জীবনসঙ্গী-৯
Chhamina_Begam
বাকি রাত টুকু ঠিক মতো ঘুম হল না আদিলার । চিন্তার পোকারা যাচ্ছে তাই ভাবে অতিষ্ঠ করে তুলেছে ওকে । একটা বোঝাপড়া দরকার রাহাতের সাথে । মুয়াজ্জিনের আজান শুনেই উঠে পড়ল সে । পাশে মিতু শুয়ে আছে । ওর দিকে একপলক চাইল । তারপর নেমে এসে অযূ করে , নামাজ পড়ে খুব সন্তপর্ণে পা বাড়াল সিড়ির দিকে । চারিদিকে আবছা অন্ধকার ,তার মাঝেই রেলিং ধরে ঠায় দাড়িয়ে রইল । অপেক্ষা করতে লাগল যদি রাহাত আসে । আর হয়তো দেখা করার বা কথা বলার সুযোগ হবে না । বিষয়টাকে ঝুলিয়ে না রেখে পরিস্কার ভাবে শেষ করাই শ্রেয় মনে হলো ওর । কিন্তু যার জন্য এত অপেক্ষা , এত প্রহর গোনা সে এলো না । অন্ধকারের চাদর সরে গিয়ে সূর্য মশাই ধরনীকে আলোকিত করল , পাখির কিচিরমিচির থেমে গেল , আস্তে আস্তে তাপ বাড়তে শুরু করল তবুও এলো না রাহাত , অপেক্ষার অবসান ঘটল না । কাল রাহাত যে চাদরটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিল , ভেবেছিল আজ সেটা ফেরত দিয়ে দেবে । কিন্তু সে যখন এলোই না তখন আর কি করা ? আদিলাকে হতাশ দেখাল খানিকটা । জোর করে হাসার চেষ্টা করল । যেন নিজেকেই বোঝাতে চাইল সে , কোনো ব্যাপার না । এটা একটা এক্সিডেন্ট মনে করে ভুলে যাওয়াই ভালো , তার জন্যেও আর আমার জন্যেও ।
-“আপু , কি করিস এখানে ?সেই কখন থেকে আম্মু খুজছে তোকে !”
সায়নের ডাকে চিন্তার জাল ছিড়ে বেরিয়ে এল আদিলা । বলল,
-“কেন খুজছে ? ”
-“আমি এতসব জানি না । তুই চল আগে ”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আদিলা । তারপর বলল,
-” চল”
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল রাহাতের । শরীর ক্লান্ত থাকায় কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি । আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই সকালের কড়া রোদ এসে চোখে মুখে ঝাপটা দিল । বা হাতে তৎক্ষণাৎ আড়াল করল নিজেকে । আলোটা চোখে সয়ে আসতেই তাকাল ঘড়ির দিকে , ন’টা চল্লিশ হয়ে গেছে । নামাজ পড়া হয়নি মনে পড়তেই ঝটপট অযূ করে এসে কাজা আদায় করে নিল । ক্ষিদে পেয়েছে ভীষণ । পেট টা গুড়গুড় করছে । কিছু খাওয়া প্রয়োজন । জায়নামাজ টা গুছিয়ে রেখে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল । ফোনটা হাতে নিতেই তার তলা থেকে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে এল । অবাক হল রাহাত । এটা কার ? কে পাঠিয়েছে ? কৌতুহলী হয়ে চিরকুট টা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে শুধু একটা লাইন লেখা ,
“আমাকে ক্ষমা করে দেবেন ।প্লিজ ।”
রাহাত বার দুয়েক পড়ল লাইন টা । অদ্ভুত লাগল ওর । এটা কি ফাহিমের ? না , তাহলে তো ওর ফোনের নিচে চিরকুটটা চাপা দেওয়া থাকত না । তাহলে কি আদিলা ? নামটা বিদ্যুতের গতিতে ক্লিক করল ব্রেইনে । প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে সে । আতিপাতি খুঁজেও যখন পেল না আদিলাকে না তার পরিবারের অন্য সদস্যদের । তখন বাধ্য হয়েই মাহিকে ডেকে জিজ্ঞেস করল আদিলার কথা । রাহাতের অস্থিরতা স্পর্শ করল মাহিকেও । নরম কন্ঠে বলল,
-“ওরা তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে ”
-“বেরিয়ে গেছে? কখন ? ”
-“এই তো আধ ঘন্টার মতো হবে মনে হয় । ওদের ট্রেন আছে এগারোটা দশে । ”
-“ওহ ”
হতাশ হলো রাহাত । আদিলার থেকে এটা আশা করেনি ও । শুধু একটা বাক্য লিখে ও কি বোঝাতে চাইছে ? সে কি পছন্দ করে না ওকে ? এমনটা হওয়ার কথা তো নয় । মনোবিজ্ঞানী না হলেও মানুষের মুখের অভিব্যক্তি পড়ার ক্ষমতা আছে রাহাতের । আদিলা না মানলেও ওর মনে যে রাহাতের জন্য সফ্ট ফিলিংস আছে সেটা ও ধরতে পেরেছিল সে । না হলে ওকে রাহাত কখনোই বিয়ের প্রপোজাল দিত না । কারণ আর যাই হোক ভালোবাসাহিন কোনো সম্পর্কে রাহাত কখনোই জড়াতে চায় না ।
-“ভাইয়া , কি ভাবছ ? খাবে চলো ,,”
মাহির ডাকে সম্বিত ফেরে রাহাতের ।চটজলদি কিছু একটা ভেবে বলে ,
-” মাহি শোন , আমি রুমে যাচ্ছি । ফাহিমকে একটু রুমে আসতে বলতো । ”
বলেই আর অপেক্ষা করল না রাহাত । তীরের বেগে ঘরে চলে গেল । মাহি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাহাতের যাওয়ার পথে । রাহাতের উদ্বিগ্নতাই অনেক কিছু বলে দিচ্ছে । মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে । আদিলা খুব শক্ত ধাচের মেয়ে । পারবে কি ওকে রাজি করতে ?
স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে আছে আদিলারা । ট্রেন আসতে আরও অনেক দেরি । কোথায় নাকি ঝামেলা হয়েছে তাই আধ ঘন্টা লেট । পুরো প্লাটফর্মের অপেক্ষারত মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে । আদিলা উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । কেমন অস্থির লাগছে ভেতরটা । মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না । মনটা এখন ও ফাহিমের রুমেই পড়ে আছে । সকালে সায়নের ডাকে যখন নিচে নেমে এসেছিল তখন আম্মু তাড়াতাড়ি প্যাকিং করে গোসল সারতে বলেছিলেন । মায়ের কথা মতো আদিলা প্যাকিং করে গোসল সেরে তৈরি হচ্ছিল । তখনই টেবিলের ওপর নোটপ্যাডটা চোখে পড়ে ।’আমাকে ক্ষমা করবেন ‘এই কথা টুকু পড়ে নিশ্চয়ই রাহাত থেমে যাবে । আদিলার একবার মনে হলেছিল সকালে দেখা হয়নি ভালোই হয়েছে । রাহাত সামনে এলেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় আদিলা । সে ওর চেনা পরিচিত গন্ডি পেরিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে । রাহাতের সামনে দাড়িয়ে তাই এই কথাটা কোনো ভাবেই সে বলতে পারত না । এ বিষয়ে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। তাই চিরকুট লিখে সবার চোখের অগোচরে গুটিগুটি পা ফেলে ফাহিমের ঘরে গিয়ে দেখে রাহাত তখন বেঘোরে ঘুমুচ্ছে । চিরকুটটা রাহাতের ফোনের নিচে রেখে চলে আসতে নিলেই কি মনে ঘুরে দাড়ায় । রাহাতের ঘুমন্ত মুখটা ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল হৃদয়ে । খুব ইচ্ছে করছিল ঘুমন্ত রাহাতের কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুল গুলোই হাত চালিয়ে ঠিক করে দিতে । কতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল জানা নেই সম্বিত ফিরল তখন যখন রাহাত পাশ ফিরে শুয়ে ব্ল্যাংকেটের কোণা আকড়ে ধরল । আদিলার তখন এক অদ্ভুত খেয়াল চেপে বসল মনে । একটু চেষ্টা করলে হয়তো রাহাত ওর হাতটাও সারাজীবন এভাবেই আকড়ে ধরে রাখত । এই মানুষটার চোখে সে নিজের জন্য একসমুদ্র সমান ভালোবাসা দেখেছিল । যেখানে ডুব দিয়ে একটা গোটা জীবন নিশ্চন্তে পার করে দেওয়া যায় । এমন একটা ভালোবাসাময় , শান্তিপূর্ণ জীবনই তো চেয়েছিল সে একসময় । আজ যখন তা ওর মনের দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে তখন মনের আবদারের কাছে ওর আত্মসম্মান বোধ বেশি ভারি হয়ে গিয়েছিল । যখনি রাহাতের হাতটা শক্ত করে ধরার ইচ্ছা জাগত তখনি মেঘনার করা অপমান গুলো চোখের পাতায় চলচিত্রের ন্যায় ভাসতে থাকে । অসহ্য লাগে ওর । মনে হয় শরীরে কেউ কাটা ফুটিয়ে দিচ্ছে । তখন এই মানুষটিকে মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয় ওর । চোখের পাতা ভিজে আসে । মেঘনা তো ভুল কিছু বলেনি । ওর আর রাহাতের মাঝে আসমান জমীন তফাত । যার মেলবন্ধন শুধু কল্পনাতেই সম্ভব । আর আজ মেঘনা বলেছে । কাল অন্য কেউ বলবে না তারই বা নিশ্চয়তা কে দেবে ? সারাজীবন যেচেপড়ে শরীরে সূচ্ ফোটানোর থেকে নীরবে সরে আসা অনেক শ্রেয় মনে হয়েছিল ওর । কিন্তু অবাধ্য মন মানতে নারাজ এই সিদ্ধান্ত ।
-“আপু ? এই আপু ? ”
বার দুয়েক ডাকার পরেও যখন কোনো হেলদোল দেখা দিল না আদিলার মধ্যে তখন সায়ন ঘাড়ে হাত রেখে ঝাকি দিল । সম্বিত ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল আদিলা । সায়ন বলল,
– এই আপু , কি হয়েছে তোর ? এত উদাস হয়ে কি ভাবছিস ?
মৃদু হাসল আদিলা । মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করল । সায়ন ভ্রু কুচকে তাকাল । আদিলা রেহনুমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আম্মু , আমি তাহলে শিলিগুড়িতেই নেমে যাই, কি বলো ? ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই চলে আসব । ”
রেহনুমা আরাফাত সাহেবের দিকে তাকালেন । সামান্য বিরক্ত মনে হল তাকে । তবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন । মাহির বিয়েতে আদিলার বড় মামা , মামি যখন এল না তখন ফোন করে জানতে পারে আদিলার নানু নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে । বেশি কিছু নয় , বয়স জনিত কারণে । তার সঙ্গে ওর বড় মামার মেয়ে আরুশি আপার ডেলিভারীর ডেট সামনে । মামি বয়স্ক শাশুড়ি আর আট মাসের গর্ভবতী মেয়েকে একা হাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন । আদিলার আম্মুর যাওয়া সম্ভব নয় । কারণ সামনেই সায়নের এইচ এস সি পরীক্ষা । তাই আদিলা ঠিক করেছে সেই যাবে । অন্তত ছুটি শেষ হওয়া অবধি সেখানে থাকবে । ততদিনে যদি নানু সুস্থ হয় তবে মামি অনেকটা আরাম পাবেন । কিন্তু আসলেই বিষয়টা যে তা নয় এটা খুব ভালো করেই জানে আদিলা । আসল কথা হল আদিলা এই কদিন নিজেকে একটু ব্যস্ত রাখতে চায় । মনটা ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে । বাড়িতে কাজ বলতে কিছুই নেই । আর কাজ নেই মানেই দুনিয়ার সব অবান্তর চিন্তাভাবনা এসে জেকে বসবে মাথায় । আর ওকে উদাসীন দেখলে মায়ের হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে । যেটা এই মুহূর্তে ফেস করতে চায় না আদিলা । তাই কোনো ক্রমে ছুটির দিনগুলো শেষ হলেও বাচোয়া
(ক্রমশ)