জান্নাহ্,পর্বঃ৪৯,৫০
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৪৯
প্রায় মিনিট পনেরো পর শুভ্রার রুম থেকে বেরিয়ে আসে সারহান।বাইরে তালা লাগিয়ে তার চাবি নিয়ে নেয় বুক পকেটে।কঠিন শান্ত সে।রুম থেকে বেরিয়েই স্বাভাবিক হয়ে ডাইনিং চেয়ার সরিয়ে আরাম করে বসে সারহান।সবাই উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।জান্নাহ্ সারহানের সামনে গিয়ে অস্বস্তিকর গলায় বললো–
“এইসব কী শুরু করেছেন আপনি?
সারহান দুর্বোধ্য হাসলো।হালকা গলায় শুধায়—
“আপনি আমার সাথে যাবেন রজনীগন্ধা?
জান্নাহ্ প্রতিবাদের সুরে বললো—
“নাহ।কোথাও যাবো না আমি।আপনি চাবি দিন।কী করেছেন আপনি শুভ্রা আপুর সাথে?
সারহান জান্নাহ্ এর প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে থমথমে গলায় বললো–
“আপনি আমার সাথে যাবেন কিনা বলুন?
সেরাজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।সারহানের এমন রুক্ষ ব্যবহারে সে বরাবরই বিরক্ত।ফুঁসে উঠে বললো—
“এইসব কী ধরনের ব্যবহার সারহান?বোনের সাথে কেউ এমন করে?
সারহান ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে চরম আক্রোশ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।তার গায়ে যেনো অসুর ভর করলো।পুরো খাবারের টেবিলটাকে উল্টে ফেলে সংক্ষুব্ধ গলায় ঘোষনা করলো—
“নাহ।শুভ্রা আমার বোন নয়।কোনো সম্পর্ক নেই এই বাড়ির সাথে আমার।আমি আমার রজনীগন্ধার সাথে কথা বলছি।আর একটা কথাও কেউ বলবে না।”
সারহান তার রাগ প্রশমিত করে চেয়ারটাতে আবার বসে।ফোঁস ফোঁস করছে সে।সরব দৃষ্টি রেখে মখমলে গলায় বললো–
“পটাসিয়াম সায়ানাইড চিনেন তো রজনীগন্ধা!আপনার হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট আর শুভ্রা আপুর কাছে দশ থেকে পনেরো মিনিট।এখন বলুন আপনি আমার সাথে যাবেন কিনা?
আঁতকে উঠে জান্নাহ্।এইসব কী বলছে সারহান!পটাসিয়াম সায়ানাইড ইনজেক্ট করা হলে ভিক্টিমের হাতে বেশি সময় থাকে না।অধৈর্য গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—
“কেন পাগলামি করছেন সারহান?
সারহান অধর কোণে হেসে বিগলিত গলায় বললো—
“আপনি চলুন আমার সাথে রজনীগন্ধা।আপনি যেমনটা বলবেন আমি তেমনটা করবো।সময় বেশি নেই রজনীগন্ধা।যাবেন?
সারহানের কথা শুনে রক্তশূন্য হয়ে যায় সবার মুখ।ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই।জান্নাহ্ অবস্থা বেগতিক ভেবে বললো–
“যাবো,যাবো আমি।”
ঝরা হাসে সারহান।মিষ্টি গলায় বললো–
“যান তৈরি হয়ে আসুন।”
বিনা সময় ব্যয়ে নিজের রুমে পা বাড়ায় জান্নাহ্।সারহান উঠে দাঁড়ায়।বুক পকেট থেকে চাবিটা নিয়ে ছুঁড়ে মারে সেরাজের দিকে সাথে একটা সিরিঞ্জ।মৃদু গলায় বললো–
“এর মধ্যে সোডিয়াম থায়োসালফেট আছে।শুভ্রা আপুকে পুশ করে দিবেন।এতে সে আরো কিছুটা সময় পাবে।আমি অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিয়ে দিয়েছি।আসলো বলে।নিয়ে যান।খুনি নই আমি।তাকে বলবেন এর শাস্তি সে পাবে।আমার সন্তান দোষী ছিলো না।”
সারহান লম্বা শ্বাস টেনে নেয়।জাবিনের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো–
“পারলে তোর মামাকে ক্ষমা করে দিস জাবিন।”
জাবিন ভোলা চাহনিতে চেয়ে রইলো।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
অন্তরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন—
“এইসব কী কইতাছোস বাপ!শুভ্রা তোর বইন।অয় কেন তোর মানিকরে মারবো?
সারহানের কিছু একটা হলো।ভুমিকম্প উঠলো যেনো তার পায়ের নিচের স্তম্ভে।দুই হাঁটু ভেঙে নিচে বসে অন্তরার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো—
“কেন এতো ভালোবাসলে তুমি আমাকে?কেন এতো আগলে রাখলে?তোমার ভালোবাসা আমায় যে মৃত্যু দিলো মা।”
অন্তরা যেনো তার শ্বাস ফিরে পেলেন।মা!তার ছেলে তাকে মা বলে ডেকেছে।লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলতে থাকে অন্তরা।আর্দ্র গলায় বললেন–
“তোরে ভালোবাসমু নাতো কারে ভালোবাসমু!তুই তো আমার কলিজার ধন।”
“সত্যিই যদি তোমার গর্ভে আমার জন্ম হতো তাহলে এ পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান হতাম আমি।”
অন্তরা যেনো বিষ খেয়ে নিলো।তার সারা শরীরে বিষাক্ত হয়ে গেলো যেনো।সেই বিষ যেনো তাকে খুড়তে লাগলো।সন্দিগ্ধ গলায় বললেন–
“কী কস তুই!তুই আমার পোলা।এই কলিজায় রাইখা পালছি আমি তোরে।আমার পোলা তুই।আমি তোর মা।”
সারহান উঠে দাঁড়ায়।গাঢ় গলায় বললো—
“সত্য বদলায় না মা।আমাকে ক্ষমা করো।না বুঝে বারোটা বছর তোমাকে আমি কষ্ট দিয়েছি।বুজতেই পারি নি সন্তানের দেওয়া কষ্ট মা কে কতটা কাঁদায়।”
অন্তরা হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলো।এর মধ্যে জান্নাহ্ এসে দাঁড়ায়।সারহান শক্ত করে জান্নাহ্ এর হাত ধরে পা বাড়ায়।অন্তরা ঝাপটে ধরে সারহান কে।সারহানের বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার মায়ের কান্নায়।তবুও নিজেকে বজ্রকঠোর রেখে বললো—
“ভুলে যাও আমাকে মা।আমি আর কখনো এই বাড়িতে ফিরবো না।এই বাড়ি আমার নয়।বাবা মাকে সামলাও।”
জমির বরফ হয়ে গেলেন।তার দুনিয়ায় যেনো আজ উল্টে গেলো।তিতি দৌঁড়ে এসে খাবলে ধরে জান্নাহ্কে।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো–
“পরীমা তুমি যেওনা।মামা,তুমি পরীমাকে নিও না।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে জান্নাহ্ এর কাছ থেকে তিতিকে ছাড়িয়ে নিলো সারহান।তিতির চোখে মুখে চুমু খেয়ে বললো—
“তোমার পরীমা আর কখনো আসবে না তিতিসোনা।এই যে সবাই আছে।সবার সাথে থেকো।ভাইয়া আছে।ভাইয়ার সাথে রোজ খেলো।জাবিন সামলা তিতিকে।”
দাঁড়ালো না সারহান।হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো জান্নাহ্ কে নিয়ে।অন্তরা বিলাপ করতে লাগলো।জমির তাকে জড়িয়ে ধরলেন।সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–
“সারহান সব জেনে গেছে অন্তরা।ও আর ফিরে আসবে না।”
অন্তরা খেটখেটিয়ে উঠলেন—
“ক্যান আইবো না!জন্ম না দিয়ে কী মা হওয়া যায় না।আমি ওরে জন্ম দেইনাই তো কী অইছে।এই বুকে আগলাইয়া রাখছি ওরে আমি।আপনি ওরে থামান।থামান ওরে।ওরে ছাড়া আমি বাঁচুম না।”
সারহান সদর দরজায় পৌঁছায়।অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা যাচ্ছে।সারহান গাড়ির দরজা খুলে আবার পেছন ফিরে তাকায়।পুরো বাড়িটাকে দেখে যেখানে তার শৈশব কেটেছে।আর কখনো ফেরা হবে না এই বাড়িতে।দেখা হবে না এই মানুষগুলোর সাথে।
গাড়ি চলতে শুরু করলো।এক হাতে স্টেয়ারিং অন্য হাতে নিজের চোখ মুছে চলছে সারহান।তার ভেতরকার মানুষটি আজ সত্যিই মরে গেছে।
জান্নাহ্ চেয়ে আছে অবিরাম।
ছোটবেলা থেকে প্রাণচঞ্চল,দুরন্ত আর ডানপিটে ছেলে সারহান।ক্লাসেও সবসময় ভালো রেজাল্টের অধিকারি।দুষ্টমির সাথে সাথে ভালো ব্যবহারেরও সুনাম তার।ষোলো সতেরো বছরে দাদুর দেওয়া ভালোবাসার উপহার ছিলো তার সাইকেল।সারা এলাকা চষে বেড়াতো তার প্যাডেল মেরে।একদিন দুর্ঘটনাবশত সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে তার শিক ঢুকে যায় সারহানের পায়ে।খবর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সারহানের অবস্থা হাতের বাইরে।ছোট্ট একটা অপারেশন করাতে গিয়ে তাকে ব্লাড দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
প্রায় পনেরো দিন পর যখন সারহান সুস্থ তখন কথায় কথায় সারহান বললো তার বাবা তাকে রক্ত দিয়েছে।কিন্তু শুভ্রা ফট করে বলে ফেলে কী করে দিবে তার রক্ত তো কখনো ম্যাচ করবে না সারহানের সাথে।মুখ ফসকে বলা সেই কথার রেশ ধরে সারহান বোনের আগে পিছে ঘুরতে থাকে।জাবিন তখন তিন কী চার বছরের।
সারহান ছোটবেলা থেকেই প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারি।কোনো দ্বিধা তার মনের ঘরে ঘর বাঁধলে তা সে যে করেই হোক পরিষ্কার করবেই।তটস্থ সারহান বুদ্ধি করে যেই হসপিটালে তার অপারেশন করায় সেই ডক্টরের কাছে চলে যায়।তিনদিন তার আগে পিছে ঘুরে ডি এন এ টেস্ট করিয়ে জানতে পারে অন্তরা বা জমির কেউ তার বাবা মা নয়।চাপা কষ্টে যেনো ঘিরে ধরে সারহানকে।ভেতরে ভেতরে নিষ্পেষিত হতে থাকে সারহান।মরিয়া হয়ে উঠে সে।তার সেই জলন্ত আগুনে ঘি ঢালে শুভ্রা।সারহানকে বলে তার মা এই বাড়িতে কাজ করতো।অন্তরা যখন সন্তান ধারণ করতে পারছে না আর এই দিকে সারহানের দাদু তার বংশ রক্ষার জন্য পুত্র সন্তানের দিকে পথ চেয়ে আছেন।সারহানের বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে যান।আর এই বাড়িতে কাজ করার সময় সে জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে।টাকার বিনিময়ে সারহানকে কিনে নিতে ব্যর্থ অন্তরা সারহানকে কেড়ে নেয় এবং তার মাকে ব্রোথেলে বিক্রি করে দেয় যাতে করে সে আর কোনো দিন ফিরে আসতে না পারে।
এমনটা বলা হয় সারহানকে।আর দ্বিধান্বিত সারহান তাই বিশ্বাস করে এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর শহরে লেখাপড়ার নাম করে বেরিয়ে আসে সেই বাড়িতে।শুরু হয় তার অতীত খোঁজার লড়াই।
কিন্তু সত্য ছিলো অন্য।সারহানের দাদুর দুই ছেলে।জমির আর জয়নাল।দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্ধ ছিলো না।শুভ্রার জন্মের পর অন্তরা ইউটেরাসে ইনফেকশনের জন্য আর গর্ভধারণ করতে পারেনি।কিন্তু এই কথা কাউকে জানানো হয়নি।এর মধ্যে জয়নালের দুই মেয়ের জন্ম হয়।সারহানের দাদু বংশ রক্ষায় পুত্রশোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।এর মধ্যে অন্তরার বোন সান্তনা তাদের গ্রামের কমল নামে এক ছেলেকে ভালোবাসতো।ষোলো কী সতেরো বয়স ছিলো সান্ত্বনার।আবেগের বশে সবচেয়ে বড় ভুল করে।সংসারের টানাপোড়েনে কমল পাড়ি জমায় দুর দেশে।তার কিছুদিন পর সান্ত্বনা জানতে পারে সে মা হতে চলেছে।কিন্তু কমল বা তার পরিবার কেউ তা মানতে রাজি ছিলো না।এই অবস্থায় কম বয়সি হওয়ায় এবোর্শনেও ঝুঁকি দেখা দেয়।অন্তরা সেই সুযোগ কাজে লাগায়।জমিরকে তার কাজে প্রায়ই রূপগঞ্জ আসতে হতো।অন্তরা সেই সুবাদে জমিরের সাথে তাদের যৌথ পরিবার ভেঙে এখানে চলে আসে।সারহানের দাদু আপত্তি করলেন না।কারণ একজন ছেলের আশা যখন কেউ পুরণ করতে পারেনি তাই তিনি কারো উপর কোনো আশা রাখলেন না।
রূপগঞ্জ এসে নিজের বোনকে নিজ বাড়িতেই রাখেন।জানতে পারেন সান্ত্বনার ছেলে হবে।এক ঢিলে দুই পাখির মারার ফন্দি আটলেন অন্তরা।নিজের স্বার্থসিদ্ধি আর বোনের কলঙ্ক ঘুচাতে সারহানকে আপন করে নিলেন।সারহানের জন্মের সময় মারা যায় সান্ত্বনা।বোনের মৃত্যু শোকে কাতর অন্তরা সারহানকে বুকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখলেন।সারহানের জন্মের পরই জানানো হলো তার দাদুকে।এই নিয়ে জয়নাল আর লতা আপত্তি করলেন।অন্তরা জানান তিনি আগে থেকে কিছু বলেন নি কারণ যদি আবারো মেয়ে হয়।সারহানের দাদু যেনো পুর্নিমার চাঁদ হাতে পেলেন।নিজের বনেদি বাড়ি ছেড়ে রুপগঞ্জ এসে থাকতে লাগলেন।অঢেল আর অফুরন্ত ভালোবাসায় বড় হতে লাগলো সারহান।সারহানের দাদু তার সম্পত্তির আশি ভাগ সারহানের নামে করলেন।এই নিয়ে দ্বিমত করেন নি জয়নাল।কারণ ততদিনে লুবনার জন্ম হয়েছে এবং সে ভেবেছে লুবনার সাথেই সারহানের বিয়ে দিবে।
শুভ্রা সব নিরবে সহ্য করলেও ভেতরে ছিলো ছাই চাপা আগুন।যা একদিন দাবানল হয়ে সব জ্বালিয়ে দিলো।নিধির সাথেও বিয়ের ব্যপারে মত ছিলো না শুভ্রার।শুভ্রা কখনো চায়নি সারহান বিয়ে করুক।কারণ পরবর্তীতে এই সম্পত্তির মালিকানা পাবে সারহানের সন্তান।আর যদি সারহানের কোনো সন্তান না থাকে তাহলে জাবিন।নিজের সন্তানদের জন্যই এই ঘৃণিত ষড়যন্ত্রের ছক কষে শুভ্রা।কিন্তু মাঝে জান্নাহ্ এসে সব নড়বড়ে করে দেয়।সারহান কেন বিয়েতে রাজি হলো শুভ্রার তা অজানা।সারহানের মনে তার বাবার প্রতি ঘৃণা ছিলো যে তার মাকে ছেড়ে চলে যায়।
কিন্তু ভাগ্য হয়তো অন্য কিছুই চেয়েছে।শুভ্রা চায়নি সারহান আর জান্নাহ্ এর মাঝে সব ঠিক হোক।কিন্তু অন্তরা তাকে কিছু না জানিয়েই এই কান্ড করে বসে।তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে খাবারের সাথেই মেডিসিন মিশিয়ে জান্নাহ্ এর গর্ভেই তার সন্তানের আত্নাহুতি দেয়।
ভেবেছিলো কম বয়সের কথা বলে সব মাটি চাপা দিবে।কিন্তু সারহানকে ডক্টরই বলে যে ফিটার্স আগেই নষ্ট হয়ে গেছে আর সেই কারণেই ব্লিডিং বেশি হয়।সারহান আর কিছু না ভেবে তার বাবার কাছ থেকে সবটা জানতে চায়।বেকায়দায় পড়ে বাধ্য হয়েই জমির সবটা বলে।তাই সারহানের আর বুঝতে বাকি রইলো না যেই মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছে সেই ই তার বুকে খঞ্জর ঢুকিয়েছে।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ৫০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
রোদের তপ্ততায় ইহতিশামের নাভিশ্বাস।তবুও দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তমার এক ঝলক পাওয়ার জন্য।মেহনাজদের বাড়ির পাশেই যে বিশাল বটগাছ তার ছায়াতেই দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।ঘন্টা ধরে আজ তিনদিন এমনভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ইহতিশাম।মেহনাজদের বাড়ির সামনেই সূর্যের প্রখর তাপমাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে শরীর গলিয়েও মন গলাতে পারেনি মেহনাজের।বাড়ির পাশের বাগান থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোজ নিয়ম করে ইহতিশামকে দেখে মেহনাজ।আর তাকে দেখেই তাপে ছড়িয়ে পড়া ইলেকট্রনের মতো বিক্ষিপ্ত হতে থাকে মেহনাজ রাগ।
দুপুর রোদে জ্বলে পুড়ে মাত্রই বটগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইহতিশাম।আজ আর সে ফিরবে না।যতক্ষন না পর্যন্ত সে তার কথা ব্যক্ত করতে পারবে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।
মেহনাজদের বাড়ির দরজাটা কাঠের তৈরি।টিনের উপর আড়াআড়ি করে কাঠ লাগিয়ে তার দুটো পাল্লা করে মাঝে ছিটকিনি দেওয়া যেমনটা সাধারণ ঘরবাড়ির হয়ে থাকে।মেহনাজের তপ্ত দেহ যেনো আরো জ্বলে উঠলো ইহতিশামকে এখনো না যেতে দেখে।চঞ্চল পা তড়িৎ বেগে বাড়িয়ে বটগাছ তলায় এসে স্থির হয়।ক্ষোভিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কেন বারবার এখানে আসছো তুমি?তোমাকে না বাড়ন করেছি।”
ইহতিশাম বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো।কোমল গলায় বললো–
“কথাতো বললে নাজ।এতোটা দহন ক্রিয়ায় জ্বালিয়েও না আমায়।অনেক তো পুড়ালে,এইবার না হয় একটু প্রেমের বর্ষণই করাও।”
তেতে উঠে মেহনাজ।স্বশব্দে বলে উঠে—-
“প্লিজ,আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।যা ছিলো তা শেষ অনেক আগেই।আর কিছু হওয়ার বাকি নেই।”
ইহতিশাম করুণ গলায় বললো—
“একবার আমাকে বলার সুযোগ তো দাও।”
ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের মতো ইহতিশামের বুকে পড়ে মেহনাজ। তার শার্ট খামচে ধরে বুক কাঁপিয়ে কেঁদে বললো—
“কেন এমন করলে?কেন ধোঁকা দিলে আমায়?
ইহতিশাম আলতো হাতে জড়িয়ে নেয় মেহনাজকে।তার বুকটা যেনো অদ্ভুত শীতলতায় অাচ্ছন্ন হলো।মখমলে গলায় প্রত্যুক্তি করে বললো—
“আমি তোমাকে ধোঁকা দেয়নি নাজ।আমি আজও ঠিক ততটাই তোমায় ভালোবাসি যতটা প্রথম দেখায় বেসেছি।যা হয়েছিলো তা আমাদের ভাগ্যের দোষ।”
মেহনাজ ইহতিশামের বুক থেকে মাথা উঠায়।কান্না মিশিয়ে অভিমানি গলায় বললো—
“এখন ভাগ্যের দোষ কেন দিচ্ছো?সেদিন এমন কেন করলে?
ইহতিশাম বিগলিত গলায় দৃঢ় হয়ে বললো—
“যা দেখেছো ভুল দেখেছো ।”
মেহনাজ ভ্রু ক্রুটি করে।কান্নার ফলে তার চশমাটা ঘোলা হয়ে যায়।ইহতিশাম ধীর হাতে তা খুলে নিয়ে একটা টিস্যু দিয়ে মুছে আবার মেহনাজের চোখে লাগিয়ে দেয়।মেহনাজ তার কান্নার দলা গিলে নেয়।সম্পর্কের শুরু থেকেই ইহতিশাম যত্নশীল ছিলো তার প্রতি।কিন্তু হঠাৎ সবকিছু ছন্নছাড়া হয়ে গেলো।
বটগাছে নিচে বসে আছে দুইজন।গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যের তীর্যক রশ্মি ভেদ করে চলে আসছে।গাছের ডালের ছায়া পড়েছে মাটিতে।মেহনাজ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে।মৃদু গলায় বিড়বিড় করে বলছে ইহতিশাম—
“আসলে ওর সাথে অনেক বছরের টানাপোড়েন।একটা ঘটনার জের ধরে ও আমার উপর ক্ষেপে আছে।তাই সেদিন ওই ছবিগুলো ইডিট করে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।আমরা সবাই একটা পার্টিতে ছিলাম।ড্রিংস করেছিলাম।কিন্তু লিমিট ক্রস করিনি।মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত নেশাগ্রস্থ ছিলো।ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম।এর বেশি কিছুই না।তুমি সেদিন আমার পুরো কথা না শুনেই আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে।কতো খুঁজেছি তোমায় আমি।পাইনি।”
মেহনাজ স্থবির হয়ে রইলো।এই ছোট্ট ঘটনায় সে যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে।ইহতিশাম ঘাড় বাকিয়ে সরব দৃষ্টিতে তাকালো।স্মিত গলায় বললো—
“ক্ষমা করবে না আমাকে?
মেহনাজ দু’ফোটা চোখের পানি ফেললো।থমথমে গলায় বললো—
“আমার সেই অধিকার নেই ইহতিশাম।আমি তোমার যোগ্য নই।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো ইহতিশাম।গভীর সুরে বললো—
“এমন বলছো কেন?
হঠাৎ করেই ঝমঝম করে কেঁদে ফেলে মেহনাজ।বটতলায় যেনো ঝড় বইতে শুরু হলো।ব্যগ্র হয়ে বুকের সাথে মেহনাজকে চেপে ধরে ইহতিশাম।উদ্বেলিত গলায় বললো—
“শান্ত হও।কী হয়েছে খুলে বলো আমাকে।”
মেহনাজ তীক্ষ্ম সুরে ইহতিশামের হাতা খামছে ধরে বিলাপ করতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে আসে তার।ইহতিশাম হাত বুলাতে থাকে মেহনাজের মাথায়।
কাকের কর্কশ আওয়াজ ছন্দ তুলে নিরাক পরিবেশে।বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর একটু ধাতস্থ হয়ে মেহনাজ ধরা গলায় বললো—
“তোমাকে ভুল বুঝে আমি চট্রগাম চলে গিয়েছিলাম।সেখানে একটা নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে কোর্স করছিলাম।সেখানে আমার সাথে পরিচয় সীমানের সাথে।ও একজন ফটোগ্রাফার ছিলো।অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই কেনো যেনো ওকে ভালোবেসে ফেললাম আমি।রোজ হোস্টেলের বাইরে ঘন্টা ধরে আমার অপেক্ষা করতো।আমি ক্লাস শেষ করে আসতাম।আমার ছোট ছোট সব আবদার আমার বলার আগেই পূরণ করতো।কী থেকে কী হয়ে গেলো আমি জানি না।তোমার দেওয়া ধোঁকার পর আমি পুরো ভেঙে পড়েছিলাম।সবটা যেনোও সীমান আমাকে মেনে নিয়েছে।নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।উড়তে শিখিয়েছে।কিন্তু পরক্ষনেই আমার সেই সবকিছু এক নিমিষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে সীমান।নিজের স্বার্থসিদ্ধর পর হাওয়া হয়ে যায়।কোথায় থাকে,কোথায় কাজ করে কিচ্ছু জানি না আমি।ওকে খোঁজার কোনো উপায়ই ছিলো না আমার কাছে।”
ঝর্ণার বেগে কাঁদতে থাকে মেহনাজ।ভালোবেসে সতিত্ব হারিয়ে সে এখন ভাঙা আয়নার মতো।তাতে মুখচ্ছবি তো দেখা যায় কিন্তু তাতে অকল্যাণ বয়ে আনে।
ইহতিশামের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।মস্তিষ্কের রগগুলো টনটন করে যেনো ছিঁড়ে যাবে।হাতের রগগুলো ফুলে ফেঁপে উঠে।ফোঁস ফোঁস করতে থাকে ইহতিশাম।ভাবতেই ঘৃণা লাগছে।তার প্রিয়তমার শরীরে অন্য কারো স্পর্শ।ছিঃ!
বেশ কিছুক্ষন মৌনতায় কাটে দুইজনের।মেহনাজ নিজের অপরাধে অপরাধি।ইহতিশাম নিজের ভুলে সাজাপ্রাপ্ত।কিন্তু সে সত্যিই এই মেয়েটিকে ভালোবাসে।সত্যিই ভালোবাসে।হুট করে অবাক কান্ড করে ইহতিশাম।বুকের পিঞ্জিরায় ঝাপটে ধরে মেহনাজকে।আশ্বস্ত করে সকল ভুল,দুঃস্বপ্ন ভুলে তারা নতুন করে শুরু করবে।মেহনাজ রাজী নয়।সে এই মানুষটাকে ঠকাতে চায় না।কিন্তু নাছোড়বান্দা ইহতিশাম।শরীরকে নয় হৃদয়কে ভালোবেসেছে সে।আর এই হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা হৃদয় দিয়ে করবে।
মেহনাজের বাবা ইটালি গিয়েছে তার মাকে নিয়ে।দুই দিন আগেই তার অপারেশন হয়েছে।কৃত্রিম হাড় বসিয়েছে হুসনার পায়ে।হয়তো সে হাঁটতে পারবে।ইহতিশাম দেয়ালের সাথে চেপে জানালা দিয়ে নির্নিমেখ তাকিয়ে আছে।হাতে তার ধোঁয়া উড়ানো কফি।মেহনাজ শান্ত হয়ে বিছানায় বসে আছে।কফিতে চুমুক দিয়েই ইহতিশাম সন্দিহান গলায় বললো–
“সীমানের কোনো ছবি আছে তোমার কাছে?
মেহনাজ অস্ফুট স্বরে বললো—-
“নাহ।”
“ও ফটোগ্রাফার ছিলো?
“হুম।”
ইহতিশাম চট করে কিছু একটা ভাবলো।পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ছবি দেখালো মেহনাজকে।তড়ক করে উঠে মেহনাজের হৃদপিন্ড।এ তো সীমান!
থতমত খেয়ে বললো—
“তুতুতুমি এই ছবি কোথায় পেলে?ওকে চেনো তুমি?
এই এক লাইনেই যেনো গা ছাড়া দিয়ে উঠলো ইহতিশাম।বিছানায় বসে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মেহনাজের দিকে।ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনাজ।অতি শীতল গলায় ইহতিশাম বললো—-
“ও সীমান নয়।ও সারহান।আর ও কোনো ফটোগ্রাফার নো।একজন জার্নালিস্ট।”
ধপ করে নিচে বসে পড়ে মেহনাজ।ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে কম্পনরত গলায় বললো—
“সাআআরহান!সারহান জেইদি?জান্নাহ্ এর স্বামী?আমি আজ পর্যন্ত ওর স্বামীকে দেখিনি।শুধু শুনেছি।ওরর বিয়ের পর আর আসিনি বাড়ি।”
ইহতিশামের কানে বাঝতে থাকে সেই কথা।সারহান বলেছিলো সে বদলা নিবে,”না গিলতে পারবে না উগরাতে”।তাই ই করলো সারহান।বদলা নিলো।
দুই মানব-মানবীর ধূ ধূ নিঃশ্বাসের আওয়াজ বাতাসে আলোড়ন তুলতে লাগলো।ইহতিশাম নিজের মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।চোখ দুটো লালা হয়ে রক্তিম রঙ ধারণ করেছে।নাক ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে।এইভাবেও কেউ বদলা নেয়?
,
,
,
ছোট্ট মুখটা ম্লান করে ডিভানে বসে আছে জান্নাহ্।তার সামনেই তার প্রাণ অধীর আগ্রহে বসে আছে কখন কথা বলবে তার রজনীগন্ধা।জান্নাহ্ ভাবতেই পারছে না শুভ্রা এমন কাজ করতে পারে!
গোধূলিয ম্লান আলো তার পাট চুকিয়েছে অনেক আগেই।নিশুথি রাত ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে ঘড়ির কাটার সাথে।সময় চলে তার আপন গতিতে।কিন্তু সেই সময় বড্ড বেইমান।কাউকে দেয় আকাশসম খুশি আর কাউকে দেয় সমুদ্রের অগণিত জলরাশি সমান কষ্ট।কেউ তা দলিয়ে পা দিয়ে পিষে ফেলে সামনে এগুতে পারে কেউবা নিজেই নিষ্পেষিত হয় সেই মায়াজালে।
বিয়ের পর থেকে শুভ্রা জান্নাহ্কে নিজের ছোট বোনের মতো আগলে রেখেছে।সারহানের সব ব্যাপারে অবগত করেছে।কিসে সারহান খুশি হয়,কিসে সে রাগ করে।কিন্তু এতো কেয়ারিং এর মাঝে এতটা ঘৃণা চেপে রেখেছে মনে যার জন্য আজ তার অনাগত সন্তানকে মাতৃগর্ভেই প্রান দিতে হলো!
সারহান নির্বিকার গলায় বললো—
“কথা বলবেন না রজনীগন্ধা!শাস্তি দিচ্ছেন আমায়?
জান্নাহ ছোট্ট ঢোক গিলে আলতো গলায় বললো–
“বাড়ি যাবেন না সারহান?
তাচ্ছল্য হাসলো সারহান।উপহাস করে বললো—
“কার বাড়ি যাবো?ওই বাড়ি আমার নয় রজনীগন্ধা।আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে তারা।এতো ভালোবাসা আমি চাইনি রজনীগন্ধা।”
জান্নাহ্ এর চোখ ভরে আসে।উপচে পড়ে সাগরের নোনতা জল।ধরা গলায় বললো—
“আপনি এমন কেন করলেন?যদি শুভ্রা আপুর কিছু হয়ে যেতো!
তাচ্ছিল্য সুরে বলে সারহান—
“আমি এতোটাও নিষ্করুণ নই।এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো সত্যিই ওই মানুষটার জানটা আমি ছিনিয়ে নেই।যে আমার ছোট্ট সোনাকে বাঁচতে দেয়নি।কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি ওই দুইজন বৃদ্ধ মানুষের জন্য যারা হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়েছে আমায়।এক গলিত পঁচা নর্দমার সারহানকে বুকে তুলে নিয়েছে।ওই ছোট্ট দুটি আকুল সত্ত্বার জন্য যারা আমাকে মামা বলে ডেকেছে।আমি তো আপনাকে ছাড়া আমার একটা নিঃশ্বাসও কল্পনা করতে পারি না।তাহলে সেরাজ কী করে তার অর্ধাঙ্গীনিকে ছাড়া বাকি জীবন কাটাবে!তাই ক্ষমা করেছি তাকে আমি।আল্লাহ্ নাকি সবাইকে তার পাপের শাস্তি দেয়।আমি তার উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করলাম।”
বারকয়েক নাক টানে জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর সামনে আসন পেতে মেঝেতে বসে থাকা সারহান ধীরগতিতে হাঁটু মেঝেতে ঠেকিয়ে উঁচু হয়।জান্নাহ্ এর নাকের ডগায় অধর স্পর্শ করায়।নাকের নিচে উপরের ঠোঁটের মাঝ বরাবর যে দ্বিখন্ডিত ভাঁজ আছে তাতে ছোট্ট চুমু খায় সারহান।জান্নাহ্ এর নরম তুলতুলে দুই গালে শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ আঁকে ।আঁজলায় নিয়ে নেয় জান্নাহ্ এর মুখটা।অতি সন্তর্পনে মৃদু কামড় বসায় জান্নাহ্ এর নিচের অধরপল্লবে।ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললো—
“আপনাকে অনেক আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে রজনীগন্ধা।রেস্ট নিন।”
সারহান উঠে যেতে চাইলে তার হাত ধরে কাতর গলায় বললো জান্নাহ্—
“সারহান!
সারহান চোখে হেসে গাঢ় গলায় বললো–
“আপনাকে যে পুরো সুস্থ হতে হবে রজনীগন্ধা।এই প্রমত্তা নদীর উপচে পড়া ঢেউ তো আপনাকেই সামলাতে হবে।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।”
চলবে,,,