জান্নাহ্,পর্বঃ৭৭ শেষ
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সারহানের বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে জান্নাহ্।নিরাক পরিবেশে একে অন্যের শ্বাসের আওয়াজ শুনতে পারছে।জান্নাহ্কে দুই হাতে আরো শক্ত করে আবদ্ধ করে নিজের সাথে সারহান।থমথমে গলায় বললো—
“আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমার শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে করতে হবে রজনীগন্ধা।”
ফুঁপাতে থাকে জান্নাহ্।তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।ঠাঁয় লেপ্টে রইলো সারহানের বুকের সাথে।সারহান ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বললো—
“আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না রজনীগন্ধা।”
সারহানের ক্ষীণ স্বর জান্নাহ্ এর হৃদকম্পন থমকে দেয়।সে আরো জোরে খামছে ধরে সারহানের শার্ট।তার বুকে মুখ ঘষতে থাকে।মৃদু ছন্দে বললো সারহান—
“জানেন,ছোটবেলা মা বলতো দৌঁড়াস না সারহান পড়ে যাবি,পড়ে যাবি।সারহান থামতোই না।কারণ তাকে সামলে নেওয়ার জন্য তার মা ছিলো,বাবা ছিলো,দাদু ছিলো।
আজ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমি অনেক ক্লান্ত রজনীগন্ধা।এই ভুলে ভরা জীবনে অনেক দৌঁড়েছি আমি।অতীতকে ভুলতে,ভবিষ্যৎ কে ছিনিয়ে আনতে।কিন্তু বর্তমানকে নিয়ে ভাবিই নি।বর্তমানই তো একসময় অতীত হয়।”
জান্নাহ্ শুনলো কিছু বললো না।সারহান বারকয়েক নাক টেনে অনায়ত গলায় বললো—
“সারহান কখনো ভাবে নি সে কাউকে এতোটা ভালোবাসবে।এতোটা উন্মাদ হবে কারো জন্য।সে শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছে।নিজেকে ভালোবেসেছে।
ঘর,পরিবার,সংসার কিছু ছিলো না তার।আপনি এলেন তার অন্ধকার জীবনের চন্দ্রপ্রভা হয়ে।তার কলুষিত জীবনে ফুলের সুবাস হয়ে।তার রজনীগন্ধা হয়ে।কী করে বাঁচবে সে আপনাকে ছাড়া!
ভুল আমি করেছি।তার শাস্তিও আমি পেয়েছি।তবে আপনাকে কেন হারাতে হবে আমার বলুনতো?
সারহান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো—-
“আজ আমার ভুলে ভরা জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস নিবো আমি।এতে যদি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।”
জান্নাহ্ ফিকে আওয়াজ তুলে তার নিরেট গলায়।বললো—
“আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না সারহান।আপনার রজনীগন্ধা আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।যাবেন না আপনি।”
মৃদু হাসে সারহান।তেজহীন গলায় বললো—
“তা তো হয় না রজনীগন্ধা।সারহান কে যে যেতেই হবে।এই পৃথিবী তার জন্য নয়।এই পৃথিবীর মায়া সে কাটিয়ে ফেলেছে।এখন শুধু অন্তিম শ্বাস নেওয়ার অপেক্ষা।”
জান্নাহ্ এর কলিজা ভাঙা ক্রন্দনে অনুরণন হয় সারহানের শরীরে।দুই হাতের বাঁধন শক্ত করতে থাকে সারহান।থামানো যায় না জান্নাহ্কে।তার প্রাণ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।কিছুতেই না।
সারহান চুপ করে রইলো। তার প্রানসঞ্চিবনী ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।নৈঃশব্দে দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে থাকে সারহান।কাতর গলায় বললো—
“আমার পরীকে আর দেখা হলো না আমার রজনীগন্ধা।এতোটা নিষ্ঠুর কী করে হলেন আপনি?একটুও মায়া হলো না আমার উপর?
জান্নাহ্ এর চোখ বেয়ে নামছে স্বচ্ছ,শীতল জলের নহর।সে চুপ করে সারহানের বুকের ভেতর গুঁজে রইলো।সে এখানে থাকতে চায়।এখানেই।
সারহান অসহায় মুখ করে বললো—
“আপনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন তো রজনীগন্ধা?
জান্নাহ্ দুই হাতে খাঁমচে ধরলো সারহানের শার্ট।নিজেকে সন্তর্পনে আরো গুঁজে দিলো সারহানের সাথে।যেনো মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারবে না।অস্ফুট আওয়াজে বললো—
“উঁহু।”
চোখের জল ছেড়ে প্রসন্ন হাসে সারহান।দুর্বল গলায় বললো—
“আপনাকে আমি কাউকে দিতে পারবো না রজনীগন্ধা।কাউকে না।”
সারহানের গলায় ডান হাত জড়িয়ে নিজের মুখটা সারহানের গলার কাছে নিয়ে আসে জান্নাহ্।তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে কম্পিত হতে থাকে সারহানের পুরুষালী ব্যক্তিত্ব।সারহান ডান হাতে চেপে ধরে জান্নাহ্কে নিজের সাথে।জান্নাহ্ সেভাবেই পড়ে রইলো।নিজের শ্বাস আটকে নেয় সারহান।এই মুহুর্তে সে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ করবে।বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে সারহান।তা সাবধানতার সাথে ইনজেক্ট করে জান্নাহ্ এর গলায়।হেঁচকি তুলে কয়েকটা অর্ধ শ্বাস নেয় জান্নাহ্।তারপর!
তারপর!
জান্নাহ্ এর শ্বাস প্রলীন হতে থাকে তার প্রাণের বুকে।জান্নাহ্ তার শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগেও সারহানকে প্রবল আবেগ,ভালোবাসায় আর মায়ায় জড়িয়ে ধরে।নিজেকে বাঁচানোর কোনো তাগিদ নেই তার।চিবুকটা হালকা সারহানের বুক থেকে সরিয়ে উঁচু করে সারহানের মোহনীয় মুখটার দিকে তাকায় জান্নাহ্।অস্পষ্ট কন্ঠে বললো—
“সারহান,আমাদের মেয়ে….।”
জান্নাহ্ এর সময় হলো না আর কিছু বলার।তার প্রাণের বুকেই তার অন্তিম নিঃশ্বাস নিঃসৃত হলো।যেমনটা সে চেয়েছে।
বাতাস ভারী হয়ে আসে সারহানের গুমোট কান্নায়।বুকের ভেতরের কষ্টগুলো বিক্ষিন্ত হতে থাকে সারা দেহে।সারহান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জান্নাহ্কে আঁকড়ে নেয় তার বুকে।বদ্ধ গলায় বললো—-
“আমাকে ক্ষমা করে দিন রজনীগন্ধা।আমি যে আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।কাউকে দিতেও পারবো না।আপনি যে শুধু আমার।আমার রজনীগন্ধা।”
সারহানের চোখ বেয়ে নামে নোনতা জলের প্রস্রবণ।তার বুক কেঁপে কেঁপে উঠে ক্ষণকাল পরপর।নিজের সকল ভালোবাসা,আবেগ,অনুভূতির অন্তিম বিসর্জন দেয় সারহান।তার হৃদয়ভরা ভালোবাসার সমর্পণ করেছে সে।তার কান্নায় যেনো দেয়ালের প্রতিটি ইট তীব্র কষ্টের নিঃশ্বাস নিচ্ছে।জমাট গলায় বলে উঠে আকুতি নিয়ে সারহান—-
“আমার যে কিছু করার ছিলো না।আপনাকে আমি হারাতে পারবো না।এপারে আপনাকে ভালো আমি বাসতে পারি নি আপনার মতো করে।কিন্তু ওপারে,ওপারে শুধু আপনাকেই ভালোবাসবো আমি।শুধু আপনাকে।আপনার প্রাণ শুধু তার রজনীগন্ধাকেই ভালোবাসবে।ওপারে কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
সারহান সিরিঞ্জের বাকি সায়ানাইড টুকু নিজের হৃৎপিন্ডে পুশ করে নেয়।অতলান্তিক মায়ায়,গভীর শ্বাসের পতন ঘটে।সারহান অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলতে থাকে।লম্বা শ্বাস।স্বগতোক্তি করে বললো—-
“ওপারে আবার দেখা হবে রজনীগন্ধা।আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
সারহান তার রজনীগন্ধার সুবাসেই অন্তিম শ্বাস নেয়।যতক্ষন তার হৃদপিন্ড স্পন্দিত ছিলো ততক্ষন সে জান্নাহ্কে জড়িয়েই বসে থাকলো।চোখ বোজার আগে সে শুনতে পায় দরজায় কারো চাপড়ের আওয়াজ।বিলীন হয়ে যায় সারহানের শ্বাস।
দরজায় ক্রমাগত করাঘাতেও খুললো না তা।তাই বাধ্য হয়ে তা ভাঙতে হলো।ইহতিশামের অধৈর্য পা দুটো থমকে যায় মুহূর্তেই।নিথর,নিস্তব্ধ,নিরব।উদ্ভাসিত দুই চোখে টলটলে জল ইহতিশামের।তার পেছনেই রাফাত,মেহনাজ,শায়িখ।
রাফাত থমকে গিয়েই একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিলো।গা গুলিয়ে উঠলো মেহনাজের।শায়িখ যেনো তার নিজের লাশ দেখলো।
রাফাত অস্ফুট আওয়াজে ডেকে উঠে–
“জান্নাহ্!
পা বাড়াতেই হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠে ইহতিশাম।
“একদম আগাবে না তোমরা।”
মেহনাজ বাতাসে ঝড় তোলে তার কান্নার আওয়াজে।ইহতিশাম ঝড়ো গলায় বললো—
“এখন কাঁদছো কেন তুমি?এটাই তো তুমি চেয়েছিলে।শেষ হয়ে গেলো এক স্বপ্ন,এক স্বপ্নচোরা প্রেমিক,এক ভালোবাসার কাঙালিনী।ধ্বংস করে দিলে তোমরা সব।”
রাফাতের দিকে তাকিয়ে খলবলিয়ে বললো—
“বেরিয়ে যাও এখান থেকে তোমরা,বেরিয়ে যাও।আজ যদি এই ছোট্ট প্রাণটা আমার হাতে না থাকতো তাহলে তোমাদের দুজন কে আমি..।এখন
ই আমার সামনে থেকে যাও।দুর হও এখান থেকে।”
রাফাত অসহায় মুখ করে কাতর গলায় বললো–
“প্লিজ ইহতিশাম,একবার আমাকে দেখতে দাও ওকে।এ আমি কী করলাম!আমার জান্নাহ্।”
“ইউ রাস্কেল!ও তোমার জান্নাহ্ নয়।ও শুধুই সারহানের রজনীগন্ধা।তোমরা দুই জন মিলে খুন করেছো ওদের।শায়িখ,ওদের বের করে দাও এখান থেকে।ওদের ছায়াও যেনো না পড়ে সারহান আর জান্নাহ্ এর উপর।”
ইহতিশামকে অনেক মিনতি করেও ওদের দুই নিথর দেহের কাছে পৌঁছাতে পারলো না রাফাত আর মেহনাজ।শায়িখ শক্ত হাতে ওদের বের করে দেয়।দরজায় বাইরেই বসে থাকে রাফাত মেহনাজ।গুমড়ে কেঁদে উঠে রাফাত।মেহনাজ তীক্ষ্ম স্বরে চেঁচাতে থাকে।ভেতরে এসে হাত,পা ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে শায়িখ।দ্বিতীয় বারের মতো সে তার মাথার উপর থাকা বটবৃক্ষের ছায়াকে হারালো।বোনকে হারালো।নৈঃশব্দে চলে শায়িখের ক্রন্দন।
নরম পায়ে সারহান আর জান্নাহ্ এর সামনে আসে ইহতিশাম।হাঁটু ভেঙে তাদের সামনে বসে।কোলের বাচ্চাটিকে মেঝেতে রাখে।আবেগপূর্ণ গলায় বলে উঠে ইহতিশাম—
“এমন কেন করলি দোস্ত!আমি তো তোকে কথা দিয়েছে।শেষ বারের মতো আমাকে বিশ্বাস করতি।আমি তোর পরীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি সারহান।কিউটি,প্লিজ উঠো।আমি আমার কথা রেখেছি।নিয়ে এসেছি তোমার মেয়েকে।উঠো প্লিজ।”
কেউ উঠলো না।পড়ে রইলো দুটি প্রাণহীন দেহ।বাচ্চাটি স্বশব্দে কেঁদে উঠে।তার কান্না শুনতে পায় নির্বাক বাতাস,গুমোট কান্না,সিমেন্ট বালুর দেয়াল।শুনলো না তার জন্মদাতা বাবা।শুনলো না তার জন্মদাত্রী।যারা একবুক আশা নিয়ে বুক বেঁধে ছিলো তার জন্য।ইহতিশাম আবার বলে উঠে—-
“উঠনা সারহান,উঠনা দোস্ত।আমি তোর পরীকে নিয়ে এসেছি।দেখ,তোর পরী তোকে ডাকছে।কিউটি উঠো।তোমার মেয়ে তোমাকে ডাকছে।এতোটা নিঠুর হয়ো না।ওকে কোলে তুলে নাও প্লিজ।নিয়ে যাও তোমাদের পরীকে এখান দেখে।দুরে চলে যাও।”
দুই হাতে নিজের চোখ চেপে ধরে আর্তনাদ করে বলে উঠে ইহতিশাম—
“এই তুই কী করলি সারহান!কেন আমাকে অপরাধী বানালি?কেন ভরসা করলি না নিজের ভালোবাসার উপর?কেন শেষ বারের মতো বিশ্বাস করলি না আমাকে?
মাথা নুইয়ে আসে ইহতিশামের।বাচ্চাটি সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে।ইহতিশামের চোখ পড়ে সারহানের হাতের দিকে।একটা সাদা রঙের কাগজের টুকরো।ইহতিশাম দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে তা হাতে নেয়।ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তা খুলে মেলে ধরে।জল ছেপে আসে ইহতিশামের নয়নযুগলে।গুটি গুটি হাতে তাতে লেখা—-
“আমায় ক্ষমা করে দিস ইহতিশাম।ভাগ্যের কাছে আমি অসহায়।আমার পরীর মতো আমার রজনীগন্ধাকেও ওরা কেড়ে নিবে।তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো নারে।আমার শাস্তি আমি পেয়ে গেছি।জীবদ্দশায় আমি আমার মেয়েকে চোখে দেখতে পারি নি।মৃত্যু আমার জন্য যন্ত্রণা নয়।তার চেয়ে বড় শাস্তি পেয়েছি আমি।
আমার মেয়েটাকে দেখিস দোস্ত।ওকে আমি তোকে দিয়ে গেলাম।আমার পরীরে দেখে রাখিস।ওর তো কোনো দোষ নেই।ওকে কখনো ওর বাবা মায়ের অতীত জানতে দিস না।আমি চাই না আমার পরী আমাকে ঘৃণা করুক।তুই আমাকে আবার ঋণী করলি।
আমি আমার রজনীগন্ধাকে খুব ভালোবাসিরে।খুব।তাকে ছাড়া তো আমি একটা নিঃশ্বাসও নিতে পারবো না।তাহলে ওপারে থাকবো কী করে আমি!তাই আমি তাকে আমার সাথে করে নিয়ে গেলাম।
ভালো থাকিস দোস্ত।আমার মেয়টাকে তুই তোর আদর্শে মানুষ করিস।তোর মতো করে।ক্ষমা করে দিস আমায়।ক্ষমা করে দিস।আমি আমার রজনীগন্ধার প্রাণ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছি।জানিস তো-
“এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার”
টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল ইহতিশামের চোখ থেকে।নাকের উপরে থাকা ভারী ফ্রেমের চশমাটা মুছে আবার চোখে পড়ে।দরজায় অনবরত করাঘাত পড়ছে।
আজ আঠারো বছর ধরে ইহতিশাম এই এক টুকরো কাগজ প্রতি বছর এই দিনে পড়ে।কাঁদে,ভাবে।তারপর তা অতি যত্নের সাথে ড্রয়ারে রেখে দেয়।দরজা খুলতেই একগাল হেসে মেয়েটি তার বাবার বুকের সাথে মিশে যায়।হাস্যোজ্জ্বল গলায় অভিমান নিয়ে বললো—
“কী করছিলে তুমি দরজা বন্ধ করে বাবা?তুমি এখনো আমাকে বললে না।প্রতি বছর তুমি এই দিনে ঘরের দরজা বন্ধ করে কী করো?
ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেলে বললো—
“কিছু না আমার রজনীগন্ধা।এতো সেজেগুঁজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে আপনার?
মেয়েটি চমৎকার হেসে বললো—
“উফ বাবা!ভুলে গেলে!আজ কলেজে বিদায় সংবর্ধণা অনুষ্ঠান।কয়েকদিন পরেই তো আমাদের পরীক্ষা।”
ইহতিশাম অনুযোগের সুরে বললো—
“সরি,সরি রজনীগন্ধা।ভুল হয়ে গেছে বাবার।ক্ষমা করে দিন।”
“দিলাম ইহতিশাম।আর যেনো না হয়।”
বিজ্ঞের মতো নিজের বাবাকে এই কথা বলেই ঝরঝর করে হেসে ফেলে মেয়েটি।ইহতিশাম মৃদু হাসে।সরস গলায় বললো—
“আপনি কী এখনই বের হবেন রজনীগন্ধা?
“হ্যাঁ,বাবা।”
“সাবধানে যাবেন।”
অনেকটা সংকোচ নিয়ে মেয়েটি বললো—-
“তোমাকে একটা কথা বলবো বাবা?
“বলুন।”
“আমি যদি কোনো ভুল কর ফেলি তুমি কী আমায় ক্ষমা করবে?
ইহতিশাম সন্দিহান চোখে তাকায়।দ্বিধান্বিত গলায় বললো—-
“ঠিক বুঝলাম না।”
মেয়েটি বিনয়ী সুরে বললো—
“কাউকে ভালোবাসা কী অপরাধ বাবা?
“নাহ।তবে ভালোবেসে এমন কিছু করা অপরাধ যা আপনি পরবর্তীতে শোধরাতে পারবেন না।”
“তাহলে যে বড় বাবা বলতো,”এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”
ইহতিশাম সহজ গলায় বললো—
“আপনার বড় বাবা তাই বলেছেন যা তিনি করেছেন।”
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো—
“ওকে আমি যাচ্ছি।”
“হুম।”
বাবার ঘর থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে সামনে আসতেই দাঁড়িয়ে যায় মেয়েটি।সে তার ডানপাশে তাকায়।দুটো ছবি বাঁধানো সেখান।সারহান আর জান্নাহ্ এর হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি।মেয়েটি হাসে। প্রাণখোলা হাসি।হাসি হাসি মুখে বললো–
“বড় বাবা,তুমিও কী আমার সাথে রাগ করবে?
সামনের ফটোফ্রেমে বন্ধি সুদর্শন পুরুষটি মনে হলো হাসলো।তার হাসিতে হৃদয় গলে পানি হয়ে গেলো মেয়েটির।কোমল গলায় আবার বললো–
“বড়মা,তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো।তোমার কথা বাবা শুনবে।আমি কী করবো বলো!ইন্তেজার আমার কথা শুনছেই না।ও কিছুতেই আমাকে ভালোবাসতে চায় না।তাই আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি ওকে বিয়ে করেই ছাড়বো।কারণ,এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”
,
,
,
লাল রঙের একটা গাউন পড়েছে মেয়েটি।তার চোখ জুড়ে কাজল।মাথায় আকর্ষনীয় খোঁপা।তাতে গুঁজে দেওয়া রজনীগন্ধার সদ্য ফোঁটা কলি।
বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটি।প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা কবর দেখতে পায় সে।কিন্তু অদ্ভুতভাবেই সে থমকে যায়।কারণ যখন থেকে মেয়েটির বোধদয় হয়েছে তখন থেকে সে রোজ যাওয়া আসার পথে দু’জন বৃদ্ধ,বৃদ্ধাকে এখানে বসে থাকতে দেখে।কবরস্থানের পাহাড়াদারকে জিঙ্গেস করে জানতে পারে এখানে তাদের ছেলে আর ছেলের বউকে সমাহিত করা হয়েছে।তারা রোজ রজনীগন্ধা ফুলের ডাল এনে কবরের বুকে রাখে।আর কবরের পাশের বেঞ্চিতে একে অন্যের কাঁধে হেলান দিয়ে বসে কাঁদে।মেয়েটি দূর থেকেই সবসময় দেখে।কিন্তু আজ সে কবরস্থানের ভেতরে এসেছে।পুরাতন কবর দুটোর পাশে আরো দুটো নতুন কবর।জানতে পারে বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা মারা গেছে গত দুইদিন।
চোখ জ্বলে উঠে মেয়েটির।কারণ মেয়েটি নিজেও জানে না এরা তারই আপনজন।পুরোনো কবর দুটোতে এখন আর রজনীগন্ধা নেই।মেয়েটি তার খোঁপা থেকে ফুলগুলো খুলে একটা একটা করে সেই কবরের উপর রাখে।
মেয়েটি জানে তার বড় বাবা আর বড় মা তাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের প্রাণ দিয়েছে।একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবেনা বলে একসাথেই প্রাণ ত্যাগ করেছে।কিন্তু তাদের কবর কখনো দেখা হয়নি তার।
সারহান আর জান্নাহ্ রোজ তাদের মেয়েকে দেখে এখান থেকেই।ইহতিশাম কবরের পাশেই একটা বাড়ি বানিয়েছে।সারহানের শেষ অংশকে সে মানুষ করেছে তার মতো করেই।
মেহনাজকে ফিরিয়ে নেয় নি ইহতিশাম।একবার সে তাকে অনুরোধ করেছিলো।কিন্তু নাকোচ করে ইহতিশাম।মেহনাজ কোথায় আছে কেউ জানে না।শুভ্রার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়।সে কাউকে চিন্তে পারে না।তার শেষ ঠিকানা হয় মানসিক হসপিটাল।সারহানের মৃত্যুর খবরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় জাবিন।তার মামার এই পরিণতির জন্য সে নিজেকেই দায়ী করে।তিতি আজও মাঝে মাঝে তার মাকে দেখতে আসে।কিন্তু শুভ্রা!
সেরাজ আবার বিয়ে করেছে।
,
,
,
হাত বাঁধা ইন্তজারের।তার সামনে চোখ পিটপিট করছে মেয়েটি।চোখে হাসলো সে।ইন্তেজার রুষ্ট গলায় বললো—
“এইসবের মানে কী!ছাঁড়ো আমাকে।”
মেয়েটি সলজ্জ গলায় বললো—
“এমন করো না বাবু।”
ইন্তেজার নাক ফুলিয়ে বললো—
“ছাড়ো আমাকে।”
মেয়েটির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধু-বান্ধব।মেয়েটি হৈ-হৈ করে বললো—
“কাজী সাহেবকে খবর দিয়েছিস?এতো দেরি করছে কেন?
তার বন্ধু বান্ধব স্বমস্বরে বলে উঠে—-
“আরে,আরে চিন্তা করিস না।সোহেল নিয়ে আসছে বলে।”
তৎক্ষণাৎ সোহেল নিয়ে আসে একজনকে।সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত ব্যক্তির দীঘল দাঁড়ি গোফ।তার হাতে একটা ঝকঝকে খাতা।কাজী সাহেব ভীত চোখে তাকালেন ইন্তেজারের দিকে।ইন্তেজারের আকুতি ভরা চোখ দেখে ভড়কে যান কাজী সাহেব।হতভম্ব গলায় বললেন—
“এএএএসব কী।একে বেঁধে রেখেছো কেন?
মেয়েটি ঝলমলে গলায় বললো—
“বিয়ে করবো তাই।”
প্রস্ফুরিত গলায় বললো কাজী সাহেব—-
“তোতোতত বেঁধে রেখেছো কেন?
মেয়েটি চটপটে গলায় বললো—
“রাজী হচ্ছে না তাই।বিয়েটা পড়ান কাজী সাহেব।আমার বাবুর কষ্ট হচ্ছ।কতোক্ষন থেকে বেঁধে রেখেছি।”
কাজী সাহেব টিমটিমে চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন।ইন্তেজার কিছুতেই বিয়ে করবে না।সব ফর্মালিটিস শেষে যখন কবুল বলতে বললো ইন্তেজার কিছুতেই বলছে না।তখন মেয়েটি একটা ধারালো,পাতলা চাকু ইন্তেজারের গলায় ধরতে ভয়ে আঁতকে উঠে ইন্তেজার।আমতা আমতা গলায় বললো—
“কী কী করছো তুমি!
“কবুল বলবে নাকি…।”
“কককবুল,কবুল,কবুল।”
“দে তালি।”
মেয়েটি উচ্ছলিত হয়ে বন্ধুদের সাথে আনন্দে কোলাকুলি করে।তখনই একজন অতীব সুদর্শন পুরুষ তটস্থ হয়ে ঢোকে সেখানে।নতুন দালান করা হচ্ছে।বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতার কারণে কাজ বন্ধ।পুরুষটি ঢুকেই গনগনে গলায় বললো–
“কী হচ্ছে এখানে?
ইন্তেজার ভরসার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে শশব্যস্ত হয়ে দৌঁড়ে গেলো বলিষ্ঠ পুরুষটির পাশে।উদ্বিগ্ন গলায় বললো—
“দেখো না মামা এই মেয়েটা…।”
ইন্তেজারকে থামিয়ে মেয়েটি রসালো গলায় বললো—
“মেয়ে বলছো কেন!বউ বলো।এখন তো আমি তোমার বউ।”
পুরুষটি ধমকে উঠে বললো—
“বউ!কীসের বউ।”
মেয়েটি চকচকে চোখে তাকিয়ে চট জলদি বললো–
“ও আপনি বুঝি ইন্তেজারের সেই কুমার মামা।প্রিয়তমার মৃত্যুতে চিরকুমার থাকার পণ করেছেন!
পুরুষটি দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো।মেয়েটি স্মিতহাস্য অধরে তাকাতেই ইন্তেজার খরখরে গলায় বললো—
“এইসব কিছুর জন্য তুমি দায়ী মামা।না সেদিন তুমি আমাকে রজনীগন্ধা ফুল আনতে পাঠাতে না এই অসহ্য মেয়েটার সাথে আমার দেখা হতো।আমার পুরো জীবনটা হেল করে দিলো।”
পুরুষটি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ক্ষীপ্ত গলায় বললো—
“এইসবের মানে কী?কে তুমি?কী নাম তোমার?
মেয়েটি চোখে হাসলো।উচ্ছ্বসিত গলায় বললো—
“জান্নাহ্।জান্নাতুল সারহান জান্নাহ্।”
রাফাত বদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।জান্নাহ্ হাসতেই তার অধরের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাতেই মনে হলো যেনো তার রেড চেরি হাসছে।জান্নাহ্ এখনো হাসছে।তার হাসির প্রগাঢ়তা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে।রাফাতের দম বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।অতীত ফিরে আসছে যেনো ক্রমশ সময়ের পরিক্রমায়।রাফাত বিভ্রান্ত,চকিত,ভীত।
আবার না ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়!কারণ জান্নাহ্ সে।এক মায়াবী প্রতিমা,এক রহস্যে ঘেরা মানবী,এক প্রেমে পাগল কাঙালিনী।চোখের সামনে থেকেও এক অদেখা পৃথিবীর আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত নারী।তার নাম জান্নাহ্।
সমাপ্ত
একদম বিরল একটা গল্প এটা। তারসাথে চরিত্রগুলোও জান্নাহ্,সারহান, জান্নাহ্এর বাবা,মাম্মা, মামা আপনি অনেক ভালো লিখেন,লেখকসাহেব।গল্পের কভার পিকটা মনে হচ্ছে বাংলোর সেই পিকটা যেটা জান্নাহ্ এর পছন্দ হয়েছিল। জান্নাহ্ এর ডাকনাম গুলো অনেক ভালো ছিল রজনীগন্ধা, রেড চেরি,পরীজান, ডল।এখন থেকে রজনীগন্ধা ফুলকে আলাদা করে দেখতে হবে।একটা বিশেষ নাম ধারণ করে আছে সে।এন্ডিংটা ভালো ছিল। অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে এই গল্পটার জন্য,৪৩ পার্ট পরে যে ধারণা ছিল ওটা চেন্জ করতে হবে।ধন্যবাদ লেখকসাহেব গল্পটা লিখার জন্য।