জান্নাহ্,পর্বঃ৭১,৭২

0
2069

জান্নাহ্,পর্বঃ৭১,৭২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৭১

সারাদিন এধার ওধার ঘুড়ে নিশুতিতে বাড়ি ফিরলো সারহান।বাসায় থাকলে তাকে দেখে উদ্ভট ব্যবহার করে জান্নাহ্।সারহানকে সহ্য করার ক্ষমতা দিনদিন বিলুপ্ত হচ্ছে জান্নাহ্ এর।বাড়িতে ঢুকেই সোজা চলে আসে নিজের রুমে।অন্ধকারে আচ্ছন্ন পুরো ঘরে থাই গ্লাসের কাঁচ গলিয়ে কুসুমরঙা চাঁদের আলো জোসনা ছড়াচ্ছে।সেই জোসনা ছড়ানো আলোয় জান্নাহ্কে দেখতে পায় সারহান।হাঁটু ভাঁজ করে বিছানার হেডবোর্ডের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।উন্মনা,শান্ত,নিশ্চল।সারহান লাইট অন করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়।ঘামার্ত শার্ট খুলে তা বারান্দায় ছড়িয়ে দেয়।ব্যস্ত পা দুটো চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।প্রায় মিনিট পনেরো পর হাত,মুখ ধুয়ে বের হয় সারহান।জান্নাহ্ এখনো সেভাবে বসে আছে।
আলমিরা থেকে একটা পাতলা টিশার্ট নিয়ে গায়ে জড়ায় সারহান।রুম থেকে বেরিয়েই সোজা চলে যায় রান্নাঘরে।ওভেনে খাবার গরম করে ফিরে আসে রুমে।জান্নাহ্ এর সামনে বসে।কোনো কথা ছাড়াই জান্নাহ্ এর মুখে খাবার তুলে দিতে গেলেই তা ছুঁড়ে ফেলে দেয় জান্নাহ্।ফিকে চোখে তাকায় সারহান।কোনো কথা বললো না।অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে পুনরায় একই কাজ করলো।জান্নাহ্ও তার কাজের পুনরাবৃত্তি করলো।সারহান নরম চোখে তাকায়।তৃতীয়বারের মতো খাবার নিয়ে বসে জান্নাহ্ এর সামনে।স্থির গলায় বললো–

“খেয়ে নিন রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ কঠোর হয়ে বললো—

“খাবো না আমি।”

সারহান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো–

“অন্তত আমাদের পরীর জন্য খেয়ে নিন।”

জান্নাহ্ রুষ্ট কন্ঠে বললো—

“কীসের পরী?কার পরী?কোনো অধিকার নেই এই বাচ্চার উপর আপনার।”

সারহান নিষ্কম্প গলায় বললো—

“আমার ভুলের সাজা কেন নিজেকে দিচ্ছেন?

তাচ্ছল্য চোখে তাকায় জান্নাহ্।বিদ্রুপ করে বললো—

“ভুল! আপনার কেন ভুল হবে?ভুল তো আমি করেছি।ভালোবেসেছি আপনাকে।জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি আমি।”

সারহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।স্বশব্দে বললো—

“একটা সুযোগ দিন আমাকে।প্লিজ রজনীগন্ধা।”

জ্বলন্ত চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল,স্বচ্ছ স্মিত ধারা।ফুঁসলে উঠে জান্নাহ বললো—

“চলে যান আপনি এখান থেকে।আপনাকে সহ্য হচ্ছে না আমার।মুক্তি দিন আমাকে।মুক্তি দিন।আপনার যা ইচ্ছে করুন।”

ঝমঝমিয়ে স্ফীত ধারায় বুক ভাসায় জান্নাহ্।ব্যগ্র হয়ে তা মুছতে গেলে সারহান ঝামটা মেরে উঠে জান্নাহ্–

“একদম ছোঁবেন না আপনি আমাকে।ঘৃণা লাগে আপনার ছোঁয়ায় আমার।আমার সবচেয়ে বড় পাপ কী জানেন?আপনার মতো একজন নিকৃষ্ট মানুষের সন্তান আমার গর্ভে।যে সবসময় মনে করিয়ে দেয় আমাকে আপনার ওই নোংরা ছোঁয়া।যদি মা হয়ে সন্তানের জীবন নেওয়ায় কোনো পাপ না হতো আমি সত্যিই ওকে মেরে ফেলতাম।এই বিকৃত,নষ্ট পৃথিবীতে আসার ওর কোনো দরকার নেই।যেখানে ও জানবে ওর মা একজন খুনী আর বাবা একজন জঘন্য নারী লোভী পুরুষ।”

রাগে হতবিহ্বল সারহান অবিশ্বাস্য কান্ড করে বসে।তার বলিষ্ঠ হাত উঁচু হয়েও আবার পরক্ষনেই স্মিমিত হয়।হিসহিসিয়ে বললো—

“এখন কেন ঘৃণা হচ্ছে আপনার?চলে যেতেন সেদিন,যেদিন জানতে পেরেছেন।আমি তো আটকাই নি আপনাকে।আসতে বলিও নি আমার জীবনে।কেন এসেছেন তাহলে?

“সেটাই আমি ভুল করেছি।আপনাকে ভালোবেসে ভুলে নয় পাপ করেছি আমি।আর এই পাপের সাজা আমার অনাগত সন্তানকে দিতে হয়েছে।”

সারহান ফুঁসে উঠে জান্নাহ্ এর গাল চেপে ধরে।ক্ষীপ্ত গলায় বললো—

“কেন জড়ালেন আমায় এই মায়ায়?আমি তো বলি নি।ভালোও বাসি নি আপনাকে।বাধ্য কেন করলেন আমাকে?আমার জীবন তো চলেই যাচ্ছিলো।কারো দরকার ছিলো না আমার।তাহলে কেন এলেন আপনি আমার জীবনে?স্বপ্ন কেন দেখালেন আপনি?আমি বলেছি আপনাকে?আমি জোর করেছি?

জান্নাহ্ ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো।সারহান বাঁকা হেসে বিক্ষিপ্ত গলায় বললো–

“এখন কেন সহ্য হচ্ছে না!যখন ওদের খুন করলেন তখন আপনার হাত কাঁপলো না?আজ নিজের বোন বলে সাত খুন মাফ?মেহনাজকে আমি জোর করেছি?নাহ।যদি আমি দোষী হই তাহলে সেও দোষী।শুধু আপনার বোন বলেই এখন আমাকে ঘৃনা হচ্ছে আপনার?আমার জীবনে যারাই এসেছে সবাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসেছে।আপনিও তার ব্যতিক্রম নন।বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর কাউকে প্রয়োজন ছিলো আপনার।আমাকেই বেছে নিলেন।কেন নিলেন?
যদি আপনি আমার জীবনে না আসতেন আমার জীবনটা এমন হতো না।না নিজের রক্তকে হারাতাম আমি।আরে ভালোবাসার উপর তো কোনো বিশ্বাসই ছিলো না আমার।আমার জন্মদাতা আমার মাকে ধোঁকা দিয়েছে।নিজের বোনের অপবাদ ঢাকতে আমার আরেক মা আমাকে কাছে টেনে নেন।সম্পত্তির লোভে আমার বোন আমাকে এক মিথ্যের মায়াজালে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।কেড়ে নেয় আমার সন্তানকে।যেই সন্তানের কারণে প্রথমবার আমার মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে আমার কেউ আছে।আমিও একজন মানুষ।আমারও নিজের পরিচয় আছে।কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে।সারহান একা,একাই রয়ে গেলো।ইহতিশাম আমার জীবনের আরেক ঝড়।ও যদি সেদিন সত্য বলতো তাহলে আমাকে জেলে রাত কাটাতে হতো না।আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে আমার সন্তানকে হারাতে হতো না।আমার জীবনটা এমন অকুলপাথারে ভাসতো না।হ্যাঁ,রাগের মাথায় ভুল করেছি আমি।সবতো ঠিক হয়েছে।মেহনাজকে মেনে নিয়েছে ইহতিশাম।তাহলে এখন কেন এমন করছেন আপনি?

জান্নাহ্ ভেজা অক্ষিপল্লব মেলে চেয়ে রইলো।তার চোখ ভরা অশ্রু কিন্ত নির্বাক ঠোঁট।অধর ছড়িয়ে বিতৃষ্ণা শ্বাস ফেললো সারহান।শাসিয়ে উঠে বললো—

“আপনার যা ইচ্ছে করুন।কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়ছি না।আর আমার সন্তানের যদি কিছু হয় তাহলে আমি কী করবো আমি নিজেও জানি না।যা হয়ে যাক জীবনের অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।যদি বাঁচতে হয় আমার সাথেই বাঁচবেন আর যদি মরতে হয় তাহলে আমার সাথেই মরবেন।”

অসহিষ্ণু পা দুটো দপদপ করে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সারহান।অঝোরে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।ভেজা গলায় বলতে থাকে—

“তাহলে মেরে ফেলুন,মেরে ফেলুন আমাকে।এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মরে যাওয়া ভালো।কী বলবো আমি আপুকে?কোন মুখে দাঁড়াবো আমি তার সামনে?কেন করলেন সারহান এমন?কেন?কেন?

বাতাস ভারী হতে থাকে জান্নাহ্ নিরন্তর কান্নায়।তার চোখ,কপোল,গলা সব ভিজে যায় তার অশ্রুবারিতে।ঝাপসা চোখ দুটো প্রস্ফুটিত করতেই জান্নাহ্ তার বাবাকে দেখতে পায়।জাফিন ম্লান চোখে তাকিয়ে আছে।তাকে দেখেই কান্নার বেগ বাড়াতে থাকে জান্নাহ্।জাফিন নরম পায়ে জান্নাহ্ এর পায়ের কাছে এসে বসে।জান্নাহ্ অবিরত চোখের জল ফেলে বললো—

“এতদিন পরে কেন এলে বাবা?আমি কাঁদলে তোমার ভালো লাগে বাবা?তাই তুমি আমাকে দেখতে আসো?

জাফিন আলতো চুমু খেলেন মেয়ের হাতে।চোখে ছোঁয়ালেন তার হাত।জান্নাহ্ অভিমানি সুরে বললো—

“এতদিন কেন এলে না বাবা?কেন চলে গেলে তুমি আমাকে ছেড়ে?কেন নিয়ে গেলে না আমাকে তুমি?কেন রেখে গেলে আমাকে?

জাফিন ছলছল চোখে চেয়ে রইলো।মেঘাচ্ছন্ন মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।জান্নাহ্ স্বশব্দে বললো–

“সারহান এমন কেন হলো বাবা?তুমি থাকলে আমি এমন ভুল করতাম না।তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও বাবা।আমার আর সহ্য হচ্ছে না।সহ্য হচ্ছে না।”

জাফিন উঠে বসলেন বিছানায়।নিজের মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে আলগোছে চেপে ধরলেন।বললেন—

“ধৈর্য্য ধরো ডল।আল্লাহ্ তোমার পরীক্ষা নিচ্ছেন।আমার ডল তো হেরে যাওয়ার মেয়ে নয়।”

জান্নাহ্ প্রতিবাদ করে বললো—

“আমি তোমার ডল নই বাবা।আমি খুনি।আমি রাফাতের রেড চেরি নই।আমি স্বার্থবাদী।আমি মামার পরীজান নই।আমি রাক্ষুসী।নিজের সন্তানকে মেরে ফেলেছি আমি।আমি কেউ নই,কেউ নই।”

জান্নাহ্ ছোটাছোটি করলে জাফিন শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে রাখেন জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে।তার ঝাপসা চোখ ঠাওর করে মৃণালিনীকে।মৃণালিনী আবেগশূন্য দৃষ্টিতে জান্নাহ্ এর দিকে তাকিয়ে আছে।তার দৃষ্টিতে হৃদয় কেঁপে উঠে জান্নাহ্ এর।হিম হয়ে আসে তার শরীর।মৃণালিনী অদ্ভুত,অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

জান্নাহ্ চিবুক উঠিয়ে হালকা গলায় বললো—

“মাম্মা আমাকে ক্ষমা করে নি তাই না বাবা?আমি মাম্মার কথা শুনি নি।মাম্মা থাকলে তার ডলের জীবন কখনো এমন হতো না।সারহান কখনো আসতো না আমাদের মাঝে।আমি পাপ করেছি বাবা।তাই মাম্মা আমার বাবুকে কেড়ে নিয়েছে।বাবা,ও বাবা!মাম্মা কী এবারও আমাকে শাস্তি দিতে আমার বাবুকে কেড়ে নিবে।ও বাবা,বলো না?
তাহলে যে আমার সারহান মরে যাবে।তার পরীকে ছাড়া যে সে মরে যাবে।তুমি মাম্মাকে বলো না আমায় ক্ষমা করে দিতে।ও বাবা,বলো না।বাবা,বাবা।ও বাবা।”

চলবে,,,

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সময় বহতা নদী।সে চলে তার আপন মহিমায়।সময়ের সাথে চলতে হয় মৃত্তিকার গড়া মহান আল্লাহ্ পাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে।

মান,অভিমানের পালা বদলের সাথে কেটে যায় আরো চার মাস।ষোড়শী জান্নাহ্ সপ্তদর্শীতে রূপ নেয়।তার শরীর জুড়ে ফুটে উঠে মাতৃত্বের লক্ষণরেখা।জান্নাহ্ এর সামনেই নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে শরীফ।চোখে,মুখে থমথমে ভাব।নির্ভয়চিত্তে অপলক চেয়ে আছে তার দুই পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে।কাতর গলায় শুধায় জান্নাহ্—

“তুমি সারহানকে ক্ষমা করেছো তো মামা?

শরীফ নির্বাক রইলেন।শুধু গ্রহণ করলেন জান্নাহ্ এর মুখ নিঃসৃত শব্দ।জান্নাহ্ ব্যাকুলতায় বললো–

“ক্ষমা করবে না তুমি সারহানকে?না বুঝে সে ভুল করে ফেলেছে।ক্ষমা করে দাও তাকে মামা।”

নরম চোখে জান্নাহ্কে দেখলেন শরীফ।বাঁধাহীন সুরে বললেন—

“আমি সবসময় আমার দুই মেয়েকে সুখী দেখতে চেয়েছি।তার জন্য যা করার আমি করেছি।হোক তা ন্যায় বা অন্যায়।কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ।পাপের শাস্তি সবার প্রাপ্য।এক মেয়ের ঘর বাঁচাতে আমি অন্য মেয়েকে ডুবিয়ে ফেললাম।”

স্বশব্দে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বিচলিত গলায় বলে উঠে শরীফ—

“কাঁদবেন না পরীজান।সারহানকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।কারণ সে অনুতপ্ত।নিজের মুখে সে তার অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে আমার কাছে।
বিবেকের স্বীকারোক্তি,দেহের পাপের কাছে হার মানে।”

নৈঃশব্দে নয়ন বারির বর্ষা নামিয়েছে জান্নাহ্।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শরীর।বাগানের দোলনায় বসে আছে সারহান।নিশ্চল তার দৃষ্টি।নির্বাক তার কন্ঠ।উন্মনা তার মস্তিষ্ক।তার অতীত খুবলে খুবলে খাচ্ছে তার বর্তমান।তার ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন।আদৌ কী সারহান তার অতীতের পাপ থেকে মুক্তি পাবে?

ভেতর থেকে শরীফের দারাজ কন্ঠস্বর পেয়ে ছুটে যায় সারহান।বিছানায় কাতরে যাচ্ছে জান্নাহ্।ডেলিভারি পেইনে মিইয়ে গেছে বিছানার সাথে।উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে ভীতসন্ত্রস্ত সারহান বললো–

“কী হয়েছে?

ব্যতিব্যস্ত হয়ে শরীফ বললো—

“পরীজানকে এখনই হাসপাতাল নিতে হবে।”
,
,
,
হসপিটালের শুভ্র বিছানায় বসে আছে জান্নাহ্।স্থির,নিষ্কম্প,কঠোর।আবেগশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সফেদ রঙের সেই বিছানায়।তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্মিত শীতল,স্বচ্ছ অঝোর ধারা।বিড়ালপায়ে কেবিনে ঢুকে সারহান।তার শক্ত,কঠোর,নির্বিঘ্ন চিত্ত।ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে জান্নাহ্ এর সামনে এসে বসে।প্রতিক্রিয়াহীন জান্নাহ্।সে এখনো পাথরমূর্তি মতো স্থির।

তাচ্ছল্য হাসলো সারহান।করুণ সুর তুলে বললো—

“বদলা নিলেন রজনীগন্ধা?এতোটা ঘৃণা আপনার আমার প্রতি।এই ঘৃণার আগুনে এতোটা না পুড়ালেও পারতেন।কেন প্রাণ দিয়ে সে প্রাণটা কেড়ে নিচ্ছেন আপনি?

নিরুত্তর জান্নাহ্।কোনো ধরনের ভাবান্তর হলো না তার।নিরুত্তেজ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—

“আমার মেয়ে কোথায় রজনীগন্ধা?

জান্নাহ্ ভাবলেশহীন গলায় প্রত্যুত্তর করে–

“জানি না আমি।”

নিরুত্তেজ গলায় সারহান বললো–

“আমার পরীকে ফিরিয়ে দিন আমায়।”

জান্নাহ্ অনুচ্চ গলায় বললো–

“আমি জানি না ও কোথায়।”

ক্ষেপে উঠে জান্নাহ্ এর গাল চেপে ধরে সারহান।দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে বললো—

“আমার মেয়েকে আমার চাই।বলুন কোথায় আমার পরী?

জান্নাহ্ অর্ধ ঢোক গিলে চোখের বদ্ধ পানি ছেড়ে দেয়।ভেজা গলায় বললো—

“আমার লাগছে সারহান।”

তড়িৎ গতিতে জান্নাহ্কে হালকা হাতে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।বিছানার পাশে থাকা চলন্ত ট্রে তে থাকা ঔষধাদি সব ফেলে দেয়।বজ্র গলায় বলে উঠে—

“এতোই যখন ঘৃণা তাহলে তাহলে মেরে ফেলতেন আমাকে।মৃত্যু যন্ত্রণা কেন দিচ্ছেন?

জান্নাহ্ ঠায় বসে রইলো।নেই কোন আবেগ,নেই কোনো অনুভূতি।একটা শীতল,সমাহিত বরফখন্ড।বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠে সারহান—

“আপনার কী মনে হয় আমি ওকে খুঁজে বের করতে পারবো না?
আমার মেয়েকে আমি খুঁজে বের করবোই। আপনি ঠিক করেন নি রজনীগন্ধা,আপনি এইটা ঠিক করেন নি।”

সারহান চলে যেতেই দরজায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা জাবিনকে দেখে জান্নাহ্।অবাক গলায় বললো—

“জাবিন!

মৃদু হাসে জাবিন।পায়ের কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা তিতি দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জান্নাহ্ এর বুকের উপর।আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—

“পরীমা।”

জান্নাহ্ বুকের সাথে চেপে ধরে তিতিকে।নিজের শূন্য বুকটা যেনো থইথই করে ভরে উঠলো জান্নাহ্ এর।ছলছল অশ্রু ঝরে পড়লো।বইয়ে দিলো খুশির বন্যা।তিতির চোখে,মুখে অজস্র চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো জান্নাহ্—

“কেমন আছো তিতি সোনা?

কোমল গলায় ছোট্ট করে বললো তিতি—

“ভালো।”

নিজের কোলে পুরোদস্তুর তিতিকে গুঁজে নেয় জান্নাহ্।সামনে বসা জাবিন নিস্পলক চেয়ে আছে।যেনো অন্য জান্নাহ্কে দেখছে সে।কেবিনের বাইরে ঘটা সারহানের উন্মাদের মতো আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত জাবিন।হাসি হাসি মুখে জান্নাহ্ বললো—

“কেমন আছো জাবিন?এতোদিন পর মনে পড়লো আমার কথা?

জাবিন নিরুপায়ের সুরে বললো—

“মামা তো আসতে দিচ্ছিলো না।ঠিকানা বলে নি কখনো।গত তিনদিন ধরে তিতি সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে।ওর জন্যই…।”

জাবিনের কথা কেটে বললো জান্নাহ্–

“বাড়ির সবাই কেমন আছো?

জাবিন নিশ্চল গলায় বললো–

“ভালো।”

“শুভ্রা আপু কেমন আছে?

তিতি মাথা ঘুরিয়ে বললো—

“মামুনি কথা বলে না।আদর করে না।”

মুহূর্তেই ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে তিতি।ব্যস্ত হয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করে জান্নাহ্।জাবিন আহত গলায় বললো—

“আমি ভাবতে পারি নি মা মামার সাথে এমন করবে!মায়ের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”

“শুভ্রা আপুর কী হয়েছে?

জাবিন নম্র গলায় বললো—

“ডক্টর বলেছে সায়ানাইডের ইফেক্ট মায়ের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।তাই সে কাউকে চিনতে পারছে না।”

“সারহানকে ক্ষমা করে দিও।সে রাগের মাথায়..।”

“মামার জায়গায় আমি হলেও এমনটা করতাম।”

এক মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে যায় জান্নাহ্ এর মুখমণ্ডল।অপলক চোখ দুটোতে ভর করে জলরাশি।জাবিন সংকীর্ণ গলায় বললো–

“মামাকে কষ্ট কেন দিচ্ছো জান্নাহ্।”

জান্নাহ্ চোখের চাহনি শক্ত করে।কড়া গলায় বললো—

“তার কষ্টের পথ সে নিজেই সৃষ্টি করেছে।”

তিতি তার ছোট্ট কোমল হাত দিয়ে জান্নাহ্ এর গাল স্পর্শ করে তার দিকে ফেরায়।মখমলে গলায় বললো—

“পরীমা,বাবু কোথায়?

জাবিনের দিকে তাকায় জান্নাহ্।জাবিন নির্ভীক গলায় বললো—

“আমি বলেছি বাবুর কথা।”

তিতি আবারও তাড়া দিয়ে বলে উঠে—

“পরীমা,বাবু কোথায়।আমি কোলে নিবো।”

জান্নাহ্ আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়ায় তিতির কপালে।মৃদু গলায় বললো–

“বাবু তার বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গেছে।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here