জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৬

0
1730

জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৬
Writer: Asstha Rahman

নূরজাহান ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে উঠে দৌড়তে লাগল অন্ধকার পথে। চোখগুলো ও যেন তার পিছু পিছু ছুটে আসছে। কিসের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। চোখগুলো তার কাছাকাছি চলে এসেছে। পায়ে বড্ড চোট লেগেছে, উঠতে পারছিনা। আল্লাহর নাম জপতে লাগলাম। শেয়ালটা আমার একদম কাছে আসতেই একটা জমকালো আলো বিচ্চুরিত হলো তার শরীর থেকে, আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল, “মাম্মা।” তারপর চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল।চোখ খুলতেই দেখি আমি একটা কুড়েঘরে শুয়ে আছি চারিদিকে পাখি ডাকছে, সকাল হয়ে গেছে। উঠে বসতেই লক্ষ করলাম আমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছি । দাদু তো এটাই বলেছিল যে, মাম্মার সাথে দেখা হলেই আমার বয়স ১৮ বছর হয়ে যাব।
একটা বোরকাপড়া সুন্দরী মহিলা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমিও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, “কেমন আছো মাম্মা?”
— তোকে পেয়ে খুব ভালো আছি মা। কখনো ভাবতে পারিনি তোকে আবার আমি ফিরে পাব। এই জঙলে পশু-পাখির রুপ নিয়েই শেষ জীবন কাটাচ্ছিলাম।
— এসব বলোনা মাম্মা। দেখবে আমি পাপাকেও ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আবার তোমরা খুব ভালো জীবন কাটাবে।
— উনাকে কখনো ফিরে পাব কিনা জানিনা। তবে তার বড় একটা আমানত আমি নিজের কাছে ফিরে পেয়েছি এতেই আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। তোকে আর হারাতে দিবনা মা। চল, আমরা নিজের জগতে ফিরে যাই।
— না মাম্মা, ওই বাজে মহিলাটাকে শেষ না করে আমি কোথাও যাবনা। জ্বীনজাতির প্রত্যেকে আমার দিকে চেয়ে আছে, কবে আমি তাকে শেষ করে তাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দিব।আমি যে জ্বীনদাদুকে কথা দিয়ে এসেছি , আমি কি করে কথার খেলাপ করব মাম্মা?
— কিন্তু এসবের মধ্যে যদি আমি আবার তোকে হারিয়ে ফেলি? খুব ভয় হয়রে মা।
— ভয় পেয়োনা আমার কিছু হবেনা। আমি সাহসী জ্বীন মুস্তফার মেয়ে নূরজাহান, এত তাড়াতাড়ি হার মানবনা মাম্মা।
— নূরজাহান নয় আজ থেকে তোর নাম মুনতাহা। তোর বাবার এই নামটা রাখার খুব শখ ছিল। মানুষটা তো আর নেই। বলেই মুশায়রা কাদতে লাগল। মাম্মাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই, তাও মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
— ভেবোনা মাম্মা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমার গায়ে বোরকা আর নিকাব এলো কোথা থেকে? মুশায়রা কান্না মুছে মুচকি হেসে বলল,
— উপযুক্ত মেয়েদের পর্দা করা ফরজ। তোর ব্যাগে এসব ছিল, তাই পরিয়ে দিয়েছি।
— মাম্মা, তুমি আর এইখানে থেকোনা। শহরের দিকে ফিরে যাও, সেখানে এক হুজুরদাদু আছে।তার কাছেই আশ্রয় নাও আপাতত।
— আর তুই?
— আমি কালপাহাড়ে যাব, যেখানে বাজে মহিলাটা ছিল। জানিনা এখনো সেখানে পাব কিনা!
— যাস না। ও বড্ড ভয়ানক, তোকেও মেরে ফেলবে।
— আল্লাহর উপর ভরসা আছে তো তোমার? উনি আমাকে হেফাজত করবে। তুমি চলে যাও মাম্মা। আমাকে শুধু বলে দাও সেখানে যাওয়ার পথটা কোনদিকে?
— কিছুটা পার হলেই এই জঙলের শেষে একটা গ্রাম পড়বে, তার শেষসীমান্তেই সব চেয়ে বড় পাহাড়টাই কালপাহাড়। ওই পাহাড়ের নিচের গুহায় ওই মহিলা নিজের তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমিও তোর সাথে যাব, চল।
— না মাম্মা। তুমি ফিরে যাও, এই যুদ্ধ শুধু আমার একা। আমাকে আল্লাহর ভরসায় ছেড়ে দাও। মাম্মা ব্যাগে কিছু ফল-পানি দিয়ে খানিকটা এগিয়ে দিল। তারপর আমার অনুরোধে অদৃশ্য হয়ে চলে গেল শহরে।আমি মাম্মার কথামত হাটতে থাকলাম।

হাটতে হাটতে জঙলের শেষে চলে এলাম। এইখান থেকে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, জনমানব ও আছে অনেক। একটু জিরিয়ে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করলাম। এর মধ্যেই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হলাম। কিছু মানুষ আমাকে ঘিরে ধরল। তারা আমাকে জঙ্গী ভেবে মারতে তেড়ে আসল। বহু বলার ও শুনলোনা, শুরু করল ইট ছোড়া। তখনি এক ২০ বছর বয়সী যুবক এগিয়ে আসল আমাকে বাচাতে। সে তার হাত বাড়িয়ে দিল আমি উঠার জন্য। আমি শান্তগলায় বললাম,
— বেগানা পুরুষকে স্পর্শ করা হারাম। তারপর আমি নিজেই মাটি থেকে উঠে দাড়ালাম। লোকজন আবার আমার দিকে তেড়ে আসতে চাইল। যুবকটি ওদের থামিয়ে বলল, “উনি জঙ্গী নন, আমার বিবাহিত স্ত্রী।”
শুনে আমি চমকে উঠলাম। এসব কি বলছে ছেলেটা? একজন লোক বলল,
— তুই আবার কবে বিয়ে করলি?
— আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল অনেকদিন। কিছুদিন আগে ওকে বিয়ে করলাম, ও শহরেই থাকে। আমি ভেবেছি ঘরবাড়ি বড় করে তুললে ওকে নিয়ে আসব। ও তা না মেনে নিজেই চলে এসেছে।
সবার মুখে হাসি দেখা গেল। তাদের একজন বলল, “ভালো কাজ করলি। যা বউমাকে ঘরে নিয়ে যা। কাল তোর বিয়ের দাওয়াত খেতে আসব। রান্নাটা কিন্তু বউমা করবে!”
ছেলেটা লাজুক হয়ে বলল, “হ, চাচা। অবশ্যই।” আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আসুন আমার সাথে। ভরসা পেলাম না তাও ছেলেটার পিছু পিছু তার বাসায় চলে এলাম। গ্রামের অন্যান্য ঘর থেকে উনার ঘর অনেক সুন্দর, কিছুটা শহুরে স্টাইলের। আমাকে একটা রুমে বসিয়ে বললেন, “আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
— আপনি আমাকে এইখানে কেন আনলেন?
— না আনলে গ্রামবাসীর হাতে মার খেয়ে মরতেন। এভাবে হাতপায়ে মোজা,বোরকা কেউ পরে? চোখটা ও ঠিক মত দেখা যাচ্ছেনা। সবাই তো জঙ্গি ভাববেই।
— আপনি আমাকে এভাবে বকছেন কেন?
— বকছিনা, আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আপনি বিশ্রাম নিন, কপাল থেকে তো রক্ত ও বের হচ্ছে ইটের বাড়ি খেয়ে।আমি ওষুধ আনছি।
উনি হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি বিছানায় ক্লান্ত হয়ে বসলাম। কপালের কাটা জায়গায় জ্বালা করছে,রক্তে নিকাব টা ভেজা ভেজা হয়ে গেছে।
ছেলেটাকে সুবিধার লাগছেনা, একটু বেশিই বিনয়ী। তাও উনার নিকট আমি কৃতজ্ঞ, আজ যেভাবে বাচালেন আমায়। নিকাব খুলতে যাব দেখি উনি রুমে ঢুকলেন। তাড়াতাড়ি আবার পড়ে নিলাম।
— ভয় পাচ্ছেন নাকি?
— ভয় পাবো কেন?
— মনে হল। এই নিন ওষুধ, কাটা জায়গায় লাগিয়ে নিন। পারবেন তো? নাকি আমি সাহায্য করব আপনাকে? ওষুধটা কেড়ে নিয়ে বললাম,
— আমি পারবো।ধন্যবাদ।
— আচ্ছা। আপনার বোরকা আর নিকাব তো রক্তে ভিজে গেছে। এই নিন এসব ছেড়ে শাড়িটা পড়ে নিন। পরে অইগুলো শুকোলে আবার পড়ে নিবেন।
— শাড়ি পরলে সবাই আমার মুখ দেখে যাবে।
— আপনি এই যুগেও এমন কেন? শুনুন একটু সমস্যায় পড়েছেন, উদ্ধার পাওয়ার জন্য আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে। আমার স্ত্রী হওয়ার অভিনয়।
— অসম্ভব। আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
— আচ্ছা যান, পরে গ্রামবাসীরা আবার পিটুনি দিলে আমি কিন্তু কিছু জানিনা।
— ভয় দেখাচ্ছেন?
— ভয় পাচ্ছেন বুঝি?
— মোটেও না। আমি বেশীদিন অভিনয় করতে পারবনা।
— করা লাগবেনা। শুধু ২-৩দিন করলেই চলবে ওদের বিশ্বাস করার জন্য। তবেই এই গ্রামের সীমানা পার হতে পারবেন নতুবা ওরা আপনাকে গ্রাম থেকে বের হতে দিবেনা। আমাদের গ্রামের মানুষ এমনিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিছুদিন আগে একটা দাঙ্গা হয়েছিল। তারপর থেকে সবাই একটু সর্তক থাকে আর কি! অপরিচিত কাউকে দেখলেই তেড়ে আসে। যাই হোক, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। দরকার হলে ডাকবেন।
বলেই চলে গেল। বড্ড অদ্ভুত লোক দেখছি! কাটা জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পরে নিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক লাগছে এই প্রথম নিজের অন্যরুপ দেখছি। ঠিক মায়ের মত মুখটা লাগছে। মাম্মা কি দাদুর কাছে যেতে পারলো, জানতে ও তো পারলামনা।

দরজায় আবার কড়া পড়ল, নিশ্চয়ই ছেলেটা আবার এসেছে। এত্ত ছ্যাচড়া কেন ছেলেটা? বিপদে না পড়লে এর ছায়া ও মাড়াতামনা। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখি….
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here