জান্নাহ্,পর্বঃ৪৩,৪৪

0
1558

জান্নাহ্,পর্বঃ৪৩,৪৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৪৩

খাওয়ার টেবিলে একে অপরের দিকে চাপা রাগ নিয়ে আড়চোখে দেখছে।বাড়ির সবাই খাওয়ায় অভিনিবেশ করেছে।সারহান যতবার লুবনার দিকে তাকিয়েছে ততবারই লুবনা মুখ ভেঙচি দিয়েছে নাহলে অদ্ভুত কোনো মুখভঙ্গি করেছে।সেইসব বেশ মজা নিয়ে উপভোগ করছে জাবিন আর সারহানের পাশে দাঁড়ানো জান্নাহ্।ফচকে হাসিতে ব্যস্ত জাবিন।জান্নাহ্ ইশারা করে হাসতে বাড়ন করে জাবিনকে।আচমকাই লুবনা উবলে উঠে বললো—

“বড় চাচা,তুমি এই টারজানটাকে জঙ্গল থেকে আনলে কেন?

লুবনার অকস্মাৎ এহেন কথায় সবাই হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই সারহান দীপ্ত কন্ঠে বলে উঠে—

“কাকীমা, যত তাড়াতাড়ি পারো এই লবণকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করো।নাহলে কিন্তু এ পঁচা ইলিশের জন্য বর খুঁজে পাবে না।”

লুবনা কৃত্রিমতা কাটিয়ে স্বশব্দে বললো–

“হে,এসেছে।আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।তোমার ভাগ্য ভালো যে জান্নাহ্ এর মতো এতো কিউট একটা মেয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে।ওর জায়গায় আমি হলে তোমাকে ওই বেল তলার নাক বোঁচা আর দাঁত উঁচু শিয়াল কন্যার সাথে বিয়ে দিতাম।”

সারহান ঠোঁট গুঁজ করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মিয়ম্রান কন্ঠে বললো–

“আমার তো হয়েছে বিয়ে।তুই তো সারাজীবন কুমারিই থাকবি।মনে নেই,রুবিনার বিয়ের সময় ওর দেবর তোকে অন্ধকার ঘরে দেখে কী ভয়টা পেয়েছিলো!বেচারা টানা তিনদিন জ্বরে বিছানায় পড়েছিলো।আগে নিজের চেহারা ঠিক কর পঁচা ইলিশ।ছিঃ!

লুবনা থমথমে ভাব নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকলো।তার বড় বোনের বিয়ের দিন লুবনা অদ্ভুতভাবে নিজের হাতে সাজে।রুবিনার দশ বছরের চাচাতো দেবর কারেন্ট চলে যাওয়ার পর যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো তখন হঠাৎ কারেন্ট আসায় আর লুবনা সামনে পড়ায় বিষম খায়।তা দেখেই ছেলেটা এতো জোরে চিৎকার দেয় ওই এক চিৎকারে পিচ্চি বেহুশ।
সারহানের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা শুকনো হৃদয়ে যেনো প্রাণের বন্যা বয়ে যায় অন্তরার।আজ অনেকদিন পর সারহানকে এতোটা প্রাণবন্ত দেখছে সে।সারহানের এই হাসিটাই যেনো এতোদিনে আঁধারে আলো খোঁজার মতো করে খুঁজে চলছিলো অন্তরা।পাশে দাঁড়ানো জান্নাহ্ এর চমৎকার হাসি মুখটা দেখে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় নৈঃশব্দে অন্তরা।যদি মা হওয়ার বার্তাতেই সারহানের এতো পরিবর্তন হয় না জানি যখন এই বাচ্চা স্বশরীরে এই দুনিয়াতে তার কান্না জুড়ানো দেহ নিয়ে আবর্তিত হবে তখন কতোটা বদলে যাবে সারহান!অন্তরা এটাই চেয়েছিলেন।তার বুকের মানিক তার কাছে ফিরে আসুক।উপর ওয়ালার সাথে সাথে তিনি জান্নাহ্ এর শুকরিয়া আদায় করেন।

সারহানের কাঁধে হালকা চাপ দেয় জান্নাহ্।যেনো কথা আগে না বাড়ায়।সে আশায় গুঁড়ে বালি দিলো লুবনা।কাটকাট গলায় উচ্চ শব্দে বললো–

“আগে নিজের চেহারা ঠিক করো।আরে তোমার বাচ্চাই তো তোমাকে চিনবে না।হু।নিজের চেহারা দেখেছো!তোমাকে দেখলেই তো মনে হয় তুমি এই বাড়ির ছেলে না।বড় চাচা আর চাচি কারো সাথেই তোমার চেহারার মিল নেই।মিলবে কী করে!কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের সাথে মিলে নাকি!

মুহূর্তেই সারহানের হাসি মুখটা তীব্র রোষে ভরে গেলো।চোয়াল শক্ত হয়ে মসৃণ কপালটায় সমান্তরাল ভাঁজ ফুটে উঠে।দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে ফোঁস করে এক দম ছাড়ে।নিজের ভয়ংকর জাগ্রত ইচ্ছাকে চোখের পাতা বন্ধ করে অবদমন করার চেষ্টা করে সে।সারহানের ঘাড়ের রগ ফুলে উঠে।তার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সবাই।খাওয়ার প্লেটে রাখা হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ধীম ধীম শ্বাস ফেলছে সারহান।জান্নাহ্ কিছু বুঝতে না পেরে অসহায় দৃষ্টিতে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে সারহানের দিকে তাকায়।শুভ্রা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে।ফট করে উঠে যায় সারহান।সামনে থাকা বাটি ভরা মসুরের ডাল,সবজি,মাংস সব এক এক করে লুবনার গায়ের উপর ঢেলে দেয়।আঁতকে উঠে সবাই।ভীতসন্ত্রস্ত লুবনা জোর গলায় চিৎকার করে উঠে।লতা ভড়কে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে।সারহানের রাগ সম্পর্কে অবগত সে।কেউ কোনো কথা বললো না।খাবার টেবিলে চারধারের মানব – মানবীরা অত্যন্ত ভীত,শান্ত আর পরাস্থের মতো চেয়ে রইলো।কারো মুখে কোনো শব্দ বের হলো না।যেনো নিস্তব্ধ কোনো ফাঁকা মজলিস।
,
,
,
এক সমুদ্র রাগ আর বিরক্তি নিয়ে ব্যস্ত হাতে বিছানা ঝাড়ছে জান্নাহ্।আজকাল বেঢপ আচরণ করে সারহান।কী দরকার ছিলো মেয়েটার সাথে এমন করার!লুবনার শরীরে আধাঘন্টা বরফ ঢলতে হয়েছে।সে কিছুতেই এই বাড়িতে থাকবে না এই মধ্য রাতেই সে চলে যাবে বলে জেদ ধরেছে।তখন সারহান গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই চুপসে যায় লুবনা।একটু আগেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।জমির আর অন্তরা কিছু বলতে গিয়েও যা বললো তা নিতান্ত পান্তা ভাত।নিজের ভাবনার মাঝেই কোমরের দিকটায় কারো হাতের স্পর্শ আর কাঁধে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে।জান্নাহ্ এর ঘন,কালো রেশমচুলে নাক গলিয় দেয় সারহান।তার গন্ধ নিতে থাকে।বার কয়েক ঠোঁট ছোঁয়ায় ভারি চুলে।জান্নাহ্ সেভাবেই গম্ভীর গলায় বললো—

“লুবনা আপুর সাথে এমন করলেন কেন আপনি?

সারহান কোনো শব্দ করলো না।আলতো হাতে জান্নাহ্ এর ঘাড়ের পাশ থেকে চুল সরিয়ে তার জামার গলাটা হালকা নামিয়ে উষ্ণ চুম্বন করে।জান্নাহ্ বিরক্ত ঝুলায় নাকের ডগায়।সারহান থেকে নিজেকে সরাতে চাইলেই সারহান তাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়।দুই হাত জান্নাহ্ এর কোমরের দিক রেখে নিজের এক হাতের কব্জি অন্য হাত দিয়ে ধরে বৃত্তাকার বলয়ে আবদ্ধ করে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—

“এমন করলেন কেন?

সারহান জান্নাহ্ এর গালে গাল ছুঁইয়ে বললো–

“লবণাক্ত বেশি বাড় বেড়েছে।”

জান্নাহ্ ফোঁস করে দম ফেলে বললো—

“তাই বলে এমন করবেন!মেয়টার পুরো শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে।”

সারহান ফচকে হেসে মৃদু গলায় বললো–

“আই ডোন্ট কেয়ার।জ্বলে পুড়ে লবণ গলে যাক।”

“এটা আপনি ঠিক করেন নি সারহান।”

সারহানকে ছাড়িয়ে যেতে চাইলে জান্নাহ্কে আঁকড়ে ধরে সারহান।মোহনীয় গলায় তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—

“যাবেন?

জান্নাহ্ নির্বিকার গলায় সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো—

“কোথায়?

“পদ্মদিঘী।”

জান্নাহ্ এক সমুদ্র আতঙ্ক আর উচ্ছ্বাসের মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে বললো–

“সত্যি!এতো রাতে?

সারহান নরম গলায় বললো–

“হুম।”

“কিন্তু আম্মা?

সারহান জান্নাহ্ এর গলায় চুমু খেয়ে সরব গলায় বললো—

“আমার বউ আমি নিবো তাতে কার কী!

জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় হতাশ হয়ে বললো–

“কিন্তু সারহান আম্মা জানলে রাগ করবে।এতো রাতে বাইরে যাওয়া!

“আমার উপর ভরসা নেই?

চোখে হাসে জান্নাহ্।ভরসা!আজীবন সাথে থাকার পণ নিয়ে যার সাথে জীবন বেঁধেছে তার উপর ভরসা থাকবে না!
,
,
,
রাত তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই।কালো আকাশে রুপালি চাঁদ জোৎস্না ছড়িয়েছে।বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুরণন।নিঃশব্দে সারহানের গাড়ি এসে থামে দিঘীর বিশাল গেইটের সামনে।দুইজন নামতেই জান্নাহ্ খেয়াল করে গেইটে বড় একটা তালা ঝুলছে।

গেইটের সাথেই বড় বড় রেইনট্রি,মেহগনি,কাঠালি আরো অনেক বিশাল বিশাল গাছ।এখান থেকেই দিঘীর কালো জল দেখা যাচ্ছে।চাঁদ আজ তার রূপের পসরা সাজিয়েছে দিঘীর ওই নিকষ কালো জলে।গেইটের সামনে আসতেই থমকে যায় দুইজন।মিচকে হাসে সারহান।চাপা গলায় বললো—

“কেরানির মেয়ে,দেয়াল টপকাতে পারেন তো?

সরু কপালটা এক চোটে ভাঁজ করে জান্নাহ্।ভ্রু নাচিয়ে বললো–

“মানে কী?

সারহান মৃদুহাস্য অধরে মিষ্টি করে বললো—

“ভেতরে যেতে হবে না!

“তো?

“গেইট টপকাতে হবে।”

থমথমে রূপ ধারণ করে জান্নাহ্ এর মুখটা।সারহান ফিচেল হেসে ব্যগ্র হয়ে গেইট বেয়ে এপাশে চলে আসে।চোখ দিয়ে টিপ্পনী কেটে বললো–

“আসুন।”

জান্নাহ্ অশ্বথ গাছের মতো স্থির হয়ে রইলো।সারহান গা দুলিয়ে হেসে উঠে।প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে জান্নাহ্ এর সামনে ধরে।জান্নাহ্ টিমটিমে চাহনিতে চাবির অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করে।কিন্তু পারলো না।সারহান গেইটের দিকে ঝুঁকে মিনমিনে গলায় বললো—

“বিকেলে যখন এসেছিলাম হরিনাথ চাবিওয়ালাকে নিয়ে এসে ছিলাম।চাবিটা বানিয়ে নিলাম।”

জান্নাহ্ ঝাঝালো কন্ঠে বললো—

“তাহলে এমন করলেন কেন?

” এইটা দেখানোর জন্য,ডোন্ট পাঙ্গা উইথ সারহান জেইদি।আন্ডারস্ট্যান্ড মিসেস জেইদি?

“আপনি একটা পাগল।”

“হ্যাঁ,আমার পরীর পাগলাবাবা।এখন আসুন তো।আচ্ছা দাঁড়ান।আমি খুলে দিচ্ছি।”

সারহান চাবি দিয়ে গেইট খুলে তা অতি সন্তর্পনে ফাঁক করে জান্নাহ্কে ভেতরে নিয়ে আসে।ভেতরে এসে খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হয় জান্নাহ্ এর।এর আগেও পদ্মদিঘীতে আসতে চেয়েছিলো জান্নাহ্।কিন্তু আন্ডার আঠারো কাউকে দিঘীতে যাওয়ার অনুমতি নেই।স্কুল ছাত্রছাত্রীদের আরো নয়।কিন্তু কেয়ারটেকার দাদুতো জানে না আঠারোর আগেই জান্নাহ মা হতে চলেছে।এইসব মনে করেই ফিক করে হেসে ফেলে জান্নাহ্

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলছে সারহানের পাশে জান্নাহ্।সারহানের এক হাত নিজের সাথে চেপে ধরে আছে।জান্নাহ্ আজ ভীষণ খুশি।তার প্রাণ সত্যিই ফিরে এসেছে।যখন থেকে সারহান ফিরে এসেছে এক অন্য সারহানকে আবিষ্কার করেছে জান্নাহ্।এতোটা উচ্ছল,এতোটা প্রাণবন্ত সারহানকে সে কখনো দেখেনি।যখনই বাড়িতে আসতো সারাক্ষন ঘরে ঘাপটি মেরে থাকতো।কারো সাথে কথা বলাতো দুর তাকাতই না।

অন্ধকারে বিড়ালপায়ে হাঁটছে দুইজন।শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি যেনো নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝঙ্কার তুলছে।ঝিঝিপোকার ডাক যেনো ষোলোকলা পূর্ণ করলো।সাথে কাঠপোকার আওয়াজ।একটু পরপর দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠে গাছগাছালি।ঝনঝনিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর শরীর।সারহানের হাতটা আরো চেপে ধরতেই ফিকে গলায় হিসহিসিয়ে সারহান বললো—

“চিন্তা করবেন না।আমি থাকতে যমদূতও আপনার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না।”

চাঁদের আলোয় আরো লাবণ্যময় লাগছে সারহানের স্মিতহাস্য মুখটা।তার পুরু ঠোঁট জোড়ায় এক অচেনা সুখ।চোখে তার তৃপ্তি।নিজের মাথাটা এলিয়ে দেয় জান্নাহ্ সারহানের গায়ের সাথে।হাঁটতে হাঁটতে দিঘীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়।প্রায় পনেরোটা সিড়ি অতিক্রম করে দিঘীর জলে পা ছোঁয়াতে হবে জান্নাহ্ এর।চাঁদের আলোয় যেনো কোনো রূপকথার রাজ্য মনে হচ্ছে পদ্মদিঘীকে।চারপাশের প্রকান্ড গাছের সারি।দিঘীর দুই ধারে পাঁচ ফুটের ব্যবধানে সিমেন্টের বেড় দেওয়া বলয়ে খাম্বাকৃতির নিয়নের বাতি লাগানো।যে পাশে জান্নাহ্ রা দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীত পাশে উঁচু ডিবি যাকে ছোটখাট পাহাড় বলে আখ্যায়িত করে গ্রামবাসী।দিঘীতে ফুটে আছে পদ্ম।চাঁদের আলোয় দিঘীর মাঝের সেই লাল পদ্মে চোখ আটকে যায় জান্নাহ্ এর।

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

চাঁদের নরম আলোয় বসে আছে জান্নাহ্।তার অদূর দৃষ্টি দিঘীর লাল পদ্মে।দিঘীর জল থেকে দুটো সিঁড়ি উপরে বসে পা দুটো ডুবিয়ে রেখেছে দিঘীর কালো,অস্বচ্ছ,শীতল জলে। হালকা করে পা দুলাচ্ছে জান্নাহ্ তাতে দিঘীর জলে অদ্ভুত মোহনীয় শব্দ হচ্ছে যা এই নিথর পরিবেশে হাঁক তুলছে।

সিঁড়ির বসার জায়গাতে বসে আছে সারহান।অনিমেষ চেয়ে আছে তার সামনে বসা ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের সেই জীবন্ত পুতুলের দিকে।সারহান সাথে করে দুটো ছোট টর্চ লাইট নিয়ে এসেছে।তা অন করে সিঁড়ির উপরের শুরুর দিকটায় রেখেছে।দিঘীর দুই পাশের নিয়নের বাতি আর চাঁদের আভায় সুনসান অন্ধকার পরিবেশকে জীবন্ত মনে হচ্ছে।

সারহান নরম পায়ে এসে জান্নাহ্ এর পাশে বসে।জান্নাহ্ আলতো হাসে।সারহান তার ডানহাত দিয়ে জান্নাহ্ এর অগোচরেই তার দীঘল কালো চুলের হাত খোঁপাটা খুলে দেয়।কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় সেই চুল।চাঁদের আলোয় এক মায়াবী মূর্তি মনে হচ্ছে জান্নাহ্কে।তার খোলা চুলের ছোট ছোট কেশ এসে উড়ে পড়ছে তার চোখে,মুখে।তার পাতলা ওষ্ঠাধরের ওই একরোখা হাসি চুম্বকের মতো টানছে সারহানকে।ঘন পল্লবের নিচে ডাসা ডাসা দুই আঁখি যেনো প্রাণের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে সারহানকে।জান্নাহ্ এর ওই তীক্ষ্ম নাকের ডগায় যেনো তারা বসে আছে।চাঁদের লুকোচুরি আলোয় হীরে বসানো সেই নাকফুল যেনো তার অবস্থানের অস্তিত্ব বলছে।
জান্নাহ্ এর ঠোঁটের সেই হৃদয়গলানো হাসিতেই যেনো সারহানের মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন জান্নাহ্কে সে প্রথম দেখেছিলো।এক কিশোরী লাবন্যকন্যা।

আশেপাশে কোথাও ব্যাঙ ডাকছে।সেই সাথে নাম না জানা এক পাখি।ঝিঝিপোকার টিপটিপ আলো।দিঘীর জলে এই লাবন্যকন্যার পদযুগল।এক মুহূর্তেই সারহানের মনে হলো সে যেনো পদ্মাসনে বসা কোনো শশীকে দেখছে।
যে হাসছে তার স্বমহিমায়।তার রূপের আগুন ঝলসে দিচ্ছে সারহানের দুই চোখ।থামিয়ে দিচ্ছে তার হৃদকম্পন।এ যেনো মরেও সুখ।এ সুখ অপার্থিব,এই পাওয়া দুর্লভ।এ যেনো সেই বিষাক্ত সাপের মনি যাকে পেয়ে মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য ধনের মালিক সে।সারহান ভাগ্যবান।পেয়েছে সে তা।তার সামনেই বসে আছে সেই ভাগ্যকন্যা।সেই পরশ পাথর।যার ছোঁয়ায় সে পবিত্র হবে।যার পরশে সে তার ভাগ্য বদলাবে।বদলাবে তার জন্ম ইতিহাস।বদলাবে তার অন্ধকার অতীত।

জান্নাহ্ এর পা দিঘীর জলে সমাহিত।তার পায়ের রুপোলি নুপুর তার ফর্সা টলটলে পায়ে উদ্বাসিত হয়ে আছে।বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সারহান তার সামনে বসা অপ্সরার দিকে।এ দেখার যেনো শেষ নেই,নেই কোনো তৃপ্তি।এতো আজন্মকালের জন্য।জান্নাহ্ মৃদু গলায় নৈঃশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কী দেখছেন?

সারহান অধর কোণ প্রসারিত করে মুগ্ধ গলায় বললো–

“আমার ভালোবাসার দেবীকে।যার চরণে নিজেকে সমার্পিত করতে চাই।দেবেন কী সেই সুযোগ?

জান্নাহ্ মুহূর্তেই মুখটা গম্ভীর করে।কপট দম্ভের সাথে বললো—

“দিলাম মহামান্য।”

ঝুমঝুম করে হেসে উঠে জান্নাহ্।সেই হাসির তরঙ্গ সোজা গিয়ে বিঁধে সারহানের বুকে।

” বিষে ভরা বাণ,বাঁচাইবে পরাণ
অমৃতের সুধা যে করিবে দান।”

সারহান চোখে হাসে।কেনো যেনো তার কাঁদতে ইচ্ছে হলো।খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো।কিন্তু কষ্টে নয়।সুখে।সেই সুখ যা আজ তার দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে।সেই সুখ যা তার পরাণ বাঁধিয়েছে।সারহানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে,

“ভোরের শিশির হোক,কিংবা তপ্ত লাভা
তোমার পরাণেই হোক আমার জীবন বাঁধা।”

জান্নাহ্ এর পাশ ঘেঁষে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল গুঁজে দেয় সে।তাতে আলতো চুমু খায়।জান্নাহ্ এর কোমল মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে তার ললাটে অধর ছোঁয়ায়।চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণকে সাক্ষী রেখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় জান্নাহ্ এর দুই মুদিত চোখের পাতায়।জান্নাহ্ নিমীলিত অক্ষিযুগলের দ্বার খুলে তার প্রাণকে দেখে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের মোনাজাতে সে এভাবেই তার প্রাণকে ফিরে পেতে চেয়েছে।তার প্রাণ শুধু তার হয়ে ফিরে আসুক।যেমনটা সে সারাজীবন স্বপ্নে দেখেছে।জান্নাহ্ এর নরম গালে গাল ছোঁয়ায় সারহান।ইচ্ছে করছে এই পুতুলকে নিজের মাঝে সমাহিত করতে।মিষ্টি করে আদর করতে।জরিয়ে নিতে ভালোবাসার চাদরে।জান্নাহ্ এর চোখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে সারহান।জান্নাহ্ মৃদু কম্পনে বললো—

“সারহান,মামা বাড়ি যাবেন?আপু এসেছে।বিয়ের পর তো আপুর সাথে আপনার দেখা হয়নি।”

সারহান নির্লিপ্ত গলায় বললো–

“যাবো।আপনি যেখানে বলবেন সেখানে যাবো।মরতে বললে মরেও যাবো।”

আঁতকে উঠে জান্নাহ্ বললো–

“সারহান!

সারহান বিগলিত হাসে।আশ্বস্ত গলায় বললো–

“চিন্তা করবেন না।এতো সহজে আমি মরছি না।যতদিন আপনার শ্বাস ততদিন আমার নিঃশ্বাস।”

সারহান জোরালো কন্ঠে ঘোষনা করে বললো—

“আমায় নিয়ে যত অভিযোগ
মিথ্যের আড়ালে সত্যেরা অপারগ
ভূমধ্যসাগরীয় অতল স্রোত
তোমার শ্বাসেই হোক আমার নিঃশ্বাস রোধ।”

কেঁপে উঠে দিঘী।নেচে উঠে দিঘীর জল।আলোড়ন সৃষ্টি হয় রহস্যপুরীর মায়াজালে।এক প্রেমে পাগল যুবা আজ আর অর্ধাঙ্গীনির প্রতি তার প্রেম নিবেদন করছে।এক প্রেমিক পুরুষ আজ তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে।ওই আকাশকে সাক্ষী রেখে,ওই চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখে বলতে ইচ্ছে করছে,”ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।”

সারহানের কথায় উচ্ছ্বাসিত হয় জান্নাহ্।তার বুকের মাঝে ছোট্ট পিঞ্জিরায় আবদ্ধ ভালোবাসার পাখিটি আজ ডানা মেলতে চায়।তরতর করে বয়ে যাচ্ছে খুশির হাওয়া।সারহান এক সিঁড়ি নেমে জলের কাছাকাছি সিড়িতে বসে।মোলায়েম গলায় বললো—

“পা উঠান রজনীগন্ধা।”

আচম্বিত হয় জান্নাহ্।সন্দিহান চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত গলায় বললো–

“কেন?

“উঠান দেখাচ্ছি।”

“আপনার শরীরে ভিজে যাবে সারহান।”

“আমার পুরো জীবনটাইতো ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসিয়ে নিলেন।শরীর দিয়ে কী হবে!

জান্নাহ্ তার ভেজা কোমল পা দুটো সারহানের ছড়ানো উরুর উপরে রাখে।সংকোচ হচ্ছে জান্নাহ্ এর।বিব্রত সে।সারহান স্মিত হেসে বুক পকেট থেকে দুটো আংটি বের করে জান্নাহ্ এর পায়ের আঙুলে পড়িয়ে দেয়।জান্নাহ্ ব্যগ্রতা নিয়ে পা দুটো গুঁটিয়ে আংটি গুলো দেখে অবিশ্বাস্য হাসে।উচ্ছলিত কন্ঠে বললো–

“কোথা থেকে আনলেন?

সারহান স্বাভাবিক কন্ঠে প্রত্যুত্তর করে—

“ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছি।পছন্দ হয়েছে আপনার?

“খুব।ধন্যবাদ।”

সারহান নাক বরাবর কপাল কুঁচকে বললো—

“ধন্যবাদ কেন?

জান্নাহ্ হেসে হেসে বললো—

“এই যে গিফ্টের জন্য।”

সারহান ভ্রু বাকিয়ে নিরুত্তাপ কন্ঠে বলে–

“আমি তো আপনাকে ধন্যবাদ দেইনি।”

“কেন?

“এই যে আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসটা গিফ্ট করার জন্য।”

জান্নাহ ফিচেল হেসে মজা নিয়ে বললো—

“তাহলে এখন দিন।”

সারহান উঠে দাঁড়ায়।শক্ত কন্ঠে শুধায়–

“বলুন আপনার কী চাই?

জান্নাহ্ উঠে দাঁড়ায়।তার কাপড়ের আঁচলটা ডান কাঁধ থেকে পড়ে যায়।খোলা চুলে এক শশীকন্যা স্বশব্দে বলে উঠে—

“আমার ওই লাল পদ্ম চাই।”

সারহান চোখ টিপে হাসে।বিগলিত গলায় বললো–

“আপনি চাইলে ওই চাঁদকেও আজ ধরণীতে নিয়ে আসতাম।”

কথা শেষ করেই এক ঝাঁপ দেয় পদ্মদিঘীতে সারহান।ভড়কে যায় জান্নাহ্।সে ভাবতে পারেনি সারহান এমন কাজ করবে।প্রায় মিনিট পনেরো পর দিঘী থেকে উঠে আসে সারহান।তার হাতে লাল পদ্ম।ভেজা শরীর বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে।সারহান সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো এক হাতে পেছনে ফিরিয়ে দেয়।তার আর্দ্র ভ্রুযুগল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল জল।জান্নাহ্ এর সামনে দুই হাতে লাল পদ্ম নিয়ে বলে–

“নিন আপনার লাল পদ্ম।”

তেতে উঠে জান্নাহ্ বললো—

“আপনি কী পাগল!এই রাতে কেউ দিঘীতে নামে?

সারহানের তার আর্দ্র আঙুল দিয়ে জান্নাহ্ এর ফোলা নাকে আলতো ছুঁইয়ে বললো—

“আপনার না রেড চেরি পছন্দ।পরী আসলে আপনাকে রেড চেরির দেশে নিয়ে যাবো।”

জান্নাহ্ লাফিয়ে উঠে বলে—

“সত্যি?

“প্রমিজ।”

জান্নাহ্ খুশিতে গদগদ হয়ে সারহানের কাছে এগিয়ে গেলে সারহান চমকে বললো—

“আরে কী করছেন!আমি এখন ভেজা মানব।”

“ভেজা হোক আর শুকনো,আমারই তো।”

জান্নাহ্ ঝাঁপিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।বুক ভরে শ্বাস নেয় সারহান।নিজেকে একদম গুঁজ মেরে নেয় জান্নাহ্ সারহানের বুকে।আর তখনই এক অবাক কান্ড করে বসে সারহান।ঝট করে জান্নাহ্কে কোলে তুলে নেয়।তার ভেজা চুলের পানি টুপটুপ করে জান্নাহ্ এর বুকের ওপর পড়ছে।সারহান তার ভেজা ঠোঁট চেপে ধরে জান্নাহ্ এর কিশলয়ের মতো ঠোঁটে।জান্নাহ্ দুই হাত সারহানের গলায় জড়িয়ে রাখে।দীর্ঘ সময় নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারহান জান্নাহ্ এর অধরপল্লবের অধরসুধায়।সারহান ধীরে ধীরে সিঁড়িতে তার পা বাড়াতে থাকে।মৃদু হেসে বললো—

“নেক্সট টাইম এমন কিছু করলে আগে থেকে আমাকে জানাবেন।”

“কেন?

সারহান ফিচেল হেসে বললো—

“তাহলে আরেকটু বেশি করে আদর করতাম আরকি!

জান্নাহ সারহানের বুকে দুর্বল ঘুষি মেরে লজ্জামিশ্রিত গলায় বললো—

“অসভ্য লোক!

” আমি তো কোনো কালেই সভ্য ছিলাম না রজনীগন্ধা।মিছে মায়ায় পড়লেন আমার।”

ঠোঁট বাকায় জান্নাহ্।ঝরা হাসে সারহান।
আজ পদ্ম দিঘী দেখলো এক প্রেমিকযুগলের প্রেমে বন্দির খেল।
,
,
,
সারহানদের বাড়ির সদর দরজায় স্টিলের বিশাল গেইট। ডুপ্লেস বাড়ির ঢুকতেই প্রকান্ড কাঠের কারুকার্যখচিত দরজা।তার সামনেই করিডোরের মতো প্রায় চার ফুটের জায়গা।বাড়ির সবাই নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে।সদর দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাইভেট কার।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছে লুবনা।সকলের সাথে কথা বললেও লুবনা কথা বলেনি সারহানের সাথে।ধীরপায়ে সিঁড়ির পাঁচটা ধাপ নেমে সদর দরজার বাইরে আসে সারহান।মুখ ফুলিয়ে বসে আছে লুবনা।গাড়ির জানালার উপর হাতটা রেখে ঝুঁকে দাঁড়ায় সারহান।তার মুখটা একদম লুবনার কাছাকাছি।স্মিতহাস্য অধরে বললো–

“কীরে,কথা বলবি না?

বার কয়েক নাক টানে লুবনা।সারহানের দিকে ক্ষীপ্ত চোখে তাকায়।চোয়াল শক্ত করে নাক ফুলাতে থাকে।সারহানের হাসি হাসি মুখটা দেখে ক্ষনকালেই রাগ পড়ে যায় লুবনাথ।
অভিমানি গলায় বললো—

“নাহ।এমন করলে কেন তুমি?

সারহান গম্ভীর মুখে বললো—

“সরি।”

“সরি বললেই সব মাফ।দেখো কী অবস্থা করেছো আমার !পুরো শরীর লাল হয়ে আছে।”

সারহান লুবনার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়।আসলেই!লুবনার সমস্ত শরীর লাল হয়ে আছে।সারহান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে।আরেকটু ঝুঁকে লুবনার কানের কাছে মুখ নিয়ে মখমলে গলায় বললো —

“এখন বুঝতে পারছিস কেন আমি তোকে বিয়ে করি নি!আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা তোর নেই।ভালো থাকিস।”

লুবনা কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে সারহানের দিকে।এ তার চোখের কাতরতা নয়।হৃদয়ের কাতরতা।পেয়েও হারানোর ব্যর্থতা।ছাই চাপা আগুনে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা।এই যন্ত্রণা অব্যক্ত,অবর্ণনীয়,অপরিমেয়,অসহনীয়।সারহান লুবনাকে একটা বক্স দেয়।আলতো কন্ঠে বললো—

“তোর সরি গিফ্ট।ভালো লাগলে রাখিস।যদি তোর টারজানকে মনে পড়ে দেখিস।”

লুবনার চোখে বাঁধ ভাঙে অশ্রু।বুকের ব্যথাটা তরতর করে গলায় উঠে এসেছে।কষ্টে কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলায়।তাই সে কিছু বলতে পারলো না।চেয়ে রইলো তার আকাঙ্ক্ষীত সেই না পাওয়া দুর্লভ বস্তটির দিকে।

সারহান জোরালো গলায় বলে উঠে—

“ড্রাইভার মামা, সাবধানে ড্রাইভ করবেন।আমার লবণাক্ত ইলিশ পড়ে না যায় যেনো।”

গাড়ি চলতে শুরু করে।জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে সম্মোহিনী দৃষ্টিতে অনিমেখ চেয়ে থাকে সারহানের দিকে লুবনা।যতক্ষন পযর্ন্ত সারহানের ওই উজ্জ্বল মুখটা লুবনা দেখতে পেয়েছে ততক্ষন চেয়ে রইলো।তা দৃষ্টির আড়াল হতেই মাথাটা ভেতরে এনে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের কান্না রোধ করে লুবনা।

বক্সটা খুলতেই চোখের জল আর বাঁধ মানলো না।স্মিত ধারায় তা গড়াতে লাগলো।বক্সের উপরে বিভিন্ন রঙের ফিতে আর কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজানো।তার ভেতরে এক মুঠ লাল রেশমি চুড়ি,এক পাতা টিপ,একটা পায়েল আর ছোট্ট একটা পারফিউম।গোলাপ আর গাঁদাফুল ছড়ানো তাতে।একটা চিরকুটও পায় লুবনা।
টলটলে পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লুবনার।না,দেখবে না।জড়াবে না নিজেকে এ মায়ায়।যা তার হওয়ার কথা ছিলো তা আজ অন্যের।কেন এমন হলো!মন মানে না লুবনার।নিজের মধ্যকার বিদ্বেষী মানুষটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুটটা খুলে লুবনা।তাতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা–

“যদি কখনো পড়ে মনে
ভেবে নিস দেখা হবে ওই জনমে
যদি দেখিস মনের দুয়ার খুলে
আমি ছিলাম তোর হৃদয়ের কোণে।”

চিরকুটটা মুচড়ে হাতের মুষ্টিতে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে লুবনা।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে।গত কয়েকদিন অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে সে।আজ আর পারলো না।পাশে থাকা নিজের মাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো লুবনা।ড্রাইভার ফ্রন্ট গ্লাসে লুবনাকে একবার দেখে।ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি।

ছোটবেলা থেকেই সারহানকে পছন্দ করে লুবনা।হয়তো সারহানও করতো।কিন্তু যেদিন থেকে বাড়ির বাইরে সে পা বাড়িয়েছে লুবনা নামের মেয়েটিকে সে ভুলতে চেয়েছে।
সারহানের কাকা চেয়েছিলেন লুবনার সাথে সারহানের বিয়ে দিতে।এই পরিবারে তিনি বাইরের কোনো মেয়েকে প্রবেশ করাতে চান নি।কিন্তু প্রথমে তা হবে বলে মনে হলেও পরে সারহানের এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ তিনি দেখেন নি।জান্নাহ্কে বিয়ে করায় সারহানের কাকার চাপা ক্ষোভ রয়েছে।তাই তিনি বিয়েতে তো আসেন নি উপরন্তু আজ পর্যন্ত তিনি এই বাড়ির মুখো হন নি।লতাও আসতেন না।কিন্তু সারহানকে দেখার লোভ লুবনা সামলাতে পারে না।তার জন্যই বাধ্য হয়ে আসে লতা।কিন্তু সারহান তার আর লুবনার মাঝে দেয়াল তুলে দেয়।সে চায় লুবনা তাকে ঘৃণা করুক।কিন্তু সারহানের অযাচিত কাজে লুবনা ধীরে ধীরে আরো ঝুঁকে পড়ে তার দিকে।সারহান আসলেই ছুটে আসে লুবনা তার মায়ের সাথে।কিন্তু সেই খুশি বেশি স্থায়ী হয়না।কারণ সারহান আসেই হুট করে,আবার চলেও যায়।কিন্তু এইবার জান্নাহ্ মা হবে সেই খুশিতে সারহান নিশ্চয়ই এখানেই থাকবে তাই অন্তরার মুখে সারহান আসার কথা শুনে আর দেরি করে নি।

চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
ভালোবাসার দেবী আর মহামান্য শব্দ দুইটি আমি বিশেষ কারণে ব্যবহার করিছি।তার ব্যাখ্যা দিতে গেলে অনেক লিখতে হবে।দয়া কর এই শব্দ নিয়ে ঝামেলা করবেন না।আর যদি নিজ দায়িত্বে বুঝতে পারেন তাহলে আমি খুশি হবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here