জান্নাহ্,পর্বঃ৬৫,৬৬

0
1479

জান্নাহ্,পর্বঃ৬৫,৬৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৬৫

টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দ।বাংলোর পেছন দিকের দুটো ঘরের বারান্দায় টিনের চাল।ঝমঝমিয়ে পড়ছে বৃষ্টি।শীতল,চঞ্চল বাতাস শনশন করে বইছে।ঝড়ো বৃষ্টির সাথে তীব্র বাতাসের আন্দোলন।

জান্নাহ্ হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁইছে।তার পাশেই তার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহান।অন্ধকার রাতের আকাশ ফুঁড়ে চলছে বৃষ্টির মাতম।এক পশলা বৃষ্টি এসে ঝপ করেই ছুঁয়ে যায় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ মুগ্ধ হাসে।ঝুমঝুমিয়ে উচ্ছাসের সাথে বললো—

“আমার বৃষ্টি ভালো লাগতো না।ছোটবেলা বৃষ্টি হলেই বাবা আর মাম্মা আমাকে স্কুলে যেতে দিতো না।বড্ড মন খারাপ হতো আমার।”

সারসান ফিক করে হেসে ফেলে।জান্নাহ্ কপাল কুঁচকে ভ্রু নাচিয়ে বললো—

“হাসছেন কেন?

সারহান বেশ কিছুক্ষন আনমনে হাসে।পাতলা টিশার্টের সাথে পরেছে ছাই রঙা ট্রাউজার।বৃষ্টির ছটা লেগে পিঠের দিকটা ভিজে আছে।পকেটে দু’হাত পুরে মোলায়েম গলায় বললো—

“আমার তো সেই লাগতো।স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিলো না।সামান্য বৃষ্টি হলেই মা আর আমাকে স্কুলে পাঠাতো না।সারাদিন চলতো ইনডোর গেম।মা রান্নাও করতেন অনেক।”

অনর্গল বলতে থাকে সারহান।ছোটবেলাকার স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত সারহানের চোখ,মুখ নিশি রাতের মায়া কাটিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠে।আচমকা থেমে যায় সারহান।উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তেই চুপসে যায়।জান্নাহ্ গাঢ় গলায় আবেগী হয়ে বললো—

“মায়ের কথা মনে পড়ছে সারহান?

তীব্র আক্রোশ নিয়ে সহজ গলায় বলে উঠে সারহান—-

“নাহ।”

জান্নাহ্ মৃদু হাসে।কোনোরূপ উচ্চ ভাবাবেশ ছাড়া পড়ন্ত বৃষ্টির দিকে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি দিয়ে বললো—

“আপনি মিথ্যে বলছেন সারহান।”

উন্মনা চোখে তাকায় সারহান।গম্ভীর গলায় বললো—

“কফি খাবেন?

জান্নাহ্ কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে অধর।হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।সারহান দু কদম বাড়িয়ে কঠিন গলায় দৃঢ় চাহনিতে বললো—-

“বৃষ্টিতে ভিজবেন না।ঠান্ডা লাগবে আপনার।”

ঝরা হাসে জান্নাহ্।বারান্দায় বৃষ্টির পানি জমে আছে।তাতে একটু একটু করে নগ্ন পা ছোঁয়ায় জান্নাহ্।শিউরে উঠে তার রোম।আকাশে চমকে উঠে বিদ্যুৎ।নিকশকৃষ্ণ আকাশ মুহূর্তেই আলোকসভায় পরিণত হয়।ধোঁয়া উড়ানো কফির মগ নিয়ে হাজির হয় সারহান।জান্নাহ্ এর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের মগ নিয়ে তাতে চুমুক লাগায়।বৃষ্টি ভেজা শীতল পরশে কফির উষ্ণতা যেনো সোনায় সোহাগা হয়ে উঠলো।বৃষ্টির ছন্দের ফাঁক গলিয়ে বলে উঠে জান্নাহ্—-

“আপনি আমার বাবার মতো হবেন সারহান?

সারহান দুর্বোধ্য হাসে।বারান্দার হাফ দেয়ালের সাথে ঠেকানো পিঠ আলগা করে জান্নাহ্কে কাছে টেনে নেয়।নিজের কফির মগ পাশের ছোট্ট টেবিলটার উপর রাখে।জান্নাহ্কে পেছন দিক দিকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া আঁকে।শুষ্ক,মোলায়েম চুলে মুখ গুঁজে ফিকে আওয়াজে বললো–

“উঁহু।জগতে কেউ কারো মতো হতে পারে না রজনীগন্ধা।সবারই নিজস্ব স্বকীয়তা আছে,আছে ব্যক্তিত্ব।কারো সাথে কারো একটা দিক মিললেই সে পুরোপুরি কখনো ওই মানুষটার মতো হতে পারে না।আমি কখনো আপনার বাবার মতো নই।না সে কখনো আমার মতো।কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি।হয়তো তার থেকে বেশি নাহয় তার থেকে কম।কিন্তু তার সমান নয়।”

সারহানের দেহের উষ্ণতায় জান্নাহ্ এর শীতল দেহ তপ্ত হতে থাকে।সারহান আদুরে মায়ায় জড়িয়ে নেয় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর শরীরে কম্পন হয়।হাতে থাকা কফির মগটা আলগোছে নামিয়ে নেয় সারহান।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খেয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো—

“আমার পরীবউ।”
,
,
,

রেগুলার চেকাপের জন্য হসপিটালে এসেছে জান্নাহ্।গাইনোকলোজিস্ট মুনিরার কেবিন থেকে বেরিয়েই জান্নাহ্কে দাঁড় করায় সারহান।ছোট্ট শরীরে ভারি পেট নিয়ে চলতে কষ্ট হয় জান্নাহ্ এর।কিন্তু তার পাশে ছায়ার মতো থাকে তার প্রাণপুরুষ।হাতের ফাইলটা শক্ত করে ধরে জান্নাহ্কে বললো সারহান–

“আপনি এখানে দাঁড়ান,আমি আসছি।”

“হুম।”

জান্নাহ্কে দাঁড় করিয়ে করিডোর ধরে হসপিটালের উত্তর দিকে হেঁটে যায় সারহান।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই পা দুটো ভার হয়ে আসে।করিডোরে তেমন মানুষ নেই।কতিপয় ডক্টর,নার্স আর ওয়ার্ড বয়দের পদচারণা।জান্নাহ্ ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে।
অগোছালো পা বাঁড়াতেই সাদা ড্রেস পরিহিত নার্সের সাথে ধাক্কা লাগে।ব্যস্ত হাতে জান্নাহ্কে সামলায় নার্স।তটস্থ গলায় বললো—

“বি কেয়ারফুল ম্যাম।”

জান্নাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রস্ফুরনিত কন্ঠে বললো—

“সসরি।থ্যাংক ইউ।”

“ইটস ওকে ম্যাম।”

কৃতজ্ঞতা জানায় জান্নাহ্ নার্সকে।জান্নাহ্ নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে।একটু ধাতস্থ হয়ে সামনে এগুতেই আবারো জোরালো ধাক্কা লাগতেই পেছন দিকে হেলে পড়ে জান্নাহ্।ভয়ে আঁতকে উঠা জান্নাহ্ চোখের পাতা বন্ধ করে সামনের মানুষটির বুকের দিকে খাঁমচে ধরে নিজেকে বাঁচানোর খাতিরে।জান্নাহ্ এর ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে এসে ঠেকে সেই পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ।ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে ভয়ে জড়সড় জান্নাহ্।নিমিঝিমি চোখ মেলে তাকাতেই চোখের পাতা ক্রমশ প্রশ্বস্ত হতে থাকে জান্নাহ্ এর।সামনের সুদর্শন ব্যক্তির চোখ ভরা উচ্ছ্বাস,ঠোঁটে হঠাৎ প্রিয় জিনিস ফিরে পাওয়ার আঁতকে উঠা খুশি।অবাক বিস্মিত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

“অর্নিশ!তুমি?

ছেলেটি মুখভর্তি উচ্ছলিত হাসে।কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া ছড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখে জান্নাহ্কে।গাঢ় গলায় একবুক খুশি নিয়ে বললো—

“জান্নাহ্!
কোথায় ছিলে এতোদিন তুমি?

জান্নাহ্ এর শ্বাসের গড়পড়তা বাড়তে থাকে সাথে সংশয়।তাকে সোজা করে দাঁড় করায় অর্নিশ।মোহবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্ এর দিকে সে।এক পাশে ছড়ানো ওড়নাটা মেলে ধরে নিজের উদর ঢাকে জান্নাহ্।অর্নিশ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো—

“কেমন আছো তুমি?

জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় বললো—

“ভালো।তুমি?

প্রাণখোলা হাসে অর্নিশ।প্রসন্ন গলায় প্রত্যুত্তর করে—

“ভালো।
কোথায় ছিলে তুমি?আমি তোমায় কত খুঁজেছি!অস্ট্রেলিয়া থাকতেই মম এর কাছে তোমার প্যারেন্টসের ডেথের খবর শুনলাম।বড় চাচ্চুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো।তাকে দেখতে গিয়েছিলাম আমি।ফিরে এসে তোমাকে আর খুঁজেই পেলাম না।”

জান্নাহ্ গাঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো।তার হাত পায়ে মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে।কম্পনরত গলায় বললো—

“আমি..।”

“রজনীগন্ধা,এখানে কী করছেন?

সারহানের গলার আওয়াজে পরপর কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে জান্নাহ্।তার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকায় অর্নিশ।উৎসুক গলায় মিইয়ে সুর তুলে—

“আপনি কে?

সারহান উষ্ণ হাসে।ঝরা গলায় বললো—

“সারহান।জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড।”

কৌতূহলী চোখ জোড়া ক্ষণকালেই প্রশ্বস্ত হয়।বিব্রত হয় জান্নাহ্।অপ্রস্তুত চাহনিতে বললো—

“সারহান,ও অর্নিশ।মাম্মার ফ্রেন্ডের ছেলে।”

“ও।আসসালামু আলাইকুম।”

অর্নিশের অবস্থা আকাশ গুড়ুম।জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড!হাউ পসিবল!অর্নিশ যেনো থমকে গেলো নিমিশেই।না শোনার মতো করে সালামের উত্তর করে।ব্যগ্রতা দেখিয়ে সারহান বললো—

“রজনীগন্ধা,আমাদের দেরি হচ্ছে।চলুন।”

“হুম।
আসি অর্নিশ।”

অর্নিশ ভ্যালভ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।যতক্ষন পর্যন্ত তার দৃষ্টি সীমানায় ছিলো জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর অবয়ব দৃষ্টির আড়াল হতেই চঞ্চল পা দুটো দপদপ করে ফেলে মুনিরার কেবিনে ডুকে অর্নিশ।অধৈর্য গলায় বললো—

“একটু আগে যে মেয়েটা এখান থেকে বেরিয়েছে ও কেন এসেছিলো?

মুনিরা আচম্বিত গলায় প্রশ্ন করেন—

“তুমি কেন জানতে চাচ্ছো?

“আন্টি ও জান্নাহ্।মনে পড়ছে তোমার !মম বলেছিলো ওর কথা তোমাকে। সংযুক্তার মৃত্যুর পর আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বাঁচাতে মম জান্নাহ্দের বাসায় আমাকে পাঠিয়েছিলো।”

মুনিরা কিছু মনে করার চেষ্টা করে বললেন—

“আই সী।মনে পড়েছে।মেয়েটা বিবাহিত অর্নিশ।শী ইজ প্রেগন্যান্ট।ফাইভ মানথ রানিং।”

আঁতকে উঠে বললো অর্নিশ—

“হোয়াট?আর ইউ সিরিয়াস?শী ইজ অনলি সিক্সটিন!

“আই নো অর্নিশ।আর সে সেকেন্ড টাইম কনসিভ করেছে।প্রথমবার মিসক্যারেজ হয়েছিলো।”

অর্নিশ মুক্ত শ্বাস নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।কিছুক্ষণ ধুম ধরে বসে থেকে বললো—

“ওর নাম্বার আছে তোমার কাছে?

“নাহ।ওর হ্যাজবেন্ডের আছে।বাট আমি তোমাকে দিতে পারবো না।এইটা রুলসের বাইরে অর্নিশ।”

অর্নিশ অসহায় গলায় বললো—

“প্লিজ আন্টি!

“ওকে মাই বয়।ওয়েট।”

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নদীর ধার ঘেঁষে জেগে আছে বুনো ঘাস।তাতে সগৌরবে মাথা উচু করে আছে নানা রঙের ঘাসফুল।কারো রঙ লাল তো কারো সাদা।নদীর পাড়ের ফিনফিনে বাতাসে বুনোফুলের মিষ্টি গন্ধ এসে ঠেকছে নাকে।তার সাথেই দুলছে দূর্বা ঘাস।তাতেও আলাদা মোহনীয়তা।ফুলবিহীন সরু,লম্বা পাতার দূর্বা ঘাস কাটা ঘায়ের রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।তা ছিলো আমাদের আদিকালের চিকিৎসার প্রাথমিক পদ্ধতির পরিচিত অংশ।

সারহানের কাঁধে মাথা হেলান দিয়ে পা দুটো হালকা সোজা করে বসে আছে জান্নাহ্।ফুরফুরে বাতাসে জান্নাহ্ এর বেনুনী করা চুলের সামনের দিকের ছোট ছোট কেশ উড়ছে।বাতাসের বেগ বাড়তেই তাতে ফরফর করে আওয়াজ হয়।তীব্র,মৃদু শীতল বাতাসের ছোঁয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে লাগতেই সারহানের হাত চেপে ধরে জান্নাহ্।সারহান গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।তার ঝাঁকড়া চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়তেই চোখ ঢেকে যায়।জান্নাহ্ ফিক করে হেসে ফেলে।সারহানের নাকের ডগা ধরে টান মারে জান্নাহ্।স্মিত হাসে সারহান।নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

“আপনার ভালো লাগা এতো আজব কেন?

জান্নাহ্ ভ্রু ক্রুটি করে বললো—

“আজব মানে?

সারহান সরস গলায় বললো—

“এই যে নদী!

জান্নাহ্ স্মিত হাসে।নরম গলায় বললো—

“সব ভালো লাগার কারণ থাকে না।কিছু ভালো লাগা চোখের প্রশান্তি,কিছু ভালো লাগা হৃদয়ের অনুরক্তি।নদী আমার চোখের প্রশান্তি আর..।”

এইটুকু বলেই জান্নাহ্ থামে।গাঢ় চোখে তাকিয়ে আগ্রহী গলায় সারহান বললো—

“আর হৃদয়ের অনুরক্তি?

জান্নাহ্ বদ্ধ ঠোঁটে হেসে বললো—

“আমার পরীর বাবা।”

সারহান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে রয়।গ্রীষ্মকালে র খরতাপে নদীর পানি নেমে গেছে পাড় থেকে অনেকটা নিচে।তবুও মাঝিমাল্লারা বসে নেই।জীবনধারনের অন্যতম উপায় মাছ বিক্রি যাদের হাতিয়ার তারা কী বসে থাকতে পারে?

নদীর বুকে তাকিয়ে জান্নাহ্ জিঙ্গাসু গলায় বলে উঠে—

“আপনি আমাকে আটকে কেন রেখেছেন সারহান?

সারহান ভাবলেশহীন প্রত্যুক্তি করলো—

“আপনার এমন কেন মনে হলো?

“তাহলে আপনি বলেন নি কেন তিশাম ভাইয়া আপুকে বিয়ে করেছে।আমি মামার কাছ থেকে জানলাম।”

সারহান নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া করলো—

“আপনি যেতে চাইবেন তাই।”

“কেন?গেলে কী সমস্যা?

সারহান নির্লিপ্ত গলায় বললো—

“কোনো সমস্যা নেই।পরী আসুক।আপনি যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে নিয়ে যাবো।”

জান্নাহ্ অভিমানি গলায় জোর দিয়ে বললো—

“তাই বলে আমাকে আটকে রাখবেন!

সারহান ফিচেল হেসে নিজের মুখটা জান্নাহ্ এর মুখের কাছে নিয়ে আসে।চাপা সুরে দম্ভ নিয়ে বললো—

“জানেন তো,এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”

জান্নাহ্ এর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।খুশি খুশি গলায় জানার আগ্রহ নিয়ে বললো—

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন সারহান?

নদীর পাড়ে স্নিগ্ধ বাতাসে গা জুড়িয়ে আসে।ছোট্ট একটা দম ফেলে ঘাস বিছানো মাটিতে গা এলিয়ে দেয় সারহান।মাথার নিচে ডান হাত দিয়ে মুক্ত আকাশে তাকায়।নীলাভ ঝলমলে আকাশে উড়ছে শুভ্র মেঘ।সেদিকে আস্ত নজর রেখে সারহান বললো–

“আপনার কী মনে হয়?

জান্নাহ্ একটু সময় নিলো।ঘুরে বসে সারহানের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।নীলাভ শুভ্র আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা বাজপাখি।জান্নাহ্ সারহানের বা’হাত আলগোছে তার স্ফীত উদরের উপর রাখে। গম্ভীর গলায় বললো—

“তাহলে বললেন না কেন?

“সব কথা ব্যক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না।কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।”

“যদি সামনের ব্যক্তি না বুঝে?

“তাহলে বুঝতে হবে সে আপনাকে কখনো ভালোবাসে নি।ভালোবাসা একটা সুপ্ত অনুভূতি।তা মুখ নিঃসৃত শব্দে প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে না।যদি কেউ কাউকে ভালোবাসে তাহলে সামনের ব্যক্তি অবশ্যই তা অনুভব করবে।যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বুঝতে হবে সামনের ব্যক্তির হৃদয়ে সেই অনুভূতি হয়নি যা আপনার হয়েছে।কারো প্রতি ঘৃণা থাকলে তা প্রকাশের প্রয়োজন হয়,কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।তা আপনাআপনি প্রকাশ্য।”

মুচকি হাসে জান্নাহ্।মৃদু গলায় বললো—

“একবার আমি আর বাবা রাফাতের নানু বাড়ি গিয়েছিলাম।তখন শীতকাল ছিলো।নদীর মাছ যাওয়ার একটু উষ্ণতা পেতে পানির উপরিভাগে চলে আসে।আমি দেখতে দেখতে কখন যে নৌকার পাটাতনের সাথে জুতোর হিল বেঁধে গেছে খেয়ালই করি নি।পড়তে পড়তে বাচলাম।রাফাত না থাকলে তো ওই মাছগুলো আমাকে খেয়েই নিতো।”

আওয়াজ করে হেসে উঠে সারহান।মাথাটা হালকা বাকিয়ে জান্নাহ্ রাগ দেখিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো—

“হাসছেন কেন?

সারহান বেশ কিছুক্ষন হাসে।হাসি থামিয়ে ঠোঁট চিপে বললো–

“মাছ আপনাকে খেয়ে নিতো!হাউ ফানি!

খেমটি মেরে বললো জান্নাহ্—

“হা তো?

“মাছের হজম ক্রিয়ায় সমস্যা হতো আপনাকে খেয়ে ফেললে!

সারহান আবারো বাতাস কাঁপিয়ে হাসে।উঠে বসে জান্নাহ্।ঝামটা মেরে বললো–

“হাসি বন্ধ করুন।”

হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে সারহান।অনেক চেষ্টায় হাসি বন্ধ করে বললো—

“মাছ আপনাকে খেয়ে নিতো!এতো সাহস!আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকতে আপনাকে খেয়ে নিতো!হাউ পসিবল রজনীগন্ধা!

জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় অভিমানি মনোভাব নিয়ে বললো—

“এই জন্য হাসছেন!
রাফাত ছিলো বলে?

সারহান বেখেয়ালি গলায় বললো–

“তেমন কিছু নয় রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ অসহায় গলায় বললো—

“আপনি আমাকে বিয়ে করে সুখী নন সারহান?

সারহান হৃদয় ভেজা হাসি হেসে বললো—

“সুখ সাগরে ডুবে যাচ্ছি আমি।উদ্ধার করুন আমায়।”

সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।সারহানের হাতের দিকে তাকাতেই চোখের পল্লব নাচিয়ে বললো—

“আপনার হাতের আংটি কোথায়?

সারহান সহজ গলায় বললো—

“ফেলে দিয়েছি।”

আঁতকে উঠে জান্নাহ্ বললো—

“সারহান!ওইটা আমাদের এংগেজমেন্টের আংটি।”

সারহান হেয়ালি গলায় বললো—

“তো!আপনার মামা সোনার বদলে তামা দিয়েছে বোধহয়!

“মামা মোটেও এমন কাজ করেনি।”

সারহান কঠিন গলায় বললো—

“আমি বলিনি সে করেছে।বলেছি বোধহয়।”

জান্নাহ্ দুঃখী দুঃখী চোখে তাকাতেই শার্টের কলার ছড়িয়ে গলার চেইনটা বের করে আনে সারহান।তার হাতের আংটি গলায় ঝুলছে।জান্নাহ্ মিহি গলায় বললো–

“এইটা কেমন কথা!হাতের আংটি গলায় কেন?এমন কেউ করে?

“আমি তো কেউ নই রজনীগন্ধা।আমি সারহান।”

জান্নাহ্ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে।সারহান জান্নাহ্ এর অধরের দিকে অনিমেষ চেয়ে একটু এগিয়ে আসতেই জান্নাহ্ পেছনের দিকে সরে ভ্রু নাচায়।ঠোঁট গুঁজ করে বললো—-

“অসভ্য লোক!
যেখানে সেখানে এইসব কী?

“ইটস কল্ড রোমান্স।”

“আপনার মাথা!খোলা আকাশের নিচে কীসের রোমান্স!

জান্নাহ্ এর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—-

“চোখের মায়ায়,ঠোঁটের ছোঁয়ায়
বেঁধেছি বুকের ক্রন্দন,
মরুর বুকে,তরুর ছায়ায়
জেগেছে প্রাণের স্পন্দন।”

জান্নাহ্ পরম আদরে সারহানের বুকে মাথা রাখে।নদীর পানির উপরে একটা সাদা বক উড়ে যাচ্ছে।সারহান তার অধর ঠেকায় জান্নাহ্ এর শিয়রে।হালকা হাতের বেড়ে বাঁধে তাকে।

সারহানের মোবাইলে ভাইব্রেট হতে থাকে।তা বের করে দেখতেই দেখে একটা আননো নাম্বার।সকালে হসপিটাল থেকে ফেরার পর থেকে একটা নাম্বার থেকে অনবরত ইনকামিং কল হচ্ছে।সারহান চিন্তিত।তার এই নাম্বার কতিপয় বিশেষ মানুষ ছাড়া কাউকে দেয় নি সে।
কল ডিসকানেক্ট করে ব্লক করে সারহান।

কল কাটতেই ক্ষুব্ধ হয় অর্নিশ।একান্ন বার কল করেছে সে।এখন ব্লক।অর্নিশের কপাল জুড়ে অদ্ভুত কিছু ঘটে যাওয়ার শঙ্কার ভাঁজ পড়ে।অর্নিশ চোয়াল শক্ত করে ফিরে তাকায়।তার মা শোয়েতা বেডে শুয়ে আছে।মিনমিনে গলায় বললো—

“কী হলো!

অর্নিশ তটস্থ হয়ে বললো–

“ওর হ্যাজবেন্ড কিছুতেই কল রিসিভ করছে না।”

ফোঁস করে দম ফেললো শোয়েতা।নমনীয় গলায় বললো—

“মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।কতদিন দেখি না।”

অর্নিশ কিছু বললো না।একজন নার্স কেবিনে ঢুকলো।হাতে ট্রে ভর্তি মেডিসিন।আধশোয়া করে উঠে বসায় শোয়েতাকে।ঔষধ খাইয়ে নার্স চলে যায়।শোয়েতা কপাল কুঁকড়ে বললেন–

“ওর হ্যাজবেন্ড কেমন?

অর্নিশ কন্ঠে গাঢ়তা টেনে বললো–

“জান্নাহ্ এর বিয়ে মৃণাল আন্টি দেয় নি মম।আন্টি থাকলে কখনই ওই ছেলের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতো না।”

শোয়েতা তীব্র হতাশা নিয়ে বললেন—

“হয়তো।তোকে রিফিউসজড তো এইজন্যই করেছিলো।তবে জান্নাহ্ এর ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।ও না থাকলে তোকে তো আমি হারিয়েই ফেলতাম।”

মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে অর্নিশ বললো–

“হুম।কৃতার্থ ওর প্রতি আমি।কিন্তু ওর বিয়ে!
আমি মানতে পারছি না মম।জান্নাহ্ কী করে করতে পারে আমার সাথে এমনটা!

শোয়েতা ছেলের উচাটন বুঝতে পারলেন।তবে ভাগ্যের কাছে সব সম্ভব।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here