জোনাকি_পোকার_বাতি পার্ট – ২

0
714

#জোনাকি_পোকার_বাতি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট – ২

উনাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম মেয়ের বয়স ২২ বছর। মেয়ের বয়স শুনে মাথায় বা”জ পড়লো আমার। এখনকার যুগে বাইশ বছরের মেয়েকে এক ছেলের বাপের সাথে বিয়ে দিচ্ছে! যেখানে পাত্রের বয়স ৫০+। লোক দুটো যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” তোমার নতুন শাশুড়ি আসছে, সবকিছু নিজের হাতে ব্যবস্থা করবে। ”

আমি কোন প্রকার উত্তর দিলাম না। হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। লোক দুইটা যাওয়ার পর থেকে বাড়ির পরিবেশ একদম ঠিক হয়ে গেছে। শাশুড়ি মা নিজের মতো কাজ করে চলেছে। আমাকে এটা ওটা হুকুম করছে, আমিও সেগুলো নিরবে পালন করে চলেছি। এতে যদি উনার মনে একটু শান্তি লাগে, তাহলে তাই হোক। মনিরুলও ব্যাপরটা নিয়ে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

ঘড়িতে তখন বিকেল চারটা। শাশুড়ি মা বারান্দায় বসে আছে, হাতে একটা গল্পের বই। পাশেই চানাচুরের বাটিটা খালি পড়ে আছে। উনাকে দেখে বড্ড মায়া লাগছে আমার। হয়তো একটা মেয়ে হওয়ার দরুন শাশুড়ি মা’য়ের কষ্ট কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেরেছি। শাশুড়ি মা সারাদিন সকলের জন্য নানান রকমের রান্না করছেন, বাড়ির সবকিছু একা হাতে সামলেছেন। আমাকে এটা-ওটা এগিয়ে দিতে বলেছেন। কতটা কষ্ট লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে আছেন। ভাবলেও গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে উনার পাশে গিয়ে বসলাম। আস্তে আস্তে বললাম, ” আম্মা, চানাচুর এনে দিবো? ”

” না বউ মা, এখন আর চানাচুর খেতে ইচ্ছে করছে না, তুমি বরং এক কাপ চা নিয়ে এসো। বই পড়তে পড়তে চা খাওয়ার মজাই আলাদা। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি কিছু সময় অপেক্ষা করুন, আমি চা নিয়ে আসছি। ”

আমার কথায় কোন উত্তর দিলেন না। হু- হ্যাঁ কিছুই শোনা গেল না। এক ঘ্যানে বই পড়ছে। হয়তো এভাবে নিজের কষ্ট কমাতে চাইছে। রান্নাঘরে গিয়ে দু’কাপ চা বানালাম। মনিরুল ঘরেই আছে। তাকে এক কাপ দিবো, অন্যটা শাশুড়ি মা’য়ের জন্য । বেলা-অবেলায় চা খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার। অভ্যাস থাকলে হয়তো নিজের জন্যও এক কাপ বানিয়ে নিতাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শাশুড়ি মা বললেন, ” বউ মা তোমায় কিছু গল্প বলবো। সময় করে শুনতে পারবে তো?”

” জ্বি নিশ্চয়ই। ”

” তাহলে শোনো। যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। সেই থেকে এই সংসারের পিছনে খেটে চলেছি। তোমার শশুর আমাকে ভালোবেসেছে, সম্মানও দিয়েছে। কিন্তু লোভের কাছে তিনি পরাজিত!”

” কিছু বুঝতে পারছি না আম্মা। ”

” তোমার শশুরের এখন যুবতী স্ত্রী প্রয়োজন। আমার মতো অসুন্দরী বৃদ্ধাকে তার ভালো লাগে না। ”

” কি বলবো বুঝতে পারছি না। ”

” বুঝতে হবে মা। ভরসা করে তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই। ”

” কি দায়িত্ব আম্মা?”

” আমার অবর্তমানে সংসারটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিও। নিজের হাতে সংসারের সবকিছু সাজিয়েছি। ছেলেটাকে খুব যত্নে মানুষ করেছি আমি, ওকে কখনো কষ্ট দিও না। ”

” আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু আম্মা, আপনি ভেঙে পড়বেন না। আব্বু আবার বিয়ে করবেন না। আমরা উনাকে বুঝাতে সক্ষম হব। ”

” ৩০ বছরে যে মানুষটাকে চিনতে পারলাম না। সাত দিনে তুমি তাঁকে চিনতে পারবে?”

কোন উত্তর দিতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। শাশুড়ি মা গল্পের বই হাতে নিজের ঘরে চলে গেলেন। হতাশা ঘিরে ধরছে আমায়, এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি! শুধুমাত্র শাশুড়ি মা’য়ের প্রতি সহানুভূতি, ভালোবাসার জন্য এমন অনুভব হচ্ছে আমার নাকি ভয়ের কারণে? কোথাও শুনেছিলাম ছেলেরা বাবার মতো হয়!

সেদিন রাতে শাশুড়ি মা’য়ের সাথে বসে খাবার খেলেন শশুর আব্বু। ঘরে যাওয়ার আগে গম্ভীর গলায় বললেন, ” মনিরুলের মা ঘরে এসো। তোমার সাথে কথা আছে। ”

শাশুড়ি মা নির্বিকারভাবে উনার সাথে চলে গেলেন। পরদিন সকাল থেকে বাড়ির পরিবেশ একদম স্বাভাবিক। শাশুড়ি মা নিজের মতো সব কাজ করছে, শশুর আব্বু, মনিরুল এঁরাও স্বাভাবিক। শুধুমাত্র আমিই স্বাভাবিক হতে পারছি না। শাশুড়ি মা’য়ের এ নিরবতা, বাড়ির পরিস্থিতি সবকিছুই আমার কাছে জোনাকি পোকার বাতির মতো মনে হচ্ছে। চোখের সামনেই আলো রয়েছে, কিন্তু সে আলোয় পথ চলা বড্ড দায়!

আগামীকাল শশুর আব্বু বিয়ে, এ কদিনে শাশুড়ি মা’কে একবারও কাঁদতে দেখিনি। মনিরুল এ ব্যাপারে সব থেকে বেশি উদাসীন। বিয়ে ভাঙার কোন চিন্তা তো নেই, বরং বাবার বিয়ে খাওয়ার জন্য উৎফুল্ল হয়ে আছে। নিজের হাতে নতুন মা’য়ের জন্য শাড়ি গহনা কিনছে, একটু আগে গেছে ফুলের অর্ডার দিতে। শশুর আব্বুকে বিয়ের বিষয়ে কিছু বলার সাহস করতে পারিনি। মনিরুলকে কয়েকবার বলেছি, ‘ বিয়ে আটকাতে না পারলে আমাকে বাপের বাড়ি রেখে এসো। আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। কিন্তু তাঁর এক কথা, বাবা বলেছেন উনার বিয়ে হলে তারপর আমরা যাবো। আজকাল মনিরুলকে দেখলে বড্ড বিরক্ত লাগে আমার, কেমন ছেলে সে! মা’য়ের কষ্ট বুঝতে পারছে না, এমনকি নিজেদের মানসম্মানের কথাও চিন্তা করছে না। বাবার অন্যায় আবদারের সায় দিয়ে যাচ্ছে।

ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা। শশুর আব্বু আর মনিরুল ঘুমিয়ে পড়েছে। শাশুড়ি মা কোথায় আছে বলতে পারি না। মানুষটা আজ-কাল রোবটের মতো আচরণ করে। আমার চোখে ঘুম নেই, কিছুই ভালো লাগছে না। আশেপাশের লোকজনের নানান কথা আমার মনটা বারবার বি”ষি”য়ে দিচ্ছে! শশুরকে নিয়ে বললে হয়তো দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিতাম। গায়ে লাগেও মনে লাগতো না। কিন্তু ওঁরা মনিরুলকে নিয়েও বাজে কথা বলছে। এইতো সকালে পাশের বাড়ির মনিরা ভাবি এসেছিল। হাতে করে পেয়ারা মাখা নিয়ে এসেছে। আমাকে ডেকে পেয়ারার বাটিটা হাতে দিলো, তারপর ব্যঙ্গ করে বললো,” তোমার শশুর শাশুড়ির প্রেমের কথা জানতে তো? আমি এসেও দেখি একজন অন্যজনকে রেখে কিছুই মুখে তোলে না। তোমার শশুর কতদিন আধা খাওয়া খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। সে-ই সম্পর্ক আজ ভাঙতে চলেছে। পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই। তুমি তো আবার সে-ই লোকের ছেলেকে বিয়ে করেছো। না জানি তোমার কপালে কি লেখা আছে! ছেলেরা বাপের মতোই হয়।”

লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এসেছিল, চাইলেও কিছু বলতে পারিনি। বলতে খুব ইচ্ছে করছিলো মনিরুল এমন নয়, কিন্তু মনিরুলের উদাসীনতা আমাকে বলতে দেয়নি। কোন এক অচেনা বাঁধায় আটকা পড়েছি। বুক চি”রে বেরিয়ে আসা কথাগুলো গলায় আটকে গেছে, ফিরে গিয়ে মাঝে খ’ঞ্জ’রের মতো আ’ঘা’ত করছে হৃদয়ে! র’ক্তা’ক্ত হয়েছে এ মন। এ যাতনা এতো নি’ষ্ঠু’র কেন! হারিয়ে যাওয়ার কষ্টের থেকে হারানোর ভয় যে মা’রা’ত্ম’ক বেদনাদায়ক।

” বউমা, এতো রাতে এভাবে হাঁটছ কেন?”

শাশুড়ি মা’য়ের কণ্ঠস্বর চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। নিচু স্বরে বললাম, ” ঘুম আসছে না তাই। ”

“ওহ্! আচ্ছা। ”

উনি চলে যেতে লাগলেন কিন্তু আমি পিছন থেকে হাত টেনে ধরে কাতর গলায় বললাম, “আম্মা, আপনি এসব কিভাবে সহ্য করছেন? ”

পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ” তুমি একদম মেয়ের মতো চিন্তা করো আমাকে নিয়ে। এ কদিনে সবকিছু লক্ষ্য করেছি আমি। কিন্তু মা সব বিষয়ে আমাদের হাত থাকে না। কেউ চলে যেতে চাইলে তাকে জোর করে আটকে রাখাটা বোকামি। চুলে পাক ধরেছে, বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছি দিনদিন, এসময়ে এমন বোকামি কি মানায় আমাকে?”

” আপনি আব্বার বিয়েতে মত দিয়েছেন? আপনার কি কষ্ট হচ্ছে না?”

” অনুভূতিহীন মানুষরা কিছুই অনুভব করতে পারে না। আমি সবকিছু মেনে নিয়েছি। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়। ”

” এতোদিন শুনেছি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়, আজ আপনাকে দেখে উপলব্ধি করতে পারছি। ”

” সবসময় চোখের দেখা ঠিক হয় না। কানে শোনা কথাও মিথ্যা হয়। ”

” সবাই বলাবলি করছে আপনাদের ভালোবাসা নাকি দেখার মতো ছিল, একজন অন্যজনে ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। তাহলে কেন?”

” ভালোবাসলে বিশ্বাস রাখতে হয়, বিশ্বাস ছাড়া কখনো ভালোবাসা হয় না। আমি এখনও বিশ্বাস করি তোমার শশুর বিয়ে করবে না। ”

” একটু আগেই বললেন আপনাকে বোকামি মানায় না। তবে এ কোন বোকামি মা? চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে চাইছেন না?”

” ভালোবাসা অন্ধই হয়! বিশ্বাস, ভরসা সেখানে আলো এনে দেয়। তোমার বয়স কম, এখনই সবকিছু বুঝবে না। ”

উনি আর কিছুই বললেন না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। শাশুড়ির আচরণ কেমন রহস্যময় লাগলো আমার কাছে, এ যেন এক রহস্যময়ী রমণী! যাকে বুঝতে পারার ক্ষমতা আমার নেই। পরক্ষণেই মনে হলো শোকে পা’গ’ল হয়ে গিয়েছে। পা’গ’লে’র প্রলাপ বকছে।

নাহ্! আর কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা আমার নেই। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে কিছুতেই ঘুম আসছে না। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, শেষ রাতের দিকে কখন ঘুমিয়ে গেছি বলতে পারি না।

সকালে মনিরুলের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ছেলেটা চিৎকার করে বলছে, ” মেহমান চলে আসবে, তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে নাও। ”

” মেহমান মানে? কে আসবে?”

” আব্বার বিয়ে এ বাড়িতে হবে। সবকিছু সাজিয়ে রাখো। তবে রান্নার চিন্তা নেই, খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করা হয়েছে। ”

” বাপের বিয়ে নিয়ে এতোটা উৎফুল্ল কেন তুমি? নির্লজ্জের মতো কাজ করো না, বিরক্ত লাগে। ”

” আমি আবার কি করলাম? সে যাইহোক তুমি কিন্তু গোলাপি রঙের শাড়ি পরবে না , ওই রঙে তোমাকে একটু বেশিই মানায়। চোখ সরাতে পারবো না। লোকের মাঝে হা করে তাকিয়ে থাকলে সবাই নির্লজ্জ বলবে। ”

” তুমি কি যাবে?”

মনিরুল চলে গেল। আমি নির্বিকার হয়ে বিছানায় বসে রইলাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here