জান্নাহ্,পর্বঃ৪৫,৪৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৪৫
লাল গোলাপের ছাপ ওয়ালা সফেদ রঙের বিছানায় ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসে একটা নয় মাসের বাচ্চা মেয়ে।তার মাথাভর্তি ঘন কালো দুই ইঞ্চি লম্বা চুলগুলো এলোথেলো।চোখের পাঁপড়িগুলো ভ্রমরকালো।ছোট ছোট চোখে ঘুমো ঘুমো ভাব।নিমিঝিমি চোখে সে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে তার সামনে বসা অতি আপনজনের মুখটি।নাকে,মুখে অস্বস্তির ভাব পেয়ে দুই হাতে বেপরোয়াভাবে ঘষতে থাকে।তাতে করে বাচ্চাটির মোমের মতো কোমল নাকটা লাল হয়ে যায়।ফুলকো গালদুটো টসটসে।চিকন লাল ঠোঁট দুটি কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে ক্লান্ত হাসে বাচ্চাটি।তার হাসিতে মৃদু ছন্দ হয়।ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকায় সেই গলুমলু পুতুলের দিকে সারহান।চোখে হাসে সে।একটা ছোট গেঞ্জি আর নরম কাপড়ের তৈরি হাফ প্যান্ট পরা বাচ্চাটি।দুই হাত দিয়ে দুই পায়ের তালু চাপকে ধরে চমৎকার হাসে সে।সারহান আয়েশি ভঙিতে কাউচে হেলান দিয়ে বাচ্চাটির কর্মকান্ড দেখে।মুহূর্তেই নেচে উঠে দুই হাতে তালি বাজায় বাচ্চাটি।সারহান ঝরা হাসে।বাচ্চাটি সারহানের হাসিতে উচ্ছ্বাসিত হয়।তার ঘুম জড়ানো চোখ দুটি উদ্ভাসিত হয় আনন্দে।
সারহান দেখছে তাকে।এক মায়াবীনি কন্যাকে।যে তারই অংশ,তার রক্ত বইছে ওই অবুঝ,জীবন্ত মাংসপিন্ডে।বুক ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নেয় সারহান।এক সমুদ্র সুপ্ত শিহরণ অগোছালোভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে।
বাচ্চা মেয়েটি তার বাবাকে দেখে।আপ্লুত হয় সে।অবাক হয় সে।কারণ তার বাবা তাকেই মনোযোগ দিয়ে দেখছে।বাচ্চাটি ভাবলো তাকে যেতে হবে।তার বাবার কোলে আঁছড়ে পড়তে হবে।কোলে উঠে মুখ গুঁজে দিতে তার ওই বুক।তার ছোট ছোট চার,পাঁচেক দাঁত বসাতে হবে তার বাবার ওই গালে।তার চোখে মুখে নিজের ধারালো,নরম নখের আঁচড় বসাতে হবে।তাই তাকে ছুটে যেতে হবে ওই বাবা নামক যত্নশীল,প্রেমময়,স্নেহশীল মানবটির কাছে।বাচ্চাটি তাই করলো।শিয়রের বালিশটিকে বালুর বস্তার মতো টেনে নিচে ফেলে দেয়।ভারি কষ্ট হচ্ছে তার।সারহান বিমুগ্ধ চিত্তে নিজের মেয়ের কর্মকান্ড দেখে।বাচ্চাটি আরো একটা বালিশ টেনে ফেলে নিচে।সারহান স্মিত হাসে।মায়ের মতো বুদ্ধিমতী।এইবার অবাক কান্ড করে বাচ্চাটি।বিছানার চাদর খামছে ধরে অতি সন্তর্পনে একটা পা নামিয়ে দেয় ফ্লোরে পড়া সেই বালিশের তাম্বুলের উপর।বাবার দিকে অতি দম্ভের সাথে তাকায়।সারহান অধর কোণে হাসে।বাচ্চাটি তার বাবাকে দেখতে দেখতে অসাবধানতায় আরেক পা বালিশের উপর রাখে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা বালিশের উপর না পড়ে তা চলে যায় বালিশের পাশ কাটিয়ে ফ্লোরে।ব্যালেন্সহীন হতেই নিজের হাতের কন্ট্রোল হারিয়ে ধপাস হয়ে পড়ে যায় টাইলসের ফ্লোরের উপর।নরম,কচি মাথায় শক্ত ফ্লোরের স্পর্শ লাগতেই গলগলিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।উদ্ভ্রান্তের মতো শ্বাস আটকে দৌঁড়ে আসে সারহান।বাচ্চাটির রক্তমাখা মাথাটা হাতের তালুতে নিয়েই গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে উঠে—-
“সারজান!
হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সারহান।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।কপাল জুড়ে মুক্তোর দানার মতো ঘাম জমেছে।কানের দুই পাশের চিপ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ।হাপড়ের মতো উঠানামা করছে সারহানের বুক।তার নাকের ডগায় ঘামের পাহাড়।ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে তার।অধর ছড়িয়ে মুক্ত শ্বাস নেয় সারহান।
বিছানা ভাঁজ করছিলো জান্নাহ্।সারহানকে চিৎকার করতে দেখে দৌঁড়ে এসে তার সামনে বসে।সারহান দিকভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।যেনো কিছু খুঁজছে সে।জান্নাহ্ শুধায়–
“কী হয়েছে সারহান?
সারহান কোনো কথা বললো না।অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো।ডিভানে শুয়ে শুয়ে মোবাইল নিয়ে কিছু করছিলো।তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই সেই ভয়ংকর স্বপ্ন এসে হানা দেয়।সারহান ধুপ করে ডিভানের নিচে বসে পড়ে।জান্নাহ্ এর কোমর জড়িয়ে ধরে তার পেটে মুখ গুঁজে দেয়।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো—
“আমার পরীর খেয়াল রাখবেন রজনীগন্ধা।আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।”
জান্নাহ্ চকিত হয়।গত কয়েকদিনে এমন অনেকবার হয়েছে।ঘুমের মধ্যেই আঁতকে উঠে সারহান।বাকি রাত জেগে বসে থাকে।জান্নাহ্কে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।জান্নাহ্ যতবার জিঙ্গেস করেছে ততবার বলে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে।সে দেখেছে কেউ তার প্রিয় জিনিস তার থেকে কেড়ে নিচ্ছে।
ক্ষীণ শ্বাস পড়ছে সারহানের।জান্নাহ্ এর উদরের সাথে লেপ্ট আছে সে।জান্নাহ্ আলগোছে সারহানের মাথাটা তোলে।কী শান্ত আর নিষ্পাপ মুখ।জান্নাহ্ সারহানের গালে হাত রেখে তার চোখের নিচে জমা ঘাম টুকু মুছে দেয়।ললাটে অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্। নিজের দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে নেয় সারহানের মুখটা।কোমল গলায় বললো—
“কী হয়েছে সারহান?এমন করছেন কেন?
সারহান বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলে।থমথমে গলায় বললো–
“আমার অতীত আমার বর্তমান ছিনিয়ে নিতে চায় রজনীগন্ধা।আমার পরী!
আর কিছু বললো না সারহান।তার চোখে জল জমে আসে।জান্নাহ্ কিছু বুঝতে পারে না।সারহানকে ভেতর থেকে কিছু খুবলে খাচ্ছে।কিন্তু তা সে কাউকে বলতে পারছে না।নিজে সহ্যও করতে পারছে না।জান্নাহ্ নরম চোখে তাকিয়ে সারহানকে দেখে।এ কয়েকদিনে প্রকুপিত,উন্মত্ত,উগ্র মানুষটা একদম শান্ত,নিশ্চল আর অসহায় হয়ে পড়েছে।জান্নাহ্ নিষ্কম্প গলায় বললো—
“আজ শুক্রবার সারহান।সবসবয় নিজেকে বিশ্বাস করেছেন আজ না হয় আল্লাহ্ পাককে করুন।আপনার সমস্ত কষ্ট,গ্লানি,অভিযোগ ওই ওপর ওয়ালাকে বলুন।দেখবেন তিনি ঠিক বুঝবেন।আপনাকে সঠিক নির্দেশনা দিবেন।”
সারহান তার কপোল থেকে জান্নাহ্ এর হাত নামিয়ে তার অঞ্জলিতে চুমু খায়।নিরুত্তেজ গলায় বললো—
“তিনি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করবেন?আমি আমার অতীত ভুলতে চাই রজনীগন্ধা।আমার বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”
“আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল।তিনি তার সকল বান্দাদের ভালোবাসেন।তার প্রিয় বান্দারা যখন ভুল করে তখন তিনি আশায় থাকেন কখন তার বান্দারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা চাইবেন।তিনি তাদের পরীক্ষা করেন।সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তিনি পুরষ্কারও দেন।যে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পারে তার চেয়ে বড় অনুশোচনা আর নেই।তাই তো আমাদের সব সময় আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয়।অতীতে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা বর্তমান ধ্বংস করে।উঠুন।আযান দিয়েছে।গোসল করে মসজিদে যান।আল্লাহর দরবার থেকে তিনি আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না।তার সামনে আপনার সব প্রশ্ন রাখবেন।তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে তার উত্তর দিবে।”
সারহান ধীরপায়ে উঠে দাঁড়ায়।মৃত্যুকে ভয় না পেলেও আল্লাহভীতি তার খুব কম ছিলো।নিজেকে বিশ্বাস করতো বেশি।কিন্তু আজ!
সারহান ওয়াশরুমে যেতেই ডিভানের কুশন ঠিক করতে গেলে জান্নাহ্ টের পায় কুশনের ডানপাশ ভেজা।হয়তো ঘুমের মধ্যে সারহান কাঁদছিলো।মানুষটা এভাবে কেন ভেঙে পড়ছে!
একটা সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরে সারহান।মাথায় সাদা রঙের টুপি।আয়নায় নিজেকে দেখে অপ্রস্তুত হয় সে।আড়াল করার চেষ্টা করে।এমনটা করতে ওই ছোট্ট প্রাণটা তাকে বাধ্য করলো।ঘরে ঢুকেই সারহানকে দেখে থমকে যায় জান্নাহ্।স্মিতহাস্য অধরে তাকে ইশারা করে বোঝায় ভালো লাগছে দেখতে।ফর্সা সারহানের গায়ে সাদা পাঞ্জাবীতে তাকে যেন ভিনগ্রহের কোনো প্রাণি মনে হচ্ছে।জান্নাহ্কে অবাক করে দিয়ে ঝাঁপটে ধরে সারহান তাকে।হতবুদ্ধিতা কাটিয়ে ধাতস্থ হতেই জান্নাহ্ টের পায় বেগতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সারহানের হৃদকম্পন।তা যেনো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে।মোলায়েম গলায় জান্নাহ্ বললো–
“সারহান,দেরি হচ্ছে।বাবা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”
সারহান শান্ত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ সারহানের ডান হাতের উল্টো পাশে চুমু খেয়ে নিজের দুই চোখের পাতায় পরম আবেশে ছোঁয়ায়।হৃষ্ট হয় সারহানের মন।অকৃত্রিম শীতলতা তিরতির করে আবদ্ধ করছে সারহানকে।রুম থেকে বের হতেই দেখে জমির আর অন্তরা আগ্রহদীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।অন্তরার চোখে চঞ্চলতা।খুশির হাওয়া বইছে তার হৃদয়ের দ্বারকোণে।আজ কতো বছর পর সারহানকে এই রুপে দেখছে সে।সারহানের চোখের সামনে তার মমতাময়ী।কিছু একটা ভেবে পা বাড়িয়েও পিছু হটলো সারহান।তার শান্ত,নরম চোখ দুটো মুহূর্তেই ঘৃণার সমুদ্রে উতলে উঠলো।দাঁড়ালো না আর সে।লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে চলে এলো।
অন্তরা কাঁদলো।কিন্তু সে প্রসন্ন।তার ছেলেটা তার চোখের সামনেই থাকুক।এই ঢের।
তিনতলা মসজিদের সামনে এসে থমকে যায় সারহান।মসজিদের পাশেই বাচ্চাদের সকালবেলা আরবি পড়ানোর জন্য দোচালা ঘর তৈরি করা হয়েছে যার পাশ দেয়ালগুলো ইটের তৈরী।এখনো পলেস্তার করা হয়নি।তার পাশেই একটা বিশাল কাঁঠাল গাছ।উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কাঁঠাল ঝুলে আছে।মসজিদের বা’দিকেই কবরস্থান।এখানেই কবর দেওয়া হয়েছে সারহানের দাদুকে।কবরটা বাঁধানো।কিন্তু অনেক দিন সংস্করণ না হওয়ায় ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।বাঁশের বেড়া দেওয়া সেই কবরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে সারহান।তার মনে পড়ে ছোটবেলার কথা।একপাশে বাবা আর আরেকপাশে দাদুকে রেখে তাদের দুইজনের দুই আঙুল ধরে একরাশ উদ্দীপনা নিয়ে জুম্মার নামাজ পড়তে আসা সারহান।মুখে তার যুদ্ধ জয়ে যাওয়ার হাসি।ধীরে ধীরে ঘোলা হতে থাকে সারহানের অক্ষিযুগল।এই মানুষটাকে এতোটা ভালোবাসার পরও খুব ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়।
নামাজ শেষে দাদুর কবর জিয়ারত করে জমিরের আগেই বের হয়ে কোথায় যেনো চলে যায় সারহান।জমির মসজিদের আশপাশ বেশ কিছক্ষন খুঁজেও যখন পেলো না সারহানকে তখন হতাশ শ্বাস ফেলে বাড়ির পথ ধরে।
কুঞ্জপুকুরের এসে বসে থাকে সারহান।শান বাঁধানো ঘাট।তার নিমগ্নদৃষ্টি পুকুরের শ্যাওলা পড়া জলে।কয়েকটা মাছ খাবারের খোঁজে উপরিভাগে এসেছে।সারহান বিমুগ্ধচিত্তে তা দেখছে।একটা মিষ্টি হাওয়া এসে লাগে সারহানের গায়ে।তার চোখ নড়ে উঠে।পুকুরের ওই প্রান্তে বাঁশঝাড়।তার শুকনো পাতা পড়ে আছে পুকুরের জলে।তার একটু দুরেই আরেকটা ঘাট তৈরি করা।এর পাশেই রেইনট্রি।মোটা বটগাছ,একটা কদম গাছ।মাঝের কিছু জায়গা ফাঁকা।এখানে হিন্দুদের একটা সমাধি আছে।রোজ ধূপ জ্বালানো হয়।একটা উঁচু বলয়ে তুলসি গাছ লাগানো।রোজ সন্ধ্যায় হিন্দু বাড়ির খুড়োপিসি পিদিম জ্বালিয়ে দেয় তুলসি তলায়।
সারহানের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক নড়ে উঠে।তার বুকের ভেতরটা ক্রমশ এক ভয়ংকর ভয়ের আবেশে ভারি হচ্ছে।তার হৃদপিন্ডটা যেনো কেউ খাবলে ধরেছে।যেনো এখনি তা টেনে হিঁচড়ে বের করে নিবে।এমন কেনো হচ্ছে সারহান জানে না।ওই ছোট্ট প্রাণ যা এখনো এই দুনিয়াতেই আসে নি তার জন্য এই মনটা কেন উতলা হয়!কেন এতো ভয় হয় তাকে হারানোর!এরই নাম বুঝি পিতৃত্ব!
সারহান বোঝে না।জীবনের মায়া না করা সারহানের আজ খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়।ওই ছোট্ট প্রাণটাকে এই হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।তার নরম কপোলে চুমু আঁকতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু সারহান ভাবে,তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার এতো চিন্তা সেখানে তার মায়ের কোল থেকে যখন তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে তখন তার কেমন লেগেছে!তার কী আদৌ বাঁচতে ইচ্ছে হয়েছে!এ কেমন মায়াজাল!
যার অস্তিত্ব এখনো পৃথিবী দেখেনি তাকে পাওয়ার জন্য সারহানে সত্তা আকুলিবিকুলি করছে সেখানে তার মায়ের বুক খালি করে তাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
তৎক্ষণাৎ সারহানের শান্ত,কোমল মন গর্জে উঠে।তার ভেতরকার মানুষটা হুংকার দিয়ে বললো–
“নাহ,করবে না সে ক্ষমা।ওই মানুষটাকে সে কখনো ক্ষমা করবে না।”
কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে অন্তরার সে মায়াভরা মুখ।এতো স্নেহ,এতো ভালোবাসা।সব কী মিথ্যে !মা কী কখনো মিথ্যে হয়!
কিন্তু সেই বিদ্বেষী আবার সারহানকে শ্বাসায়—
“নাহ।তোকে নরম হলে চলবে না।এই কষ্ট তার প্রাপ্য।সন্তান হারানো এক মায়ের আকুতি।তাকে ক্ষমা করা যাবে না।”
সারহান চমকে উঠে।তার কাঁধে আলতো হাত রাখে জমির।সারহানদের বাড়ি যাওয়ার পথেই কুঞ্জপুকুর।ছোটবেলাই কতো ঝাঁপাঝাঁপি করেছে এই পুকুরে।আজ শুধু তা স্মৃতিকথা।
জমির নির্বিঘ্নে বসলেন।কোমল হাসলেন তিনি।সারহান ঘুরে বসলো।বাবার দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো।জমির সারহানের কাঁধে পুরো হাতটা দিলেন।নিজের বুকের একপাশে সারহানের মাথাটা ছোঁয়ালেন।আজ এতোদিন পর ছেলের স্পর্শে বাবার হৃদয় গভীর উচ্ছ্বাসে সরব হলো।সারহান শান্ত হয়ে রইলো।জমির তাকে ছেড়ে বসলেন।আবেগী গলায় বললেন—
“বাবা হতে চলেছিস।নিশ্চয়ই ভয় হচ্ছে?
সারহান তার বাবার দিকে তাকালো।কী সুন্দর ওই দুই চোখ।কতো মমতা খেলে যাচ্ছে সেখানে।সারহানের সেই মমতা দেখতে ইচ্ছে হলো।সে তাকিয়ে রইলো।জমির স্মিতহাস্য অধরে আবার প্রশ্ন করলেন—
“কথা বলছিস না যে?
সারহান সরব হলো।বললো—
“হুম।হচ্ছে।কোথাও কিছু হচ্ছে বাবা।বুঝতে পারছি না।বাবা হওয়ার অনুভূতি বুঝি এমনই হয়!
জমির চমৎকার হাসলেন।স্বাভাবিক গলায় বললেন—
“হয়।সব পুরুষের মধ্যেই একটা বাবা থাকে।কিন্তু তা অদৃশ্য।তার পরিস্ফুটতা ঘটে ওই ছোট্ট একটি ডাকে।বাবা!
সারহান সরস হাসলো।বাবা!চমৎকার শব্দ।অদ্ভুত একটা অনুভূতি আছে এতে।ছেলে হয়ে জন্মানো সারহান একদিন কিশোরে রূপ নেয়।তারপর যুবকে।একজন স্বামী।আজ তার পূর্ণতা আসতে চলেছে।সেও বাবা হবে।তার ভেতরকার সুপ্ত একটা মানব যার আছে স্নেহ,আদর আর ভালোবাসা তা সবার সামনে আসতে চলেছে।বটবৃক্ষের মতো কাউকে ছায়া দিবে সে।তার ছোট্ট আঙুল ধরে কেউ বলবে বাবা।কী অদ্ভুত শব্দ!
সারহান সুপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।আবার ঘুরে বসে সে।পুকুরের ওই পাড়ে তাকায়।একটা পাখি দেখা যাচ্ছে ওই সমাধিতে।সারহান আলতো গলায় প্রশ্ন করে–
“বাবা,একটা প্রশ্ন করি?
জমির সোজা গলায় বললেন—
“কর।”
নির্বিঘ্নে প্রশ্ন করে সারহান—
“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?আমাকে না আপুকে?
দুর্বোধ্য হাসলো জমির।অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় উদাস ভঙিতে পাল্টা প্রশ্ন করে—
“আমি যদি তোকে বলি তোর দুই চোখের মধ্যে কোন চোখটা আমায় দিবি তাহলে তুই কোনটা দিবি?
ফট করে ঘুরে বসে সারহান।অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠে–
“মানে?
জমির শীতল গলায় বললো—
“সন্তান বাবা মায়ের সেই দুই চোখ,যার একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন কাঁদতে বাধ্য।তুই যদি আমাদের প্রাণ হোস তাহলে শুভ্রা আমাদের দেহ।প্রাণ ছাড়া যেমন দেহ মূল্যহীন তেমন দেহ ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন।”
নীরস হাসলো সারহান।হালকা কন্ঠে শুধায়—
“তাহলে দাদু এমন কেন করলো?
জমির আকাশের দিকে তাকালেন।নির্মেঘ আকাশে যেনো তিনি তার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখলেন।প্রসন্ন হাসলেন তিনি।গম্ভীর গলায় বললেন—
“বাবা সেকেলে মানুষ।বংশ রক্ষায় ছেলে সন্তানের গুরুত্ব বুঝতেন।তাই।”
“তাই বলে..।”
জমির হুট করেই বললেন—
“তুই নিশ্চয়ই তোর বোনকে ফেলে দিবি না!
সারহান চুপ করে রইলো।জমির আলতো করে সারহানের হাত ধরলেন।বললেন—
“চল, আজ তোকে মহানবী( সাঃ) এর সেই মা পাখিটি আর তার ছানার গল্প শোনাবো।তারপর একসাথে খাবো।অনেকদিন একসাথে খাওয়া হয় না।কী জানি তোর ছেলে এলে আর সে সুযোগ নাও পেতে পারি!
সারহান মৃদু লজ্জায় হাসলো।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইশাককে দেখে খলবলিয়ে উঠে রাফাত।যখন থেকে ওই গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে এই ঘরে নিজেকে বদ্ধ করে নিয়েছে।গর্জে উঠে রাফাত বললো—
“কেন এসেছিস এখানে?বের হ,বের হ আমার ঘর থেকে।”
হতচকিত গলায় ইশাক বললো–
“এমন করছিস কেন?কী হয়েছে তোর?
দাপিয়ে উঠে রাফাত।ইশাককে এক ধাক্কা মেরে বললো—
“চলে যা এখান থেকে,চলে যা।আমার কাউকে চাই না।কাউকে না।”
ইশাক রাফাতকে শান্ত করা চেষ্টা করছে।কিন্তু রাফাতের রাগ তরতর করে যেনো তার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের চেষ্টায় অব্যাহত।খাবলে ধরে ইশাকের টিশার্ট রাফাত।গরগরে গলায় ক্ষীপ্ত হয়ে বললো—
“বলছি না চলে যা।আর কখনো আসবি না।কেউ আসবি না আমার কাছে।কাউকে চাই না আমার।সবাই ধোঁকাবাজ।সবাই।”
রাফাতের চিৎকার চেঁচামেচিতে দৌঁড়ে আসে তার বাবা মা।কোনো মতে ক্ষুব্ধ রাফাত থেকে ইশাককে ছাড়িয়ে রুমের বাইরে নিয়ে আসে।দরজা লক করেই দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিচে বসে পড়ে রাফাত।দুই হাতে নিজের চুল খাবলা মেরে ধরে।চিৎকার করে উঠে রাফাত।সেই চিৎকারে কেঁপে উঠে রাফাতের মা,বাবা আর ইশাক।
পুরো ঘরে সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ওয়াইনের বোতলের টুকরোগুলো ফ্লোরে গড়িয়ে আছে।সিলিং আর দেয়াল জুড়ে শ’খানেক ড্রিম ক্যাচার।বিছানায় পড়ে আছে জান্নাহ্ এর জন্য আনা সেই রেড গাউন।শুকনো চেরি ফুলের ধ্বংসাবশেষ।খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে আছে রাফাতের নির্জীব চেহারা।চোখের নিচটায় দেবে আছে।কালো রঙে ছেয়ে আছে তা।ফ্লোরে আছে কালচে রক্তের ছোপ।রাফাতের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শুকনো রক্ত কালসে হয়ে আছে।সমস্ত ঘরজুড়ে ভোটকা গন্ধ।এক মৃত্যুপুরীতে বসবাস রাফাতের।এক হতজীব প্রাণি সে।
রাফাতের বাড়ি থেকে বিষন্ন মন নিয়ে বের হয় ইশাক।ঝাপসা চোখে পকেটে দু হাত পুরে অগোছালোভাবে হাঁটছে।আকস্মিক সামনে আসা তীব্র বেগের গাড়ির হুডের উপর আঁছড়ে পড়ে ইশাক।ধাতস্থ হয়ে সামনে তাকাতেই গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে উগ্রমুর্তি ধারণকারী সুদর্শন পুরুষটি তড়িৎ বেগে এসে ইশাকের গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয়।হতভম্ব ইশাক কিছু বুঝে উঠার আগেই তার কান চেপে ধরে ব্যক্তিটি।অরুনলোচন চোখে তাকিয়ে তপ্ত গলায় বললো—
“তাহলে এই তোর ডাক্তারী?
ইশাক কিছু বলবে তার আগেই ব্যক্তিটি তার কান চেপে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসায়।
,
,
,
বিভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে ইশাক।সামনের ব্যক্তিটির প্রকুপিত মুখ দেখে ভয়ে তটস্থ সে।সামনের ব্যক্তিটি দারাজ গলায় বললো–
“কবে এসেছিস তুই?
ইশাক ভাঙা ভাঙা গলায় প্রত্যুক্তি করে—
“সাত মাস।”
উবলে উঠে ইহতিশাম,বললো—
“সাত মাস! আর তুই এই পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করিস নি!
ইশাক ভীত গলায় নরম হয়ে বললো—
“ভাই।আই এম রিয়েলী সরি।আসলে..।”
ইহতিশাম নাকের পাটা ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে।দমদমে গলায় বলে উঠে—
“চাচা,এতো কষ্ট করে তোকে ডক্টরী পড়তে পাঠিয়েছে আর তুই চলে এলি!চাচার কষ্টের কোনো দাম নেই তোর কাছে?
ইশাক অনুযোগের সুরে বললো—
“ভাই,আই এম সরি।আসলে যা হয়েছে তার জন্য আমি..।”
ইশাক চুপ হয়ে যায়।ক্ষুব্ধ গলায় শাসিয়ে উঠে ইহতিশাম–
“বল।চুপ করে আছিস কেন?
ইশাক ধীর গলায় রাফাতের পুরো কথা শোনায়।ইশাক ইহতিশামের চাচাতো ভাই।ইশাক দেশে ফিরেও গ্রামে যায়নি।এতোদিন রাফাতের সাথেই ছিলো।কিন্তু গ্রাম থেকে ফিরে এসে একটা ম্যাসে থাকা শুরু করে।সম্পূর্ন ঘটনা শুনে উদ্দীপিত হয় ইহতিশাম।কৌতূহলী গলায় বললো—-
“মেয়েটার নাম কী?
সহজ গলায় উত্তর করে ইশাক—
“জান্নাহ্।”
ঝিমুনি দিয়ে উঠে ইহতিশামের শরীর।চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করে।নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে সে।চাপা গলায় প্রশ্ন করে—
“ওর হ্যাজব্যান্ডের নাম সারহান?সারহান জেইদি?
ইশাক উৎসুক গলায় বললো–
“তুমি কী করে জানলে?
ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেললো।নাকের তলায় হাত রেখে কিছু একটা ভাবছে।পৃথিবী আসলেই গোল।এক গোলকধাঁধা।সেই ধাঁধার উত্তর পেতে আমরা সবাই একে অপরের অপর নির্ভরশীল।ইশাক সম্মোহিনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।গভীরভাবে ইহতিশামের চিন্তিত মুখের অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করলো।সে দেখলো ইহতিশামের দুই ভ্রু এর সন্ধিস্থলের সেই তারকা চিহ্ন মৃদু ছন্দে নড়ছে।কপালের উপরে মসৃনতা ভেঙে মোটা মোটা ভাঁজ পড়েছে।মৌনতা ভেঙে চটপটে গলায় আবদার করে বসে ইহতিশাম–
“তুই আমার সাথে রাফাতের দেখা করিয়ে দিতে পারবি?
ইশাক দ্বিধান্বিত গলায় প্রত্যুত্তর করে বললো—
“ভাই,রাফাত এখন উন্মাদ।কাউকে সহ্য করতে পারে না।হি ইজ লাইক আ ব্লাডি হান্টার।”
ইহতিশাম জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তা আবার চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বললো—
“আই উইল ম্যানেজ।তুই আমার সাথে ওর দেখা করিয়ে দে।”
ইশাক আশ্বস্ত গলায় বললো–
“আচ্ছা ভাই।”
তপ্ত গলায় বললো ইহতিশাম—
“আজ এখানেই থাকবি।বস,মাকে খাবার দিতে বলছি।রাফাতের সাথে আমার মিট করিয়েই বাড়ি যাবি।চাচা আমাকে পাগল করে ফেলছে।”
ইশাক আনম্র চোখে তাকায়।
,
,
,
বিছানায় আসন পেতে বসে আছে জান্নাহ্।চারপাশে সুনসান নিরবতা।জান্নাহ্ এর কোমর জড়িয়ে তার কোলে মাথা দিয়ে বসে আছে সারহান।শান্ত,শীতল,নিষ্কম্প।প্রায় এক ঘন্টা ঠাঁই এভাবেই বসে আছে সারহান।জান্নাহ্ আলতো হাতে সারহানের ঘন চুল নাড়িয়ে যাচ্ছে।তার দুই চোখের পল্লব সিক্ত।নাক টেনে নিয়ে বললো—
“সারহান,এমন কেন করছেন?আমি ঠিক আছি।”
সারহান এক চুলও নড়লো না।কোনো প্রতিক্রিয়াও করলো না।উল্টো আরও জোরে চেপে ধরলো জান্নাহ্কে।মুখটা সোজা করে জান্নাহ্ এর পেটের দিকে গুঁজে দেয়।ক্ষনকাল পরপর বিক্ষিপ্ত শ্বাস টানে সারহান।তার শুষ্ক অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্ এর উন্মুক্ত উদরে।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।সারহানের ভেজা গালের স্পর্শ পায় জান্নাহ্।আলগোছে সারহানের মাথাটা উঠিয়ে নির্বিকার চোখে তাকায় সে।সারহানের দুই গালে লেপ্টে আছে নোনতা জল।যা জবজবে।জান্নাহ্ দুই হাতের তালু দিয়ে ভালো করে মুছে দেয় সারহানের গাল।নরম গলায় বললো—
“আমি ঠিক আছি সারহান।দেখুন,একদম ঠিক আছি।”
চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে আবারও আঁকড়ে ধরে জান্নাহ্কে।কেঁপে কেঁপে উঠে সারহান।তার ভয় তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো।একটু আগেই তিতির সাথে ছোটাছুটি করতে গিয়ে সিঁড়িতে পিছলে যায় জান্নাহ্।দুই সিঁড়ি নিচে গড়িয়ে পড়তেই সিঁড়ির ধারালো কোণা লেগে ছুঁলে যায় জান্নাহ্ এর হাঁটু।ভাগ্যিস সারহান ধরে ফেলেছিলো তার হাত।তাই পেটে কোনো চাপ লাগেনি।চিৎকার চেঁচামেচিতে ছাদ থেকে ত্রস্ত পায়ে দৌঁড়ে আসে নিধি।একটু আগেই একগাদা কাপড় নিয়ে ছাদে উঠেছে সে।সিঁড়ির উপরে পানি হয়তো তার অজান্তেই পড়েছে।
অন্তরা পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।নিধির চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে অভব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।বেচারি নিধি শুধু চোখের জল নাকের জল এক করেছে।
আর সেই থেকে সারহান ঘরের দরজা বন্ধ করে জান্নাহ্কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।কাউকে একটা কথাও বলেনি।এমনকি নিধিকেও না।বাড়ির সবাই তাজ্জব বনে যায় সারহানের এই আকস্মিক পরিবর্তনে।এইসব কী শুধুই সারহানের প্রায়শ্চিত্ত নাকি ওই ছোট্ট প্রাণটার প্রতি আর হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা !
দুপুরের সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে।জৈষ্ঠ্যের কাঠফাটা রোদ যেনো আগুনের লেলিহান শিখা।নিরাক পরিবেশ।একটা পাতাও নড়ছে না।সূর্যের দম্ভ করা অগ্নিলাভা থেকে শেষ রক্ষে হলো না।থমথমে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠাঁল গাছটা যেনো রোদকে শাসিয়ে বলছে সময় একদিন আমারও আসবে।মুহূর্তেই কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে কাঠাঁল গাছের পাতা।কাকের কর্কশ ধ্বনির সাথে তাল মিলিয়ে যেনো পাতারা হাসছে।
মৃদু গলায় সারহান বললো—
“এতো কষ্ট না দিয়ে একবারেই মেরে ফেলুন আমাকে।মরে যাই আমি।”
জান্নাহ্ এর বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়।সারহানকে না জানিয়ে যখন সে কনসিভ করে জান্নাহ্ বুঝতে পারেনি সারহান এতো সহজে সবটা মেনে নিবে।কিন্তু যখন থেকে বাবা হওয়ার আনন্দকে সে উপলব্ধি করেছে সে যেনো অন্য এক সারহান।ঘি ঢালা আগুনে তেঁতে উঠা সারহান যেনো তাপে গলে যাওয়া প্যারাফিন।বাচ্চা নিয়ে এতোটা কনসার্ন হবে তা জান্নাহ্ কখনো ভাবতে পারে নি।সারহানের কখনো এইসবে আগ্রহ ছিলো না।উপরন্ত সে চাই নি জান্নাহ্ মা হোক।কিন্তু এমন কী হয়েছে এখন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে!
নিষ্প্রভ সুরে বললো জান্নাহ্—
“সারহান,নিজেকে সামলান।আমি সাবধানে থাকবো।বিশ্বাস করুন।আর কখনো এমন হবে না।”
সারহান তপ্ত হয়ে উঠে।কড়া গলায় বললো—
“কী করে বিশ্বাস করি আপনাকে!আজই তো আমার সবকিছু শেষ করে দিচ্ছিলেন।”
“সরি।”
সারহান রাগের সাথে অভিমান মিশিয়ে বললো—
“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আমি নিজেকে বদলাতে চাই।কেন দিচ্ছেন না সেই সুযোগ আমাকে?
অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার সম্মুখীন হয় জান্নাহ্।সারহানের দুই শান্ত চোখ মুহূর্তেই আগ্নেয়গিরির মতো উগরে উঠে।হিংস্র হায়েনার মতো জান্নাহ্ এর উপর ক্ষেপে উঠে তার দুই গাল নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে দাঁতখামটি মেরে বললো—
“যদি আমার সন্তানের কিছু হয় জান নিয়ে নিবো আপনার।আমার পরীর গায়ে যদি কেউ একটা ফুলের টোঁকা দেয় তার পুরো জীবন ভ্রংশ করে দিবো আমি।”
ব্যথায় কুঁকড়ে যায় জান্নাহ্।তার দুই চোখ টলটল করে উঠে।সারহান শিথিল করে তার হাত।জান্নাহ্ এর ভীতসন্ত্রস্ত দুই চোখ আটকে আছে সারহানের ওই ক্ষীপ্ত চাহনিতে।একটু ধাতস্থ হয়ে জান্নাহ্ এর পেটের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে গনহারে চুমুর আন্দোলন চালাতে থাকে।অস্বাভাবিক কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে সারহান বললো—
“ডোন্ট ওয়ারি পরী।পাপা আপনার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না।আপনি একটুও ভয় পাবেন না।পাপা ইজ অলওয়েজ উইথ ইউ।”
সারহান চোখ তুলে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।পেছন দিকে ঝুঁকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।তার শ্বাস যেনো তার মায়া ছেড়ে দিচ্ছে।সারহান গম্ভীর থাকলেও আজ পর্যন্ত তার সাথে কোনোদিন এমন আচরণ করে নি।ফাঁকা ঢোক গিলে জান্নাহ্।ঠোঁট দুটো চেপে ভেতরে নিয়ে তা ভিজিয়ে নেয়।গাঢ় দৃষ্টিতে সারহানকে দেখে।কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে সে।জান্নাহ্ এর নরম মেদহীন উদরে হাত বুলাতে থাকে।যেনো কোনো শিশুকে আদরে ঘুম পাড়াচ্ছে ।অস্পষ্ট ছড়া কাটে সারহান।অধরে বোকা বোকা হাসি।চোখে আদুরে ভাব।তার অঙ্গভঙ্গি কেমন দিশেহারা,পাগল,চেতনাহীন মানুষের মতো।জান্নাহ্ এর শ্বাস ভারি হতে থাকে।এ কোন মহাবিপদ সংকেত!না চাইতে আঁতকে উঠে জান্নাহ্।ভয়ে তার কলিজা ফুড়ে যাচ্ছে।সারহানের আচরণ স্বাভাবিক নয়।এইটুকুতেই সারহান আজ যে আচরণ তার সাথে করেছে যদি সত্যিই কিছু হয়ে যায়!
তাহলে প্রলয় শুরু করে দিবে সারহান।সেই প্রলয়ে সব ভ্রষ্ট হয়ে যাবে।
চলবে,,,
???