জান্নাহ্,পর্বঃ৭,৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৭
শান্ত,স্থির,নিষ্কম্প দৃষ্টিতে বসে আছে জান্নাহ্ এর সেই চির আকাঙ্ক্ষীত সুদর্শন পুরুষটি।তার বুক চিরে গড়িয়ে পড়া উষ্ণ লহুর দিকে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।
তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল নোনতা জলের প্রস্রবণ।জান্নাহ্ এর নির্নিমেষ আঁখি চাইছে থেমে যাক এই সময়,থেমে যাক এই ধরা।তার প্রাণ তারই থাক।এই প্রাণ কে নিজের করে পাওয়ার জন্য জান্নাহ্ দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর খেলা খেলেছে।তাহলে তার প্রাণ কেন তার হতে পারলো না?
জান্নাহ্ এর প্রাণ আজ কথা বলছে না।সে শুধু তার হৃদমোহিনী কে দেখছে।একটু পরেই তাকে তার দুই চক্ষু মুদন করতে হবে।গলায় শ্বাস আটকে আছে।নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে ঝরছে শ্রাবণের ধারা।কিন্তু মুখে ঔজ্জ্বল্য।ঠোঁটে সেই ভুবন ভোলানো স্মিত হাসি।তার চোখ আবদ্ধ তার প্রাণনাশকারিনীর ওই পদ্মলোচন আঁখিতে।যার হিংস্রতা আজ তার ভালোবাসাকে হার মানিয়েছে।জান্নাহ্ তার ছুরিটা আরেকবার তার প্রাণের বুকের বা’পাশের সেই কম্পিত নরম যন্ত্রটার উপর ঢুকিয়ে দেয়।গলগল করে মুখ ভর্তি রক্তবমি করে তার প্রাণ।জান্নাহ্ এর প্রাণআত্না কেঁপে উঠে।তার প্রাণ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।কখনোই না।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে জান্নাহ্।তার হাত,পা কাঁপছে।কান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বের হচ্ছে।কপাল বেয়ে ঝরছে ঘাম।হাপরের মতো উঠানামা করছে তার বুকটা।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ায় তার শ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।বিছানা থেকে নেমে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে গিলে নেয়।ধাতস্থ হয়ে বিছানায় বসে জান্নাহ্।তার চোখে,মুখে অবিশ্বাস্য অনুভূতি।এমনটা হতে পারে না,কিছুতেই না।বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে জান্নাহ্।সে কোনো ভাবেই তার প্রাণকে আঘাত করতে পারে।এই স্বপ্ন কখনো সত্যি হতে পারে না।
আচমকা বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পায় জান্নাহ্।বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে।জান্নাহ্ এর মনের গহীনেও ঝড় শুরু হয়েছে।সে এখনো কাঁপছে।তার প্রাণকে আঘাত করার কথা সে ভুলেও ভাবতে পারে না।দ্রুতপায়ে বারান্দায় আসে জান্নাহ্।বারান্দার গ্রীলের ট্রান্সপারেন্ট নামিয়ে দেয় এতে করে বারান্দা আর ভিজবে না।মফস্বলে এমন ডুপ্লেক্স বাড়ি খুব কম দেখা যায়।জান্নাহ্দের বারান্দায় গোলাপ,কচমচ,বেলী আরো নানা রকমের ফুলের গাছ লাগানো।বারান্দায় ডিবানের কাছে একটা কৃত্রিম পদ্মফুলের জার রাখা।জান্নাহ্ দুটো মোমবাতি ভাসিয়ে দেয় সেই পানিতে।নিভুনিভু তার আলো।বাইরের বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ আসছে জান্নাহ্ এর কানে।খানিক পরপর মৃদু বিদ্যুতের ঝলকানি।তা অস্পষ্ট।জান্নাহ্ একটা ডাইরি নিয়ে ডিবানের উপর বসে।একটা জলচৌকিতে তা রাখে।মোমবাতির ঈষৎ হলদে আর লালচে আলোয় জান্নাহ্ তার ডাইরির লেখাগুলো স্পষ্ট দেখতে পায়।অনেক আগে থেকেই ডাইরি লেখার অভ্যাস জান্নাহ্ এর।নিজের একাকিত্ব কাটানোর সবচেয়ে সহজ উপায় এইটা তার কাছে।বৃষ্টির তোড়ে মৃদু হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে জান্নাহ্কে।আজ অনেকদিন পর জান্নাহ্ তার প্রাণকে নিয়ে লিখবে।আজকাল সময়ই হয় না তার।নিজের বিবাহিত জীবন সামলে হাঁপিয়ে উঠে জান্নাহ্।ফোঁস করে এক দম ফেলে সে।
কলমটা হাতে নিয়ে আবারো সেই স্বপ্নের কথা ভাবে জান্নাহ্।শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে তার।কী বীভৎস !
জান্নাহ্ লেখা শুরু করে।বাতাস একটু বাড়তেই তা ট্রান্সপারেন্ট ছাঁপিয়ে যায়।কেঁপে উঠে মোমবাতির আলো।জান্নাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“প্রিয় প্রাণ,
বর্ষণমুখর এই নিকষকৃষ্ণ রাতে আমার পাখোয়াজ মন আপনারে শুধায়,
প্রাণ;
এক বারো কী মনে পড়ে না আমায়?এতোটা কাল,এতোটা দিন যে সুখের প্রত্যাশায় আমি আপনার পথ চেয়ে নিরভিমান অপেক্ষমান,আমার এই অপেক্ষার অবসান কী এই জনমে আর হবে না?
আপনার ওই নিটোল আঁখির নির্নিমেখ চাহনি আমায় যে নিঃশেষ করে প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে,আপনার ওই পাখলঝোরা হাসি আমার হৃদযন্ত্রে তোলে ঝড়।
আমার পূজনীয় প্রাণেশ্বর,আবার অবচেতন মনের অধিরাজ,যার প্রতিটি ছোঁয়ায় আমার কোমলাঙ্গ দেহ সুখের বন্যায় ভাসে।দেখা কী হবে না আমাদের এই জনমে?
আমার হৃদয়রাজ,
এক নিশিসমাগম বেলায় আপনার আর আমার প্রথম দেখা।সেই প্রথম দেখায় আমার কী যে হলো!আমি আজো বুঝতে পারিনি।
আপনার ওই অধরপল্লবের অনুরণন,আমার সমস্ত দেহপিঞ্জরে ঝংকার তোলে।আমি অবদমন করি আমার সেই তৃষ্ণাকে যা আমার সারা দেহকে নিশ্চেতন করে দিচ্ছে।
আমার নয়নাসার কী আপনার চোখে পড়ে না প্রাণ?তাহলে কেন বাস্তব জীবনে আমি আপনার দেখা পাই না!আমার সত্ত্বা তন্ময় হয়,একবার আপনার দেখা পেতে।যেমনটি আমি ভেবেছি ঠিক তেমনটি।
আমার নির্মেঘ আকাশের নবারুণ আপনি,যার কোমল স্পর্শে শুরু হয় আমার দিন।আমার চাতক মন খোঁজে আপনায়,বৈকালের ওই নিভন্ত প্রভাকরের নিমিষ আঁখিতে।
কবে দিবেন দেখা?কবে করবেন আমায় আপন?আমি আপনারই প্রতিক্ষায় কাটাই অজস্র প্রহর।আপনি আসবেন তো প্রাণ?সেই নিশিসমাগমে,যেমনটা আমি চেয়েছি!আপনার প্রতিক্ষায়,
আপনারই
হৃদমোহিণী”
জান্নাহ্ থামে।বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় সে।তার মনে হচ্ছিলো কোনো দম বন্ধ করা গহব্বরে আটকা পড়েছে সে।হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠে।জান্নাহ্ সে আওয়াজ শুনতে পায়।দক করে উঠে তার বুকটা।দ্রুতহস্তে কলমটা হাতে নেয়।গড়গড়িয়ে লিখতে থাকে–
“প্রাণ, জানেন আজ কী হয়েছে!আজ আমি এক অকল্পনীয় স্বপ্ন দেখেছি।ছিঃ!কী বিদঘুটে,বীভৎস,অবর্ণনীয়।ভয়ে আঁতকে উঠি আমি।ভাবি,এও কী সম্ভব!
কী করে আমি আমার প্রাণকে আঘাত করি!আমার কী ইচ্ছে জানেন!ইচ্ছে হচ্ছে নিজের সমস্ত স্মৃতি ভুলে যাই।মুছে ফেলি আমার অস্তিত্ব।কিন্তু!
কিন্তু,তাহলে যে আমি আপনাকে হারাবো।আপনাকে আমি হারাতে পারবো না প্রাণ।কোন একদিন তো আপনি সত্যি হয়ে আসবেন।আমি সেই আশায় পথ চেয়ে থাকবো আপনার।আমার অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত।”
জান্নাহ্ বেশ কিছুক্ষন নিরব থাকে।মোমবাতির আলোয় তার ছায়া পড়ছে লম্বভাবে দেয়ালে।তা দেখেই হেসে উঠে জান্নাহ্।ফুঁ দিয়ে আদো আদো জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা নিভিয়ে ফেলে সে।ঘরে এসে বিছানায় উঠে বসে।মনের উচাটন কমে নি।এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখলো সে!যার গায়ে একটা সূঁচ বিঁধার কথা সে ভাবতেও পারে না তার বুকে ছুরি!
ঝনঝন করে উঠে জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর।নাহ,সে আর ভাবতে চায় না।জানালার পাশে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে জান্নাহ্।থাই খুলতেই এক পশলা বৃষ্টি তার চোখে,মুখে ঝাঁপটে পড়ে।থইথই করে জান্নাহ্ এর মন।এখনো অবিরত মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।জান্নাহ্ আকাশের দিকে তাকায়।বৃষ্টির তোড়ে মনে হচ্ছে এখনি খসে পড়বে চাঁদ।আকাবাকা চাঁদ।জান্নাহ্ হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরের দিকে।বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার হাত।জান্নাহ্ সেই শীতল জলধারা তার গালে মাখে।প্রস্ফুরণ হয় তার শরীরে।লোমকূপগুলোও শিউরে উঠে এই ছোঁয়ায়।জান্নাহ্ মৃদু ছন্দে হাসে।তার হাসিতে যেনো বৃষ্টিও আজ হাসছে।
হঠাৎ জান্নাহ্ এর সারহানের কথা মনে পড়ে।কাঁপন ধরে তার গায়ে।এই কাঁপন হয়তো সারহানের উষ্ণতাই সারাতে পারতো।লজ্জামিশ্রিত হাসে জান্নাহ্।লোকটা থাকলে আজ আর তার ঘুম ই হতো না।জান্নাহ্ বাইরের দিকে চেয়ে বসে থাকে।আলো ফুটতে শুরু করেছে।বৃষ্টির ছন্দও ক্রমশ কমে আসছে।এলাকার মসজিদ থেকে মিষ্টি সুরে ভেসে আসছে আযানের ধ্বনি।জান্নাহ্ আশ্বস্ত হয়।এখন আর ঘুমিয়ে কাজ নেই।অযু করে নামাজের জন্য তৈরি হয় জান্নাহ্।স্নিগ্ধ একটা সকাল।
,
,
,
গম্ভীর হয়ে বসে আছে রাফাত।তার বিক্ষিপ্ত অক্ষিযুগল অক্লান্তভাবে খুঁজছে তার জানেমানকে।কিন্তু কোথাও নেই সে।জান্নাহ্দের স্কুল গেটেই একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো।ছেলেমেয়েরা ক্লাস শেষে আড্ডা দেয়।একদিন কথা কাটাকাটিতে মারামারি বেঁধে যায়।কিন্তু আসল দোষীকে খুঁজে পাওয়া ছিলো দুষ্কর।তাই ভবিষ্যতে ঘটা এই ধরনের ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য ক্যামেরার ব্যবস্থা।
তার মনিটরিং রুমে গত কয়েকদিন ধ্যান ধরে ঘন্টা পার করে রাফাত।আজোও বসে আছে।পাশে বসা ইশাক ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–
“কী শুরু করলি তুই?রেজিষ্টারে গিয়ে নামটা দেখলেই সব ল্যাটা চুকে যায়।আর তুই কিনা!
ইশাকের কথায় বিন্দুমাত্রও বিরক্ত হয় না রাফাত।তার নির্নিমেখ চাহনি এখনো মনিটরে।স্কুলে প্রবেশ করা প্রতিটি ছেলে মেয়েকে ভালো করে দেখছে সে।খেয়ালিপনায় বললো–
“যা সহজে পাওয়া যায় তার মোহ অতি সহজে কেটে যায়।কিন্তু যা অর্জন করা যায় তার মায়ায় পড়ে যায়।”
ইশাক নাক ফুলিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো–
“তোর এইসব আউল ফাউল বাউলা ঘ্যানঘ্যান শুনতে ভালো লাগছে না।এইভাবে কী তুই ওকে খুঁজে পাবি?
“পাবো বন্ধু পাবো।”
ইশাক জ্বলন্ত চোখে তাকায়।হঠাৎ করেই রাফাত উন্মনা গলায় বললো–
“জানিস ওর না চেরি ফুল ভীষন পছন্দ ছিলো।আমি আসার সময় জাপান থেকে ওর জন্য চেরি ফুল নিয়েও এসেছিলাম।কিন্তু হারিয়ে ফেললাম আমি ওকে।ওর প্রিয় রং হলো লাল।রেড চেরি।ভীষন পছন্দ করতো।ঠিক রেড চেরির মতো ছিলো আমার জানেমান।আমি কখনো খেতে পারতাম না।এতোটা মিষ্টি আমার সহ্য হতো না।কিন্তু ও পারতো।এই জন্যই ও এতোটা মিষ্টি ছিলো।
প্রতি বছর ওর জন্মদিনে ওকে রেড কালারের ড্রেস গিফ্ট করতাম।কিন্তু কখনো ওকে সেই ড্রেসে দেখার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি।সব কিছু শেষ হয়ে গেলো।”
বুকটা ভারি হয়ে আসে রাফাতের।তার কলিজায় যেনো কেউ ছেদ করে দিয়েছে।তা আর জোড়া লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।চোখের কোণে জল জমে রাফাতের।তা ইশাকের চোখ এড়ালো না।বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো–
“চল,রেজিস্ট্রার থেকে ওর নাম দেখে আসি।আর ওখানেই ঠিকানা পেয়ে যাবো।”
“উঁহু।এতো সহজে না।ওকে আমি খুঁজে বের করবোই।কথা দিয়েছে ও আমাকে।ছোটবেলা থেকে ভালোবেসেছি আমি ওকে।এই,এই এইটুকুন ছিলো ও।তখন থেকে।ভালোবাসা কী বুঝতে পারতাম না আমি তখন।তবুও ওকে চেয়েছি।আর আজ সব বুঝেও শুধু ওকেই চাই।আমার রেড চেরি।আমার জানেমান।খুঁজে আমি ওকে বের করবোই।”
ইশাক নিরস্ত্র সৈনিকের মতো আত্নসমর্পণ করে।রাফাতকে বোঝানো দায়।
চলবে,,,
#জান্নাহ্
#পর্বঃ৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
চেয়ারে হেলান দিয়ে দুই পা একসাথে করে তা উঠিয়ে রেখেছে টেবিলের উপর সারহান।তার পাশেই সারহানের অফিসিয়াল ল্যাপটপ।পাশে একটা ফ্লাওয়ার ভাস।শায়িক রোজ আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে তাতে তাজা রজনীগন্ধ্যা এনে রাখে।
উত্তরমুখী ঘরের পশ্চিম পাশটায় টেবিলটা রাখা।সারহানের ফ্ল্যাটে দুটো বেড রুম।একটা সে অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করে আরেকটা ঘুমানোর জন্য।সারহান পেশায় একজন আন্ডারকভার ক্রাইম রিপোর্টার।দেশের উঁচ স্থানে অবস্থানকারী অনেক মানুষের সাথে তার গোপন আঁতাত।
দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাদেরও অনেক গোপন তথ্য আছে সারহানের কাছে।ক্ষমতার লোভে মানুষ আজ মানুষকে পিষে তার উপর দালান তৈরি করে।সেই দালানে এসি অন করে শান্তির ঘুম ঘুমায়।সারহানের একটা রিপোর্ট সেই ঘুম হারাম করতে যথেষ্ট।অবশ্য এইসব কাজ করতে গিয়ে তার শত্রুও কম নয়।কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু সে যাকে দেখেও চেনা যায় না।
টেবিলের ও প্রান্তেই প্রভুভক্ত প্রাণীর মতো বসে আছে শায়িখ।তার নরম চোখ দুটো তার স্যার এর দিকে।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো–
“স্যার,আপনার কী ভয় লাগছে না?
সারহান মাথার নিচে হাত দিয়ে আয়েশি ভঙিতে বসে ছিলো।শায়িখের কথায় অক্ষিপল্লব মেলে তাকায়।ক্ষনকাল চেয়ে থেকে বিগলিত হাসলো।সারহানের হাসিতেই চোখ পিট পিট করে শায়িখ।এতো ভয়ংকর মুহূর্তেও লোকটার হাসি কী করে পায়!
সারহান নির্বিঘ্ন গলায় প্রত্যুক্তি করলো–
“ভয় লাগবে কেন?
শায়িক চোখে,মুখে ভয় ফুটিয়ে গলায় স্বর গভীর করে বললো—
“তিথি ম্যাম আর সামিরা ম্যামের জন্য আপনার চিন্তা হচ্ছে না?
সারহান বাঁকা হাসলো।উঠে গিয়ে শায়িখের পেছনে দাঁড়ালো।পাশে থাকা জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস ডুকছে আর তাতে সারহানের সিল্কি চুলগুলো উড়ছে।শায়িখ সামনে থাকা মিররে তাকায়।কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সারহান।শায়িখ ঘাবড়ে যায়।লোকটার এই অদ্ভুত দৃষ্টিতে ভীষন ভয় করে তার।যেনো শরীর হিম হয়ে আসে।সারহানের দৃষ্টি দেখে কখনো বোঝার উপায় থাকে না একটু পরে সে কী করতে চলেছে।যে কোন অপ্রস্তুত বা ভয়ংকর মুহুর্তেও অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিজেকে সামলে নেওয়ার কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষ সারহান।কিন্তু তার ওই চোখ ক্ষেপা নেকড়ের চেয়েও ভয়ংকর,হিংস্র,তীক্ষ্ম আর তান্ডবপূর্ণ।শায়িখ ভেবে পায় না এই যে চোখের নরম চাহনিতেই তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সেই চোখের চাহনিতে মেয়েরা প্রেমে কী করে পড়ে?
শায়িখের কাঁধে হাত রেখে হালকা ঝুঁকে মিররে সরল দৃষ্টি রেখে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় সারহান বললো–
“যে নেই তাকে নিয়ে চিন্তা করে যে আছে তাকে অপমান করার কোনো মানে হয় না।”
শায়িখ ফাঁকা ঢোক গিলে।তিথি আর সামিরা সারহানের তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড।গত চারমাস আগে তিথি আর ঠিক তার দুই মাস পর সামিরা খুন হয়।নিজেদের বাড়িতেই খুন হয় তারা।বেচারিরা মরেও শান্তি পায় নি।যে বা যারা খুন করেছে শরীরকে কয়েকটুকরো করে ফেলেছে।সারহান একবারই দেখতে গিয়েছিলো।তারপর বেমালুম ভুলে যায় তাদের কথা।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় দুই জন খুন হওয়ার কিছুদিন আগেই একটা করে চিঠি এসেছিলো সারহানের অফিসে।অবশ্য সারহান তা পায় তার দু’দিন পর।কাজে ব্যস্ত ছিলো সে চট্টগ্রামে।সেখানে কবিতাংশ লেখা ছিলো।ঠিক একই রকম কবিতাংশ তিথি আর সামিরার মুখের ভেতরের কাগজটায় পাওয়া যায়।
এতো কিছুর পর অধৈর্য হয়ে পড়ে শায়িখ।তার দৃঢ় বিশ্বাস এইসব কিছু সারহানের কোন শত্রুই করেছে।কিন্তু তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সারহান।বরং সে অন্য নারীতে মত্ত হয়েছে।
শায়িখ বিনা দ্বিধায় বললো–
“স্যার,আপনার কী মনে হয়?কে করতে পারে এই কাজ?
সারহান শান্ত হয়ে বসে।অধরে তার সেই স্মিত হাসি।মুখের অভিব্যক্তি যে কোনো নারী হৃদয়কে ঘায়েল করবে।তার ব্যক্তিত্ব,বাচনভঙ্গিতেই মেয়েরা ঘায়েল হয় বেশি।আর তার সেই হিংস্র চাহনি,ধূর্ত বুদ্ধি,নিশ্চিন্ত চালচলন,বেপরোয়া মন সবকিছুতেই কাঠিন্যভাব।
সারহান নরম গলায় বললো–
“তোমার কী আমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না আমার গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে?
“নাউজুবিল্লাহ স্যার!এক গার্লফ্রেন্ড রে সামলাইতে পারি না।তার উপর….।”
শায়িখ তার কথা শেষ করলো না।রহস্য হাসে সারহান।শায়িখ গত চারবছর ধরে কাজ করে তার সাথে।অবশ্য সারহান তার কোনো অ্যাসাইমেন্টেই কাউকে অ্যালাউ করে না।যা করে সে নিজেই করে।তবে শায়িখের উপর তার বেশ ভরসা।
সারহান রসালো গলায় বললো–
“ফুলের মধু একদিন শেষ হবেই।সে ঝড়ে পড়বেই।তাই বলে কী ভ্রমর থেমে থাকবে!
শায়িখ অবগত হলো তার স্যার এর কথা।কিন্তু তবুও দ্বিধান্বিত গলায় সে প্রশ্ন করলো–
“স্যার,খুনিটা আপনার গার্লফ্রেন্ডদেরই কেন বেছে নিলো?
সারহান আয়েশি গলায় বললো–
“দ্যাটস আ গুড কোয়েশ্চন!হয়তো তার আমার গার্লফ্রেন্ডদের পছন্দ নয়।”
“কিন্তু কেন স্যার?
সারহান এইবার বিরক্তিকর চোখে তাকায়।তার সেই চাহনিতেই কেঁপে উঠে শায়িখ।মনের প্রশ্ন মনেই অবদমন করে।
,
,
,
টিফিন আওয়ারে দুই বান্ধবী মিলে গল্পে মশগুল।কিন্তু তিল আজ উন্মনা।কথার ফাঁকে তা উপলব্ধি করে জান্নাহ্।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে জান্নাহ্–
“কী হয়েছে তোর?গালটা একদম চুষা আমের মতো কেন করেছিস?
তিল তাচ্ছিল্য করে বললো–
“সোনার যৌবন যায় বিফলে,নাগর আমার কই?
তার দহনে পুড়ছে দেহ,পুড়ছি আমি সই।”
জান্নাহ্ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে হতভম্ব গলায় বললো–
“এইসব কী বলছিস তুই?
“আর বলিস না,যেদিন থেকে ওকে দেখেছি ঘুম ই আসে না রাতে।”
তিল শান্তভাবে তার হাতটা বেঞ্চের উপর রেখে তাতে চিবুক রেখে উদাসী ভঙিতে সামনে তাকায়।জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে এক ধাক্কা মেরে খেটখেটে গলায় বললো–
“কী আজেবাজে কথা বলছিস!কাকে দেখার কথা বলছিস?
তিল অতি উৎসাহ নিয়ে বললো–
“আরে ওই যে ক্যাম্পেইনের জন্য যে ছেলেরা এসেছে না তাদের মধ্যে একজন।আহা!কী ডেশিং দেখতে!কী গভীর চোখ!কাটা কাটা নাক!আর ঠোঁট দুটো যেনো একদম পাকা জাম।ইশ!
জান্নাহ্ হতবাক হয়।ঠোঁট গুঁজ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।ঠাট্টামিশ্রিত গলায় বললো—
“এখন তোর রণবীর সিং এর কী হবে!তুই যে রনবীর কাপুরের প্রেমে পড়লি!
“আরে দুর।ইশ!তুই যদি দেখতি!ছেলেটা কী সুন্দর কথা বলে!
জান্নাহ্ কিছুক্ষন বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।গত এক সপ্তাহ ধরে ওদের স্কুলে কিছু ছেলে মেয়ে এসেছে।তারা কিছু স্বেচ্ছাকর্মী নিতে চায়।তারা দেশের বিভিন্ন স্কুল,কলেজ থেকে কিছু ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করবে।দরিদ্র,অসহায় শিশুদের জন্য কমপক্ষে ক্লাস টু পর্যন্ত বিনা খরচে পড়ার সুবিধার পাশাপাশি আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করবে।
জান্নাহ্ কপট ভীত গলায় বললো–
“এই এখন যদি এইসব ভাবিস তাহলে তোর মডেলিং এর কী হবে?তুই না দীপিকা পাডুকোন।”
তিল মেকি আফসোসের গলায় বললো–
“হায়!আমার দীপিকা!এখন আমি কী করি!
হঠাৎ করে তিল জান্নাহ্ এর হাত ধরে তাকে করিডোরে নিয়ে আসে।সেখান থেকে মাঠের মাঝখানে অবস্থানরত সেই ছেলেমেয়েদের দেখা যাচ্ছে।তিল গদগদ হয়ে বললো–
“দেখতো ছেলেটাকে কেমন লাগে?
তিলের দিকে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে জান্নাহ্।তারপর বাধ্য হয়েই বান্ধবীর মন রক্ষার্থে সামনে তাকায়।ঝনাৎ করে উঠে জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর।কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো–
“ওওওই ব্ল্যাক কালারের পোলোশার্ট পরা ছেলেটা?
তিল আমুদে গলায় বললো–
“তুই কী করে বুজলি?
“কিইইছু না।”
ত্রস্ত পায়ে ক্লাসে আসে জান্নাহ্।ব্যাগের উপর থাকা বই,খাতা গুছিয়ে নিয়ে তা ব্যাগে ডুকায়।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যেতে চাইলে তিল অবাক গলায় প্রশ্ন করলো–
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?এখনো তো দুটো ক্লাস বাকি।”
জান্নাহ্ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো–
“আমার ভালো লাগছে।অস্বস্তি লাগছে।”
“এইতো ভালো ছিলি।”
জান্নাহ্ ঈষৎ চটে গিয়ে বললো–
“এখন লাগছে না।যেতে দে।”
“মেঘনোলিয়া ম্যামের ক্লাস আছে।”
“জানি।যা হবার হবে।”
“দারোয়ান যেতে দিবে না।”
“রতন স্যারকে বলেই যাবো।”
তটস্থ হয়ে ক্লাস থেকে বের হয় জান্নাহ্।থরথর করে কাঁপছে তার শরীর।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।অতি উত্তেজনায় শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।সিড়ির কাছে যেতেই ধাক্কা খায় রাফাতের সাথে।শ্বাস আটকে নেকাবের মধ্য থেকেই প্রশ্বস্ত দুই চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকে রাফাতের দিকে।ধাক্কা লাগায় অপ্রস্তুত হয় রাফাত।অনুযোগের গলায় বললো–
“আই এম সরি।”
জান্নাহ্ কোনো কথা বললো না।রাফাতকে পাশ কাটিয়ে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে যায়।রাফাত নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে জান্নাহ্ এর যাওয়ার পানে।আচমকা বাঁকা হাসে রাফাত।ইশাক উৎসুক গলায় জিঙ্গেস করে–
“হাসছিস যে?
এইবার পুরো অধর ছড়িয়ে হাসে রাফাত।রসালো গলায় বললো–
“চল,তোকে আজ বিরিয়ানি খাওয়াবো।”
“বিরিয়ানি!
“ইয়েস।মানুষের মাংসের বিরিয়ানি।”
চলবে,,,