জীবনসঙ্গী_১৪

0
939

জীবনসঙ্গী_১৪
Chhamina_Begam

বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙল আজ আদিলার । জানালার পর্দা ভেদ করে সূয‍্যি মশাই আলো পৌঁছে দিয়েছে ওর ঘরে । আলোআধারি এক মায়াময় পরিবেশে উঠে বসল আদিলা । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাড়ে আট টা বাজতে চলেছে প্রায়। আশ্চর্য তো , আম্মু আজ ডাকল না কেন ? ফজরের নামাজটাও কাযা হয়ে গিয়েছে । মনটাই খারাপ হয়ে গেল আদিলার । তড়িঘড়ি করে অযু করে এসে কাযা আদায় করে বাইরে এসে অবাক হয়ে গেল । সবাই ব‍্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে । বাড়ির সামনের উঠোনে শামিয়ানা টাঙানো হচ্ছে । কতকগুলো ছেলে ছোকড়া বড়ো বড়ো হাড়ি পাতিল নামিয়ে আনছে টেম্পু থেকে । তাদের লিডার গোছের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আব্বু কথা বলছে হেসে হেসে ।পাড়ার বয়োজৈষ্ঠ দাদু , চাচা , জেঠুরাও এসে যোগ দিয়েছে ।সেই আলোচনার মধ্যমনি আব্বুর উৎফুল্ল মুখখানায় খুশির জোয়ার উঠেছে দেখে আদিলাও মৃদু হাসল । আপন মানুষদের হাসতে দেখলেও মনে শান্তি লাগে ।

-“কি হে ঘটক মশাই ,আপনার চাঁদমুখখানার যে আজকাল দর্শন পাওয়া যাচ্ছে না । কোথায় থাকো আজকাল ? ”

মিজান সাহেব হৃষ্টচিত্তে এগিয়ে এলেন ফাহিমের দিকে ।

-” এই তো চাচা আজ এলাম তো আপনাদের খোঁজ করতে । কেমন আছেন আপনি ?”
-“আলহামদুলিল্লাহ । তোমার কারণে আজ এত সুন্দর একটা দিনের সাক্ষাৎ পেলাম, ভালো থাকব না মানে আছে।তা ও বাড়ির খবর সব ঠিক আছে তো ? ”
-” জি চাচা , আমি একটু পর সেখানেই যাচ্ছি । ”
-“সে কি ! তুমি হলে আমাদের সবথেকে স্পেশাল গেস্ট । ঘটকমশাই বলে কথা । সেই তুমি যদি এখানে না থাকো চলবে কি ভাবে ?”
বলতে বলতে এগিয়ে এলো তিতলি ।
-“কি আর করা যাবে বল । দায়িত্ব যখন নিয়েছি । দৌড়াই আর কি । দেখতে তো হবেই সব কিছু ঠিক চলছে কি না । ”
-” তা ভাইয়া,আমি বলি কি , চাকরি বাকরি ছেড়ে দাও বুঝলে । একটা ঘটকালির এজেন্সি খুলে বসো । তোমার যা ট‍্যালেন্ট দেখছি । আমি গ‍্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি , খুব নাম কামাবে । ”
ফাহিম তিতলির মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে ,
– ” বিটকেল একটা ! …….. একচুয়ালি, তুই ঠিক বলেছিস ,একটা এজেন্সি খোলাই যায় ,তাই না ? রাহাতকেই দেখ , এমন রাফ এন্ড টাফ ছেলেটার ও একটা ব‍্যবস্থা করে ফেললাম আমি । এজেন্সি টা ভালোই চলবে মনে হয় । তোর গ্ৰাজুয়েশনটা কমপ্লিট হোক । আমার এজেন্সির ফাস্ট ব্রাইড তুই হবি, ঠিক আছে ? চিন্তা করিস না বুনু । খুব শিগগিরই তোর ও একটা ব‍্যবস্থা করে ফেলব আমি । কি বলেন চাচা ? খোঁজ লাগাব নাকি ? ”

-“একদম । তুমি শুরু করো খোঁজখবর । আমি তোমার সঙ্গে আছি ”
-“আব্বু !!তুমিও !! ধুর ভাল্লাগে না । তোমাদের সঙ্গে কথা বলাই দোষ হয়েছে । আমি কত সুন্দর একটা বুদ্ধি দিলাম তোমাকে। আর তোমরা আমাকেই বলির বকরা বানাতে চাও । যাও । ছাড়তে হবে না তোমাকে চাকরি । তোমার জন্য চোরডাকাতের পেছনে ধাওয়া করাই বেস্ট জব । শুয়ে বসে খাওয়া তোমাদের ভাগ্যে নেই । বুঝলে ?”
বলেই অভিমানী তিতলি গটগট করে পা ফেলে চলে গেল সেখান থেকে । মিজান সাহেব আর ফাহিম হেসেই উঠলেন সমস্বরে ।
– ” আচ্ছা চাচা , রাহাত কোথায় ? দেখছি না যে …”
মিজান সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই হাতে নাস্তার ট্রে সমেত উপস্থিত হলেন সাবিহা ।বললেন ,
– “আর রাহাত ! এখন তো সারাদিন ওর দেখা পাওয়াই দুষ্কর হয়ে গেছে । ছেলেটা সব একা হাতে সামলাচ্ছে । আছে বোধহয় আসে পাশে কোথাও !তুমি নাস্তা করো এখন , ও আসুক ততক্ষণে । ”

*****
-“রাহাত ,তোর মনে হয় না এটা একটু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে গেল ?
– “হুম ,একটু । তবে এতে সমস্যা হবে না । হলেও আমি সামলে নেব । বরং সার্টিফিকেটটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারব । ”
-“কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ছে আদি রিজেক্ট য়‍্যু । তারপরও তুই ইনসিস্ট করলি বলে আমি খালুকে তোর কথা বলেছি । আচ্ছা , তুই কিভাবে বুঝলি আদির সবথেকে উইক পয়েন্ট হচ্ছে ওর বাবা । ও খালুর কথা কখনো অমান্য করে না । সত্যি বলতে আমিও কখনো খেয়াল করিনি এই বিষয় টা । ”
-” আসল কথা হলো ,তোর কখনো প্রয়োজন পরেনি বলে তুই সেভাবে খেয়াল করিস নি । কিন্তু আমি করেছি কারণ আমরা যখন কাউকে খুব পছন্দ করি তখন তার প্রত‍্যেকটা বিষয় আমরা নিজের অজান্তেই খেয়াল করতে শুরু করি । তোদের বাড়িতে আমার কাজ তো কিছুই ছিল না। সেই সময় আমার পুরোটা ধ‍্যান জ্ঞান জুড়ে শুধু সেই ছিল । তখনই আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম আদিলা আর সায়ন পারতপক্ষে ওদের আব্বুর সামনে পড়তে চাইত না । পড়লেও একটা তঠস্থ ভাব ঘিরে থাকত ওদের । বিশেষ করে আদিলার ক্ষেত্রে এই বিষয়টা আমি বেশি লক্ষ্য করেছি । এর দুটো কারণ হতে পারে -এক ,তারা তাদের আব্বুকে ভয় পায় আর দুই , ওদের আব্বু একজন ডোমিনেটিং পার্সন যে কিনা নিজের পরিবারের সদস্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পছন্দ করেন । এবার এমন একজন লোক সে যে যেকোনো বিষয়ে তার সন্তানদের জোরজবরদস্তি করবেন না সেটা আশা করা বোকামি । আর বাঙালী কালচারে মেয়েরা বয়োসন্ধি পেরোতেই তাকে বিদায় দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় । তার ওপর আদিলারা গ্ৰামে থাকে এবং এটা গ্ৰামের কমন একটা বিষয় । এবার তুই আমাকে টিপিক্যাল ওপারচুনিস্ট বলতে পারিস । আমি মাইন্ড করব না । কারণ আমি এই সুযোগটাই নিয়েছি । এর একটা ভ‍্যালিড কারণ আছে । আর তা হলো আদিলা কোনো একটা বিশেষ কারণে আমাকে একসেপ্ট করতে চাইছিল না কিন্তু তার মনে আমার জন্য সফট্ ফিলিংস আছে এটা আমি বুঝতে পেরেছি । তাহলে আমি কেন একটা সিলি কারণের জন্য আমার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে যেতে দেব ? ”

এতক্ষণ রাহাতের প্রত‍্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনছিল ফাহিম । এবার হাঁফ ছেড়ে বলল ,
-” ইয়েজ , লজিক আছে । কিন্তু বন্ধু, তুই একটা নতুন সম্পর্কে যেতে চলেছিস । সেখানে এমন কস্ট-বেনিফিটের হিসেব করে চললে কি চলে ? ”

-“আমি বাধ‍্য ছিলাম ফাহিম । আদিলা আমার জন্য কোনো পথ খোলা রাখেনি । ‌ তাই আমাকেই রাস্তা তৈরি করতে হয়েছে….”

-” যাই হোক । আমি জানি তোরা ভালো থাকবি । আমার ভরসা আছে তোর ওপর । তাই তো আমি তোর সঙ্গ দিয়েছি । এখন ওই পাগলী টা বুঝলে হলো । সে তো আমার কলই রিসিভ করছে না । রাগ করে বসে আছে মনে হয় । তার ফাহিম ভাইয়াকে যে তার সাথে চিট করেছে”
ফাহিমের কন্ঠস্বরে বিষন্নতা ঝরে পরে ।
রাহাত সান্ত্বনার সুরে ফাহিমের কাধে হাত চাপড়ে দিয়ে বলল,
-“আর একটু কষ্ট কর বন্ধু । তার পর তোর ছুটি ”

– “উম হু । ছুটি বললে তো হবে না । আমার বকশিশ কে দেবে , বল ? ”
হেসে ফেলে রাহাত ।
-“শালা । তুই সমন্ধি হয়ে আমার কাছে বকশিশ চাইছিস । ”
-“এসব বললে তো হবে না ।আমি তোর বন্ধু হিসেবে চাইছি । আমার বকশিশ কিন্তু চাই । মানে চাইই । ….”
হাসতে হাসতেই বলল ফাহিম ।
-“ঠি…ক আছে । তোর আর মিতুর হানিমুন প‍্যাকেজটা আমার তরফ থেকে পাবি । খুশি ? ”
-“ডিল ।।”
দুজনেই হাত মুঠো করে আলতো করে ঘুষি মেরে হেসে ওঠে ।

*****
সারাটা দিন শুধু সবার দৌড় ঝাপ দেখতে দেখতেই কেটে গেল আদিলার । বাড়িতে পাড়াপড়শি থেকে আত্মীয় স্বজনের উপছে পড়া ভীড় দেখে বুঝতে বাকি নেই এ পাড়ার ছোট শিশু থেকে বয়ো বৃদ্ধ সবাই জেনে গেছে আরাফাত সাহেবের মেয়ের আকদ হবে আজ । বয়ষ্ক দিদি ,ভাবিরা কৌতুক মিশ্রিত চটুল বাক‍্য দ্বারা ওকে লজ্জা দেওয়ার কোনো কসরত বাকি রাখছে না । আদিলা কখনো বিরক্ত হচ্ছে আবার কখনো লাজরাঙা হয়ে মুখ লুকাচ্ছে ।পাড়াতো এক বোন তো জোর করে মেহেদী লাগিয়ে দিল দু হাতে । এদের যন্ত্রণায় আদিলা দুপুরে খাওয়ার সময় টুকু পায়নি । বিকেল হতে হতেই পেট গুড়গুড় করতে শুরু করেছে সাথে গ‍্যাস্ট্রিকের ব‍্যাথা । অথচ বাকি সবাই দিব‍্যি খেয়ে বসে আছে । তাছাড়াও বাড়িতে এত লোকজনের ভীড় যে তাদের সামনে দিয়ে হেটে যেতেও লজ্জা লাগছে আদিলার । অগত্যা রহিদকে পাঠিয়ে দিল দাদিকে ডেকে আনতে । শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ব‍্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এলেন রেহনুমা । জিজ্ঞেস করলেন ,
-“ডেকেছিস আমায় ? কি হয়েছে ? ”

আদিলা কয়েক পলক নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে । সারাদিনের ব‍্যস্ততা , অতিথি আপ‍্যায়নের পরেও মায়ের মুখে ক্লান্তির ছাপ নেঈ বরং একধরনের প্রশান্তির ছায়া দেখতে পাচ্ছে আদিলা ।
-“কি হলো ? তাড়াতাড়ি বল । আমার অনেক কাজ পড়ে আছে এখনো । বড়ো ভাবিরা যে কখন আসবে ? আমি একা আর কত দিক সামলাবো !”
-“আমার ক্ষিদে পেয়েছে আম্মু । পেট ব‍্যাথা ব‍্যাথা করছে । ”

এতক্ষণের সমস্ত ব‍্যস্ততা, কাজের চাপ এই একটি বাক‍্য শুনেই যেন উধাও হয়ে যায় । থমকে যায় রেহনুমা । সব দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজের মেয়েটারই খোঁজ নেওয়া হয়নি তার । মেয়েটার মুখ শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেছে । অথচ বিয়ের দিন মেয়েরা কত সপ্রতিভ দেখায় । বুকের মাঝে ব‍্যাথা অনুভব করে রেহনুমা । খুব চিনচিনে , সুক্ষ্ম অথচ কি প্রবল তার রেশ । মনে হচ্ছে যেন কেউ তার হৃদয়টাকে ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে । আজ থেকে তার কলিজার টুকরাটা অন‍্যের আমানত হয় যাবে । পাঠিয়ে দিতে হবে তাকে একটা অজানা অচেনা পরিবারে । মেয়েটা কি পারবে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে ? ওর শশুর বাড়ির লোকেরা ভালোবাসবে তো ওকে ? মনে মনে আল্লাহর কাছে মেয়ের কল‍্যানের জন্য প্রার্থনা করেন । চোখে আসা জলের ধারাটাকে সযত্নে লুকিয়ে ফেলেন রেহনুমা । মায়েদের যে এত দূর্বল হতে নেই । ঠোঁটে মৃদ হাসির রেখা টেনে বলেন ,
-” তুই বোস ।আমি আনছি এখনি । ”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রেহনুমা ভাতের প্লেট নিয়ে ফিরে এলে ঘরের উপস্থিত বাকিরা ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে যায় । রেহনুমা জল ভরা বোতলটা টেবিলে রেখে চটপট খেতে বলে বেরিয়ে যেতে উদ‍্যত হয় । অনেক কাজ পড়ে আছে তার ।

-“আম্মু ? ”
রেহনুমা প্রশ্নচোখে ফিরে তাকায় ।

-“খাইয়ে দাওনা আম্মু । অনেক দিন তোমার হাতে খাওয়া হয় না । ”
রেহনুমা প্রশ্রয়ের হাসি হাসে ।চোখে কোণে অশ্রু বিন্দুদের চিকচিক করতে দেখা যায়। রেহনুমা একমনে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেয় আদিলাকে । আর আদিলা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে । ইচ্ছে করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে । কত কত দিন ঠিক মতো ঘুম হয় না ওর । যেন ঘুমের সাথে আড়ি হয়ে গেছে অলিখিত ভাবে। বড়ো হয়ে যাওয়ার পর আর সেভাবে আল্লাদ করে মাকে জড়িয়ে ধরা হয় না । কোথা থেকে যেন একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরে ওকে । অথচ আজ মনে হয় এই আলিঙ্গন টুকুর খুব প্রয়োজন এই মুহুর্তে ।

মুখে লোকমা তুলে দেওয়ার সময় ইষৎ কেঁপে ওঠে রেহনুমার হাত । দেখতে দেখতে কবে যে তার মেয়েটা বড়ো হয়ে গেল ! রেহনুমার এখনো মনে পড়ে এই তো সেদিনের কথা , শশুরমশাই সাকিবের জন্য সাইকেল কিনে এনেছিলেন । সাকিব সেই সাইকেলে চেপে পাড়ার কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে টিউশন পড়তে যেত । সেই সময় আদিলা জেদ করত সেও যাবে দাদার সাথে । অথচ সাকিব নিজেও তখন দশ এগারো বছরের বালক । বছর দুয়ের ছোট মেয়েকে রেহনুমা ছেলে সাথে কোনো মতেই পাঠাতো চাইতো না । ভয় হতো যদি কোনো অঘটন ঘটে । অথচ আদিলা মানবে কেন ? সাকিব চলে যেতেই হাত পা ছুড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করত উঠোনে । বাধ্য হয়ে সাকিবকে কথা দিতে হতো বোনকে টিউশন থেকে ফিরেই তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে সে । পুরোনো স্মৃতি চারণ করে রেহনুমা দূর্বল হয়ে পড়ে । ঠোঁট চেপে ধরে রাখে শক্ত করে। আদিলা বেশ বুঝতে পারে আম্মু কান্না চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে । সেও মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য চিন্তায় নিজেকে ব‍্যস্ত রাখতে চায়।ক্ষনিকের জন্য ভুলে যেতে চায় আজকের এঈ বিশেষ দিনটিকে । তখনি মনে পড়ে যায় একটা অতি পরিচিত সাদৃশ্যপূর্ণ চিত্র । মাহি আপুর বিয়েতে রাহাত ঠিক একি ভাবে যত্ন করে খাইয়ে দিয়েছিল আদিলাকে । সেদিন নেহাত ক্ষিদের তাড়নায় লজ্জা, সংকোচ সব বিসর্জন দিয়েছিল সে । কিন্তু আজ মনে হয় ঠিক সেদিন থেকেই সঙ্গে একটু একটু করে দূর্বল হয়ে গেছে রাহাতের প্রতি । অথচ এটা কোনো মতেই কাম‍্য ছিল না ।

-খাওয়া হয়ে গেলে একটা ক‍্যাপসুল খেয়ে নিস । ব‍্যাথা কমে যাবে ।
-হুম । …….. আম্মু ?
-হু….
খাওয়া শেষ করে রেহনুমা উঠে দাড়ায় । আদিলার অভিমান জমে , কান্না পায় ভীষণ । আনমনেই বলে ওঠে ,
-” আমাকে আর কটা দিন নিজের করে রাখতে পারলে না আম্মু । এত তাড়া কেন তোমাদের ? আমি কি খুব কষ্ট দেই বলো ? …..আম্মু, আমি এখানেই থাকতে চাই । তোমার সাথে , ভাইয়া-ভাবি , সায়ন-রহিদের সাথে । আমাকে কেন পর করে দিচ্ছ গো তোমরা ? ”

আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারে না দুজনেই । ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মা মেয়ে । বাইরের কোলাহলে ওদের কান্নার মৃদু ঝংকার চাপা পড়ে যায় অনায়াসে। এসময় ভেঙে পড়তে চায় না রেহনুমা । তার যে অনেক দায়িত্ব । শাড়ির আঁচলে আলতো করে চোখ মুছে দরজার দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পান আদিলার কন্ঠস্বর,

-“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে আম্মু ? প্লিজ … একবার ,, ”

মেয়ের আদুরে ডাকে দায়িত্বের দেয়াল ভেঙে গিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয় । মেয়েকে বুকে চেপে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে বলতে থাকেন রেহনুমা ,
-” মেয়েরা কখনো পর হয় না আম্মু । শুধু ঠিকানাটা বদলে যায় । তাদেরকে দূরে, অন‍্যের ঘরে পাঠানো হয় ঠিকই , শুধু নিজের সংসারকে গুছিয়ে নিতে , নিজের একটা পরিবার গড়তে । তারা সবসময় বাবা মায়ের বুকের ভেতর থাকে সযতনে লুকোনো মূল্যবান সম্পদ হয়ে । যে সম্পদ কোনো দিন ক্ষয়ে যায় না , কোনো দিন নষ্ট হয়ে যায় না । তুই আজ কষ্ট পাচ্ছিস । এটা স্বাভাবিক । চির চেনা গন্ডি পেরিয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সবার কষ্ট হয় । কিন্তু মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারে । এই ক্ষমতা প্রত‍্যেকটা মেয়ের জন্মসূত্রে পাওয়া । তাই আমাদেরকেই এই ত‍্যাগটা করতে হয় । আমি জানি , আমার মেয়ে দূর্বল নয় । তুই ঠিক পারবি মানিয়ে নিতে । জানিস তো , সাদা পৃষ্ঠায় যাই ইচ্ছে তাই আঁকা যায় , লেখা যায় । একটা নতুন সম্পর্ক ও ঠিক তেমনি একটা সাদা পৃষ্ঠার মতো । তাই তুই সেখানে যাই আঁকবি তাই পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠবে । তারা তোর সম্পর্কে সেরকম কিছুই জানে না ।তাই তুই যা দিবি তাই ফেরত পাবি । পরিবারের প্র‍ত‍্যেকটা সদস্যকে সম্মান করে , ভালোবেসে আপন করে নিলে তারাও তোকে ভালোবেসে নিজের পরিবারের একজন ভাবতে দেরি করবে না । ”

শাশুড়িকে কোনো কারণবশত ডাকতে এসে মা-মেয়ের এমন আবেগঘন মুহূর্ত দেখে দরজায় দাড়িয়ে পড়ে ফারিহা । ইচ্ছে করে না ডাকতে । মন বলে থাকুক না আরো কিছু সময় দুজনেই একসাথে । তবুও বেলা বয়ে যায় , সময়কে আটকে রাখা যায় না । চোখের জল মুছে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

-” আম্মু , বড়ো মামী ,নানুরা এসেছে । চলুন ।তারা খুঁজছে আপনাকে । ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here