জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৫

0
1622

জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৫
Writer: Asstha Rahman

জ্বীনসর্দার আবার একটু থেমে বললেন, “আজ থেকে তোমার লড়াই শুরু। প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাও দক্ষিণের জঙলের দিকে। বিপদসঙ্কুল স্থান, সাবধান থাকব।
আমি তোমায় অন্য কোনো সাহায্য করতে না পারলেও পরামর্শ আর কিছুটা সহযোগিতা দিতে পারব। দরকার হলেই আমাকে স্মরণ করো, তবে আমি কিন্তু তোমায় দুইবারের বেশি সাহায্য করতে পারবনা।আল্লাহ তোমার সহায় হোক, ফি-আমানিল্লাহ।” বলেই দমকা হাওয়া আবার জানালা দিয়ে শব্দ করর বেরিয়ে গেল।হুজুর আমার দিকে ফিরে বললেন, “বুঝেছো তো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।সারারাত আর ঘুম এলোনা।শুধু ছটফট করছি, কখন আমার মাম্মাকে দেখতে পাব! আমার প্রতিশোধ পূর্ণ করতে পারব।
সকাল হতেই আমি বেরিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু হুজুরদাদু আমাকে বাধা দিলেন এবং বললেন, “তাড়াহুড়োয় কাজ কখনোই ভালো ফল দেয়না। তোমার এখনো কিছু প্রস্তুতি নেওয়া বাকি।” হুজুরদাদু একটা ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তোমার কাজে আসবে। সাথে রেখো এটা। তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছেনা। কেননা, তুমি এমন এক বিপদজনক স্থানে যাচ্ছো, যেখানে তোমাকে একা যেতে দেওয়ার সাহস আমার নেই। তবুও যে তোমাকে যেতেই হবে।” হুজুর দোয়াকালাম পড়ে মাথায় ফু দিয়ে বললেন,
— আল্লাহ তোমার হেফাজত করবেন। সাবধানে যেও। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।তিনিই তোমায় সঠিক পথ দেখাবেন। ফি-আমানিল্লাহ।আমি উনাকে সালাম করলাম।খানিকটা এগিয়ে দিয়ে হুজুরদাদু বিদায় জানালেন। পিচের রাস্তা ছেড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে দক্ষিনের সরুপথে চলতে লাগলাম। সিলেট শহরে এমনিতে জঙল আর পাহাড়ের অভাব নেই। চলতে চলতে পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়লাম। পথে আদিবাসীরা যাতায়াত করছে। বুঝলাম আমি শহর পেরিয়ে এসেছি। দু-একজন আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, বোধহয় কিছু জিজ্ঞেস করার সুবিধে পাচ্ছেনা।
আমি তোয়াক্কা না করে নিজের পথে হাটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, চাষক্ষেত সব পিছনে পড়ে গেল। এমন একটা জায়গায় এসে পৌছালাম যেখানে চারিদিকে গাছপালা, জনমানবশূন্য।
তাহলে এটাই সে জঙল, যেটার কথা জ্বীনদাদু বলেছিলেন। কড়া রোদে হেটে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তার উপর ভারী ব্যাগের বোঝা। বাচ্চা মানুষ আমি, কতটুকুই হাটতে পারি! মাটিতে ঘাসের উপর বসে পড়লাম।
পেটে মনে হয় নেংটি ইঁদুর দৌড়াচ্ছে, সাথে করে তো খাবার-দাবার কিচ্ছু আনিনি। এখন খাবোটা কি?

মাথা চুলকোতে চুলকোতে ব্যাগের দিকে চোখ পড়ল। ব্যাগে দাদু খাবার দিয়েছে কিনা একটু দেখি। ব্যাগ খুলতেই বড় পলিথিনে কিছু বিস্কিট,চিপস আর পানির বোতল পেলাম। সাথে একটা খিচুড়িভর্তি টিফিন বক্স ও ছিল। দেরী না করে খানিকটা খেয়ে নিলাম।হিসেব করে খাওয়া লাগবে, জানিনা তো আর কতটা গেলে মাম্মাকে পাবো! মাম্মার কথা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে মানুষের আর্তনাদের আওয়াজ আসতে লাগল।ভয় পেয়ে গেলাম, এই নির্জন জংগলে মানুষ এলো কোথা থেকে! কিছু ভাবার আগেই ৩-৪ জন বাজে চেহারার লোক আমার সামনে চলে এল। ফিসফিস করে দুই-একটা কথা বলেই একটা লোক আমাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। পা ছুড়াছুঁড়ি করতে আমার নাকে রুমাল ধরল।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমাকে একটা ছাউনির খুটিতে বেধে রেখেছে, মুখে রুমাল গুজে দিয়েছে। চেষ্টা করলাম হাতের দড়িটা খোলার কিন্তু এত শক্ত দড়ি যে কিছুতেই খুলছেনা। ওপাশের তাবুর ভেতর থেকে কিছু কথা ভেসে আসছে। কোনো এক মোটাকন্ঠ কাউকে অর্ডার করছে, “আজ প্রায় বাচ্চা ছেলেমেয়েদের থেকে ৮টা কিডনী পেয়েছি, কিছুদিনের জন্য এটা যথেষ্ট। তবে বাচ্চা মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে তার ও কিডনী নিয়ে নিতে হবে। বেশী দেরী করা ঠিক হবে।” গলা শুকিয়ে গেল এসব শুনে। না এভাবে হার মানলে তো চলবেনা, হে আল্লাহ! তুমি আমায় রক্ষা করো। জ্বীনদাদু তুমি কোথায়? এসোনা একবার।
এমনসময় কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে অজ্ঞানের ভান ধরলাম। কেউ এসে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার চলে গেল।এখানেই কি আমার জীবনের ইতি হবে? তা কি করে হয়, আমি চলে গেলে আমার মাম্মার কি হবে ? প্রতিশোধ ই বা নিব কি করে? ভাবতে ভাবতে দেখি একটা বড় ইঁদুর আমার তাকিয়ে আছে। ওটা আমার হাতের বাধনের কাছে গিয়ে দাত দিয়ে দড়ি কেটে দিল। আশে-পাশের লোকগুলা আচমকা চিৎকার করে উঠল।পাশে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন ব্যাগটা নিয়ে পালাতে গিয়ে দেখি ওদের সবার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দেরী না করে দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে গভীর জঙলের সরুপথটা ধরলাম।

পচা লোকগুলো ব্যাগটাকে ছিন্নভিন্ন করে রেখেছে, হয়তো ভেবেছে দামী কিছু আছে। বেশ শাস্তি হয়েছে তাদের, মানুষের ক্ষতি করার ঠেলা এখন বুঝো। বিকাল পেরিয়ে এদিকে সন্ধ্যা নামতে চলল। তখন তো কিছু দেখতেও পাবনা, হাটতে পারবোই না। কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। কোথায় নেওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে দেখি জঙলের ২টো রাস্তা দুদিকে বেকে গেছে। কোনটা দিয়ে গেলে আসল স্থানে পৌছাতে পারব তাও জানিনা। জ্বীনদাদুকে একবার জিজ্ঞেস করব? না থাক আরেকটা সাহায্য কখন দরকার পড়ে কে জানে। বুদ্ধি খাটিয়ে আসল পথ বের করতে হবে।
কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। পরে মাথায় আসল বরাবর দক্ষিণের যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু কি করে বুঝবো দক্ষিণ কোনটা? এখানের গাছপালা এত ঘন যে ঠিকমত সূর্য দেখা যাচ্ছেনা।
চোখ পড়ল হাতে থাকা ঘড়ির দিকে। দেখি ঘড়ি দিয়ে বের করতে পারি কিনা? সোজা কাটা অনুসরণ করে সামনের পথে হাটতে থাকল। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। চারিদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক শুরু হয়ে গেছে।
আর সামনে এগোনো যাচ্ছেনা। পথিমধ্যে ই ধপাস করে বসে পড়লাম। এইখানেই রাতটা পার করা যায়, যদি বাঘ-শেয়ালের সামনে না পড়ি।
খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দেখলাম জ্বলজ্বল করে থাকা এক জোড়া চোখ আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here