জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০১

0
2452

জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০১
Writer: Asstha Rahman

জানালার পাশে বসে সকালের সৌন্দর্য দেখছিলেন মিসেস নিষ্পাপ আহমেদ।সিলেট শহরটা তার কাছে অপার ভালোলাগার একটা জায়গা। গত ৬বছর ধরে এখানেই তার স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস। কাজের মেয়ে মালিহার গলা শুনে তার ধ্যান ভাঙল।
— কি হয়েছে মালিহা?
— ছোট্টমণি খাচ্ছেনা। কত চেষ্টা করছি একটু কিছুও মুখে দিচ্ছেনা।
— তুমি খাবারটা আমায় দাও। চায়ের কাপটাও নিয়ে যাও। মালিহার কাছ থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে নিজের মেয়ের রুমের দিকে গেলেন নিষ্পাপ। “মেয়েটা কে নিয়ে আর পারা যায়না, যত বড় হচ্ছে তত এর বায়না বাড়ছে। কোন রাজকার্য করছে যে একটু কিছু খাওয়া যায়না।” বিড়বিড় করতে করতে মেয়ের রুমে ঢুকলেন। ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া।তার মেয়ে হাদিস শিক্ষার বই ঘাটাঘাটি করছে। বিস্মিত হয়ে বললেন,
— নূরজাহান তুমি এখন এসব নিয়ে বসেছো কেন?
— মাম্মা, আজ তো হলিডে। তাই একটু এইগুলো পড়ছি।
— কিন্তু ব্রেকফাস্ট না করে এসব পড়লে তো হবেনা। নাও ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করো। বিকালে অবসর মোমেন্টে এসব পড়ো কেমন সোনা!
— আচ্ছা মাম্মা। ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে নিষ্পাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। এমনসময় তার স্বামী সায়েম আহমেদের ডাক এলো। নিজের রুমে ঢুকে বললেন,
— ডাকছিলে কেন?
— টাই টা পড়িয়ে দাও। নিষ্পাপ সায়েমের টাই বেধে দিতে দিতে বলে,
— ৬বছরের মেয়ের বাবা হয়ে গেছো এখনো টাই বউকে পড়িয়ে দিতে হয়?
— হুম হয়। আমার মামণি কই?
— রুমে বসে বসে হাদিসের বই ঘাটাঘাটি করছিল। বকে খাইয়ে দিয়ে এলাম। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সকাল সকাল অইসব নিয়ে বসেছে।
— এমন করো কেন? এটা তো ভালো গুন ই। এমন মেয়ে লাখে একটা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।
— এত অল্প বয়সে এসব দিকে এত আগ্রহ আমি কোনো বেবির দেখিনি। আমার মনটা কেমন খুতখুত করে।
সায়েম নিষ্পাপের হাত দুটো জড়িয়ে বলল, জানোই তো আমাদের মেয়েটা একদম আলাদা। ডা. রা তো বললেন, ও একটু অস্বাভাবিক। ওর বুদ্ধিদীপ্ত সবদিক দিয়ে সবার থেকে বেশি।
— তাও আমার ভয় হয় গো।
— ভয় পেয়োনা তো। শুধু শুধু ভয় পাওয়া আমার বউয়ের একটা বদগুন। আমার মামণির মত সাহসী হও বুঝচ্ছো।
— হয়েছে হয়েছে। যাও অফিসে যাও। আমি তোমার গুনবতী মেয়েটাকে দেখে আসি। হোমওয়ার্ক গুলা শেষ করল কিনা! বলেই নিষ্পাপ নিজের মেয়ের রুমে চলে এলেন। এসে দেখেন তার মেয়ে জানালার ধারে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে।

নিষ্পাপ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কি ভাবছো নূরজাহান?
— মাম্মা দিন এত সুন্দর কেন? দেখো সূর্যমামা তার সময়মত উঠে পড়ে আবার ডুবে যায়। সবকিছুতেই একটা রুটিন আছে আমার পড়ার রুটিনের মত।
— ওরা ওদের রুটিনের হেরফের করেনা। আল্লাহ তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি তো তোমার রুটিনের নিয়ম মেনে চলোনা। হোমওয়ার্ক করেছো?
— জ্বি মাম্মা। সব ফিনিশ। নিষ্পাপ অবাকতুর হয়ে বলল,
— এত তাড়াতাড়ি? কই আমাকে দেখাও তো। সত্যিই তো সবগুলাই শেষ। এত তাড়াতাড়ি কি করে করলে?
আচ্ছা চল মাম্মার সাথে একটু ঘুরে আসবে।
— পরে যাই মাম্মা? বইগুলো পড়া হয়নি!
— আচ্ছা পড়ো। মিসেস নিষ্পাপের মনটা কেমন জানি বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। তার মেয়েটা কেন এমন!আচ্ছা তার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবেনা তো? নূরজাহান যে তার দুনিয়া, তাকে ছাড়া সব অচল।নিজের মেয়ের চোখের দিকে তাকালে তার সব কষ্ট, ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। নুরজাহান টকটকে ফর্সা, ডাগর ডাগর নীল চোখ, লম্বা খাড়া নাক, চুলটা হালকা সোনালী রঙের। সব মিলিয়ে মনে হয় ছোটখাট পরীর বাচ্ছা।প্রথম দেখায় যে কারো মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতি, একদম শুদ্ধভাবে স্পষ্ট কথা বলে।
শুধু চিন্তার ব্যাপার একটাই যুগের সাথে তাল মেলাতে চায়না। নিজের আলাদা জগতে থাকতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার পরও নুরজাহানের আগ্রহ আরবি নিয়ে। ইসলামের নানাদিক সম্পর্কে তার জানা চাই ই চাই। সায়েম তার মেয়ের এসব গুন দেখে খুবই খুশি। শুধু আমার মনটা কেমন জানি করে! আমি জানি এসব ভালো, কিন্তু আমাদের কারো এমন গুন নেই তাহলে নুরজাহান পেল কি করে?
ভাবতে ভাবতে নিষ্পাপ নিজের কাজে মন দেয়।

মাঝরাতে নূরজাহানের চিৎকার শুনে নিষ্পাপ আর সায়েম নূরজাহানের ঘরে ছুটে আসে। নূরজাহান প্রচন্ড হাপাচ্ছে। নিষ্পাপ তাকে পানি খাইয়ে বুকে টেনে নেয়। সায়েমের দিকে ভয়মাখা চাহনীতে তাকিয়ে বলল,
— সায়েম এসব কি হচ্ছে বলো তো!
— ভয় পেয়োনা। দুঃস্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়ে গেছে। তুমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। ওর কাছেই থাকো বরঙ।
সায়েম এগিয়ে এসে নূরজাহানের কপালে চুমু দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। নিষ্পাপ মেয়ের চোখে ভয় আর অবাকতা দেখছে।নূরজাহানকে পাশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” কি দেখেছো সোনা? মাম্মাকে বলো। নুরজাহান কাপা কাপা কন্ঠে বলে,
— একটা মহিলা অনেক উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। জানো মাম্মা উনার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কাদছিল খুব। মনে হচ্ছিল আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। হঠাৎ নিচের কুয়াশায় উনি হারিয়ে গেলেন। এসব শুনে নিষ্পাপ মেয়েকে আরো আঁকড়ে ধরেন। এই ঘটনা তার নতুন শোনা নয়। গত ৩ বছর ধরে উনি এই বর্ণনাই শুনে আসছেন। মাঝে মাঝেই নুরজাহান মাঝরাতে চিৎকার করে উঠে আর এই ঘটনাই বলে। কত সাইকোলিজিস্ট দেখালেন। সবার একটাই কথা, ” এটা তার কল্পনায় বানানো চিত্র। হয়তো কোনো মুভি দেখে সে নিজের মাথায় এই চিত্র গেথে নেয়। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে!”
ঠিক হওয়ার তো নামই নেই। দিনদিন তা বেড়েই যাচ্ছে, এইটুকু বাচ্চাকে কেন এত প্রেসার দিচ্ছো আল্লাহ! কেন ওকে সবার মত সাদামাটা বানালে না। তাহলে ওর এত কষ্ট আমাকে দেখতে হতনা। ভেবেই নিষ্পাপের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল।
নূরজাহান চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “কাদছো কেন মাম্মা? তুমিও কি উনার মত কষ্ট পাচ্ছো। কষ্ট পেয়োনা। তোমার নুরজাহান আছেনা আমি সবার কষ্ট দূর করে দিব দেখো।” নিজের মেয়ের এমন মিষ্টি কথায় নিষ্পাপের মুখে হাসি ফুটে ওঠল। তার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “সোনা মেয়ে আমার! ঘুমো এখন”

নুরজাহানকে স্কুলে যাওয়ার জন্য মালিহাকে রেডি করতে বলে নিষ্পাপ সায়েমকে চা দিতে গেল। চা টা রেখে সায়েমের টাই বেধে দিতে দিতে বলল,
— সাবধানে যেও। নুরজাহান স্কুলে ঢুকে গেলে তবেই তুমি অফিসে যাবা অকে।
— জো হুকুম মহারাণী। কিন্তু তোমার কি মনে হয়না তুমি নুরজাহানকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করছো।
— মা হও তবে বুঝবে কেন এত বেশি ভাবি।
— এত রাগ করো কেন? নুরজাহান তো আমারো মেয়ে। এই কথাটা শুনে নিষ্পাপের অন্তর আত্মা কেপে উঠল। সে যেন ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। সায়েম তাকে এভাবে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে গা নাড়া দিয়ে বলল,
— কি ভাবছো এত?
— না কিছুনা।
— যাও দেখে এসো নুরজাহান রেডি হয়েছে কিনা? স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে যে।
— তুমি বের হও আমি এক্ষুনি ওকে নিয়ে আসছি।
নুরজাহানকে নিয়ে মালিহা ড্রয়িং রুমে এসে দাড়াতেই নিষ্পাপ তার মেয়েটিকে এক নজর দেখে নিলেন। আজ তার মেয়ে হিজাব পড়েছে।
— নুরজাহান এটা তুমি কেন পড়েছো?
— কেন মাম্মা? সুন্দর লাগছেনা আমায়?
— হুম খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু মাম্মা তোমার স্কুলে তো এসব নিষেধ। খুলে ফেলো মাম্মা।
— না মাম্মা পড়িনা প্লীজ।
— জেদ করোনা সোনা।তুমি না মাম্মার গুড গার্ল।
সায়েম পিছন থেকে এসে বলল, ” আমার মামনিটাকে তো খুব সুন্দর লাগছে!”
— থ্যাংক ইউ পাপা। কিন্তু মাম্মা এটা খুলে ফেলতে বলছে, তুমি মাম্মাকে বুঝাওনা।
— নিষ্পাপ খুলতে বলছো কেন?
— ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এসব এ্যালাউ না তুমি জানোনা।
— তাতে কি হয়েছে? একদিন পড়লে কিচ্ছু হবেনা। আমি ম্যামের সাথে কথা বলে নেব। আচ্ছা আমরা বেরিয়ে পড়ি।
— হুম সাবধানে যেও। টাটা মাম্মা
— আল্লাহ হাফেজ মাম্মা। বলে নুরজাহান সায়েমের সাথে বেরিয়ে গেল। নিষ্পাপ তাদের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলাম। বুকের ভিতরে মনে হচ্ছে কে হাতুরি দিয়ে আঘাত করছে। মনের ভেতরটা কু ডাকছে।
আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে হেফাজত করো।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here