জীবনসঙ্গী_১৬
Chhamina_Begam
– তোর মেয়ে তো দেখি রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছে রেহনুমা। জামাই তো রাজপুত্রের মতো দেখতে। কপাল আছে আদিলার, নাহলে ঘর- বর কি আর এমনি এমনি জোটে ।
রেহনুমা মৃদু হাসল । মহিলাদের আড্ডায় এমন কথা এখন অহরহ শুনছে সে । এইবিষয়ে কিছু বলার নেই ওর । সব কর্তৃক তো উপরওয়ালার ।এখন মেয়ে যাতে সুখী হয় এই আশাতেই মহান করুনাময়ের দরবারে হাত পেতে রয় সর্বদা ।
– তোর মেয়েটার ভাগ্য দেখলে মাঝে মাঝে হিংসা করতে ইচ্ছে হয় । আমার মিনাটাকে দেখ , রাজকন্যার মতো রূপসী মেয়ের ভাগ্যে কি না এমন স্বামী ,শশুর বাড়ি জুটলো যার নুন আনতে পান্তা ফুরায় । জামাইটাও একেবারে হাড় বজ্জাত , মদ গাজা খেয়ে এসে মেয়েটার ওপর জুলুম করে । মেয়েটার আমার শান্তি নেই ।
পাশের বাড়িতে আম্মুকে ডাকতে এসে নিজের ভাগ্যের এমন উত্তপ্ত গুনাগুন শুনে থমকে দাড়ায় আদিলা । মিনা চাচি যে পরোক্ষ ভাবে নিজের মেয়ের সাথে তুলনা করে ওকে হেয় করতে চাইছে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর । বিয়ের আগে অনেকেই বয়স বেশি , গায়ের রং এসব নিয়েছে আব্বু কে আজেবাজে কথা বলে ভড়কে দিত । তা নিয়ে কম অশান্তি তো হয়নি বাড়িতে ! কিন্তু বিয়ের পরে কি শান্তি আছে ! এখনো লোকের কাছে ওর গায়ের রংটাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে । ভাগ্যের দোহাই দিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক কথা বলতেও বাধছে না । আদিলার খুব কঠিন করে বলতে ইচ্ছে করে আজ নিজের মেয়ের জন্য কষ্ট কেন হচ্ছে ? মিনার বিয়ের আগে কেন এই কথা গুলো ভাবে নি তারা ?তখন আদিলা চাচির হাত ধরে অনুরোধ করেছিল এত কম বয়েসে মেয়ের বিয়ে না দিতে। কতই বা বয়স তখন মীনার ? সদ্য মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়েছিল কেবল । মেয়েটার ইচ্ছে ছিল আরো অনেক দুর পড়ার । নিজে কিছু করে দেখাতে চেয়েছিল সে । আদিলাকেই কতবার বলত সে , আপু আমি ও তোমার মতো কলেজে যাব । বার বার জিজ্ঞেস করত কোন বিষয় নিয়ে পড়লে ভালো হবে ? কত স্বপ্ন ছিল মেয়েটার !অথচ তখন আদিলা বা মিনা কারোরই কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি ওর বাবা মা । সুন্দরী মেয়েকে বাড়িতে রাখতে চায়নি । আদিলাকে উল্টো ধমকে বলেছিল , মেয়েকে আইবুড়ো বানিয়ে তোমার মতো শিক্ষিত করে কি হবে ? শশুর বাড়ি গিয়ে তো সেই চুলাই ঠেলতে হবে । হাতাখুন্তি ধরা মেয়েদের আসল কাজ । সেই কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রপ্ত করবে ততই ভালো । কিন্তু এত শীঘ্র হাতাখুন্তির কাজ শিখেই বা কি লাভ হলো মীনার !ওর বাবা মা মেয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কদর করল না । ফলস্বরূপ বছর ঘুরতেই মীনার কোল আলো করে এলো এক ফুটফুটে কন্যা । মা মেয়ে দুজনেই অপুষ্টিতে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে আছে এখন । স্বামী নামক ব্যক্তিটি রোজ মাতলামি করে বৌ পিটাচ্ছে । শশুর শাশুড়ি নীরব দর্শক হয়ে বিনে পয়সার নাটক দেখছে । অথচ সেদিন যদি মেয়ের কথা একটিবার ভাবত , যদি মনে করত চাকরিবাকরি না করুক , অন্তত মেয়েটি ভবিষ্যতের উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে থাকুক, যাতে প্রয়োজনে সে নিজেই নিজের অবলম্বন হতে পারে , নিজের একটা শক্ত ভীত তৈরি করতে পারে ।কিন্তু না , সব বাবা মা তা ভাবে না । মেয়েরা যেন তাদের মাথার বোঝা ,যেন নামিয়ে ফেললেই বেঁচে যায় ।অথচ তাড়া বুঝতে চায় না সময় বদলাচ্ছে । সময় বদলের সাথে মানুষের চাহিদাও বদলে যাচ্ছে । একসময় যা বাড়তি ছিল আজ তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়িয়েছে । প্রতিটি মেয়ের উচিত নিজের নূন্যতম চাহিদা পূরণের যোগ্যতা রাখা । আজকাল কর্মসংস্থানের একমাত্র উপায় শুধু চাকরি নয় । আরো কত কত পথ খোলা আছে !আদিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । বাড়ির ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকেই রেহনুমাকে ডেকে বলল ,
-“আম্মু ? আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে তো । তাড়াতাড়ি এসো , ”
-” হ্যাঁ, আসি । দাড়া , টিফিন বাক্সটা নিয়ে যাই । ”
****
গেস্টরুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ করলে ভেতর থেকে রাহাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল । দরজা খুললে আদিলা চমকে তাকাল ,
-আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
কোমরের বেল্ট ঠিক করতে করতেই রাহাত বলল,
– কোথায় আবার ! আমাকেও তো ফিরতে হবে । মাত্র একদিনের ছুটি পেয়েছি । তাছাড়া তুমিও থাকছ না । আমি একা এখানে কি করব ?
রাহাত দরজা ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়াল । আদিলাও পিছন পেছন ঢুকে বলল,
– কি করবেন মানে ? আপনি হলেন এ বাড়ির স্পেশাল গেস্ট । আমি না থাকলেও আপনার যত্ন আত্তির কমতি হবে না ।
রাহাত চুলে চিরুনি চালিয়ে আয়নার ভেতর দিয়েই দেখল আদিলাকে । মুচকি হেসে বলল,
– হুম । তা জানি । তবে নিজের বৌটা না থাকলে এত আদর যত্ন সব পানসে লাগবে যে ।
আদিলা বিরক্তি নিয়ে তাকায় । রাহাত হাসে । আদিলার সামনে দাড়িয়ে দু কাধেঁ হাত রেখে বলল,
-আদু , তুমিও ক্যাম্পাসে ফিরে যাচ্ছ ।এরপর কবে দেখা হবে কে জানে ? যাবার আগে একবার আদর করে দাও না ।
আবদারের সুরে কথা গুলো বলেই চোখে চোখ রেখে তাকাল রাহাত । লম্বায় আদিলা প্রায় রাহাতের কাধ সমান ।এতক্ষণ খানিকটা লজ্জা পেলেও এবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল আদিলা । শ্লেষ মেশানো গলায় বলল,
-শখ কতো !ছাড়ুন আমায় । দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
বলেই রাহাতের হাত সরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই রাহাত বলল,
– শোনো ,আব্বুকে বলে দিও আমিও বেরোচ্ছি ।
-হুম ।
প্রতিবার আরাফাত সাহেব আর না হলে সায়ন আদিলাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসে । এবার রাহাত ওকে পৌঁছে দিতে চাইলে কেউ বারণ করার কোনো কারণ খুঁজে পায় না । ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি পৌঁছেতেই আদিলা জেদ করে ওকে নামিয়ে দিতে । রাহাত রাস্তার পাশে বাইক থামিয়ে সপ্রশ্ন তাকায় ,
– কী হলো ? থামতে বললে কেন ? এখনো তো ভার্সিটি পৌঁছতে অনেকটা পথ বাকি !
-আমি এখান থেকে একাই যেতে পারব ।
রাহাত ভ্রু কুঁচকে তাকায় ,
-মানে ? তুমি একা যাবে কেন ?আমি গেলে কি সমস্যা ?
-কোনো সমস্যা নেই । আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না ? আপনি চলে যান । আমি এখান থেকে টোটো করে চলে যাব ।
– কিন্তু আমি বলছি তো আমি পৌঁছে দেব ।
– না !
-কি না?
এবার প্রায় মরিয়া হয়ে উত্তর দেয় আদিলা ,
– আপনি বুঝতে চাইছেন না কেন ? আপনার সেখানে যাওয়া চলবে না । বুঝতেই পারছেন এই বিয়েটা আমার জন্য একটা শক ছিল । আমি নিজেই এখনো অভ্যস্থ হয়নি । আমার ফ্রেন্ডরা দেখলে তো না জানি কত প্রশ্ন করবে ? এমনিতেই সেদিন সেতু আপনাকে দেখে ফেলেছে । এবার যদি দেখে আপনি আমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে এসেছেন তাহলে ওর প্রশ্নের জেরে আমি নাজেহাল হয়ে যাব । প্লিজ , বোঝার চেষ্টা করুন । আমাদের কাছে এখনো অনেক সময় আছে আমাদের সম্পর্কটাকে পাবলিকলি এনাউন্স করার ।আর কটা দিন যাক । তারপর আমি সবাইকে বলব । ঠিক আছে?
– আদু , আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ ।আজ না হয় কাল সবাই জানবেই । তাহলে আজ জানলে ক্ষতি কী ?
-প্লিজ ,আদিলা হাতজোড় করে ।
– ওকেই। ছাড়ো । লেটস গিফ মি আ হাগ ।
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় আদিলা।
-আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন ? দিস ইজ আ পাবলিক প্লেস । আমরা বাজারের পাশে দাড়িয়ে আছি !
-ওহ ,কাম অন আদু ।ছাড়ো তো । সবার এতো সময় নেই । দেখো , সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত ।
বলে অপেক্ষা করে না রাহাত । হাত ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে আদিলাকে । আদিলা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে রাহাত মুখ দিয়ে ‘ শশশ’ উচ্চারণ করে বলল,
-ডোন্ট মুভ। জাস্ট লিভ দ্যা মোমেন্ট ।
লোক লজ্জা ভুলে আদিলা জমে যায় বরফের মতো । চুপ করে থেকে অনুভব করে নিজের বেড়ে যাওয়া হৃৎস্পন্দন । কিছুক্ষণ পর আদিলাকে ছেড়ে দিয়ে টোটো ডেকে আদিলার ব্যাগপত্র তুলে দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দেয় রাহাত । আদিলা উঠে বসলে রাহাত বলল,
– যাও । আর পৌঁছে আমাকে কল করো ।
আদিলা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় । কিছুক্ষণের মধ্যেই টোটোটি রাস্তার অগনিত চলন্ত গাড়ির মাঝে হারিয়ে গেলে রাহাত বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় নিজের গন্তব্যে । বাজারের ব্যাগ হাতে একজোড়া বিস্ফোরিত চোখ পর্যায়ক্রমে একবার আদিলার যাওয়ার পথে তাকায় তো আর একবার রাহাতের দিকে তাকায় । কুঞ্চিত ভ্রু যুগল ঠিক করে ভাবতে বসে সে কি ঠিক দেখল ?
*****
-ওই? ওই ,আদি? দাড়া ।”
পেছন ফিরে রিপনকে দৌড়ে আসতে দেখে আদিলা হাসল ।
– দৌড়াচ্ছিস কেন ?
– শোন, তোর সাথে কথা আছে ।
হাপাতে হাপাতে হাটুতে হাত রেখে ঝুকে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলল রিপন । তারপর সোজা হয়ে দাড়াল ।
– কি কথা ? আর কই গেছিস তুই ? এগুলো কী ?
– এগুলো কাচা সবজী । কাল আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছিল তাই আর বাজার করা সম্ভব হয় নি । পরোটা খেয়ে রাত কাটাতে হয়েছে । তাই আজ সকাল সকাল বাজার করে নিয়ে আসলাম ।
– পৌনে বারো’টা বাজে । এখনো সকাল আছে তোর !
-আরে পনেরো মিনিট তো এখনো বাকি আছে, না ?
আদিলা হালকা হাসল । রিপন বলল,
-ওহ হ্যাঁ ? যেটা বলছিলাম , কে ওটা ? কার সাথে এলি ?
– আমি এখানে একাই নেমেছি , দেখিস নি ?
– আরে , আমি এখানকার কথা বলছি না কি ?ওই তো বাজারের পেরিয়ে মোড়টায় যার সাথে কথা বলছিলি ….!
চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো মুখ শুকিয়ে যায় আদিলার । বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রিপনের দিকে ।
– কি রে বললি না তো !কে ছিল ওটা ?
– কোথায় কে ? আমি তো এই মাত্র টোটো থেকে নামলাম ।
– উমম । একদম মিথ্যা বলবি না । আমি স্পষ্ট দেখেছি । তুই ওই লোকটার বাইক থেকে নামলি । আমি তখন বাজার থেকে বেরোচ্ছিলাম । কিছুক্ষণ কথা বলার পর লোকটা তোকে হাগ করল । তারপর তোকে টোটোয় উঠিয়ে দিয়ে চলে গেল ।
-কি যে ভুলভাল দেখিস না তুই! কে না কে ছিল !আর তুই আমার নামে অপবাদ দিচ্ছিস । ওই, তোর চশমা কোথায় , হ্যাঁ ?চশমা ছাড়া একটা অক্ষর ও পড়তে পারিস না ।আর ও নাকি আমাকে দেখেছে !
বলেই আদিলা রিপনের কাধে একটা চাপড় মেরে দিল ।
– উম হু , মিথ্যা বলে কাজ নেই । আমি সত্যি সত্যি তোকে দেখেছি ।
– হ্যাঁ , অনেক কিছু দেখেছিস তুই ।চাশমিশ একট ! এবার ব্যাগ ওঠা । হোস্টেলে দিয়ে আয় আমাকে । আমি একা এই ব্যাগ বইতে পারছি না ।
রিপন কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ তোলে ,
– ওরে বাবা ! কি এনেছিস ? এত ভারী কেন ব্যাগ ?
– আম্মু দুই বয়ম ভরে শুকনো খাবার দিয়ে দিয়েছে । মানা করলাম, শুনলো না ।
– তোর কথা শোনেনি ,ভালো করেছে । এতটাও ভারি না ব্যাগটা । তুই না খাবি তো সব আমি নিয়ে যাব । আন্টিকে আমার তরফ থেকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে দিস ।
– পেটুক কোথাকার ! ,,,আচ্ছা, সেতু কোথায় ? ক্লাসে গেছে ?
-হুম ।
– তুই যাসনি কেন ?
-আমি ঘুম থেকেই উঠলাম দশটায়। আর তাছাড়া আমি বিশাল টায়ার্ড হয়ে আছি । তাই ক্লাস করার ইচ্ছা নেই । এমনিতেও আজ ক্লাস হবে না ঠিক মতো । তাই আমি আজ সারাদিন ঘুমাব ।
– আর রান্না কে করবে ?
-রান্নার কি দরকার । এখান থেকে একটা বয়ম তো আমার ।
– য়িই, তোকে দিলে তো ।
– তোকে দিতে হবে না ? আমি নিজেই নেব । আর শোন আদিলা, তোর এসব খেয়ে কাজ নেই ,বুঝলি । বেশি খেলে তুই মোটা হয়ে যাবি । তাই তোর খেতে হবে না । তোকে এমনিই ভালো লাগে ।
আদিলা চোখ সরু করে তাকায় ।
– একদম বাজে বকবি না । নাহলে সেতুকে বলে দেব দেখিস । তারপর বুঝিস মজা । এখন কথা কম , তাড়াতাড়ি পা চালা ….
আদিলা জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে যায় সামনে । রিপন হাসতে হাসতে ওকে অনুসরণ করে ।
(চলবে)