জীবনসঙ্গী_৪
Chhamina_Begam
আদিলা ভোরে নামাজ পড়তে উঠে দেখে মাহি তখনো ঘুমাচ্ছে। কাল রাতে আড্ডা দেওয়ার পর ঘুমাতে এসে মাহি আর আরমান অনেকক্ষণ কথা বলে তারপর ঘুমাতে যায় । ডাকতে ইচ্ছে না হলেও তবুও ডাকে মাহিকে । ওরা দুজনেই একসঙ্গে নামাজ পড়ে নেয় । আদিলা বলে,
– ” চল আপু আর না ঘুমিয়ে ছাদে যাই ”
-“হ্যাঁ চল”
মাহিদের ছাদটার একপাশে টবে করে ফুল গাছ লাগানো হয়েছে । তাতে অনেক ধরনের ফুল ফুটে আছে । চারিদিকটা হালকা কুয়াশায় ভরে গেছে । হিমেল বাতাস বইছে । ওরা দুজনেই গায়ের শালটা একটু ভালো করে টেনে নেয় । দুজনেই পাশে থাকা দোলনায় বসে পড়ে ।আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটছে চারিদিকে । কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে । ফুল গাছ গুলির পাতায় ,ফুলে পরা শিশির বিন্দুর ওপর আলো পড়ে চকচক করছে । দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা দেয় । আস্তে আস্তে সূর্যের তাপ বাড়তে থাকায় দুজনেই নিচে নেমে আসে । নাস্তা করে মাহি আর আদিলা দুজনেই রুমে চলে যায় ।
মাহিদের বাড়িটা আজ খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । দেখে মনে হচ্ছে যেন ফুলের দোকান বসেছে ।বেলা বাড়ার সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করেছে । লোক জন যত বাড়ছে নানা জনের নানা কথা কানে আসতে শুরু করেছে । আরমানের বাড়ি শিলিগুড়িতে হওয়ায় আর মাহি নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী হওয়ায় সবাই মনে করছে হয়তো কোনো গুরুতর ব্যাপার হয়েছে । না হলে বিয়ে এত তাড়াহুড়ো করে দিচ্ছে কেন ? কিন্তু মাহি আর আরমানের বিয়েটা পারিবারিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই হচ্ছে । বাড়ির সবাই এইসব কথা উপেক্ষা করে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত । কারণ বিয়ে বাড়িতে নানাজনে নানা কথা বলে ।এসব কথার জবাব দিলে রীতিমতো ঝগড়া শুরু হয়ে যায় । তাই বাড়ির সবাই কথা গুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মাহি , আদিলা আর মেঘনা একসঙ্গে বসে গল্প করছে । গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আদিলা মাহিকে লক্ষ্য করে দেখে মাহি বারবার মুখ কুচঁকে পেটে হাত দিচ্ছে । পেটে হাত দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ।
– ” আপু তুই ঠিক আছিস ” আদিলা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে । মাহি পেটে হাত দিয়েই বলে,
– “আদি, আমার পেট খুব ব্যথা করছে রে ,”
– ” ব্যাথা করছে? কেন ? দাড়া , আমি ওষুধ নিয়ে আসি খালাম্মুর কাছ থেকে ”
-“মনে হচ্ছে অ্যাসিডিটি হয়েছে “মেঘনা অনুমান করে ।
-“আরে না না অ্যাসিডিটি নয় । আমার পিরিয়ডের সময় হয়ে গেছে । কিন্তু এবার তাড়াতাড়ি হয়ে গেল কেন ? বুঝতে পারছি না,” বলে মাহি বাথরুমে চলে যায় । একটু পর মাহি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আবার বিছানায় বসতে বসতে বলে
– ” আমার কাছে তো এক্সট্রা প্যাড ও নেই । এবার কি হবে ? ”
– ” আমার কাছেও তো নেই ” মেঘনা বলল ।
মেঘনার কথায় আদিলাও মাথা নাড়িয়ে বলল,
– ” আমিও আনিনি । কি করবি এখন ? আমি কাউকে পাঠাব ? না না থাক । তোকে টেনশন করতে হবে না । আমি বাজারে গিয়ে নিয়ে আসবো ।আমারও কিছু কসমেটিক লাগবে । তোর অন্য কিছু লাগবে নাকি বল আমি নিয়ে আসবো তাহলে ।”
– কসমেটিকস তো সব নিয়ে এসেছি । শুধু প্যাড নিয়ে আসলেই হবে ”
– “মেঘনা , তুই কি আমার সঙ্গে যেতে পারবি ? ” আদিলার প্রশ্নে ইতস্ততঃ করে মেঘনা । বলে,
– “আমি ? আসলে আমি খুব টায়ার্ড হয়ে আছি । তুই যা ।”
-“ওকে। ” আদিলা যেন একটু হতাশ হল ।
মেঘনা মনে মনে সরি বলে আদিলাকে । আজ যেভাবেই হোক রাহাতের সাথে ওর কথা বলতেই হবে । এরা সারাক্ষণ পাশে থাকলে সে একটু সুযোগ পাচ্ছে না ।
– “আচ্ছা , আমি তাহলে ফাহিম ভাইয়াকে গিয়ে বলি । যদি যায় আমার সাথে ” আদিলা বেরিয়ে যায় ।
নিচে নেমে এসে আদিলা ফাহিমকে খুঁজতে বের হয় ।কোথাও খুঁজে না পেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ওর খালাকে জিজ্ঞেস করে ,
– “খালাম্মা ফাহিম ভাইয়া কোথায় ? ”
– ” ফাহিম ? ও বাইরে কোথাও আছে হয়তো ? দেখ খুজে ”
– “খুজলাম তো । পাইনি ”
– ” আমি একটু আগেই ওকে বাইরে যেতে দেখলাম । ডেকোরেশনের ছেলে গুলোর সাথে কথা বলছে দেখলাম । কিন্তু তুই ওকে খুজছিস কেন ? ” রেহনুমার প্রশ্নে আদিলা ইতস্তত করে বলে,
– “আম্মু , আপুর না কিছু জিনিস লাগবে আর আমারও কিছু কসমেটিকস কেনার বাকি আছে । তাই ভাবছিলাম ভাইয়াকে নিয়ে কেনাকাটা করে আসি ”
-“ওহ । ফাহিম বাইরে আছে হয়তো । দেখ গিয়ে ,,”
-” হুম ”
আদিলা বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ফাহিম ডেকোরেশনের কাজ দেখছে। পাশে গিয়ে বলে,
-” ভাইয়া আমার একটু বাজারে যেতে হবে । চলো না আমার সঙ্গে ”
– “এখন ? আচ্ছা রেডি হয়ে নে তাড়াতাড়ি । আমি বাইক টা বের করি ”
-” ঠিক আছে । আমি আসছি তাহলে ” বলেই আদিলা তাড়াতাড়ি রুমে এসে গোসল করে নেয় । তৈরি হয়ে নিচে এসে ওর আম্মুকে বলে
– “আমি যাই আম্মু ”
-” হুম, সাবধানে যাস , ”
এদিকে ডেকোরেশনের কাজ এখানে অনেক বাকি । সঠিক গাইডেন্স না পেয়ে ছেলেপেলেরা ইচ্ছে মতো যার যা খুশি তাই করে যাচ্ছে । যেটা পছন্দ হচ্ছে না ফাহিমের । তাই সে ঠিক করল অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেবে আদিলার সাথে । বিশ্বাস যোগ্য কাউকে না পেয়ে সে রাহাতকে পাঠাবে ঠিক করে । তাই সে রাহাতকে ডেকে বলে,
-” রাহাত তুই একটু আদিকে নিয়ে বাজারে যেতে পারবি ? ”
– ” হ্যাঁ আমি তো ফাকাই তো আছি ”
– “ঠিক আছে তাহলে । আমি বাইকটা বাইরে বের করে রেখেছি । তুই আর আদি গিয়ে তাড়াতাড়ি বাজারটা করে আয়। ওর কিছু কেনাকাটার বাকি আছে ”
আদিলা রেডি হয়ে নিচে আসলে ফাহিম বলে,
– “আদি , আমাকে ডেকোরেশনের দিকটা দেখতে হচ্ছে । তাই আমি যেতে পারছি না । তুই রাহাতের সঙ্গে চলে যা । ও বাইরে বাইকে অপেক্ষা করছে । ”
ফাহিমের কথায় আদিলা একটু যেন চমকে যায় । ওই লোকের সঙ্গে এক বাইকে ! অসম্ভব । অস্বস্তি না বিরক্তি কে জানে তবে ভ্রু কুচকে যায় আদিলার । ওর কুচকানো ভ্রু দেখে ফাহিম হেসে ফেলে ,
-” আদি, আমার বন্ধু কিন্তু এতটাও খারাপ না । সত্যি বলতে গেলে ডায়মন্ড সে । তবে সেও তো মানুষ । একটা ভুল না হয় করেই ফেলেছে । আর সরিও বলেছে তোকে । এখন প্লিজ আর না করিস না । আমি ব্যস্ত না থাকলে আমিই নিয়ে যেতাম তোকে । কিন্তু আমাকে এদিকের কাজ গুলো দেখতে হচ্ছে । তুই একটু ম্যানেজ করে নে প্লিজ। আর দেখ এই মুহুর্তে ওকে ছাড়া ভরসাযোগ্য আর কাউকে আমি দেখতে পাচ্ছি না । আর তোকে একাও ছাড়তে পারব না আমি । তাই আর না করিস না লক্ষ্মীটি । ”
নিজের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও আর মানা করে না ফাহিমকে । গোমড়া মুখে বলে,
-” ঠিক আছে । ”
রাহাত বাইকে চড়ে বসে আছে । ঠিক তখনই ও দরজায় আদিলাকে দেখতে পায় । আদিলা আজ একটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে । সদ্যস্নাত ভেজা চুলগুলো খুলে রেখেছে ,চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর ছোট ঝুমকোতে ওকে মোহময়ী দেখাচ্ছে। রাহাত মুগ্ধ হয়ে দেখছে আদিলার এই নতুন রূপ। নিজেকে লোহা মনে হচ্ছে ওর । যে কিনা চুম্বকের আকর্ষণে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে চলেছে ।
আদিলা রাহাতের চোখের মুগ্ধতা দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যায় ।ইচ্ছে করে এই মুহূর্তে নিজেকে কোথাও লুকিয়ে ফেলতে । কিন্তু তা আর সম্ভব নয় । এখন এই লোকের সাথেই কমপক্ষে দু-দুটো ঘন্টা পার করতে হবে । তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় আদিলা । রাহাতের সামনে এসে বলে ,
-“চলুন ,”
রাহাত সম্ভিত ফিরে পায় । আচ্ছা , আদিলা কিছু মনে করল কি ? ধুর , কি সব ভাবছে সে । নিজেকেই যেন বোঝায় রাহাত ।
-“কিছু বললে? ”
– ” হ্যাঁ । বলছি চলুন । দেরি হয়ে যাচ্ছে ”
– ” তুমি কি কোথাও যাবে ? আচ্ছা যাও । আমি আদির জন্য অপেক্ষা করছি ”
রাহাতের কথা শুনে আদিলা মুচকি হেসে বলল , -” আমি আদি -আদিলা- আদি । হয়েছে। চলুন এবার । দেরি হচ্ছে ।”
ওর কথা শুনে রাহাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
– “তুমি আদি? .. আমি তো ভাবলাম কোন ছেলে হবে ” ।
রাহাতের কথা শুনে আদিলা হেসে ফেলে । রাহাত মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখে । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে
– ” চলো ”
– “হ্যাঁ চলুন ”
ওরা দুজনে বাইকে করে বেরিয়ে যায় বাজারের উদ্দেশ্যে ।
বেলকনি থেকে ওদের দুজনকে যেতে দেখে মেঘনা একটু হতাশ হয়ে যায় । ও ভেবেছিলো আদিলা ফাহিমের সঙ্গে বাজারে গেলে মাহি আপু আরমানের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে যাবে । আর সেই সুযোগে ও রাহাতের সঙ্গে ভাব জমাবে। কিন্তু তা আর হল না । মেঘনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে চলে যায় ।
To be continue…….