়ে নিজের হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো আউলাঝাউলা করে ব্যগ্র গলায় বললো–

“মাফ চাই।এতো প্যাঁচাল পারিস না।ক্লিয়ার কইরা ক।”

রাফাত দুর্বোধ্য হাসলো।ভারি গলায় বললো–

“আঙ্কেল,আন্টির মৃত্যুর পর পুরো হসপিটাল বন্ধ করে দেওয়া হয়।যেই হসপিটাল আঙ্কেলের স্বপ্ন ছিলো।আমি আর জান্নাহ্ দুই জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ডক্টর হয়ে সেখানেই জয়েন করবো আমরা।
জান্নাহ্ এর বিয়ে হয়েছে একবছর।কিন্তু ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে প্রায় আঠারো মাস।কোথায় ছিলো এই ছয় মাস?ওর মামার কাছে!যদি তাই হয় তাহলে এতোদূর কী করে বিয়ে হলো জান্নাহ্ এর।প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা পথ পাড়ি দিতে হয়।”

ইশাক জিঙ্গাসু গলায় বললো–

“কোথায় থাকে জান্নাহ্ এর মামারা?

“দোহার।”

“তুই গিয়েছিলি?

“নাহ।কিছুদিন আগেই জানলাম।”

ইশাক তাড়া দিয়ে বললো–

“তাহলে চল আমরাও যাই।”

শান্ত চোখে তাকালো ইশাকের দিকে রাফাত।আপত্তির সুরে বললো–

“নাহ।আমার প্রশ্নের জবাব আমি ওর কাছ থেকেই নিবো।

মৃদু কম্পনরত গলায় ইশাক বললো—

“তুই আসলে কী জানতে চাইছিস বলতো?

উন্মনা হয়ে আকাশের দিকে তাকায় রাফাত।সন্ধ্যা নেমেছে আরো আগেই।লালচে আভা বক্রকার হয়ে বিছিয়ে আছে পুরো আকাশ।তার মাঝেই একটা কালো রঙের পাখি উড়ে যাচ্ছে।ওপাড়ের দৃশ্য এখন আর চোখে স্পষ্ট নয়।অন্ধকার ঘনিয়ে দিনের আলো সরিয়ে রাতের মায়া জড়াচ্ছে প্রকৃতিকে।বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে।আচমকাই তাল গাছের পাতা জোরালো শব্দ করতে থাকে।বাতাসে ঝংকারের সৃষ্টি হয়।তীব্র বাতাসে গাছের মস্তিষ্ক যেনো লড়াই শুরু করে।নদীর পানিতে উত্তাল ঢেউ শুরু হয়।শান্ত রাস্তা হতে ধূলো এসে মাখিয়ে দেয় রাফাত আর ইশাককে।চোখ ডলতে থাকে দুই বন্ধু।বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ বলছে ঝড় হবে।ভয়ংকর ঝড়।ইশাকের উত্তর প্রকৃতি দিয়েছে।কিন্তু তা কী ইশাকের বোধগম্য আদৌও হয়েছে?
,
,
,
বিছানায় নম্র হয়ে বসে আছে জান্নাহ্।অনবরত সারহানের কলে বিরক্ত সে।আজ বারোদিন।কথা বলে নি জান্নাহ্ সারহানের সাথে।যতবার কল করেছে মোবাইলটাকে সামনে রেখে শুধু চেয়ে থাকে।পুড়ছে তার মন সেই সাথে ক্ষয় হচ্ছে অনুভূতি।কিন্তু ভালোবাসা যে দুর্লভ সোনার মতো।পুড়তে পুড়তেই খাঁটি হয়।

মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে জান্নাহ্ এর।পরীক্ষা আসার পর রাত জাগতে হয়।দুই হাতে কপালের দুই পাশ চেপে বসে আসে।কিন্তু তার কাতর,স্থির দৃষ্টি মোবাইলে।এই নিয়ে আজকে সারাদিনে ষাটবার কল করেছে সারহান।কিন্তু জান্নাহ্ বজ্রকঠোর।চকিতে তার ধ্যান ভাঙে তিতির চিকন আহ্লাদী কন্ঠে।

“পরীমা,পরীমা!

পা দুটো ছড়িয়ে সহজ হয়ে বসে জান্নাহ্।ঝপাৎ করে তার কোলে এসে পড়ে তিতি।মিষ্টি গলায় চোখের পাতা চড়িয়ে বললো—

“আমাকে খাইয়ে দাও।”

জান্নাহ্ গম্ভীর মুখে বললো–

‘তুমি এখনো খাওনি তিতি?

তিতি ডান হাতের লাল চুড়িগুলোতে বা’হাতের আঙুল ঢুকিয়ে সজোরে টান দিতে দিতে স্বশব্দে বললো-

“না।খাইয়ে দাও।”

বিব্রত হয় জান্নাহ্।রাত এগারোটা বেজে গেছে মেয়েটা এখনো খায়নি।দুই হাত দিয়ে তিতিকে কোল থেকে সরিয়ে বিছানায় বসায়।তিতির উলুথুলু চুলের মাঝে হাত দিয়ে সিঁথি করে দেয়।ঝকঝকে হাসে তিতি।জান্নাহ্ মায়াভরা গলায় বললো—

“তুমি বসো,আমি খাবার নিয়ে আসি।”

জান্নাহ্ তার দুই কোমল পা বাড়াতেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠে।দু’একদিন ধরে এমনটাই হচ্ছে।চঞ্চল পা দুটো দ্রুত চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।বিছানায় বসা তিতি তা দেখেই ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করে।প্রায় মিনিট পাঁচেক ওয়াশরুমে অতিবাহিত করে রুমে আসে জান্নাহ্।পুরো মুখ জুড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানির বিন্দু।ঠান্ডা পানির ঝাঁপটা দেওয়াতে ভালো লাগছে এখন।জান্নাহ্ অবাক হয় সামনেই ভ্রু বাকিয়ে দাঁড়ানো শুভ্রাকে দেখে।শুভ্রা শশব্যস্ত হয়ে সন্দিগ্ধ গলায় বললো–

“কী হয়েছে তোর?

জান্নাহ্ নিরুদ্বেগ গলায় বললো–

“তেমন কিছু নাতো।কেন?

শুভ্রা সরল গলায় বললো—

“তিতি বললো তুই নাকি বমি করছিস।”

জান্নাহ্ দ্বিধান্বিত গলায় বললো–

“আসলে কয়েকদিন ধরে রাতে পড়ছি তো,ঘুম কম হচ্ছে।তাই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।”

আশ্বস্ত হতে পারলো না শুভ্রা।সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো–

“সত্যিই কিছু হয়নি তো!

জান্নাহ্ খেয়াল করে ছোট্ট তিতি তার মায়ের কাপড় খামছে ধরে জলভরা চোখে ঠোঁট উল্টো করে দাঁড়িয়ে আছে।জান্নাহ্ নিচু হয়ে তিতিকে কাছে টেনে নেয়।মখমলে গলায় বললো—

“কী হয়েছে তিতি সোনা!দেখো পরীমার কিচ্ছু হয়নি।একদম ঠিক আছি।”

তিতি পিঠ ভেঙে ঝুঁকে জান্নাহ্ এর গলা জড়িয়ে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে।জান্নাহ্ ওর পিঠের দিকটায় হাত দিয়ে ঘষতে থাকে।মোবাইলে আবার রিং বাজতে থাকে।শুভ্রা মেয়েকে টেনে নিয়ে জান্নাহ্কে উদ্দেশ্য করে বললো–

“সারহান কল করেছে বোধহয়!রিসিভ কর।”

জান্নাহ্ ফিকে গলায় বললো–

“তিতির খাওয়া…।”

শুভ্রা আশ্বস্ত গলায় বললো–

“তোকে ভাবতে হবে না।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

কল রিসিভ করার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলো শুভ্রা।তাই বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করে জান্নাহ্।তিতিকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয় শুভ্রা।
জান্নাহ্ ছোট্ট দম ফেলে মোলায়েম গলায় বললো–

“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না।শুধু ক্ষীন নিঃশ্বাসের ছন্দপতন হচ্ছে।জান্নাহ্ আবারও নম্র গলায় বললো—

“হ্যালো।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে থমথমে গলায় সারহান বললো–

“এতোটা পাষাণ কী করে হলেন রজনীগন্ধা!আমি তো আপনার গায়ে পাষাণ প্রেয়সীর তকমা কখনো লাগাইনি।”

জান্নাহ্ এর বিপরীতে কিছু বললো না।ধুম ধরে বসে রইলো।ফ্যানের নিচে বসলেও তার চোখে মুখে কেমন উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলো।আদৌ কী তা পরিবেশের উষ্ণতা না তা হৃদয়ের দহনের তা সে বোঝে না।সারহানের বিষন্ন কন্ঠে কান্না পেলো জান্নাহ্ এর।ঘোলা চোখে উদ্দেশ্যহীনভাবে পুরো ঘরে নজর বিলাতে থাকে।ঠোঁট কামড়ে কান্না রোধ করে জান্নাহ্।
জান্নাহ্ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে সারহান ওপাশ থেকে বিরস হেসে বিতৃষ্ণা গলায় বললো–

“আমাকে পুড়িয়ে কতটুকু শান্তি পাবেন রজনীগন্ধা?যে দহনে আমায় পুড়াবেন তার আঁচ যে আপনাকেও সহ্য করতে হবে।”

জান্নাহ্ ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে লাগলো।চেনা পরিবেশটা হঠাৎ অচেনা মনে হলো।বুকের হাহাকার বাড়তে লাগলো তার।স্মিত ধারায় গড়িয়ে পড়া জলধারা ক্রমশ বাড়তে লাগলো।সারহান তার নয়নযুগল নিমীলিত করে।বদ্ধ চোখে ভেসে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।সে হাস্যোজ্জ্বল দুই চোখ।আবেগভরা গলায় আর্তনাদ মিশিয়ে সারহান বললো–

“কী করে পারলেন এমনটা করতে!এই বারোটা দিন একবার আপনার মনে হলো না আমি আপনাকে ছাড়া অচল!

জান্নাহ্ কিছু বললো না।কান্না গিলে নিয়ে আবেগশূন্য দৃষ্টিতে এলোমেলো তাকালো।সারহান দৃঢ়হয়ে বললো—

“আমি নিজেকে বদলাতে চেয়েছি অনেকবার।কিন্তু দ্বিতীয় সুযোগ আমি পাইনি।আমি নিজে যায়নি আপনার কাছে।আপনি নিজে এসে করা নেড়েছেন আমার বন্ধ দ্বারে।গত দুইমাসে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশিয়েছেন নিজেকে।আমার পঁচা নর্দমায় পদ্মফুল হয়ে ফুটেছেন।এখন কেন মেনে নিতে পারছেন না আমাকে?নাকি আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আপনার জীবনে?

সারহান থামলো।জান্নাহ্ এর মুখ নিঃসৃত ধ্বনি বলছে সে কাঁদছে।সারহান কঠিন গলায় বলে উঠে—

“তবে যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আপনি ভুল করছেন।আমার জীবনে আপনার প্রয়োজন কখনো ফুরাবে না।কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনাকে আমি ছাড়ছি না।যে সুযোগ আপনাকে আমি দিয়েছি তা আপনি কাজে লাগান নি।নাউ মাই টার্ন।নিজেকে আপনার যোগ্য করার চেষ্টা আমি করছি।শুধু একটা সুযোগ চাই আমি।ভালো থাকবেন।”

কল কাটতেই ডুকরে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।উত্তাল নদীর মতো উথলে উঠছে তার নয়নাসার।তার মেদহীন পেটের উপর আলতো হাত রেখে ক্রন্দনরত গলায় স্বগতোক্তি করে উঠে—

“আমি দিলাম আপনাকে সুযোগ সারহান।আপনি আমার প্রাণ হয়ে ফিরে আসুন।প্লিজ ফিরে আসুন।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here