জান্নাহ্,পর্বঃ৩৯,৪০

0
1434

জান্নাহ্,পর্বঃ৩৯,৪০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৩৯

হসপিটালের করিডোরে উৎসুক জনতার ভীড়।একটু আগেই একটা লাশ বের করা হয়েছে ওটি থেকে।তার সার্জারি চলছিলো।কিন্তু ডক্টররা কিছু করার আগেই পেশেন্ট এর অবস্থা এতোটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি।কিন্তু পেশেন্টের পরিবার তা মানতে চায় না।তাদের ধারণা ডক্টররা ইচ্ছে করে এইসব করেছে।কারণ যখন গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটাকে হসপিটালে আনা হয় তখন নাকি হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পুলিশ কেস বলে গড়িমসি করতে থাকে আর এতেই মেয়েটির মৃত্যু ঘটে।কিছু কিছু জনতারা এতোটাই উত্তেজিত যে হসপিটালের করিডোরের ওয়েটিং চেয়ার,নার্সদের হাতা থাকা সার্জারি ট্রে সব ভেঙেচুরে একাকার করে ফেলছে।কিছুতেই যখন থামানো যাচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে কল করা হয়।পুলিশ আসতেই ধীরে ধীরে সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আসে।

আর এ সবকিছুই নির্ভয়চিত্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো মেহনাজ।এইসব তার কাছে নতুন নয়।দিল্লীর একটা নামি হসপিটালের সিনিয়র নার্স সে।তার আন্ডারে প্রায় অর্ধ শতাধিক জুনিয়র রয়েছে।সে একজন ট্রেইনারও।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাবিনে ঢুকে মেহনাজ।
হুসনা বেডে শুইয়ে আছে।একটা চেয়ার টেনে তার কাছে বসে মেহনাজ।হুসনার হাতটা ধরে পরম আদুরে গলায় প্রশ্ন করে—

“চিন্তুা হচ্ছে?

হুসনা চোখের পাল্লা ফেললো দুইবার।মেহনাজ মিষ্টি হেসে আশ্বস্ত গলায় বললো—

“ডোন্ট ওয়ারি মা।সব ঠিক হয়ে যাবে।অপারেশনের পর তুমি আবার হাঁটতে পারবে।ডক্টর যে টেস্ট গুলো করিয়েছে তার সবগুলোর রেজাল্ট পজিটিভ।”

হুসনা মলিন হাসলো।তার চোখে উজ্জ্বলতা।ত্রস্ত পায়ে ক্যাবিনে ঢুকলো শরীফ।মৃদু গলায় বললো—

“ডক্টর বললো সব ঠিক আছে।আমরা ইচ্ছে করলেই তোর মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি।”

ম্লান হাসলো মেহনাজ।চোখে থাকা মাইনাস পাওয়ারের চশমাটা ঠিক করে নির্মল গলায় বললো–

“ওয়েল।আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।তুমি মাকে নিয়ে যাও।”

শরীফ ভ্রু কুঞ্চি করে জিঙ্গাসু গলায় বললেন–

“তুই যাবি না বাড়িতে?

মেহনাজ খসখসে গলায় বললো–

“নাহ।আমার ছুটি শেষ হয়ে এসেছে।আমাকে দিল্লী ফিরে যেতে হবে।”

“তাই বলে..।”

শরীফকে কথা শেষ করতে দিলো না মেহনাজ।কাঠখোট্টা গলায় বললো—

“আমাকে তোমার কী প্রয়োজন বাবা?তোমার জান্নাহ্ আছে তো।”

মেহনাজ দাঁড়ালো না।চাপা কান্না উগরে আসার আগেই ক্যাবিন থেকে বেরিয় এলো।শরীফও মেয়ের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো।মেহনাজের কাঁধে হাত রাখতেই তেঁতে উঠে সে।রুক্ষ গলায় বললো—

“প্লিজ,বাবা।এমন কিছু বলবে না যা আমি রাখতে পারবো না।”

শরীফ অনুনয় করে বললো—

“একবার অন্তত চল।জান্নাহ্ তোর সাথে দেখা করতে চায়।মেয়েটা কতো আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।”

তাচ্ছিল্য হাসে মেহনাজ।বাবার দিকে পূর্ণ নজর ক্ষেপন করে বললো—

“হাসালে বাবা।একটা কথা বলবে বাবা,আমার একটা ভুলে আমার গায়ে হাত তুলেছিলে তুমি।আর জান্নাহ্!এতো বড় একটা নাটক করলো তুমি ওকে বাঁধা দেওয়ার বদলে উল্টো ওর নাটকে পার্টিসিপেট করলে!

শরীফ তেজী গলায় বললো–

“মেহনাজ!

মেহনাজ নাক ফুলিয়ে দমদমে গলায় বললো—

“জান্নাহ্কে তো অস্কার দেওয়া উচিত।কোটিপতির মেয়ে হয়েও একটা অনাথ,দরিদ্র মেয়ের অভিনয় করে যাচ্ছে।সমাজে চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে বাবা মায়ের মৃত্যুর পর মামা,মামির চক্ষুশূল ভাগ্নিকে টাকার বিনিময়ে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলে শান্তি।এমনটাই সাজিয়েছিলে না পুরো নাটকটা?

গর্জে উঠে শরীফ।তার এহেন আচরণে হসপিটালের নার্স চোখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো।এমন চাহনিতে বিব্রত হয় শরীফ।নিজেকে শান্ত করে শান্ত সুরে কঠোর গলায় বললেন—

“জান্নাহ্ সারহানকে ভালোবাসে।আর ওরা সত্যি জানলে কী সারহানের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতো!শুধু শুধু জল ঘোলা হতো।তাই এমনটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।”

উপহাসমিশ্রিত হাসে মেহনাজ।নিষ্কম্প গলায় জিঙ্গাসুসূচক হয়ে বললো—

“ভালোবাসায় নাটক করার কী প্রয়োজন!ওই ছেলেকে ভালোবাসার কোনো স্পেশাল কারন?রাফাত!রাফাতের দোষ কোথায়?

শরীফ প্রতিবাদের সুরে বললো–

“তোকে এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।ওকে ওর মতো থাকতে দে।মেয়েটা এমনিতেও অনেক কিছু সহ্য করেছে।”

অধর কোণে বিপন্ন হাসে মেহনাজ।গম্ভীর গলায় বললো—

“এতো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে জান্নাহ্ ঠিকই তার ভালোবাসা পেলো।আর আমি!বিশ্বাস করে বারবার ধোঁকা খেয়েছি।আমার সাথেই এমন কেন হলো বলোতো!

মেহনাজের চোখে উবরে আসে শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণ।ঝাপসা চোখে করিডোর থেকে সে দেখতে পায় স্ট্রেচারে করে একটা রোগীকে হসপিটালে ভেতরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে।নিজের ভাগ্যের উপর বেদনাগ্রস্ত হাসি আসে মেহনাজের।প্রথমবার কাউকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে যখন হৃদয়টা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো সেই ভাঙা মন নিয়ে দ্বিতীয়বার যখন কাউকে উজার করে ভালোবাসলো সেও তাকে ধোঁকা দিলো।সেই ধোঁকাটাও এতোই গভীরভাবে তাকে বিক্ষিপ্ত করলো এই মনে সে আর কোনোদিন কাউকে জায়গা দিতে পারবে।যে ক্ষতের অস্তিত্ব সে তার শরীরে বহন করে তা কোনো দিন মুছার নয়।
,
,
,
অন্তরার খুশি যেনো আজ সাত অসমান ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।যখন থেকে জানতে পেরেছে জান্নাহ্ কনসিভ করেছে কী থেকে কী করবে ভেবে পায় না সে।পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছে গত একদিনে।জান্নাহ্কে না পারে মাথায় তুলে রাখতে।
জমিরের বুকটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠে।সে দাদুভাই হতে চলেছে।পুরো ঘরের খুশির আমেজ তিতি বুঝতে না পারলেও ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে সে।জাবিনের মুখে হাসি।আফটার অল তার ভাই বা বোন আসতে চলেছে।যদিও ব্যপারটার একটু অকওয়ার্ড।তবুও জাবিন বেশ খোশমেজাজে আছে।জান্নাহ্ এর জন্য একগাদা আচার কিনে এনেছে।জান্নাহ্ জিঙ্গেস করতেই বললো,সে নাকি মুভিতে এমনটা দেখেছে।প্রেগন্যান্সিতে টক খেতে ভালো লাগে।তাই।তার এই বাচ্চাসুলভ আচরণে হেসে কুটুকুটি হয় জান্নাহ্।তার অবশ্য একটু লজ্জাও করছে।কী একটা সাংঘাতিক ব্যাপার!ষোড়শী জান্নাহ্ মা হতে চলেছে।ইশ!আর কয়েকদিন পর তারও একটা পিচ্চি বাবু হবে!ভাবতেই গা নেচে উঠে জান্নাহ্ এর।তার আর তার প্রাণের অংশ আসতে চলেছে।এখন আর তার শাশুড়ি তাকে কথা শুনাতে পারবে না।বাড়ির সবার মনে খুশির মোলায়েম,স্নিগ্ধ ভালোবাসার হাওয়া বইলেও কেউ একজন একদমই খুশি হয়নি এই খবরে।তার এতো বছরের সব পরিকল্পনা এক নিমিশেই ধূলিসাৎ করে দিবে জান্নাহ্ আর সারহানের অনাগত সন্তান।তা সে কিছুতেই হতে দিবে না।

জান্নাহ্ এর প্রাণবন্ত হাসিতে যেনো স্বর্গ নেমেছে আজ এই বিরাণ বাড়িতে।কিন্তু জান্নাহ্ জানে না তার এই খুশি ভয়ংকর ঝড় তুলবে তার প্রাণের জীবনে।সেই ঝড়ে চিরতরে শেকড় হতে উপরে যাওয়া গাছের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তার প্রাণের অস্তিত্ব।

হাসির ফোয়ারা বইছে জান্নাহ্ এর।গত এক ঘন্টা যাবৎ কথা বলছে সারহানের সাথে।সারহান আজ বেশ খুশি।কিন্তু কেন তা সে জানে না।কথার মাঝেই তিতি ওর আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—

“পরীমা,পরীমা।”

সারহানের সাথে কথা শেষ করে মোবাইল রাখে জান্নাহ্।তিতিকে কোলে তুলে নিয়ে খুশি খুশি গলায় জিঙ্গেস করে—

“কী হয়েছে তিতি?

তিতি ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো—

“আঙ্কেল এসেছে।”

“কোন আঙ্কেল?

“তায়িখ।”

খিলখিলিয়ে উঠে জান্নাহ্।তিতির গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো—

“শায়িখ।বলো।শা,,য়িখ।”

“শাআআয়িখ।”

“আমার পাখিটা।চলো।”

শায়িখ ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসেই কলারটা ছড়িয়ে দেয়।ঘামে ভিজে জামাটা ঝাপ্টে আছে তাকে।এক থালা মিষ্টি এনে রাখে তার সামনে শুভ্রা।অনেক বিস্ময় নিয়ে হতবাক হয়ে শায়িখ বললো—

“মিষ্টি কেন হঠাৎ!কোনো খুশির সংবাদ?

শুভ্রা ভ্রু ক্রুটি করে সন্দিহান গলায় বললো—

“সারহান তোমাকে কিছু বলে নি?

শায়িখ তার পুরু ঠোঁট জোড়া কুঁচকে রইলো।ভ্রু নাচিয়ে সাবলীল কন্ঠে বললো–

“বলেছে।কিন্তু মিষ্টি খাওয়ার মতো কিছু ঘটেছে বলে তো মনে হয় না।”

“আরে সারহা….।”

কথা শেষ করতে দিলো না জান্নাহ্।মাঝ পথেই শুভ্রাকে থামিয়ে দেয় তার মখমলে কন্ঠে।

“আপু।”

শুভ্রা পেছন ফিরে তাকায়।শায়িখকে সালাম জানায় জান্নাহ্। প্রত্যুত্তরে শায়িখও উষ্ণ হাসে।তার দিকে একটা চেক বই এগিয়ে দেয়।সারহান বলেছে শায়িখকে দেওয়ার জন্য।বিগলিত হাসে শায়িখ।টপাটপ দুটো মিষ্টি মুখে পুরে নিয়ে ভজভজ করে বললো–

“খুশির সংবাদটা কী ভাবিজান?

মিষ্টি হাসে জান্নাহ্।লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো–

“ওটা আপনার স্যারের কাছ থেকে জেনে নিবেন।”

শায়িখ উঠে দাঁড়ায়।মৃদুহাস্য অধরে বললো–

“ঠিক আছে।স্যারের কাছ থেকেই না হয় শুনবো।অনেক দিন স্যারের মুখে গুড নিউজ শুনি না।শুধু আউলাঝাউলা খবরাখবর।”

শায়িখের এহেন কথায় ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।মুহূর্তে শায়িখ গোমড়া মুখে বললো–

“স্যার না আসা পর্যন্ত অনেক ঝামেলা হচ্ছে।শ্রীজা ম্যামের খুনি এখনো ধরা পড়েনি।রোজ রোজ পুলিশ আসায় আতঙ্কিত সবাই।”

গোলগোল চোখে তার দিকে অভিনিবেশ করে জান্নাহ্।শুভ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–

“এই এইসব কী কথা বলছো ওর সামনে!এই সময় এই ধরনের কথা শুনতে নেই।জানো না জান্নাহ্…।”

“আপু।”

আবারো তাকে থামিয়ে দেয় জান্নাহ্।শায়িখকে ইশারা করে চলে যেতে।শায়িখ যেতেই উৎসুক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে শুভ্রা–

“এই কী হয়েছে বলতো তোর!বারবার আমাকে থামাচ্ছিস কেন?

জান্নাহ্ খসখসে ঠোঁট দুটো জীভ দিয়ে ভিজিয়ে অনুযোগের সুরে বললো—

“সারহানকে বলিনি আমি।”

শুভ্রা বাজ পড়ার মতো আঁতকে উঠে বললো–

“কি!সারহান জানে না!কী বলছিস এইসব?

জান্নাহ্ নম্র গলায় বললো–

“সারহান জানে না।সে ফিরলে তারপর বলবো।”

শুভ্রা জান্নাহ্ এর হাত ধরে ঝাঁকি মেরে ত্রস্ত কন্ঠে শুধালো–

“এই তুই কী বলছিস বলতো!তুই কনসিভ করেছিস সেইটা সারহান জানে না?

জান্নাহ্ ভোলা ভোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বললো–

“উঁহু।”

বজ্রকঠোর গলায় খেমটি মেরে উঠে শুভ্রা–

“কী করেছিস বলতো?

জান্নাহ্ কিছুক্ষন চুপ থেকে নির্বিকার গলায় বললো–

“আম্মা যা বলেছে তাই করেছি।আমি পিল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”

শুভ্রা চোখের পাল্লা ছড়িয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বললো–

“এমন কেন করলি তুই!সারহানকে না জানিয়ে এইসব করার কী দরকার ছিলো তোর!এখন আমি কিছু জানি না।তুই,তোর আম্মা আর সারহান বুঝবি।আমাকে কিছু বলতে পারবি না।”

জান্নাহ্ ভীত গলায় বলে উঠে-

“এমন করে বলো না প্লিজ।আম্মা বললো উনি সবকিছু সামলে নেবে।সারহানকে বোঝাবে।”

শুভ্রা গা ঝাড়া দিয়ে বললো–

“তাইলে বোঝা।আমাকে কেন বলছিস!

টলটল করে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নৈঃশব্দের মাঝেও ভয়াবহ আলোড়ন।হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে অপরাধির মতো দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।তার সামনেই চোয়াল শক্ত করে কপালে দীর্ঘ গম্ভীরতার রেখা টেনে স্থির,শান্ত কিন্তু ভয়ংকর আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছে সরফরাজ মাহমুদ।অত্যন্ত শান্ত হলেও তার কন্ঠ বেখাপ্পা শুনালো।

“ইহতিশাম,হোয়াটস রং উইথ ইউ?

ইহতিশাম মাথাটা হালকা উঁচু করে অনুযোগের সুরে সংক্ষিপ্ত শব্দে বললো–

“সরি স্যার।”

“হোয়াট?

ইহতিশাম অবনত মাথা উঁচু করে তাকালো।এসির হাওয়ায় শীতল রুমেও ইহতিশামের গলা শুকিয়ে আসছে।ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে সরফরাজের টেবিলে থাকা পানির গ্লাসের দিকে তাকাতেই সরফরাজ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন–

“ড্রিংক ইট।”

ইহতিশাম আনুগত্যের সুরে বললো–

“থ্যাংক ইউ।”

ইহতিশাম চেয়ার টেনে বসলো।দীর্ঘ পনেরো মিনিট সে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো।পানিটা নিয়েই ঢকঢক করে পান করলো।একটু ধাতস্থ হয়ে সরফরাজের দিকে তাকাতেই কম্পিত হলো তার শরীর।সরফরাজ আহত বাঘের মতো তার দিকে চেয়ে আছে।ইহতিশাম ফিকে গলায় বললো–

“আরেকটু সময়ের প্রয়োজন আমার।”

সরফরাজ উত্তেজিত গলায় বললেন–

“সময়!আর কতো সময়!গত পাঁচ মাস ধরে তো সময় দিয়েই যাচ্ছি।”

ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো–

“সরি স্যার।আমার কারণে যা হচ্ছে তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।আপনি তো শুনেছেন মিস শ্রীজা ব্যানার্জীর কেসটার কথা।”

সরফরাজ পাত্তাহীন ভাবে বললেন-

“তো?

ইহতিশাম দৃঢ় গলায় বললো–

“আই থিংক এই কেসটাও বাকি কেসগুলোর সাথে জড়িত।একই মার্ডার উইপেন ইউস করা হয়েছে।শুধু ডাম্প করার পদ্ধতি ডিফারেন্ট।”

সরফরাজ কৌতূহলী গলায় বললেন–

“কী বলতে চাচ্ছো তুমি?

ইহতিশাম নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

“সবগুলো খুনই একজন করেছে।আর সে একা নয়।আই মিন খুনি একের অধিক।”

“আর ইউ সিরিয়াস?

” ইয়েস স্যার।”

সরফরাজ মৌনতা অবলম্বন করলেন।তার চোখের সামনে তার মেয়ে সামিরার চেহারা ভেসে উঠলো।খুন হওয়ার আগেরদিন অনেক উৎফুল্ল ছিলো সামিরা।বাবাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো।কিন্তু সরফরাজ তখন জরুরি কাজে আউট অফ টাউন থাকায় সামিরা সিদ্ধান্ত নেয় সরাসরি বাবাকে খুশির খবর দিবে।কিন্তু তার আগেই..।আর ভাবতে পারলেন না সরফরাজ।মেয়ের সেই লাশের কথা মনে পড়লে আজো তার বুক কেঁপে উঠে।ইহতিশামের দিকে গাঢ় দৃষ্টি দিয়ে বজ্রকঠোর হয়ে বললেন–

“অনলি ফিফটিন ডেইস।আই ওয়ান্ট রেজাল্ট।”

ইহতিশাম প্রসন্ন হেসে আশ্বস্ত গলায় বললো–

“শিওর স্যার।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ম গলায় শাঁসিয়ে উঠে ইহতিশামকে সরফরাজ।

“পনেরো দিনের বেশি একদিনও নয়।তুমি না পারলে আমি ক্রাইম ব্রাঞ্চকে এই কেস হ্যান্ড ওভার করবো।যা আমি আগেই করতে চেয়েছিলাম।শুধুমাত্র সারহান তোমার নাম রিকোমেন্ড করেছিলো বলে আমি কেসটা তোমাকে দিয়েছি।”

ভ্রু নাচায় ইহতিশাম।তার দুই চোখের কোণে একটা সমান্তরাল রেখা ফুটে উঠে।কিন্ত সে উদ্বিগ্ন নয়।সে আশ্বস্ত।সারহান তার নাম রিকোমেন্ড করেছে।কোনো বড় কারণ তো আছে।সরফরাজের রুম থেকে বের হতেই একটা উষ্ণ হাওয়া ধাক্কা মারে ইহতিশামকে।বিরক্তিতে তেতো হয় মুখটা।এই গ্রীষ্মকালকে একটা জবরদস্ত গালি দিতে ইচ্ছে হলো তার।কিন্তু মুহূর্তেই খেলে যায় তার মস্তিষ্কে একটা খেল।সারহান!কী চায় সে?
ইহতিশাম ডেম শিওর এই খুনের সাথে কোথাও না কোথাও জড়িয়ে আছে সারহান।কিন্তু ইহতিশাম দ্বিতীয়বার ভুল করতে চায় না।সে আগে সারহানের সাথে কথা বলতে চায়।নিজের একটা ভুলে সারহানকে অন্ধকার গলিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে।আর সে ভুল করতে চায় না।এইবার সে বন্ধুত্ব নেভাবে।তাই পুরো বিষয়টা নিয়ে সারহানের সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু সারহানকেও পাওয়াও দুষ্কর।কল তো রিসিভ করেই না।উল্টো কোথায় আছে তাও জানা নেই ইহতিশামের।শায়িখটাও হয়েছে পাক্কা চামচা।সারহানের অনুমতি ছাড়া যেনো নিঃশ্বাসও নিতে চায় না।
,
,
,
ক্লাস শেষে সিঁড়ি বেয়ে নামছে তিল আর জান্নাহ্।কৃঞ্চচূড়ার গাছটা কেমন কাঠ হয়ে আছে।জান্নাহ্ এর মন খারাপ হয়।কৃষ্ণচূড়া জান্নাহ্ এর বেশ ভালো লাগে।বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে যখন থোকায় থোকায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে থাকে পুরো গাছ তখন যেন আগুন ফুলের গাছ মনে হয়।
কিন্তু আজ আর তা নেই। বিবর্ন সেই গাছ।গাছের পাতারাও শাখা-প্রশাখার সাথে আড়ি কেটেছে।সেদিকে তাকাতে তাকাতেই হোচট খায় জান্নাহ্।পড়তে গেলেই তাকে সামলায় তিল।তীক্ষ্ম সুরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো—

“আরে দেখে হাঁট।এখনই তো পড়ে যেতি।”

ভড়কে গিয়ে নিজেকে সামলায় জান্নাহ্।বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।এখন তো সে একা নয়।তাকে সাবধানে থাকতে হবে।তিলকে জানানো হয়নি।মেয়েটা বিদ্যুতের মতো চঞ্চল।ছোট খাটো বিষয়েই আকাশ কাঁপিয়ে ফেলে।এই কথা শুনলে না জানি কী করে বসে!

স্কুলের ভবন পার হয়ে গেইট অব্দি পৌঁছে যায় দুই বান্ধবী।চকিতে তিলের চোখ গিয়ে ঠেকে রাফাতের ওই হিমশৈল অবয়বে।গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো একদম শান্তু,স্থির,নিষ্কম্প।যেনো কোনো কথা নেই সেই চোখে।তিলের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে ভুবন ভোলানো হাসি।উৎফুল্ল হয়ে একটা গুতো মারে জান্নাহ্ এর কনুইতে।ইশারায় রাফাতকে দেখায়।রাফাতের পাশেই বট বৃক্ষের ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ইশাক।তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা।ঘাবড়ে যায় জান্নাহ্।তার পা দুটো স্থির হয়ে আসছে।প্রাণহীন মনে হচ্ছে নিজেকে।ফাঁকা ঢোক গিলতে থাকে জান্নাহ্।রাফাত ভ্রু কুঞ্চি করে ভাবুক নয়নে পর্যবেক্ষন করে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে।লুকাতে চায় জান্নাহ্।কিন্তু রাফাত নাছোড়বান্দা।তার প্রশ্নের উত্তর আজ তার চাই।রাফাত পদযুগল বাড়াতেই ইশাক ধুম করে তার কাঁধে চাপড় মেরে বসে।কড়া গলায় বললো–

“ঝামেলা করিস না।পাশে ওর ফ্রেন্ড।”

রাফাত স্থির হয়।নিজেকে সংযত করে।জান্নাহ্ এখনো ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে আছে।চোখের পল্লব যেনো আপনা আপনি তার কম্পন বাড়িয়ে চলছে।গলা ধরে আসে জান্নাহ্ এর।হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে আসে।তিল নিজের বাড়ির দিকে চলে গেছে অনেকক্ষন।কিন্তু চিন্তায় সেইদিকে মনোযোগ নেই জান্নাহ্ এর।চঞ্চল পা দুটো চলছেই বিরতিহীন।হতবুদ্ধির মতো থমকে যায় জান্নাহ্।তার সামনে অশ্বথ গাছের মতো উদ্ভব হয় রাফাতের।চমকে গিয়ে দু’কদম লাফিয়ে পিছু হটে জান্নাহ্।ঝাড়া মেরে উঠে বললো–

“এইসবের মানে কী রাফাত!

রাফাত মিচকি হাসলো।কৌতুকের ছলে বললো—

“ওয়েলকাম রেড চেরি।
তলে তলে পাখি তুমি খেয়েছো যে ধান
এইবার পাখি তোমায় বাঁধিবে পরাণ।

জান্নাহ্ নাকের পাল্লা ফুলিয়ে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে ধৈর্য্য হারা হয়ে বললো—

“এইসব কী বলছো তুমি?

মৃদুহাস্য অধরে শুধালো রাফাত—

“কেমন আছো জান্নাহ্?

জান্নাহ্ বিতৃষ্ণা গলায় দৃঢ় হয়ে বললো–

“যেতে দাও আমাকে।”

ঝরঝরে হাসে রাফাত।মুগ্ধ নয়নে দেখে তার রেড চেরি ওই ভাসন্ত দুই চোখে।দীর্ঘ অক্ষিপল্লব ভিজে যেনো আরো কৃষ্ণকালো বর্ণ ধারণ করেছে।রাফাত প্রশ্বস্ত গলায় বলে উঠে—

“আমার প্রশ্নের জবাব?

জান্নাহ্ এর গলা বসে আসে।শুকনো গলায় কথা আটকে যায়।দূর্বল গলায় বললো—

“প্লিজ রাফাত,চলে যাও তুমি এখান থেকে।প্লিজ।”

ফুঁসলে উঠে রাফাত বললো–

“তাহলে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।”

জান্নাহ্ আর্দ্র গলায় বললো–

“আমি তোমাকে কিছু বলতে পারবো না।যদি সত্যিই তুমি তোমার রেড চেরির ভালো চাও তাহলে চলে যাও এখান থেকে।আর কখনো এসো না।”

রাফাত রুক্ষ কন্ঠে ঘোষণা করলো—

“যতক্ষন না আমার প্রশ্নের জবাব আমি পাচ্ছি আমি কোথাও যাচ্ছি না।কীসের এতো নাটক!কেন এই মিথ্যের মায়াজাল!কী সেই কারণ?বলো আমাকে জান্নাহ্।”

ফুঁসে উঠে জান্নাহ্।মেঘের মতো গর্জন করে বললো—

“কোনো জবাব আমি তোমাকে দেবো না।যেতে দাও আমাকে।”

রাফাতকে পাশ কাটিয়ে যেতেই জান্নাহ্ এর হাত চেপে ধরে রাফাত।তৎক্ষণাৎ গা গুলিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর।মুখভর্তি বমি আসতেই মুখ চেপে ধরে নিজের।আটকাতে পারলো না।গরগর করে ফুটপাতের দেয়াল ধরে বমি করে দেয়।রাফাত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার দৃষ্টি যেনো আজ তাকেই ধোঁকা দিচ্ছে।একটু ধাতস্থ হয়েই তীব্র গতীতে শ্বাস ফেলতে থাকে জান্নাহ্।তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।দ্রুত পা চালায় সে।
রাফাতের পেছনে এসে দাঁড়ায় ইশাক।উৎসুক কন্ঠে বললো–

“কীরে কী হয়েছে?

রাফাত ভয়ংকর শীতল গলায় বললো–

“জান্নাহ্ মা হতে চলেছে।আমার রেড চেরির শরীরে অন্য কারো সত্তা।তুই ভাবতে পারছিস!

ইশাকের উদ্ভাসিত,স্থির নয়ন জান্নাহ্ এর এলোমেলো পায়ের দিকে।জান্নাহ্ চলছে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here