জীবনতরী #পর্ব_৩

0
401

#জীবনতরী
#পর্ব_৩
লেখনি- Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা

সাদিয়াকে নিয়ে সিদ্দিক সাহেব যখন বাস থেকে নামলেন তখন সকাল হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত জ্যামে পড়েছিল তারা। তা না হলে ভোর থাকতেই পৌঁছে যেত। তমাল কাউন্টারেই বসে ছিল। স্যারকে দেখেই এগিয়ে গেল। ও ভেবেছিল আসেপাশে কোনও হোটেলে নাশতা করিয়ে তারপর মেসে নিয়ে যাবে ওদেরকে। কিন্তু সাথে এত গাট্টিগুট্টি দেখে মনে পরে গেল নিজের ঢাকায় পদার্পনের দিনটা। এত জিনিসপত্র নিয়ে ঘুরাঘুরি সম্ভব না কিছুতেই। তাই একটা সিএনজি ঠিক করল তমাল। আগে তাহলে মেসেই যাওয়া হোক।

সিএনজি চলতে শুরু করলে এবার কাজের কথায় আসলো তমাল।

“স্যার আমি কোচিং সেন্টারে কথা বলে রাখছি। সাদিয়া আজকে থেকেই শুরু করতে পারবে। আমরা জিনিসপত্র মেসে রেখে এসে নাশতা করব। তারপর কোচিং সেন্টারে যাবো।“

“ঠিক আছে বাবা। যেটা ভালো হয় করো।“

আচমকা সিদ্দিক সাহেবের মনে পরে গেল, বাস থেকে নেমে স্ত্রীকে জানানো হয়নি। তড়িঘড়ি মোবাইলটা বের করে ডায়াল করলেন। মাহফুজা বেগম যেন ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলেন। রিং হওয়া মাত্রই শুনতে পেলেন,

“হ্যালো? পৌঁছাইছো তোমরা?”

“হ্যাঁ পৌঁছাইছি। তুমি চিন্তা করো না। আমরা এখন মেসের দিকে যাচ্ছি।“
“আচ্ছা।“

“আল্লাহ হাফেজ”

রাস্তা ফাঁকা থাকায় অল্প সময়েই মেসে পৌঁছে গেল তারা। পুরোনো ধাঁচের একটা বাড়ি প্রতিটা রুমে চারজন করে থাকে। বেশিরভাগই সাদিয়ার মত এডমিশনের পরীক্ষার্থী, ভার্সিটি পড়ুয়া আছে কয়েকজন, চাকরিজীবি দুইএকজন। তমালের এক বন্ধুর ছোটবোন এই মেসে থাকে, ওর কাছ থেকেই খোঁজ পেয়েছিল এই বাসার। ভাড়াটা একটু বেশি হলে এখানে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল কোচিং সেন্টারটা খুব কাছে। সাদিয়া যেহেতু আগে কখনো ঢাকায় চলাফেরা করেনি ওর জন্য এইটাই ভালো হবে। তমাল যে এই বিষয়টা চিন্তা করেছে এতে সিদ্দিক সাহেব খুব খুশি হলেন। সাদিয়ার মা খুব চিন্তা করছিল, মেয়েটা কিভাবে এতবড় শহরে একা চলাফেরা করবে। এই দুশ্চিন্তাটা কিছুটা কমবে।

“স্যার… কি চিন্তা করছেন?”

“মেয়েটাকে একা রেখে যাচ্ছি বাবা, খুব চিন্তা হচ্ছে।“

“চিন্তা করবেন না। আমি তো আছি।”

“তোমার ভরসাতেই তো এতদুর এলাম। তোমার চাচি তো রাজিই হচ্ছিল না।“

“চাচিকে বলবেন এত চিন্তা না করতে। সাদিয়া তো আমার ছোট বোনের মতই। আমি খোঁজ খবর নিব সবসময়য়। কি সাদিয়া? পড়াশুনা করতে হবে কিন্তু ভাল করে।“

সাদিয়া মাথা নিচু করে বলল, “জি ভাইয়া।“

“কোচিং এর সব খবর কিন্তু আমার কাছে আসবে। আমিও ক্লাস নেই তো ওখানে।“

গল্পে গল্পে কোচিং সেন্টারে পৌঁছে গেল ওরা। সব ফর্মালিটি শেষ করে ঠিক হল আজকের দিনটা রেস্ট নিয়ে আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করবে সাদিয়া। কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে সিদ্দিক সাহেব বললেন যে তিনি সাদিয়াকে মেসে পোঁছে দিয়ে আজই পাহাড়তলীতে ফিরে যাবেন। কিন্তু তমাল তাতে বাধ সাধল।

“স্যার সারারাত জার্নি করে এসেছেন। সাদিয়াকে মেসে দিয়ে আমার সাথে হলে চলেন। দুটা ডালভাত খেয়ে ঘুমাবেন। রাতের বাসে উঠিয়ে দিব আপনাকে।“

“আমি চলে যেতে পারব তমাল। তোমার চাচি ছোট মেয়েটাকে নিয়ে একা বাসায়।“

“একটা রাতই তো। এখন রেস্ট না নিলে শরীর খারাপ করবে। এই বয়সে এত ধকল সইবে কেন শরীর?”

“আব্বা তমাল ভাইয়া ঠিকই বলছে তুমি রাতে যাও।“

ইততস্ত করে সিদ্দিক সাহেব রাজি হলেন। কিন্তু তার জড়তা কাটল না।

“তোমার হলে সমস্যা হবে না?”

“ছি ছি স্যার। কি বলেন? আমি তো আপনাকে হলে দিয়ে টিউশনিতে যাবো। সন্ধ্যায় ফিরব। আপনি ততক্ষন একটু ঘুমাবেন।“

“আচ্ছা ঠিকাছে। এত করে বলছ যখন…“

সাদিয়াকে পৌঁছে দিয়ে সিদ্দিক সাহেবকে নিয়ে ওর হলে চলে গেল তমাল। যাওয়ার আগে দুপুরে খাওয়ায় জন্য এক প্যাকেট তেহারি কিনে দিল, মিল শুরু হবে রাত থেকে। সাদিয়া মেসে ফিরে চিন্তা করল একটা লম্বা গোসল দিয়ে খেতে বসবে। রাতের জার্নির উপর দুপুর পর্যন্ত ঘোরাঘুরিতে শরীর একদম কাহিল হয়ে গেছে। বিছানাটা কোনমতে চাদর পেতে গুছিয়ে নিল আগে। তারপর ব্যাগ থেকে গামছা আর একসেট জামা নিয়ে বাথরুমের দিকে গেল। দরজা আটকানো, কেউ গোসল করছে। গোসলখানার সামনে তিন চারটা বালতি রাখা লাইন দিয়ে। জামাকাপড় নিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসল সাদিয়া। এসে দেখলো ওর এক রুমমেট ফিরেছে।

“নতুন?”

“হ্যাঁ আজকে আসলাম।“

“আমি সিমি। ফার্স্ট ইয়ার। তুমি?”

“সাদিয়া। ভর্তি পরীক্ষার্থী।“

“ও আচ্ছা। আজকেই আসছো না?“

“জি আপু।“

হাতে জামাকাপড় আর গামছা দেখিয়ে সাদিয়াকে বলল, “গোসলে যাবা?”

“জি আপু। সিরিয়াল দিছো?”

“মানে?”

“গোসলের সিরিয়াল। বাথরুমের সামনে একটা বালতি রেখে আসো।“

“বাথরুমে বালতি নাই আপু?”, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল সাদিয়া।

“আরে মেয়ে, এখানে সবাই নিজ নিজ বালতি মগ দিয়ে গোসল করে। তুমি এক কাজ কর। আমার বালতিতে আজকের দিনটা চালাও।“

“আচ্ছা আপু।”

“বাথরুমের সামনে কালো বালতিটা আমার। এখন গোসলে গেছে পাশের রুমের আপু। তারপর আমার সিরিয়াল। নাম লেখা আছে বালতির গায়ে। গোসল করে আবার ওখানেই রেখে আইসো। অন্য কারো বালতি ধইরো না আবার। পাশের রুমের সামিয়া আপুর বালতিও কিন্তু কালো।“

“আচ্ছা আপু।“

কি আচ্ছা আচ্ছা শুরু করছো?”

“অনেক ধন্যবাদ আপু।”

“আরে ধন্যবাদ তুলে রাখো। প্রথমদিন আসছো তাই একটু স্পেশাল ট্রিট, আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ। আমি এত ভাল না। যাও তাড়াতাড়ি আপুর গোসল শেষ, নাহলে অন্য কেউ ঢুকে পড়বে।“

“আচ্ছা আপু।“

তাড়াহুড়া করে গোসলখানার দিকে এগুলো সাদিয়া। সিমির বালতিটা হাতে নিতেই দেখলো অন্য একটা মেয়ে সরু চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে।

“কিছু বলবেন আপু?”

“তোমার সিরিয়াল এখন?”

“না আপু। সিমি আপুর সিরিয়াল। আপু বলছে আমাকে যেতে।“

“ও আচ্ছা।“

সাদিয়া বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। কিন্তু শাওয়ার কাজ করেনা। বুঝলো এবার, বালতির দরকারটা কি। বালতিতে পানি ভরতে ভরতে চিন্তা করল, কি আজব যায়গা। একটা গোসল করা নিয়ে কত কাহিনী। না জানি আরো কত কাহিনী আছে সবকিছুর। মায়ের সাথে একটু কথা বলা দরকার। সকাল থেকে একটা ফোন করা হয়নি। নিশ্চয় অনেক চিন্তা করছে।

গোসল দিয়ে ফ্রেশ লাগছে এখন।মায়ের সাথে কথা বলে ব্যাগ থেকে প্লেট আর গ্লাস বের করল সাদিয়া। খাওয়ায়ার পানির ব্যাবস্থা কোথায় শুনতে হবে। আপাতত ব্যাগে থাকা বোতলের পানিই ভরসা। তেহারির প্যাকেট খুলে প্লেটে নিল কিছুটা। সিমিকে সাধলো একসাথে খাওয়ার জন্য। কিন্তু সে এখন ভীষন ব্যাস্ত ফোনে কথা বলায়। ইশারায় বুঝালো, ক্ষুধা নেই।

খেয়েদেয়ে বাবাকে ফোন করে খোঁজ নিল সাদিয়া। খাওয়া শেষে ভাতঘুম দেওয়া বাচ্চাকালের অভ্যাস ও। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। একসময় নিজেকে আবিস্কার করল এক গহীন অরণ্যে, পথ খুঁজে পাচ্ছেনা কিছুতেই। দিকিবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে দৌড়াতে থাকল। বাবা… বাবা… বলে চিৎকার করছে। কিন্তু গলা থেকে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছে না। একসমইয় দূর থেকে স্কুলের ঘন্টা শুনতে পেল সাদিয়া। ঘন্টার শব্দটার দিকে দৌড়াতে থাকল ও। একটা সময় খেয়াল করল চারপাশের দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। নিজেকে আবিষ্কার করল ব্যাস্ত রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে। গাড়িঘোড়ার ভীড়ে কিছুতেই রাস্তা পার হতে পারছে না সে। কিন্তু ঘন্টাটা বেজে চলেছে একনাগাড়ে।
চোখ খুলতেই সাদিয়া দেখল ঘরটা অন্ধকার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অপরিচিত রুমটায় আর কেউ নেই। ফোনটা বেজে চলেছে। এটাই তাহলে স্বপ্নে ঘন্টার শব্দ মনে হচ্ছিল? ভাবল সাদিয়া।

“হ্যালো আব্বা।“

“আম্মাজান ঠিক আছো তুমি? কতক্ষন থেকে ফোন করতেছি।“

“ঘুমায়ে গেছিলাম আব্বা। কাউন্টারে গেছ তুমি?“

“আমি তোমার মেসের নিচে দাঁড়ানো। একবার দেখা করে চলে যাবো।“

“আবার কষ্ট করে আসছো তুমি? দুপুরেই তো রেখে গেলে।“

“কষ্টের কিছু না আম্মা। একবার নিচে আসো।“

“একটু দাঁড়াও আব্বা।“

কোনওমতে ওড়নাটা পেঁচিয়ে দৌড় দিল সাদিয়া। না জানি কতক্ষন থেকে নিচে দাঁড়িয়ে আছে আব্বা, নিজেকে একশটা বকা দিল সাদিয়া। নিচে গিয়ে দেখলো সিদ্দিক সাহেব তমালকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেসের গেটে। দুইহাত ভর্তি খাবারদাবার। বিস্কুট, চানাচুর, চিপ্স, কেক, ফলমুল। চোখ ছলছল করছে তার। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাঁচমিনিটের মধ্যে বিদায় নিলেন এক দরদী বাবা।
ঘরে ফিরে শুন্য আনুভব হোল সাদিয়ার। এতক্ষনে বুঝতে পারল এই বিশাল শহরে এবার ও একা। একদম একা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here