জ্বীনকন্যা ২,পর্বঃ০৩

0
1958

জ্বীনকন্যা ২,পর্বঃ০৩
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

মেয়েটির শুকনো মুখটা দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। মুনতাহা ফিরে আসবে এটা ভাবতেই শান্তি পাচ্ছি। মেয়েটিও আজকাল আমার সাথে অত বকবক করেনা, খুব চিন্তিত চিন্তিত মনে হয়। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সাহসে কুলায়না। তাই আমিও দুরত্ব বজায় থাকি।
আবছা অন্ধকার রুমে এক প্রকট লম্বা সাদা জোব্বা পড়া সুন্দর বয়স্ক মানুষ দৃশ্যমান হয়ে রুমের কোণে থাকা ফণা তুলে থাকা সাপটার সামনে এসে বলল, ” তোমার চিন্তার কারণ আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এত ভেঙ্গে পড়োনা।”
সাপটি জিব দিয়ে হিসহিস শব্দ করল। বৃদ্ধ লম্বা লোকটি আবার চিন্তিত মুখে বলল,
— বাজ তোমার উপর নজর রাখছে সেটা আমিও জানি। সাবধানে থেকো, তুমিই শেষ ভরসা। আল্লাহ তোমার সাথে আছে চিন্তা করোনা। তাকে মন দিয়ে ডাকো।
তুমি তোমার লক্ষ্যের নিকটে আছো এটাই ভাবো। সাপটি ফণা নামিয়ে বৃদ্ধের পা ছুয়ে দিল মুখ লাগিয়ে। বৃদ্ধ সাপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে আছে মা। আল্লাহ তোমার ভালো করুক।
বলেই বৃদ্ধ আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। সাপটা নিজের আসল রুপ ধারণ করল আবার।
এমন সময় রুমের আলোটা জ্বলে উঠল। আতকে উঠল ছদ্মবেশ ধারণকারী। হাসনাত তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভয় পেলে নাকি জাদুকারিণী?”
নূরজাহান ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। হাসনাত তার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বলল, “তুমি তাহলে কোনো মানুষ নও। এতক্ষণ আড়াল থেকে এই দৃশ্য না দেখলে কখনো বুঝতে পারতামনা। এত নিখুঁত তোমার অভিনয়! এইবার ভালোয় ভালোয় বলে ফেলো কে তুমি? নূরজাহান এইবার ও কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুটতে লাগল। হাসনাত এসব খেয়াল করে রেগে গেল, ” বলো তুমি কে? কি উদ্দেশ্যে এইখানে এসেছো? কার ক্ষতি করতে! নাকি আমাকে মেরে ফেলার জন্য?” নুরজাহান আস্তে করে উত্তর দিল, কোনোটাই না।
— তাহলে কেন এসেছো বলো? কি তোমার আসল পরিচয়? চুপ না থেকে বলো নতুবা তোমার কপালে দুঃখ আছে। যত বড় জাদুকারিণী হও তুমি, আল্লাহর কালামের কাছে তোমার সব তুচ্ছ। নুরজাহান ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল।
মিসেস নিষ্পাপ আহমেদ জানালার পাশে বসে এক দৃষ্টে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখটা হালকা ভিজে আছে, চশমা খুলে শাড়ির আচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলেন ভালো করে। ১৮ বয়সী একটা মেয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— মাম্মা তুমি এখানে বসে কি করছো? নিষ্পাপ নড়েচড়ে উঠে বলল,
— কিছুনা তো নওশিন মাম্মা। তুমি রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো?
— হোস্টেলে আবার ফিরে যেতে হবে মাম্মা। সামনে পরীক্ষা আছে তো।
— একা যাসনা। ওয়েট আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
— নাহ, মাম্মা। পাপা আমাকে দিয়ে আসবে। পাপা আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। মাম্মা আমি আসছি। নওশিনের কপালে নিষ্পাপ চুমু দিয়ে বলল,
— সাবধানে থেকো মাম্মা। গিয়ে মাম্মাকে কল দিয়ো সোনা।
নওশিনের চলে যাওয়ার দিকে নিষ্পাপকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সায়েম তার কাধে হাত রেখে বলল,কি এত ভাবছো? নিষ্পাপ সায়েমের বুকে মাথা রেখে বলল,
— নওশিনের মাঝে আমি নূরজাহানকে দেখতে পাই। জানিনা এখন আমার নূরজাহান কেমন আছে? ও চলে যাওয়ার কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল তাইনা!
— ভেবোনা নূরজাহান খুব ভালো আছে। ওর কথা আমারো খুব মনে পড়ে কিন্তু তোমাকে বুঝতে দেইনা, পাছে তুমি কষ্ট পাও। ও চলে যাওয়ার পর আমরা নওশিনকে এডপ্ট করেছি যাতে নূরজাহানের কষ্টটা ভুলে থাকতে পারি। কিন্তু তারপরও নুরজাহানকে আমরা ভুলতে পারিনি।
— ও না বলেছিল আমাদের কাছে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। ও তো জ্বীনকন্যা তাহলে কেন ও নিজের কথা রাখল না। এতবছরের ভালোবাসা, স্নেহ সে ভুলে গেল বলো? জ্বীনরা কি মানুষের ভালোবাসা বুঝে না! আমায় মিথ্যে শান্তনা দিয়েছিল সে।
— শান্ত হও নিষ্পাপ। ও তো আমাদের মেয়েই ছিল, আর আমাদের মেয়ে কখনো আমাদের কথা ভুলে যেতে পারেনা। দেখো একদিন ও ঠিকিই ফিরে আসবে।
— তোমার কথা যেন সত্যি হয়। আমার মৃত্যুর আগে আমি ওকে একবার চোখের দেখা দেখতে চাই। নাহলে যে আমার আক্ষেপ থেকে যাবে সায়েম, আমি মরেও শান্তি পাবোনা।
— চিন্তা করোনা, ও আসবে। সায়েমের ফোন বাজতেই ও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
— আসছি নিষ্পাপ। নওশিন অপেক্ষা করছে, আমার ফিরতে একটু দেরী হবে। নিজের খেয়াল রেখো। আর এসব নিয়ে একদম ভেবোনা।
— আচ্ছা এসো। সাবধানে যেও।

সায়েমকে বিদায় দিয়ে দরজা অফ করে কফির কাপে চুমুক দিতেই আবারল
কলিংবেলটা বেজে উঠল। এ সময় আবার কে এলো? সায়েম কি কিছু ফেলে গেছে নাকি? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলল নিষ্পাপ। অবাক হয়ে বলল,
— তুই এখানে তাও এইসময়। হাসনাত নুরজাহানের হাত ধরে বাসার ভেতরে ঢুকল।
নিষ্পাপ অবাক হয়ে বলল, কিরে? খবর না দিয়ে এলি যে! আর ওকেই বা……
— খালামণি, তুমি কি ওকে চিনো?
— এই প্রশ্ন কেন করছিস? ও তো তোর বউ না চেনার কি আছে! তোদের বিয়েটা তো আমি নিজেই দিয়েছিলাম।
— ওর আগের পরিচয় তুমি জানো? আগে থেকে চিনতে ওকে?
নিষ্পাপ নুরজাহানের দিকে তাকাল। ভয়ার্ত চেহারা, খুব ভয় পেয়ে আছে বেচারী।
— কিছু কি হয়েছে তোদের মধ্যে?
— সবটা বলছি আগে তুমি বলো। নিষ্পাপ আরেকবার তার দিকে তাকিয়ে বলল,
— না, আমি ওকে চিনিনা। তোর বিয়ের সমন্ধের খোজ করতেই ঘটক ওর কথা বলল। বেচারী গ্রামে থাকে সৎ বাবার কাছে। তিনকুলে আপন বলতে কেউ নেই। আমার ওকে বড্ড সরল মনে হয়েছিল, ভেবেছিল তোর জন্য খুব ভালো হবে। কিন্তু এখন কি কিছু হয়েছে? মেয়েটা কি খারাপ!
— এইসবের অনেক উর্ধে ও। ও মানুষ নয় খালামনি, ও একটা খারাপ জাদুকারিনী।
ছদ্মবেশে কারো না কারো ক্ষতি করতে এসেছে। কালরাতে আমি নিজের চোখে ওকে সাপ থেকে মানুষ হতে দেখেছি। এর আগেও বাজের সাথে ওকে যুদ্ধ করতে দেখেছি, সেদিন ওর শরীরে বাজের আঁচড়ের দাগ ছিল।
নিষ্পাপ আঁতকে উঠল এসব শুনে। কি বলছে হাসনাত এসব! এত সরল একটা মেয়ে কি করে এমন হতে পারে।
— তুই কি নিশ্চিত হয়ে বলছিস হাসনাত? ওর মত মেয়ে একজন জাদুকর!
— হ্যা খালামনি। আমি সত্যি বলছি, সবটা আমার নিজের চোখে দেখা।
নিষ্পাপ নুরজাহানের গাল শক্ত করে ধরে বলল, “কে তুই বল? আমার হাসনাতের কাছে এসেছিস?”
— কাল রাত থেকে আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি খালামণি। উত্তর দিচ্ছেনা একদমি।একে এভাবে হবেনা, অন্য উপায় খুজতে হবে। কোনো বড় হুজুর ডেকে ওর জাদুশক্তি নষ্ট করতে হবে।

নূরজাহান চোখ মুছে বলল, “আমি কোনো জাদুকারিণী নই।” হাসনাত বলল,
— তাহলে কে তুমি? একদম মিথ্যে বলবানা।
নিষ্পাপ হাসনাতের সামনে হাত জোড় করে বলল, “তোর খালামণি তোর এত বড় ক্ষতি করছে সেটা জানত না রে। সত্যিই আমি জানতামই ও একটা ডাইনী। তোর মা মারা যাওয়ার আগে আমার কাছে তোর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোর বাবা তোকে নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের আধারে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। কত খুজেছিলাম তোদের আমি। অনেক বছর পর তোকে আমি আল্লাহর ইচ্ছেতে খুজে পেয়েছি। তোর মা হিসেবে তোকে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছি।
কিন্তু আমার এই সিদ্ধান্তে তোর জীবন সংশয় হবে সেটা আমি জানতামনা রে।
— আমি জানি তো খালামণি। আমাদের ঠকানো হয়েছে, ও নিজের বড় কোনো উদ্দেশ্য পূরনের জন্য প্ল্যান করে এসব করেছে। ওকে তো আমি ছাড়বনা।
তুমি তাহলে ভালোই ভালোই বলছো না তুমি কে!
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here