জান্নাহ্,পর্বঃ৪৭,৪৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৪৭
সকালটা তপ্ত রোদে ছাওয়া।ভ্যাবসা গরমে নাভিশ্বাস উঠার যোগাড়।ঘূর্ণায়মান ফ্যানের নিচেও যেনো মনে হচ্ছে আগুনের দলা সিলিং খসে খসে পড়ছে।সেই হাওয়াতেও জ্বলছে শরীর।
ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছে অন্তরা।তার পাশেই বসে আছে সারোজা বেগম।জান্নাহ্কে ডেকে আনে নিধি।তাকে দেখেই একগাল হাসলেন সারোজা বেগম।পান খাওয়া দাঁতগুলো কেলিয়ে বললেেন—
“অ্যারে বউ তুই দেহি আগেরতুন আরো বেশি সুন্দর হইছোস!
জান্নাহ্ মৃদু হাসে।নিঃশব্দে সারোজা বেগমের পাশে গিয়ে বসে।তার দিকে উন্মুখ হয়ে আছে শুভ্রা,অন্তরা,নিধি।সারোজা দাঁত কেলিয়ে হেসেই জান্নাহ্ এর শাড়ির আঁচল ভেদ করে তার পেটে হালকা চাপ দেয়।চমকে উঠে জান্নাহ্।চোখ বড় বড় করে তাকাতেই মৃদু হেসে অন্তরা বললেন—
“ভয় পাইয়ো না বউ।খালা দেখতাছে তোমার পোলা অইবো না মাইয়া।”
জান্নাহ্ কিঞ্চিৎ ভ্রু ক্রুটি করে তার বিরক্তি বুঝানোর চেষ্টা করে।সারোজা বেগম দাম্ভিক হেসে বললেন—
“চিন্তা করিস না অন্তরা,পোলাই অইবো।”
অন্তরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো যেনো।তার চোখ,মুখ ঝলমলে সোনালী রোদের মতো চিকচিক করে উঠে।
প্রাণখোলা হেসে বললেন–
“সত্যি কইতাছো খালা!
সারোজা ক্রোধান্বিত গলায় বললেন—
“তোর কী মনে অইতাছে আমি মিছা কথা কই!সারোজা বেগম যা কয় তাই ই অয়।তোর সারহাইন্নার পোলাই অইবো।মনে নাই শুভার সময় কী কইছিলাম!পোলা অইবো কইছিলাম আর তোর নাতি অইছিলো।”
প্রশান্তিময় হাসলেন অন্তরা।সারোজা বেগম সেকেলে মানুষ।তার চক্ষু তীরের ফলার মতো।যেনো খুঁচিয়ে ভেতরের খবর বাইরে নিয়ে আসেন।তাই তিনি দেখেই বলতে পারেন ছেলে হবে না মেয়ে।দাত্রী হিসেবেও তার অনেক পরিচিতি।জাবিন আর তিতির সময় তিনিই ছিলেন।হয়তো কোনো মেডিক্যাল ইস্যু না থাকলে জান্নাহ্ এর নর্মাল ডেলিভারিতে তিনিই থাকবেন।কিন্তু সারোজা বেগমের বয়স হয়েছে।
জান্নাহ্ অধর কোণে হাসলো।মনে মনে আরেক পসলা হাসলো।এভাবে কী বলা যায় নাকি ছেলে হবে না মেয়ে হবে!তার উপর সারহান চায় তার মেয়ে হোক।সারহানের ধারণা তার একটা ছোট্ট পরী হবে।কিন্তু সে যদি জানে তার পরী নয় রাজকুমার হবে তখন!
জান্নাহ্ কথা বাড়ালো না।বয়স্ক মানুষ যা বুঝেছেন তাই বলেছেন।যা হবে দেখা যাবে।আপাতত তার বাবার পাগলামি ভয়ংকর।মৃদু গলায় জান্নাহ্ বললো—
“দাদু,আপনার জন্য চা নিয়ে আসি?
সারোজা বেগম আপত্তি করে বললেন–
“নাহ।গরমে মইরা যাইতাছি।এই গরমে চা খাইতাম না।”
“তাহলে বেলের শরবত নিয়ে আসি?
“যাও,এতো যখন কইতাছো নিয়া আসো।একটু চিনি বাড়াইয়া দিও।”
“আচ্ছা।”
জান্নাহ্ উঠে দাঁড়াতেই দেখে ঝড়ের বেগে দরজা দিয়ে ঢুকেছে সারহান।কোনোদিকে তার খেয়াল নেই।সোজা গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে।অন্তরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরস গলায় বললেন–
“তোমারে আর শরবত বানান লাগবো না বউ।সারহান আইছে তুমি ঘরে যাও।”
“জ্বী আম্মা।”
অন্তরা নিধিকে শরবত বানিয়ে আনতে বললেন।সারোজা বেগম মুখে বড়সড় পান গুঁজে নিলেন।পান চিবুতে চিবুতে বললেন—
“বউডা দিনদিন কী সুন্দর হইতাছে!পোয়াতি মাইয়ারা এমনেই সুন্দর অয়।তার উপর তোমার বউর তো পোলা অইবো।পোলা অইলে মায়েগো রূপ খেইলা উঠে।দেহোনাই শুভার সময় অইছিলি!আমাগো শুভা কী সুন্দর অইছিলো!
অন্তরা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
ঘরে ঢুকে আরেক দফারফা।সারহান তার ঘামার্ত জামা কাপড় বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে রেখেছে।শশব্যস্ত হয়ে কাপড় পরিবর্তনে ব্যস্ত সে।ধূসর রঙের শার্টটা পরেই আলমিরা খুলে কিছু নগদ টাকা আর চেক বইটা নিয়ে নেয়।জান্নাহ্ মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কী হলো?কোথায় যাচ্ছেন?
সারহান সরল গলায় বললো—
“ঢাকা।”
চমকে গিয়ে জান্নাহ্ বললো—
“কেন?
নিজের সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় সারহান বললো–
“এই শ্রীজাটাও মরার সময় পেলো না!
জান্নাহ্ এর সন্দিগ্ধ চোখের চাহনিতে সারহান আবার বললো–
“এনজিও পেছনের দিকে ঘরগুলো অনেক পুরোনো।গত ঝড়ে সেগুলোতে ফাটল দেখা দেয়।বিভিন্ন ঝামেলার কারণে ঠিকও করতে পারিনি।তৌহিদ আর তানিয়াকে কতবার বললাম কাউকে যেনো সেদিকে যেতে না দেয়।গাধার বাচ্চাগুলা কী করে কে যানে!আর এই শ্রুতিটাও কারো কথা শোনে না।কী করতে গিয়েছিলো কে জানে!দেয়াল ধ্বসে শ্রুতির পায়ের উপর পড়েছে।”
আঁতকে উঠে জান্নাহ্।উদ্বেলিত গলায় বললো—
“কী বলছেন এইসব?
“হুম।শায়িখ ওকে হসপিটালে নিয়েছে।আমাকে এখনই যেতে হবে।”
জান্নাহ্ এর কাছে এসে দাঁড়ায় সারহান।তার ললাটে অধর ঠেকিয়ে বললো—
“আমি দু’দিন পর এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।সাবধানে থাকবেন।আর আমার পরীর খেয়াল রাখবেন।”
জান্নাহ্ সারহানের দুই হাত ধরে চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে।
“আসি।”
ব্যস্ত পদযুগলে লম্বা লম্বা পা ফেলে বের হয় সারহান।জান্নাহ্ এর পাংশুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস।
,
,
,
হসপিটালের করিডোরে বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আছে সারহান।হসপিটালে এসে শ্বাস নেওয়ারও সময় পায়নি।শ্রুতির চিৎকারে যেনো মুছড়ে যায় তার ভেতরটা।মেয়েটা কী কখনো একটু সুখ পাবে না!
করিডোর থেকে সারহানের চোখ যায় রিসিপশনে।একটা তেরো কী চৌদ্দ বছরের মেয়ে একজন বয়স্ক মানুষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখে সারহান।মেয়েটি রিসিপশনে ওয়েটিং চেয়ারে বসে।পাশে অতি সাবধানে বয়স্ক মানুষটিকে নিয়ে বসায়।
সারহানের মানসপটে ভেসে উঠে সেই সন্ধ্যেবেলা।এমনই একদিন হসপিটালে প্রথম দেখেছে সে তার রজনীগন্ধাকে।দুই ঘন পল্লবে আবৃত চোখ,একপাশে সিঁথি করে চুল ফেলে রেখেছে দু’পাশে।সেই চুল গিয়েছে ঠেকেছে তার রজনীগন্ধার কোমরে।সিঁথির দুই পাশে তিনটি করে মৌ ক্লিপ লাগানো।ব্রাউন কালারের চুড়িদারের সাথে হলুদ,কালোর মিশেলে হাঁটু অব্দি লম্বা ফ্রক।পায়ে লাইট পিংক কালারের স্ক্যাকার্স।
জান্নাহ্ তার বাবার হাত ধরে যাচ্ছে আর বারবার ফিরে দেখছে সারহানকে।সারহানের পুরো শরীর তখন রক্ত মাখানো।বেখেয়ালিভাবেই সারহান তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।কিন্তু জান্নাহ্ এর ওই হৃদয়হরণ করা চোখ আর কলিজা কাঁপিয়ে দেওয়া তার পাতলা ঠোঁটের হাসিতেই যেনো ক্ষনে ক্ষনে মরতে ইচ্ছে হয় সারহানের।কিন্তু পরক্ষনেই সারহানের মনে হলো সে তো অনেক আগেই মরে গেছে।এখন যা আছে তা শুধুই দেহ নেই তার আত্না।
বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় সারহান।আজ সে জীবন্ত।ওই ছোট্ট মেয়ে তার প্রাণ সঞ্চারিনী।তার নির্জীব দেহে প্রাণের জন্ম দিয়েছে।তাকে প্রাণদেবতা বানিয়েছে।
সারহানের ভাবনার ব্যবচ্ছেদ ঘটে তার মোবাইলের রিংটনে।হাতে নিতেই দেখে এই মূহুর্তে যাকে তার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে সেই ব্যক্তির কল।সারহান পরম আবেশে হাসলো।রিসিভ করেই অতি আবেগের সাথে বললো—
“কেমন আছেন রজনীগন্ধা?
জান্নাহ্ অভিমানি গলায় বললো–
“দুরে গেলে আর আমাকে মনে পড়ে না?
স্মিতহাস্য অধরে প্রত্যুক্তি করে সারহান–
“মনে তো তাকে করবো যে দুরে।যে এই বুকে তাকে কী করে ভুলে যাই!
লজ্জামিশ্রিত হাসে জান্নাহ্।ফিকে গলায় বললো–
“শ্রুতি কেমন আছে?
সারহান সাবলীল গলায় বললো—–
“ভালো নেই।গোড়ালির উপরের দিকে হাড়টা ভেঙে নিচের দিকে চলে গেছে।অপারেশন ইমিডিয়েট করতে হবে।আমি এখন আসতে পারবো না রজনীগন্ধা।সময় লাগবে।”
জান্নাহ্ মিষ্টি গলায় ভরসা দিয়ে বললো—
“চিন্তা করবেন না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আগে শ্রুতি ঠিক হোক তারপর আসুন।আমি নিজের খেয়াল রাখবো।”
সারহান কন্ঠে গভীরতা টেনে বললো—
“শুধু নিজের নয়।আমার পরীরও খেয়াল রাখবেন।তার কিছু হলে কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়বো না।”
জান্নাহ্ ঝুমঝুমিয়ে হাসে।সারহান ভ্রু নাচিয়ে বললো–
“হাসছেন কেন?
আরেক পসলা হাসে জান্নাহ্।ঠোঁট চিপে হাসি রোধ করে ক্ষীন গলায় বললো–
“আজ সারোজা দাদু এসেছিলেন।তিনি বললেন আমাদের ছেলে বাবু হবে।”
হঠাৎ করেই সারহানে কিছু হলো।কড়া গলায় বললো—
“মা নিয়ে এসেছে তাই না?
“হুম।”
তাচ্ছিল্য হাসলো সারহান।তার ঘৃণা যেনো বিদ্যুতের মতো ঝাঁকিয়ে তুললো তাকে।থমথমে গলায় বললো—
“কিছু খেয়েছেন আপনি?
“হুম।আপনি নিশ্চয়ই কিছুই খান নি?
“সারহান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো—
“আপাতত খেতে ইচ্ছে করছে না।কাল সকালেই শ্রুতির অটি।দোআ করবেন।মেয়েটা যেনো ঠিক হয়ে যায়।”
“আল্লাহ্ এর ভরসা রাখুন সারহান।তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”
সারহান কথা কাটতে বললো–
“আচ্ছা রাখছি।রেস্ট নিন।রাতে খেয়ে ঘুমাবেন।”
“আচ্ছা।”
মোবাইলটা পকেটে রেখে রেলিং এ হাত দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ায় সারহান।নিমীলিত চোখের পর্দায় সে দেখতে পায় শ্রুতিকে।যে মানুষটাকে সে খুঁজে চলছে সেও শ্রুতির মতো।এই জন্যই কী এতোটা অনুভব করে সে শ্রুতিকে!
জান্নাহ্ এর পাশে শুয়ে আছে তিতি।বিকেলে এসে সে যে শুয়েছে আর উঠেনি।আধশোয়া হয়ে কথা বলছিলো জান্নাহ্।কথা শেষে নিজের পেটের উপর আলতো হাত রাখে জান্নাহ্।স্বগতোক্তি করে বললো—
“দেখলি পুঁচকো,তোর বাবার আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই।সব চিন্তা তোর জন্য।তুই এলেই তোর বাবা একদম বদলে যাবে।আমি আমার প্রাণকে ফিরে পাবো পুঁচকো।তুই ভালো থাকিস।তোর কিছু হলে যে আমি আমার সব হারিয়ে ফেলবো।”
ছোট্ট দম ফেলে জান্নাহ্।ডেলিভারি নিয়ে তার ততটা ভয় নেই।অনেক কাছ থেকে সে এইসব দেখেছে।ছোটবেলা থেকেই হসপিটালে আসা যাওয়া তার।প্রেগন্যান্সির জটিল বিষয়গুলো সে তার বাবার কাছ থেকেই জেনেছে।শুনেছে সেইসব মায়েদের আর্তনাদ যারা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুসম যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে।কিঞ্চিৎ ভয় হয় জান্নাহ্ এর।কিন্তু এই বাড়ির মানুষগুলোর খুশি আর তার প্রাণের জন্য সে এইটুকু সহ্য করেই নিবে।মা হবে সে।এইটুক যদি সহ্য করতে না পারে তাহলে মা হওয়ার সার্থকতা কী!
কিন্তু জান্নাহ্ এর ভয় হয় সারহানকে নিয়ে।সারহানের ব্যবহার কেমন ভয়ংকর,শান্ত।সন্তান নিয়ে সে একটু বেশিই পজেসিভ।দুনিয়াজুড়ে তামাম কথা ভাবতে ভাবতে চোখে বুজে আসে জান্নাহ্ এর।ঘুমে ঢুলে পড়ে সে।
রাত প্রায় দশ।হঠাৎ জান্নাহ্ নড়ে উঠে।বুঝতে পারে না সে।একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে।তলপেটে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে।কিছু বুঝে উঠার আগেই তরতরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।জান্নাহ্ এর মনে হলো কেউ যেনো তার পেটে ছুরিকাঘাত করছে।জান্নাহ্ চমকিত হয় তার শরীরের নিম্নাংশ দেখে।সে অনুভব করে একটা উষ্ণ স্মিত ধারা নেমে যাচ্ছে।ঠোঁট কামড়ে ধরে জান্নাহ্।পায়ের দিকটা রক্তে মাখামাখি।বিছানার চাদর খামছে চিৎকার দিয়ে উঠে জান্নাহ্।পাশে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাক ছোট্ট তিতি ধড়ফড় করে উঠে চোখ কচলাতে থাকে।জান্নাহ্কে এই অবস্থায় দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।জান্নাহ্ ক্রন্দনরত গলায় বললো—
“তিইইইতি।আহ্!
তিতি ঝাপটে ধরে জান্নাহ্ এর গলা।কেঁদে কেঁদে বললো—
“পরীমা।”
তিতি জান্নাহ্ এর পায়ের দিকটা দেখে আরো চিৎকার দিয়ে উঠে।ছোট্ট বাচ্চার তীক্ষ্ম গলায় স্বর তার উপর জান্নাহ্ এর গলার আওয়াজে দরজায় করাঘাত শুরু হয়।কিন্তু জান্নাহ্ এর পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব না।নিজের এই অবস্থা আর তিতির কান্নায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে জান্নাহ্।উচ্চ গলায় বলে উঠে—
“আম্মা,শুভ্রা আপু!
কিন্তু ভেতরে আসার আর কোনো পথ নেই।ছোট্ট তিতি কী করবে ভেবে পায় না।তার পরীমার চোখের পানি সে দেখতে পারছে না।জান্নাহ্ ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়ছে।ওদিকে সমানতালে দরজা ধাক্কাচ্ছে জমির,সেরাজ।
এক অদ্ভুত কাজ করলো তিতি।বিছানা থেকে নেমে ডিভানের সামনে থাকা সেন্টার টেবিল ধাক্কা দিতে লাগলো।কিন্তু তা একবিন্দুও নড়াতে পারলো না তিতির ওই কচি হাত।সমানতালে কাঁদছে তিতি।রক্তে মাখা জান্নাহ্কে দেখে আরো ভয়ে কুঁকড়ে যায় তিতি।একটা টুল টেনে আনে।সারহানের রুমের দরজার দুটো ছিটকিনি।জান্নাহ্ মাঝের টাই লক করে।একমাত্র সারহান আসলেই উপরের ছিটকিনিটাও লক করা হয়।ছোট্ট তিতি নাগাল পেলো না।তখন অবিশ্বাস্য কাজ করলো সে।বারান্দায় থাকা তুলসি গাছটা মরে গেছে।তার টবটা এমনিতেই পড়ে আছে।ছোট্ট তিতি সেটাই নিয়ে আসে।সে একটা মুভিতে দেখেছিলো এমন।টবটাকে উপুর করে রাখে তিতি।টুলের উপর উঠে সাবধানে পা উঠায় টবের উপর।অনেক কষ্টে ছিটকিনি খোলে তিতি।হুরহুড়িয়ে ঘরে ঢুকে সবাই।জান্নাহ্কে দেখে মরা কান্না জুড়ে দেয় অন্তরা।শুভ্রা গিয়ে জান্নাহ্ এর মাথাটা নিজের কোলে নেয়।শ্রান্ত জান্নাহ্ হাত পা ছেড়ে দেয়।অজ্ঞান হওয়ার আগে শুধু এতটুকুই বললো—
“শুভ্রা আপু,আমার বাচ্চা…।”
অন্তরা সেরাজকে অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে বলে।অন্তরা মাথা চাপড়াতে থাকে।রক্তের শ্লথ ধারা বলে দিচ্ছে আর কোনো আশা নেই।জমির যেনো পুরো জমে গেলেন।জাবিন ভেতরে আসলো না।বরফখন্ডের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো।জান্নাহ্ এর অচেতন শরীর পড়ে রইলো শুভ্রার কোলে।জাবিন এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে আসে।জান্নাহ্ এর ফর্সা মুখটা নীল হয়ে আছে।জাবিনের পা খাবলে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো তিতি—
“ভাইয়া,পরীমা!
জাবিনের দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।বিছানার রক্ত দেখে গা গুলিয়ে উঠলো তার।যেনো নিঃশ্বাস আটকে আসলো।
অন্তরা বিলাপ করতে থাকে।সেরাজ একের পর এক কল করেই যাচ্ছে।জান্নাহ্ নিশ্চেতন।সে অবচেতন মনে তার প্রাণকেই দেখছে নিশ্চয়ই।কী জবাব দিবে সে তার প্রাণকে?
সে যে তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারে নি।ক্ষমা করবে তার প্রাণ তাকে?
সে ফিরে আসবে তো মৃত্যুর দুয়ার থেকে?নাকি নিজ সন্তানের সাথে সেও চলে যাবে তার প্রাণ থেকে দুরে,বহুদুরে।আর কখনো তাদের দেখা হবে না।হবে না কথা।হয়ে যাবে সব স্মৃতিকথা।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
হসপিটালের সফেদ বিছানায় শুয়ে আছে জান্নাহ্।তার মাতৃত্বের বিসর্জন হয়েছে।যে ছোট্ট প্রাণটা এক সমুদ্র খুশি নিয়ে এসেছে সেই খুশিকে এক মুহূর্তে পা দিয়ে পিষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।জানালার পর্দা উড়িয়ে ফিনফিনে বাতাস বইছে।শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।তার দেহ তো পড়ে আছে কিন্তু তা প্রাণহীন।
এক মুহূর্তে মনে হয়েছে সে নিজেও হয়তো আর মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসবে না।কিন্তু সে এসেছে,সব হারিয়ে এসেছে।এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো।বুক কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।ঠোঁট কামড়ে বিছানার সফেদ চাদর হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে।তার পাপের সাজা আজ তার সন্তানকে পেতে হলো।
ঘোলা চোখে কেবিনে কারো অস্তিত্ব টের পায় জান্নাহ্।নরম পায়ে কেবিনে ডুকেছে সারহান।রাতে জান্নাহ্কে হসপিটালে নিয়ে আসার পর ভোরের দিকে সারহানকে জানানো হয় পুরো ঘটনা।আর এই ভয়ংকর কাজটা করে সারহানকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করা সেই ব্যক্তি জাবিন।সারারাত কেঁদেছে জাবিন।তার উনিশ বছরের জীবনে এমন বীভৎস ঘটনার সম্মুখীন সে কখনো হয়নি।যেই মানুষটাকে এতোটা ঘৃণা করতো আজ তার জন্য গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিলো তার।
সারহানকে দেখেই পাশ ফিরে জান্নাহ্।কী করে দেখবে এই মানুষটার মুখ।কাল রাতেও একরাশ বুক ভরা আশা নিয়ে ছিলো।আর আজ!
সারহান নিঃশব্দে জান্নাহ্ এর পাশে এসে দাঁড়ায়।ফিনাইলের কটকটে গন্ধ নাকে এসে ঠেকে তার।হাঁটু মুড়ে বসে সে।জান্নাহ্ এর ছড়ানো চুলে নিজের মাথা ঠেকিয়ে ভেজা গলায় বলে উঠে—-
“এমন কেন করলেন রজনীগন্ধা?এতো বড় শাস্তি কেন দিলেন আমায়?এর চেয়ে আমার প্রাণটাই কেড়ে নিতেন।”
জান্নাহ্ ঠোঁট কামড়ে চুপ করে আছে।তার শ্বাস আটকে আসছে সারহানের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দে।বুকের ভেতর পুঞ্জীভূত ব্যথাটা যেনো ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগ করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।বিবশ হয়ে আসছে তার শরীর।ক্রমশ নিজেকে একটা লাশ হিসেবে আবিষ্কার করছে জান্নাহ্।
সারহান আলতো করে জান্নাহ্ এর চুল থেকে মাথা উঠায়।থমথমে গলায় বললো–
“আপনার আল্লাহ্ কেন করলো এমন আমার সাথে?জবাব দিন রজনীগন্ধা।আমার পাপ কী আমার প্রায়শ্চিত্তের চেয়েও বড়!
উত্তর দিন রজনীগন্ধা।”
কান্নার তোড়ে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠে জান্নাহ্ এর নির্জীব শরীর।সারহান ঘুরে বিছানায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে।হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁটের উপর অগোছালো একটা ঘষা মেরে স্বাভাবিক গলায় বললো—
“ভালোই হয়েছে।আমার মতো পুরুষের বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই।আমার জন্মই পাপ।আমার সন্তান সেই পাপের সমুদ্রে আসতে চায়নি।আপনি তাকে টেনে আনতে চেয়েছেন।ভালোই হয়েছে।”
জান্নাহ্ সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে।বিড়বিড় করে আবোলতাবোল বলেই যাচ্ছে সারহান।তা নিরব দর্শকের মতো হজম করছে জান্নাহ্।পাপ তো সেও কম করেনি।আজ তার পুঁচকোকে তার জান দিয়ে সে পাপের ভার হালকা করতে হলো।
ধীমপায়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।কোনো রকম শব্দ ছাড়াই কেবিন থেকে বেড়িয়ে হাঁটা ধরে।দেয়ালে এক পা ঠেসে হেলান দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেরাজ।সারহান কিছুই দেখলো না।সে উন্মনা হয়ে হাঁটছে।ওয়েটিং চেয়ারে বসে আছে জমির।তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক হতপ্রায় জীব।যার মনে ছিলো উচ্ছলতা,বুকে ছিলো বাবা হওয়ার খুশি,চোখ ভরা ছিলো আশা।আজ সব শেষ।জমির নিরবে কাঁদলেন।সারহান তার সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।অচঞ্চল পায়ে অগোছালোভাবে এগিয়ে চলছে সে।সারহান জানে না তার আশে পাশে কী হচ্ছে।তার বুকটা কেমন খালি খালি মনে হচ্ছে।এই যে এখানে,এখানে একটা যন্ত্র থাকে।যাতে প্রাণের শ্বাস থাকে।সারহানের মনে হচ্ছে তা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।এই যে এইখানে পাঁজরগুলো,খুব যন্ত্রণা হচ্ছে এখানে।এই যে চোখ দুটো যা দিয়ে সে তার পরীকে দেখতে চেয়েছিলো,তা জ্বলে যাচ্ছে।ধীম ধীম পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সারহান।জমির তার অশ্রুভরা চোখে তার সারহানকে দেখছে।সেই সারহান,যে তিনটা আইসক্রীম চাইলে তিনটাই তাকে দিতে হতো।নাহলে বাকিগুলো রাস্তায় ফেলে বালিতে মেখে ফ্রিজে রেখে আসতো।সেই সারহান,যার পায়ে একটা পিঁপড়া কামড় দিলে সেই দিন আর কারো কোল থেকে সে মাটিতে পা রাখতো না।আজ সে শান্ত,সমাহিত।জমির অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।তার নেকড়ে বাঘ যেনো হুংকার দিতে ভুলে গেছে।
সিঁড়ি দিয়ে ব্যাগভর্তি ঔষধ নিয়ে উঠছিলো জাবিন।স্টিলের রেলিং ধরে নিষ্প্রাণ প্রাণির মতো এক পা এক পা করে অসাঢ় পা দুটো ফেলে আবেগশূন্য চাহনিতে নেমে যাচ্ছে সারহান।তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ায় জাবিন।দুই প্রান্তের দুই মানুষের মাঝ দিয়ে ব্যস্ত মানুষগুলো উঠছে আর নামছে।জাবিনকে পেছন ফেলে সিঁড়ির নিচের দিকটায় চলে যায় সারহান।ঔষধের ব্যাগটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আচমকাই জাবিনের মনে হলো ওই ঘৃণিত মানুষকে একবার মামা বলে ডাকতে।একবার তার বুকে পড়ে কেঁদে বলতে আমরা আছি তো।
কিন্তু বলা হলো না।জাবিনের ভেতরকার মানুষটি সায় দিলো না।একটা দ্বিধান্বিত মন তাকে কষে চড় মেরে বললো,” ভুল করলি জাবিন।একদিন এই জন্যই তোকে পস্তাতে হবে।”
সারহান হেঁটে চলছে।উদ্দেশ্যহীন পথ চলা তার।তার পাপ তাকে ঘিরে ধরেছে।এর থেকে মুক্তি নেই।হাঁটতে হাঁটতে আজান শুনতে পায় সারহান।সামনেই সদরের মসজিদ।বেখিয়ালিভাবেই মসজিদে ঢুকে সারহান।খাদেম হুজুর নামাজিদের জন্য জায়গা ঠিক করছেন।সারহান অজু করে ভেতরে যেতেই দেখে পুরো ফ্লোর খালি।সে গিয়ে সামনের দিকের তৃতীয় সারির দেয়ালের পাশের দিকে বসলো।একটা পিলার আছে সেখানে।সারহান তার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়ালের দিকে মাথা হেলিয়ে দিলো।যথা সময়ে নামাজ শুরু হলে সবার সাথে নামাজ আদায় করে সারহান।একে একে মসজিদ ফাঁকা হতে থাকে।ইমাম সাহেব দেখলেন কেউ একজন বসে আছে এখনো।তিনি কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে শুনছেন সারহানের কান্না।কান্না থামাতে নিজে বা’হাতের তালু কামড়ে ধরে রেখেছে সারহান।সে যতই চাইছে নিজেকে শান্ত করতে ততই যেনো তার ভেতরকার সন্তান হারানো বাবা কঠোর দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে আসতে চাইছে।এই বুকটা চিরে দেখাতে ইচ্ছে করছে কতটা ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছিলো এই বুকে।কান্নার তোড় থামাতে নিজের দাঁতের উপরেই জোর লাগায় সারহান।নিজেকে গুটিয়ে একটা বলয় তৈরি করে যেনো তাতেই আবদ্ধ হতে চায় সে।আরেক হাত দিয়ে দুই হাঁটু জড়ো করে ধরে রেখেছে সারহান।তার গলা বেয়ে ঝড়ছে নোনতা জলের ধারা।
তীক্ষ্ম দাঁতের আঘাতে সারহানের হাত কেটে রক্ত ঝড়তে লাগলো।ইমাম সাহেব আর চুপ থাকলেন না।শশব্যস্ত হয়ে বসে পড়লেন সারহানের পাশে।তার মুখ থেকে হাত টা সরাতেই গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসে।ইমাম সাহেব তার পকেটে থাকা মসৃন,নরম সাদা ছোট্ট তোয়ালে টা সারহানের হাতে পেচিয়ে দিলেন।উদ্ভ্রান্তের মতো ইমাম সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো সারহান।গলার স্বর সূচাঁলো করে কাঁদতে লাগলো।ইমাম সাহেব বেশ অবাক হলেন।চমকে গিয়ে বললেন—
“আল্লাহর ঘরে এসে কেউ ফেরত যায় না বাবা।শুধু চাইতে হয়।”
সারহান ধরা গলায় ব্যস্ত হয়ে বললো—
“চেয়েছি,চেয়েছি আমি তার কাছে।পাইনি আমি।ফিরিয়ে দিয়েছে সে আমায়।কেন ফিরিয়ে দিলো?আমাকে কী ক্ষমা করা যেতো না?তার দরবারে নাকি সবাই ক্ষমা পায়।তাহলে আমাকে কেন খালি হাতে ফেরালো?
ইমাম সাহেব সারহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—
“ধৈর্য্য ধরো বাবা।তিনি কাউকে নিরাশ করেন না।এই পৃথিবীতে তিনি তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন যারা তার উপর ভরসা রাখে।সবুরে মেওয়া ফলে।আল্লাহ্ পাক তোমার থেকে যা কেড়ে নিয়েছেন তার দ্বিগুণ ফেরত দিবেন।শুধু প্রয়োজন তাকে বিশ্বাস করা,তার প্রতি একাগ্রতা থাকা।”
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ইমাম সাহেবের সুশ্রী মুখের দিকে চেয়ে রইলো সারহান।
,
,
,
আজ সাতদিন।সময়ের সাথে ভরতে থাকে ক্ষত।কিন্তু তার রেশ রয়ে যায় বহুদিন।সেদিনের পর থেকে জান্নাহ্ এর সাথে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় সারহানের।শুধু জান্নাহ্ নয়,বাড়ির কোনো মানুষের সাথে কথা বলে না সারহান।বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকে।তার দাদুর কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে।সারহানের মনে হয় তার জীবনের এই বিপর্যয়ের শুরু এই মানুষটার জন্যই হয়েছে।ক্ষমা করবে না সে তাকে।বাড়ির প্রতিটি মানুষের মাঝেই অদ্ভুত নীরবতা।সবাই অতি স্বাভাবিক আচরণ যাকে সহজ ভাষায় অস্বাভাবিক বলে।
বাইরের দুনিয়া দেখা হয় না জান্নাহ্ এর।তার সমস্ত খুশি এক নিমিষেই মিলিয়ে গেছে।শরীর সুস্থ হলেও তার মন কখন সুস্থ হবে তা সে জানে না।বিছানার উপর ঘাপটি মেরে জানালা ঘেঁষে বসে আছে।নীলাভ ঝকঝকে আকাশ।আছে শুধু দলা পাকানো শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি।সাদা আর নীলের এক অকল্পনীয় মিশ্রণ।জান্নাহ্ ঠাঁই নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে।
বিড়ালপায়ে রুমে ঢুকে সারহান।কোনো ধরনের কৃত্রিম উত্তেজনা ছাড়াই ট্রলি ব্যাগটা টেনে নিয়ে আলমিরা থেকে সাবধানে জান্নাহ্ এর কাপড় নিয়ে তা গুঁছাতে থাকে।আকস্মিক ঘটনায় সরব হয় জান্নাহ্।তবুও শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে —
“কী করছেন সারহান?
থমকে যায় সারহান।তার রজনীগন্ধার কন্ঠস্বরে যেনো প্রাণ ফিরে পেলো সে।কাপড় ভাঁজ করতে করতে নরম গলায় বললো—-
“আমরা ফিরে যাচ্ছি।”
ব্যস্ত ভঙিতে বিছানা ছাড়ে জান্নাহ্।কৌতূহলী গলায় বললো—
“কোথায় যাবো?
“ঢাকা।”
জান্নাহ্ গলার স্বর শক্ত করে বললো—
“আমি কোথাও যাচ্ছি না সারহান।”
সারহানের চাপা ক্ষোভটা সেকেন্ডেই ফুঁসলে উঠলো।দারাজ গলায় বললো—
“কী বলতে চান আপনি?
চোখের পলকেই কেঁপে উঠে জান্নাহ্।স্থির গলায় বললো–
“এই বাড়িতেই থাকবো আমরা।”
ছুঁড়ে ফেলে দেয় ব্যাগ।মসৃণ কপালটা ভাঁজ করে চোয়াল শক্ত করে বললো—
“কেন যাবেন না আপনি?
জান্নাহ্ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে—
“দেখতেই তো পাচ্ছেন সবার অবস্থা।তবুও কেন পাগলামি করছেন?
এইবার যেনো সারহানের রাগ পাহাড়ের মতো ধ্বসে পড়লো।তেড়ে এসে জান্নাহ্ এর দুই বাজু চেপে ধরতেই শক্ত হয়ে যায় জান্নাহ্।চোখের পল্লব প্রশস্ত করে ভয়াতুর চাহনিতে সারহানের ওই ক্ষোভিত নয়নযুগল দেখে।প্রানআত্না কেঁপে উঠে তার।সারহান যেনো ওই চোখ দিয়েই তাকে শেষ করে দিবে।বজ্রকঠোর কন্ঠে শাসিয়ে উঠলো সারহান—
“পাগল তো আপনি আমাকে বানিয়েছেন।কেন কথা রাখেন নি আপনি?কেন আমাকে এতো আশা দিলেন! আমি তো আপনাকে বলিনি এইসব করতে।তাহলে এখন কেন সব কেড়ে নিলেন আমার কাছ থেকে?
জান্নাহ্ বরফখন্ডের মতো জমে যায়।সারহান আবারো অগ্নিনালা মতো জ্বলে উঠে বললো—
“যেতে আপনাকে হবেই।এই বাড়িতে আমি আপনাকে রাখবো না।যেই বাড়ির মানুষগুলো আমার সব ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে সেই বাড়িতে আমি আপনাকে রাখবো না।”
এক পশলা পানি ঝড়িয়ে ফিকে গলায় জান্নাহ্ বললো-
“কিন্তু সারহান..।”
হতচকিত জান্নাহ্ তার কথা শেষ করার আগেই দেয়ালের সাথে লেপ্টে থাকা টেবিলের উপর থেকে ল্যাম্পশেডটা নিয়ে কর্ণার শোকেসে ছুঁড়ে মারে সারহান।ঝনঝন করে তা ভেঙে পড়ে।সেরাজ,শুভ্রা,অন্তরা বাদ বাকি সবাই দৌঁড়ে আসে।জান্নাহ্কে ভীতসন্ত্রস্ত দেখে যেই অন্তরা তার কাছে এগোতে লাগলো ঠিক তখন ই সারহান খলবলিয়ে উঠে —
“একদম আগাবেন না।ছোঁবেন না আমার রজনীগন্ধাকে।এই বাড়ির মানুষগুলো আমার সব কেড়ে নিয়েছে।”
অন্তরা ক্রন্দনরত গলায় শুধায়–
“কী হইছে বাপ?এমন করতাছোস ক্যান?মায়ের কথা শোন।সব ঠিক হইয়া যাইবো।বউ আবার মা হইবো।তোর সব আশা পূরণ হইবো।”
সারহান তাচ্ছল্য চোখে তাকিয়ে দাঁত মুখ খিঁচে চড়ানো গলায় বললো—-
“চুপ করুন আপনি।এইসব কিছুর জন্য আপনি দায়ী।কে বলেছিলো আমাকে ভালোবাসতে?কে বলেছিলো ওই নোংরা আস্তাকুড় থেকে টেনে আনতে আমাকে।যেখানে শুরু হয়েছিলো সেখানেই আমার জীবন শেষ হয়ে যেতো।মরে যেতাম আমি।তাহলে এই জঘন্য জীবন পেতে হতো না আমাকে।”
হতবিহ্বল দৃষ্টি সকলের।সারহানের কথা জের কেউ বুঝলো না।তিতির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাবিন।তার চোখে প্রশ্নের আকুলিবিকুলি।বিমূঢ় গলায় অন্তরা বললো–
“এইসব কী কইতাছোস?
সারহান ধমকে উঠে বললো—
“ঠিক ই বলছি।আপনারা সবাই খুনি।আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন।এখানে থাকলে আমার রজনীগন্ধাকেও মেরে ফেলবেন।”
বিপন্ন গলায় অন্তরা বললো–
“পাগল হইছোস!কী কইতাছোস!আমরা কেন মারতে যামু তোর বউরে?
শুভ্রা যেনো একটা সুযোগ খুঁজছিলো।জোর গলায় মরিয়া হয়ে বললো—
“এমন নাটক করছিস কেন তুই?মিসক্যারেজ হওয়া আহামরি বিরল কিছু না।আর এতো তাড়া কীসের ছিলো বাচ্চা নেওয়ার!সবে তো ষোলো বছর।এই বয়সে বাচ্চা নিলে তো এমন হবেই।
যা হওয়ার হয়েছে।সময় চলে যায়নি এখনো।জান্নাহ্ তো ভালো আছে।বেঁচে আছে।মা হওয়ার অনেক সময় আছে।”
গনগনে আগুনে ঘি ঢালার মতো ফুঁসলে উঠে সারহান।দারাজ গলায় চিৎকার করে বলে উঠে—-
“মিসক্যারেজ স্বাভাবিক হলেও আমার সন্তানকে তার মায়ের গর্ভেই মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই।তোমারও নেই।”
ছয় জোড়া উৎসুক,কৌতূহলী আর প্রশ্নবিদ্ধ চোখ চেয়ে রইলো সারহানের দিকে।জান্নাহ্ যেনো গলে যাওয়া বরফের মতো অসহায় চাহনি দিয়ে তার প্রাণের আক্রোশ দেখছে।শুভ্রা হতভম্ব হয়ে যায়।তার চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করে।পুরো পরিবেশ নিমিষেই থমথমে রূপ ধারণ করে।সারহান তাচ্ছিল্যের সাথে আক্রোশ মিশিয়ে বললো—
“আমার শাস্তি আমার সন্তানকে কেন দিলে আপু?ওর তো কোনো দোষ ছিলো না।কেন করলে তুমি এমন?কেন?
শেষটুকু যেনো সবার হৃদয় কাঁপিয়ে দিলো।সবার আস্ত নজরে শুভ্রা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে মনে হয়।সারহান তীব্র ক্রোধে ক্রোধান্বিত হয়ে ক্ষেপে এসে শুভ্রার হাত ধরে নিজের রুম থেকে বের করে নিয়ে এসে শুভ্রার ঘরের মধ্যে নিয়ে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়।বাড়িসুদ্ধ মানুষ ভয়ে তটস্থ হয়ে দরজায় করাঘাত করতে থাকে।জমির হঠাৎই তার বুকে চাপ অনুভব করে।ঝিমঝিম করে উঠে তার মস্তিষ্ক।হাত,পা বিবশ হয়ে আসছে।ধপ করে কাউচে বসে পড়ে সে।বুকের ভেতরের থিতিয়ে থাকা ব্যথাটা ক্রমশ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
জমিরের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।তার মেয়ে!
ভাবতেই শরীরের মাংস যেনো কোনো সাড়াশীতে বিদ্ধ হচ্ছে।জমির ভাবতেই পারছে না শুভ্রা এইসব করেছে।শুভ্রা তার ভাইকে কখনো আপন ভাবতে পারে নি।সেই ছোট্ট সারহানকে তার মনে জায়গা দিতে পারে নি।সারাক্ষন বোনের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকা সারহান ভাবতে পারেনি তার সবচেয়ে বড় শত্রু তার প্রিয় বোন।
জমিরের নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে।সে দেখতেই পেলো না।চোখের সামনে ঘটা স্বাভাবিক ঘটনার পেছনেও এতো জঘন্য ষড়যন্ত্র।তার সারহানকে এইভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিলো।আর এই জন্যই সারহান তার বাবাকে চেপে ধরেছে নিজের জন্ম ইতিহাস জানতে।
জমিরের যেনো শ্বাস আটকে আসছে।সে কাউচে হেলান দিয়ে ভাবতে থাকলো।
চলবে,,,