জীবনসঙ্গী_১৭
Chhamina_Begam
ক্যাম্পাসের দিনগুলো কেমন ঝড়ের বেগে কেটে গেল ।
সারাদিন ক্লাস , সপ্তাহে একদিন গ্ৰুপ ডিসকাশন , অ্যাসাইনমেন্ট , পিপিটি তৈরি করা এসবের মাঝেই এক মাস কেটে গেল । তবে রাহাতের সঙ্গে সম্পর্কটা এখনো কেমন যেন খাপছাড়া । আদিলা কথা বললেও সহজ হতে পারে না । কী যেন একটা অদৃশ্য কাঁটা খুচিয়ে যায় সারাক্ষণ ।আবার দূরে যাওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও মনে আসলে হৃদয়ের অন্তপুরে অঝোরধারায় রক্তক্ষরণ হয় । সবথেকে যেটা অদ্ভুত লাগে আদিলার তা হলো রাহাতকে একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ ভেবে কখনো পুলকিত হয় , পছন্দের পুরুষটির সাথে আগামী দিনের সপ্নীল কল্পনায় জনমভর ডুবে থাকতে ইচ্ছা করে । আবার সেই মানুষটিই যখন সামনে এসে নিজের দাবি জানায় তখন তাকে সাদরে গ্ৰহন করতে পারে না । না চাইতেও সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার জাল ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে , কখনো কখনো হীনমন্যতায় ভোগে সে ।
অনবরত ফোনের রিংটোনের শব্দে বিরক্ত হয়ে উঠে বসে সেতু ।
– আদি, হয় কলটা রিসিভ কর আর না হয় কেটে দে না । কখন থেকে বেজে যাচ্ছে !আদি? আদি ?
সেতু হাত ঝাকি দিয়ে বুঝতে পারে ঘুমিয়ে পড়েছে আদিলা । অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ারই কথা । আজ সারাদিন যা ব্যস্ততা গেল ! কাল ভার্সিটিতে বসন্ত উৎসব । সেই উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে ক্যাম্পাসে । ডেকোরেশন থেকে বিভিন্ন প্রোগ্ৰামের প্ল্যানিং ভার্সির ছাত্রছাত্রীদের অবজারভেশনেই হচ্ছে । সেই প্ল্যানিং টিমের একজন সদস্য আদিলা । সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতেই সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে । প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকায় রুমে ফিরেই শুয়ে পড়েছিল । সেতু জোর করে তুলে মুখ ধুইয়ে ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিয়েছে , নিজেও লাগিয়েছে যাতে কালকের অনুষ্ঠানে ওদের সতেজ দেখায় ।সেতু আদিলার চোখের ওপর দিয়ে রাখা শশার টুকরোটা মুখে পুরে আর একবার ডাকে আদিলাকে ।
– কি হলোওও ?
– তোর ফোন বাজছে সেই কখন থেকে ?
– কার ফোন ?
সেতু ফোনটা হাতে তুলে দেখে বলে ,
– এইচ ডট ডট দিয়ে শেইভ করা । এইচ ফর কে ?
আধো ঘুম আধো জাগরণে আনমনেই বলে ফেলে আদিলা ,”হাবি …”
– কি ?
সেতু এত জোরে চিৎকার করে ফেলল যে চমকে উঠে আদিলা ধরপর করে উঠে বসল । সেতু বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে ।
– কি বললি তুই ?
আদিলা বুঝতে পারল না কি জানতে চাইছে সেতু ।
-কি বললাম ?
– এইচ ফর কি বললি ?
আদিলা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আমার ফেসে টান পড়ছে । ধুয়ে আসি আগে ….
-যাহ ,
আদিলা ওয়াশরুমে যেতেই আবার বেজে ওঠে ফোন । কোনো জরুরী কল ভেবে সেতু রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে শুনতে পায় একটি উদ্বিগ্ন পুরুষালি ভরাট কন্ঠস্বর,
– আদু , কি হয়েছে তোমার ? কল রিসিভ করছ না কেন ? আম্মুর কল ও নাকি রিসিভ করোনি ? কি হয়েছে ? শরীর খারাপ নাকি ? কি হলো ? কিছু বলছ না কেন ? আদু? আদু ? লাইনে আছ ?
– ওহ ,হ্যাঁ । আদি ভালো আছে । আসলে ও খুব ক্লান্ত ছিল আজ তাই হোস্টেলে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল । তাই আপনার কল রিসিভ করতে পারেনি ।
– হ্যালো , আপনি কে ?
-আমি ? আমি আদিলার ফ্রেন্ড । কিন্তু আপনি কে ?
-আমি ……
– এই তো আদিলা এসে গেছে । নিন কথা বলুন । ধর .. আবার কল করেছে …..
সেতু ফোনটা এগিয়ে দেয় আদিলার দিকে । সেতুর কথা খেয়াল করতেই তোয়ালে ফেলে প্রায় ছো মেরে কেড়ে নেয় ফোনটা । ফ্যাকাশে মুখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় । সেতু অবাক হয়ে যায় ওর কর্মকান্ডে । এভাবে ছিনিয়ে নেওয়ার কি হলো ? ও তো দিচ্ছিলোই ফোনটা । সন্দিহান হয়ে সেতু ভাবে কে এই ব্যক্তি যার কারণে আদিলা এমন উদ্ভট আচরণ করছে ? ততক্ষণে আদিলা ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেছে ।
– হ্যাঁ বলুন ,
আদিলার কন্ঠস্বর শুনে যেন জানে পানি আসে রাহাতের । কঠিন স্বরে বলল,
– কোথায় ছিলে তুমি ? সেই কখন থেকে ফোন করছি ! আম্মুর কল ও নাকি রিসিভ করনি । আমি তো টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম তোমার চিন্তায় চিন্তায়। তোমার কোনো ফ্রেন্ডদের ও নম্বর নেই আমার কাছে যে আমি তোদের ফোন করে তোমার খবর নেব । আজ ওদের কারো নম্বর দেবে আমায় যাতে তোমায় ফোনে না পেলে ওদের থেকে জেনে নিতে পারি ।
এই প্রথম রাহাত রুঢ় স্বরে কথা বলল আদিলার সাথে । অথচ ওর একটু ও খারাপ লাগল না । বরং ওই রুঢ় শব্দগুলির মাঝে লুকায়িত চিন্তা টুকু দেখে বড়ো ভালো লাগল আদিলার । পরিবারের সবার স্নেহ, ভালোবাসায় বড়ো হওয়ার পরেও কোনো বিশেষ একজনের কাছ থেকে এই যত্নটুকু পেতে কোনো মেয়েই না আশা করে । আদিলার সারাদিনের যাবতীয় ক্লান্তি চোখের পলকেই যেন হাওয়া হয়ে গেল । নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হতে লাগল ওর । চাঁদের আলোয় চোখের কোলে জমে থাকা জলকনা চিকচিক করে উঠল । অত্যন্ত নরম সুরে বলল সে,
– চিন্তা করবেন না । আমি ভালো আছি । আসলে কাল প্রোগ্রাম তো । ওই যে , আপনাকে বলেছিলাম, না ? বসন্ত উৎসব । আজ তারই ফাইনাল টাচ দিতে হলো ।তখন ব্যস্ততার কারণে ফোন চেক করা হয়নি । আর রুমে ফিরে এত ক্লান্ত ছিলাম যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । তাই ….আপনি কি রেগে আছেন ?
একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে রাহাত বলল ,
– এ রকম আর কখনোই করবে না । ঠিক আছে ? সেই বিকেল থেকে তোমাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না । আম্মু খুব টেনশন করছিল । ওনার প্রেসার বেড়ে গেছে । ফোন চেক করে দেখো তোমাদের বাড়ি থেকেও কল করেছে বোধহয় ? আমাকে ফোন করলে আমি মিথ্যে বলেছি যে তোমার সাথে কথা হয়েছে আমার । তারপর সবাই শান্ত হয়েছে । আদু ,একটা কথা সবসময় মনে রাখবে । যেখানেই যাও অন্তত একটা টেক্সট করে দেবে আমায় । যাতে আর সবাই চিন্তা মুক্ত থাকতে পারে ।
ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখল আদিলা । আট’টা বেজে চব্বিশ মিনিট । শাশুড়ির সাতটা মিসড কল । তিতলিও করেছে অনেক বার। আবার বাড়ি থেকেও আম্মুর ষোলো টা মিসডকল । এত এত মিসড কলের লিস্ট দেখে সত্যিই ঘাবড়ে গেল আদিলা । ভাবতেই পারেনি এমন কিছু হতে পারে । অন্তত একবার ফোন চেক করা উচিত ছিল ওর । মনে করার চেষ্টা করল ফোনের সাইলেন্ট মোড অফ করে নরমাল করেছিল কি না ? তাহলে ভাইব্রেশন মোড কখন অন হলো ? নিজের অসাবধানতার কারণে এত গুলো লোককে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার কারণে অনুতপ্ত হলো আদিলা । মিনমিন করে বলল ,
– আমি আসলে বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে । আ’ম স্যরি ।
-ইট’স ওকেই । আর কখনো এমন করবে না ।
-হুম ।
– তুমি তো কাল কোনো প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছ না । তাই না ?
– হুম । আমি ওসবে নেই । তবে সেতু আর মৌ দিচ্ছে । ওরা দুজনে নাচের প্র্যাকটিস করছে ।
– ওহ ,তুমি ফ্রি হবে কখন ?
– কেন ?
– কাল বিকেলে আমিও ফ্রি থাকব । কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসতে পারতাম দুজনে মিলে ।
রক্তিম আভায় লাজরাঙা হয়ে উঠল আদিলা । এরকম আবদার আজ প্রথমবার করল রাহাত । মানা করতে ইচ্ছে করল না ওর । বসন্ত উৎসবে এমনিতেও আগ্ৰহ নেই আদিলার । সবাই পরিচিত বন্ধু-বান্ধবী হলেও রং নিয়ে তাদের পিছনে ছুটোছুটি করতে ইচ্ছে করে না আদিলার । যার কারণে গত বছর ও সাবধানে এড়িয়ে গেছিল সে। তবে প্ল্যানিং টিমে যেহেতু নাম আছে তাই তাকে নামমাত্র উপস্থিত থাকতেই হবে । তারপর না হয় বেরিয়ে যাওয়া যাবে !আদিলা সম্মতি দিয়ে লাজুক সুরে বলল ,
– ঠিক আছে । আপনি এলে আমাকে কল করবেন । আমি বেরিয়ে আসবো ।
– হুম । এখন ভেতরে যাও ।
– আচ্ছা , বলে দু পা এগোতেই আদিলার কপালে ভাঁজ পড়ল ।
– আপনি কিভাবে জানেন আমি বাইরে দাড়িয়ে আছি ?
– কারণ আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি । বাঁ দিকে তাকাও , গলিতে ।
সেদিকে তাকাতেই আদিলা চমকে উঠল । হোস্টেলের বাউন্ডারির বিপরীতে মেহগনি গাছটার নিচে দাড়িয়ে আছে রাহাত । আদিলার রুমটা দ্বিতীয় তলায় হওয়ায় ল্যাম্প পোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে । পাশেই দাড় করিয়ে রাখা রয়্যাল এনফিল্ডটা । বাঁ হাতে ফোন ধরা , আদিলা তাকাতেই ডান হাত নাড়ল । আদিলার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল ।
– আপনি এখানে ?
– কি করব বলো ? বৌ লাপাত্তা হয়ে গেছে । খুঁজে আনার দায়িত্বটাও তো আমার , তাই না ?
আদিলা চোখ ফিরিয়ে ইতিউতি চাইল তারপর মুখ নামিয়ে নিল । একবার দাঁত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরল । সামান্য ব্যাথা লাগতেই আবার চাইল রাহাতের পানে ।
– আপনার এবার ফেরা উচিত । এটা আবাসিক এলাকা , লোকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলে খারাপ ভাবতে পারে ।
– হুম , যাচ্ছি। তুমি ভেতরে যাও আগে ।
– হুম,
বলেই চপল গতিতে ঘরে প্রবেশ করে দরজায় হাত রেখে উকি দিল বাইরে । রাহাত বাইকে চড়ে বসেছে । ও চলে যেতেই ঘুরে দাড়িয়ে কাষ্ট হাসল আদিলা । সেতু ওর দিয়ে তাকিয়ে আসন করে বসে আছে বিছানায় । সেতু প্রশ্ন করল,
– ছেলেটা কে ?
– কোন ছেলেটা ?
-যার সাথে এতক্ষণ অব্দি প্রেমালাপ ও শুভদৃষ্টি হলো ।
হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আদিলা বলল ,
– বাজে বকিস না তো । কেউ ছিল না । বাড়ি থেকে আম্মু ফোন করেছে ।
বলেই আদিলা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ফোন ঘাটতে লাগল ।
-আচ্ছা ? তা আম্মু কবে থেকে এইচ হয়ে গেল ? আমি তো কালকেই দেখলাম আন্টির নম্বর আম্মু লিখে সেভ করা ছিল !আদিলা সত্যি করে বল তো , ছেলেটা কে ? একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না । বল , কার সাথে প্রেম করছিস তুই ? ছেলেটাকে কি আমি চিনি ? আমাদের ইউনিভার্সিটি তে পড়ে ? কোন ডিপার্টমেন্ট ? বল নাআআ …… ওইইই ”
সেতু হাত ঝাকাঝাকি শেষে কাতুকুতু দিতে শুরু করলে আদিলার হাসির দমকে হেচকি উঠে গেল ।
– প্লিজ , সেতু । থাম, থাম । বলছি , বলেই বড়ো বড়ো শ্বাস টানলে সেতু আবার তাড়া দিল ,
– বল , নাহলে কিন্তু আবার কাতুকুতু দেব । বল , তাড়াতাড়ি ,,
– প্লিজ, আর না । বলছি , বলছি , দাড়া …
সেতু অধীর আগ্ৰহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ।
– সে আমার প্রেমিক নয় । আমার হাসবেন্ড । তবে……. আগের শব্দটাও বলা যায় ।
বলেই মাথা অব্দি কম্বলমুড়ি দিয়ে নিজেকে আড়াল করে আদিলা ।
– হোয়াট ?
সেতু প্রচণ্ড বিস্ময়ে থম মেরে থাকে কতক্ষণ ।চোখ দুটো রসগোল্লার মতো গোল হয়ে যায় ।সম্বিৎ ফিরতেই কম্বল নিয়ে টানাটানি শুরু করে । আদিলা শক্ত করে ধরে রাখে কম্বলের কোণা । সেতুর বিস্ময়ের ঘোড় কাটে না সহজে ।
– সিরিয়াসলি ? আদিলা , তুই বিয়ে করলি কবে ? ও মা…ই গড !তুই বিয়ে করে ফেলেছিস !আর আমাদের জানাসনি ? শালা, স্বার্থপর একটা । একা একা খেয়ে ফেলছিস । হারামি । দাড়া ,সবাইকে বলতে দে ।
বলেই ফোন হাতে তুলতেই আদিলা কম্বল সরিয়ে মোবাইল কেড়ে নেয় । সেতু ভ্রু নাচিয়ে স্বপ্রশ্ন তাকায় ।
– কি হলো ? মোবাইল দে ,
-আমার বিয়ের কথাটা এখনি কাউকে বলিস না ।
– তা বললে তো হবে না । আমি সব্বাইকে বলবো । কোনো ছাড় নেই । পার্টি থ্রো করতেই হবে । নো বাহানা ।
– হ্যাঁ, সে না হয় পরে দেখা যাবে । কিন্তু এখনি না, প্লিজ । আমি নিজেই এখনো সহজ হতে পারছি না । সবাই জেনে গেলে রাহাতকে দেখতে চাইবে । আমি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাবো । প্লিজ । বোঝার চেষ্টা কর । সব কিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে আমার কাছেই এখনো কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে । মনে হয় এখনি ঘুম ভেঙে দেখব সব কিছুই আমার অবচেতন মনের ভ্রম ছিল ।
আদিলার পাংশুটে হয়ে যাওয়া মুখখানা দেখে মায়াই হয় সেতুর । কিছু একটা ভেবে আগ্ৰহি শ্রোতার মতো আসন করে বসে বললো ,
– ঠিক আছে । বলবো না । এখন আমাকে শুরু থেকে বল । কিভাবে , কখন , কবে হলো ? সবটা বলবি ।
আদিলা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে আবার । ওর দেখাদেখি সেতুও ওর পাশেই শুয়ে পড়ে । আদিলা একে একে বলতে শুরু করে প্রথম দেখা , ট্রেন জার্ণি থেকে মাহির বিয়ে , সব কিছু ।
(চলবে….)