জীবনসঙ্গী_৭
Chhamina_Begam
স্যাঙ্কচুয়ারিতে পৌছনো অবধি আদিলা আগের মতো স্বতস্ফূর্ত হয়ে কথা বলতে পারেনি । রাহাত আশেপাশে থাকলেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয় । একি সঙ্গে ভালোলাগায় অবশ হয়ে আসতে চায় হাত-পা । আবার সংকোচে কোথাও লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে যেখান থেকে রাহাতের সামনে পড়তে হবে না ।
ফাহিম একেবারে কুলীক ব্রীজে গিয়ে গাড়ি থামায় । রায়গঞ্জ ফরেস্টের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে কুলীক নদী তার নিজস্ব ছন্দে । ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ে স্যাঙ্কচুয়ারির । পাকা রাস্তা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে । কিছুক্ষণ ব্রীজের ওপর দাড়ানোর পর ওরা আবার গাড়ি নিয়ে পাখিরালয়ে ঢুকে পড়ে । গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে ওরা হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সবকিছু । চারপাশে তখন অনেক প্রজাতির পাখির কলতান শোনা যাচ্ছে । বড় বড় গাছগুলিতে সারস পাখিরা বাসা বেঁধেছে ।ওরা অক্সবো লেক সহ অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখে ।প্রায় দেড় ঘণ্টা ঘুরাঘুরির পর ওরা আবার গাড়িতে করে রায়গঞ্জ ইকোপার্ক এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।
রায়গঞ্জ ইকোপার্ক দেখতে ভারী সুন্দর । জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতীরা যেখানে সেখানে বসে প্রেমালাপ করছে । ওরা সবাই ঘুরতে ঘুরতে আলাদা হয়ে পড়ে । ফাহিম মিতুকে পুরো পার্ক ঘুরে ঘুরে দেখাতে থাকে । আদিলা, মেঘনা, রাহাত এক সাথে হাটছে ।সায়ন আর জিসান পিছিয়ে পড়েছে । ওরা দুজনেই সেলফি নিতে ব্যস্ত । হাটতে হাটতে আদিলার পা ব্যাথা করছে । তাই ও পাশেই একটা বেঞ্চে বসে পড়ে । মেঘনাদের বলে ঘুরে দেখতে । আদিলাকে বসতে দেখে মেঘনা মনে মনে খুশি হয়ে যায় । মেঘনা রাহাতকে বলে,
-“ও না হয় বসুক । চলো , আমরা ওপাশটা ঘুরে আসি । ”
-” কিন্তু তোমাকে একলা রেখে ,,” রাহাত মেঘনাকে উপেক্ষা করে আদিলাকে গুরুত্ব দেয় । মেঘনা হাতের মুঠো শক্ত করে ।
-” আপনি চিন্তা করবেন না। এই জায়গাটা আমি অনেক বার এসেছি । সব পরিচিত আমার । আপনারা বরং ঘুরে আসুন । ”
আদিলার কথায় রাহাত ইতস্তত করলেও মেঘনাকে মানা করে না । মুখটা একটু ভার হয় ঠিকই তবে আদিলাকে দেখে মুচকি হাসে । আদিলাও স্মিত হাসি ফেরত দেয় । রাহাতরা চলে গেলে আদিলা একটু যেন উদাস হয় । হয়তো অবচেতন মন আশা করছিল রাহাতের উপস্থিতি । একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওদের যাওয়ার পথে ।
মেঘনা আর রাহাত পাশাপাশি হাটছে । কেউ কোনো কথা বলছে না । মেঘনার অনেক কথা বলছে ইচ্ছে করছে । কিন্তু কোনো কথায় মুখে আসছে না । কেন যেন এই লোকটা সামনে এলেই কথা হারিয়ে যায় ওর ।
পার্কের এদিকটা বেশ নির্জন । রাহাতের অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ মেঘনার পাশে পাশে হাটতে। টুকটাক কথা বলেই আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে । একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আদিলাকে দেখে চিন্তিত হল রাহাত । পা কি খুব ব্যাথা করছে ? নাহলে এমন ঝুকে পড়ে পায়ের পেশিতে চাপ দেবে কেন ? ওর মনে হলো এবার ফেরা উচিত । এরকম একটা নিরিবিলি জায়গায় এই টিনেজ মেয়ের সাথে চলা ঠিক নয় । তার ওপর মেয়েটা ওকে বারবার আড়চোখে দেখছে । এর মানেটা বুঝতে দেরি হলো না ওর । মেঘনাকে বলল ফেরার কথা ।
আদিলা জল পান করছিল । রাহাত আর মেঘনাকে একসঙ্গে দেখে বুকের ভেতরে চিনচিন করে উঠল হঠাৎ । তাহলে কি ও মেঘনাকে হিংসে করছে ? কথাটা মাথায় আসতেই চট করে নিজেকে সামলে নিল আদিলা । বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল,
-“এতো তাড়াতাড়ি ঘোরা হয়ে গেল ?”
আদিলার কথায় অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মেঘনা । সব এই মেয়ের জন্য হয়েছে । করে দেখে মজেছে রাহাত এই মেয়েতে ?
রাহাত জবাব দিল না । শুধু হাসল একটু । তারপর বলল,
-“এখানে একটা ফাস্টফুডের দোকান দেখলাম । তোমরা বসো আমি । আমি এক্ষুনি আসছি । ”
রাহাত যেতেই মেঘনা আদিলার দিকে মুখ ফেরায় । তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে আদিলাকে । শক্ত গলায় বলে,
–
” তুই রাহাত ভাইয়াকে পছন্দ করিস ? ”
জল খাচ্ছিল আদিলা । মেঘনার কথা শুনে নাকে মুখে জল উঠে যায় । বিস্মিত হয়ে তাকায় আদিলা ।মেঘনা বুঝল কিভাবে ? কই সে তো কক্ষনো ভুলেও নিজের মুখে রাহাতের নাম নেয়নি । তাহলে? নাকি ওর চোখ মুখেই লেখা আছে তা ? আজ সকালে রাহাতও একি কথা বলছিল । কি আশ্চর্য ! শেষে এই ভাবে ভরা মজলিসে নিজের চারপাশে তুলে রাখা অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে যাবে? ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল আদিলা । প্রশ্ন চোখে তাকাল সে ।
– “তোর মনে হয় না তুই নিজের যোগ্যতার থেকেও বেশি বড় স্বপ্ন দেখে ফেলছিস ? ”
-“মানে বুঝলাম না । কি বলতে চাইছিস তুই ? ”
-” নাটক করবি না একদম । আমি যা বলতে চাচ্ছি তা তুই খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিস ”
– ” যা বলার পরিষ্কার করে বল”
-” দেখ, তুই রাহাতের থেকে দূরে থাক। সে শুধুই আমার । ”
ভ্রু কুচকে তাকায় আদিলা মেঘনার দিকে ।
মেঘনা আবার বলে ,
-“ওদের সঙ্গে তোদের স্ট্যাটাস কোনোভাবেই মেলে না । তাই এত বড় বড় স্বপ্ন দেখিস না । আর তুই কখনো নিজেকে আয়নায় দেখেছিস ? একবার নিজেকে দেখ আর একবার ওকে দেখ । তুই ভাবতে পারিস কিভাবে ওর মত ছেলে তোর মত একটা মিডিল ক্লাস মেয়েকে ভালোবাসবে ? স্ট্যাটাসে ইকুয়ালিটি দেখে স্বপ্ন দেখা উচিত বুঝলি । যেটা তোর নয় আমার সাথে ম্যাচ করে ।”
চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায় আদিলার । আজ পর্যন্ত এতটা অপমানিত কখনই হতে হয়নি ওকে । দৃঢ় কন্ঠে বলে,
-“দেখ মেঘনা ,তুই যদি জেলাস হয়ে থাকিস তবে সেটা তোর সমস্যা । আমাকে ছোট দেখিয়ে যদি আনন্দ নিতে চাস তাহলে সেখানে হয়তো আমি কিছু করতে পারব না । সেটা তোর মেনন্টালিটির ওপর ডিপেন্ড করে । আর আমি কখনো আমার নিজের যোগ্যতা থেকে বেশি বড় স্বপ্ন দেখি না । তুই যদি রাহাতকে ভালোবেসে থাকিস তাহলে আমি সেখানে তোর কম্পিটিটর নই । আর একটা কথা আমি রোজ নিজেকে আয়নায় দেখি । আমি জানি আমি দেখতে কেমন? তাই তোর না বললেও চলবে । আর হ্যাঁ, একটা কথা , নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করিস না । কারণ এটা তোর নিজের তৈরি নয় । আর কি জানিস তো , সৃষ্টির ওপর অহংকার করা একমাত্র স্রষ্টারই সাজে ।”
ঘুরে দাড়ায় আদিলা । আজ অনেক বছর পর ওর নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। ও ভাবতেও পারছে না ছোটবেলায় যে দিনগুলোর সঙ্গে ও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে এসেছে । এত বছর পর আবার সেই একই কারণে কারো কাছে ছোট হতে হবে ।কেউ তাকে অপমান করতে পারে। দূর থেকে মেঘনা আর আদিলাকে তর্ক করতে দেখে রাহাত এগিয়ে আসে । কিন্তু ওর পৌঁছানোর আগেই আদিলা সেখান থেকে সরে যায় ।
রাহাত মেঘনাকে প্রশ্ন করে
– ” কি কথা বলছিলে তোমরা ? আদিলা এভাবে চলে গেল কেন? ”
– ” তেমন কিছু না । আমরা এমনিই কথা বলছিলাম , জায়গা টা খুব সুন্দর তাই বলছিলাম ওকে ” আমতা আমতা করে উত্তর দেয় মেঘনা ।
– “মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করো না , আমি কিন্তু সব শুনেছি । ”
মেঘনা ভয় পেয়ে ঢোক গিলে। তোতলাতে তোতলাতে বলে
– ” কি- কি শুনেছেন আপনি ? ”
– “তুমি ওকে ছোট করার চেষ্টা করছিলে কেন ? কি ভাবো তুমি নিজেকে ? মানুষের গায়ের রং কেমন হবে? সেটা তার শরীরের মেলানিনের উপর নির্ভর করে । এই মেলানিন তোমার শরীরে কম আছে জন্য তোমার গায়ের রং ফর্সা হয়েছে । সেটাই ওর শরীরের কোষ গুলোতে বেশি আছে জন্য ওর গায়ের রং শ্যামলা হয়েছে । এতে তোমার সমস্যা কোথায় ? ”
মাথা নিচু করে নিরুত্তর দাড়িয়ে থাকে মেঘনা ।
-” মেঘনা , এখন ও সময় আছে নিজের চিপ মেন্টালিটি ত্যাগ করো । না হলে জীবনে প্রতি পদে লাঞ্চিত হবে । দিন দিন বড়ো হচ্ছ । সাথে নিজের চিন্তা ভাবনার পরিসর ও বাড়াও । যে যেমন তাকে সেভাবেই একসেপ্ট করা শেখো। দেখবে দুনিয়াটা অনেক সুন্দর লাগবে । ”
কথা শেষ করেই চলে যায় রাহাত । মেঘনা রাগে ফুসছে থাকে। একটা সামান্য মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করলে ! এটা তুমি ঠিক করলে না রাহাত । এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে । আদিলা এবার তুই বুঝবি আমি কি করি । সব জায়গার তোর বাড়াবাড়ি আমার আর সহ্য হচ্ছে না । জাস্ট সহ্য হচ্ছে না । তুই মিতুকে নিজের বান্ধবী বলে নিয়ে এসেছিস না ।এবার দেখ মামা মামিকে বলে তোর কি হাল আমি করি । মনে মনে কথা গুলো ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এগিয়ে যায় সে ।
অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরির পর ওরা সবাই একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।এবার আর আদিলা মেঘনার পাশে বসে না ।মিতুকে মাঝখানে দিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ে।
সায়ন পিছন থেকে বলে ,
-” আপু তোর ফোনটা দে না ,ছবিগুলো দেখি ”
আদিলা ওর ফোনটা সায়নকে দিয়ে দেয় । সায়ন ছবি গুলো দেখতে দেখতে আদিলাকে একটি ছবি দেখিয়ে বলে ,
-” আপু এই ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে না ? আমি ফেসবুকে আপলোড করি এটা । তোর একাউন্টে,,,, ”
– ” না, তার দরকার নেই ”
– “কেন ? ” নিরাশ হয়ে সায়ন বলে । ফাহিম আদিলাকে চুপচাপ থাকতে দেখে বলে
-” আদি চুপ করে আছিস কেন রে ? ”
– “এমনি …..”
– ” শরীর খারাপ লাগছে? ”
-” না , আমি ঠিক আছি । ” বলে আবার জানালার দিকে মুখ করে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে । মিতুকে ফাহিম চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে ‘কি হয়েছে ওর ?’
মিতু মাথা নেড়ে না জানায় । ফাহিম আর কিছু বলে না ।
বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দুটো বেজে যায় । গিয়ে দেখে দুপুরের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন চলছে । অনেকেই বসে পড়েছে খেতে । ওরা সবাই নিজেদের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় । আদিলা আর মিতু অযু করে জোহরের নামাজ পড়ে বিছানায় শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে ।
চারটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে মিতু আর আদিলা বাইরে বেরিয়ে দেখে ওর খালা -খালু ,ওর আম্মু- আব্বু সবাই থমথম মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে । আদিলার সবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সবাই খুব রেগে আছে । এক সাইডে রাহাত আর ফাহিমকেও দেখতে পায় । দুজনেই চিন্তিত মনে হচ্ছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে মেঘনা মিটমিট হাসছে । আদিলার বুঝতে বাকি থাকে না যে মেঘনা নিশ্চয় কিছু করেছে । তবুও নিজেকে শান্ত রেখে আদিলা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
-” কি হয়েছে? তোমরা সবাই এভাবে বসে আছ কেন? ”
– ” আদি, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে , ঘরে আয় আমার সাথে ”
আদিলাকে ওর খালা আর ওর আম্মু ডেকে নিয়ে যায় ঘরে ।
-“কি হয়েছে ? তোমরা আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন ? আর তোমরা এতো রেগে আছো কেন ?
– “মিতু কি সত্যিই তোর বন্ধু ? ”
খালার প্রশ্নে আদিলা একটু ভড়কে যায় । তবুও নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করে,
– ” কি হয়েছে ? এভাবে জিজ্ঞেস করছ কেন ? ”
-” তুই আগে বল বান্ধবী কি না? ”
-” কেউ কি তোমাদের কিছু বলেছে? ”
-“হ্যাঁ, মেঘনা সব বলেছে আমাদের ”
– ” কি বলেছে ও? ”
-” এটাই যে ফাহিম আর মিতু একে অপরকে হয়তো ভালবাসে আর মিতু তোর বান্ধবী নয় ”
আদিলা চমকে ওঠে । মেঘনা এটা না করলেও পারত ।
– ” ঠিক আছে ।আমি সব বলব । তোমরা পাঁচ মিনিট সময় দাও । আমি এক্ষুনি আসছি ”
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে আদিলা বেরিয়ে যায় । কিছুক্ষণ পর আব্বু ,খালুকে ডেকে নিয়ে আসে । ফাহিমের মুখ শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেছে । সে রাহাতকেও টেনে নিয়ে আসে । সবাই সপ্রশ্ন তাকিয়ে আছে আদিলার দিকে । আদিলা বলতে শুরু করে ,
-” আমি জানি না, মেঘনা ,তোমাদের কি বলেছে? কিন্তু আমি একটা কথা বলতে চাই তোমাদের । তোমরা প্লিজ একটু ধৈর্য ধরে শুনবে ”
সবাই আদিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । ও কি বলছে শোনার জন্য । আদিলা ওর খালার দিকে মুখ ফেরায় ।
-” খালাম্মা ,মাহি আপুর তো বিয়ে হয়ে গেল এবার তুমি নিশ্চয়ই চাইবে ফাহিম ভাইয়াকেও বিয়ে দিয়ে সেটেল করে দিতে । কি চাও তো নাকি? ”
-” হ্যাঁ ”
-” আচ্ছা ,বলো তো তোমরা কেমন মেয়ে চাও ভাইয়ার জন্য? ”
আদিলার খালা-খালু মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
– ” সুশীল ,ঘরোয়া ভালো মেয়ে চাই ”
– “আচ্ছা, মিতু আপুকে দেখে কি তোমাদের খারাপ মনে হয় ।আপু দেখতে শুনতে ভাল । ভালো জব করে । বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে , তার ওপর ধার্মিক ।তোমরা এতগুলো গুণ খুঁজলে হয়তো পেতে পারো কিন্তু সবগুলো একসঙ্গে কখনো ভাবে না ।আর তাছাড়াও তোমরা কি আমাকে গ্যারান্টি দিতে পারো তোমরা দেখে শুনে কোন মেয়ের সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে দিলে ভাইয়া সুখী হবে । পারবে কি গ্যারান্টি দিতে ?”
সবাই মাথা নেড়ে না জানায় ।
– “ওকে ,,,, ভাইয়া আর আপু যদি বিয়ে করে, ওদের মাঝে ঝামেলা হওয়ার সুযোগ কম । ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালো করে চেনে-জানে। ওদের দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা খুব ভালো । আপু এই বাড়ি প্রত্যেকটা মেম্বারকে খুব ভালবাসে ।ওর ব্যবহার আচার তোমরা সবই দেখেছ । খালাম্মা আপুর মা নেই, কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন । আপু তোমাকে খুব পছন্দ করে জানো তো ।কাল আপু ঘুমানোর সময় আমাকে বলছিল তোমার মধ্যে নাকি ও ওর মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় । তাহলে তোমরা আমাকে বল যে মেয়ে তোমাদেরকে এতটা পছন্দ করে আগের থেকেই এবং এই বাড়ির সবার সম্বন্ধে খুব ভালো করে জানে সবাই কে এত ভালোবাসে । তাহলে তাকে তোমরা অপছন্দ কেন করছ ? ”
আদিলার যুক্তিসম্মত কথা শুনে সবাই খুশি হয় । ও ওর খালুকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
-“খালু তোমার মিতু আপুকে পছন্দ হয়নি ? মিতু আপু খুব ভাল ফ্যামিলির মেয়ে । ওকে না পছন্দ করার আমি তো কোনো কারণ দেখছি না । আর আমি আগে ওর পরিচয় দেইনি কারন ,আগে পরিচয় দিয়ে দিলে হয়তো তোমাদের মনে আপুর সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাতো ।তাই আমি আগে বলিনি ।”
– ” হ্যাঁ । কাল থেকে তো আমি দেখছি মেয়েটাকে । খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে । আসলে মেঘনা আমাদেরকে এমন করে কথাগুলো বলল যে,অন্য কিছুভাবার সুযোগ হয়নি । তৎক্ষণাৎ রাগ চরে গিয়েছিল । ”
– “এমনিতেও আমরা কালকেই পছন্দ করে নিয়েছিলাম মেয়েটাকে । খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল ফাহিম আর ওকে একসঙ্গে ।”
এতক্ষণ তঠস্থ হয়ে বসে ছিল ফাহিম। ওর আম্মুর কথা শুনে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয় ।
-“খালাম্মা , আমি তো ছোট মানুষ । যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তোমরাই নেবে । তবুও আমি বলব এখন তো সবকিছু ঠিক আছে। তাহলে আমরা এক কাজ করতে পারি না ? আপুর বিয়ের পর পরই ফাহিম ভাইয়া আর মিতু আপুর বিয়ে দিলে কেমন হয় ”
খালা খালু ওর কথা শুনে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় ।
– ” সত্যি ! তাহলে প্রবলেম সল্ভ ”
আদিলা উল্লসিত হয়ে ওঠে ।রাহাত মনে মনে ওর প্রশংসা না করে পারে না । আর কত রূপ দেখবে সে এই মেয়ের !
– ” খালাম্মা, আমি তাহলে আপুকে খবরটা দিয়ে আসি ”
– “দাঁড়া আমিও যাচ্ছি ”
-“ভাইয়া তোর বিয়ে হতে যাচ্ছে আমরা আবার বিয়ে খাব । আমার গিফ্ট চাই কিন্তু ,,,,”
সবাই আদিলার কান্ড দেখে হেসে ফেলে । রাহাত মনে মনূ বলে পাগলি একটা !এখনই ম্যাচুয়রদের মতো স্ট্রং হাতে প্রবলেমটা সল্ভ করল আর এখনি বাচ্চাদের মতো লাফালাফি শুরু করেছে !
আদিলা ,ওর আম্মু আর খালাম্মা একসঙ্গে মাহির রুমে গিয়ে দেখে মিতু বিছানায় বসে কি যেন ভাবছে।
– ” আপু তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ”
মিতু মুখ তুলে সবার দিকে তাকায় ।আদিলার খালা বিছানায় বসে মিতুর হাতটা ধরে বলে,
– ” মিতু, আমার ছেলের বউ হবি ? দেখ, আমার ছেলেটা খুব পছন্দ করে তোকে । একদম মাথায় করে রাখবে । আর শোন, এরকম অফার কিন্তু একবারই আসে । তাই ঝটপট উত্তর দে তো ”
মিতু ফাহিমের আম্মুর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নামিয়ে নেয় ।
– ” দেখি মুখটা । কি হল বল ? আমার ছেলেটাকে তুই পছন্দ করিস না ? আমি কিন্তু তুই করেই বলছি , আমার কাছে মাহি ও যা তুই ও তাই । দেখ আমার ছেলেটা কিন্তু দেখতে খুবই হ্যান্ডসাম । হ্যাঁ একটু রাগী আছে কিন্তু মনটা খুব ভালো রে ।কিরে কিছু তো বল ? ”
মিতু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে ফাহিমের আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। মিতুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফাহিমের আম্মু বলল,
-“ধুর পাগলী, কান্না করছিস কেন ?তোর মা নেই তো কি হয়েছে ? আমি তো আছি। আমাকে আম্মু মনে করিস । আর তোর আম্মুকে যেন আল্লাহ জান্নাত বাসী করেন (আমিন) । আচ্ছা বল তোর বাবার সঙ্গে তাহলে কবে কথা বলব ? ”
– “তোমাদের যখন ইচ্ছা হবে। ”
-” ঠিক আছে তাহলে। এই অনুষ্ঠান গুলো শেষ হোক ।তার পর আমরা তোর বাবার সঙ্গে কথা বলতে যাব ।”
মিতু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় ।
-“আচ্ছা তোরা বস তাহলে । আমরা আসি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে । সন্ধ্যা নামছে একটু পর বৌভাতের জন্য রেডি হতে হবে তোদের ” বলে রেহনুমা তার বোনকে নিঢ়ে বেরিয়ে যায় ।
-“আদিলা এসব কি হচ্ছে ? কিভাবে হলো? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না ”
মিতু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ।
– “তোমাকে বেশি কিছু বুঝতে হবে না । তুমি শুধু এখন নিজের বিয়ের প্রিপারেশন করো ।বুঝলে বৌরানি ?”
মুচকি হেসে মিতু আদিলাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,
-“তোর ভাইয়া সত্যি বলে, তুই সত্যি ব্লেসিং আমাদের জন্য । ”
মিতু আর আদিলা গল্প করছিল। এমন সময় ফাহিম রুমে প্রবেশ করে । মিতু স্মিত হাসে । বলে,
-“কংগ্ৰাচুলেশন হবু বর ”
হেসে ফেলে ফাহিম ।
-“ইউ টুউ ,উড বি মিসেস শেখ ”
‘ উম হু ‘আদিলা গলা খাকড়ি দেয় । ফাহিম মিতু দুজনেই হেসে ফেলে ।
-“আদিইইই” বলেই ফাহিমকে আদিলাকে জড়িয়ে ধরে । বলে ,
-“থ্যাংক ইউ ,পিচ্চি । থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ । তুই আমার জীবনের বেস্ট গিফ্টটা আমাকে পাইয়ে দিলি । ”
-” ওফ হো । ভাইয়া ছাড়ো। আমি শ্বাস নিতে পারছি না ”
-” সরি সরি ,,,,, আমি একজন আর্মি অফিসার হয়েও কখনও আব্বুর সামনে ঠিক ঠাক কথা বলতে পারি না ।আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না । এবার কি হবে ?সব কিছু এভাবে ঘেটে গেল কীভাবে ? ভাগ্যিস তুই ছিলি !তুই এত সহজে সবকিছু সল্ভ করে দিলি ! সত্যি তোর জবাব নেই!”
– “ভাইয়া, তোকে আমি আগেও বলেছি না এত ফরমালিটি করবি না আমার সঙ্গে। আমি কি তোর পর নাকি । বারবার এসব বলে আমাকে পর করে দিস ” মুখ ভার করে বলে আদিলা ।
– ” সরি সরি , আমি ভুলে গেছিলাম। ”
-“এবার আমার গিফ্ট দে “বলেই হাত পাতে আদিলা । ফাহিম হাতের মুঠো বন্ধ করে দিয়ে বলে,
-“এটা তোলা রইল । সঠিক সময়ে পেয়ে যাবি ,”
-“বাকির নাম তো ফাকি” আদিলা মুখ ভেংচায় । ফাহিম উচ্চ স্বরে হেসে ফেলে ।বলে,
-” বলছি তো, সঠিক সময় এলে পেয়ে যাবি তোর গিফ্ট। আর যখন সেটা দেখবি আমি শুধু তখনকার এক্সপ্রেশন টা দেখতে চাই । ”
-“এতটা এক্সপেন্সিভ? ”
-“হুম ” ফাহিম রহস্যময় হাসি দেয় । আদিলা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে ।
ঠিক হয় এশার নামাজ পড়ে ওরা বৌভাতের উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ি রওনা দেবে । রায়গঞ্জ থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছতে মোটামুটি তিন ঘন্টার মত সময় লাগবে তাই ওরা একটু তাড়াতাড়ি বের হতে চায় । খাওয়া-দাওয়া করে মোটামুটি বাড়ির সবাই রেডি হয়ে গেছে ।
আদিলা আজ একটি খয়েরি কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে ।সাথে ঘিয়া কালারের ব্লাউজ এবং ওড়নাটা খয়েরি কালারের মধ্যে সুতোর আর জরির কাজ করা ।ওড়নাটা ও বাঁম কাধের ওপর এক পিন করে রেখেছে । চুলগুলো বাম কাঁধের ওপর খোলা রেখেছে আদিলা ।ম্যাচিং জুয়েলারি, বাঁ হাতে ঘড়ি , ম্যাট খয়েরী লিপস্টিক,চোখ দুটো কাজল দিয়ে সুন্দর করে সেজেছে । মিতু ওকে দেখে বলে ,
– ” মাশাল্লাহ ! তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ আদি ”
– “আচ্ছা ,তাই ?তোমাকে ও কিন্তু খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ।”
মিতু আজ জলপাই কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে ।ওটা ফাহিমের আম্মু দিয়েছে ওকে ।
-” শোনো না আদি , তৈরি হয়ে আম্মু একবার আমাকে তার কাছে যেতে বলেছে । তুমি রেডি হয়ে নিচে আস । আমি যাই ।”
-” কিন্তু আপু , ওড়না টা কি এভাবে ছাড়াই থাকবে ? মানে দেখ না , কোমড় টোমড় তো সব বেরিয়ে আছে ! শখ করে কিনেছি । কিন্তু এটা পড়ে আমি বাইরে যেতে পারব না । ভীষণ অস্বস্থি হচ্ছে । কি করব এখন ? ”
-” ওড়নাটা প্লট করে নাও । আর না হলে অন্য কিছু,,,,”
ফোন বেজে ওঠে মিতুর । হবু শাশুড়ি ফোন করেছে । আদিলা ইশারায় যেতে বলে মিতুকে । মিতু চলে যায় । আদিলা ড্রেসিংয়ের সামনে গিয়ে দাড়ায় । নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয় সে । উন্মুক্ত নাভিমূল দেখে অস্বস্তিটা আরো জেকে বসে । ওড়নাটা টেনে কোমড়ে পেচিয়ে দেয় । এই ভাবে কি যাওয়া উচিত ? দোটানায় পড়ে যায় আদিলা । আর একবার মিতু আপুকে জিঞ্জেস করতে হবে ।দরজা হালকা ফাক করে বাইরে উকি মারে আদিলা । পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব উঠেছে । ছেলে-মেয়ে ,মহিলা সবাই সেজে উঠেছে আজ । তখনি পুরো ফ্রিজ হয়ে যায় আদিলা । অন্যমনস্ক হয়ে রাহাত এদিকেই আসছে । সে যে উকি দিয়ে দেখছে এ কথাও ভুলে যায় সে ।
আজ রাহাত কালো প্যান্ট আর সাদা শার্টের ওপর কালো ব্লেজার পরেছে , আবার শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে রেখেছে । ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।শার্টের ওপরের খোলা বোতামের ফাক দিয়ে বুকের লোম গুলো উকি দিচ্ছে ।এতে আদিলা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ।আবার ওর রাগ ও হচ্ছে রাহাতের প্রতি । বোতাম গুলো লাগিয়ে দিলে কি ক্ষতি হত ? এত হটসট হয়ে যাওয়ার কি আছে?
-“এভাবে লুকিয়ে দেখলে হবে ? হ্যাঁ বলে দাও । তখন একদম সামনে থেকে দেখতে পাবে ,,”
To be continue…….