জ্বীনকন্যা ২,পর্বঃ০৪

0
1963

জ্বীনকন্যা ২,পর্বঃ০৪
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

নূরজাহান আস্তে করে বলল, “আমি কোনো জাদুকারিণী নই। এটুকু বিশ্বাস করুন।”
হাসনাত রেগে ধমক দিয়ে বলল, “তখন থেকে একি কথা বলে যাচ্ছো! আসল পরিচয় বলো, কে তুমি? কি উদ্দেশ্য তোমার!” নিষ্পাপ হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
— এভাবে হবেনা। এক কাজ কর, তুই বড় কোনো হুজুরকে ডেকে নিয়ে আয়।
তারা চলে যেতে উদ্যত হলে নূরজাহান তাদেরকে পিছু ডাকল, “মাম্মা।”
নিষ্পাপ আর হাসনাত নূরজাহানের দিকে তাকাতেই দেখল এক অন্য চেহারার মেয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাসনাতের অস্পষ্ট স্বরে বলল, “মুনতাহা!”
নিষ্পাপ হাসনাতের কথা শুনে বলল, “কে ও? চিনিস তুই? এই তো দেখছি অন্য মেয়ে।” হাসনাত হাসিমুখে নিষ্পাপের হাত ধরে বলল,
— খালামণি ও ই আমার সেই হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা।
— একজন বহুরুপী কি করে তোর ভালোবাসা হয় হাসনাত?
— ও বহুরুপী নয়, ও জ্বীনকন্যা মুনতাহা। জ্বীন মুস্তফা আর মনুষ্যকন্যা মুশায়রার একমাত্র মেয়ে ও। ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ও আমার পুরোনো গ্রামে এসেছিল, পরে ওর শত্রুকে ধবংস করে ওর মা-বাবার সাথে ও জ্বীনজগতে ফিরে যায়। আমাকে বলেছিল ও একদিন ফিরবে, দেখো ও ফিরেছে!
নিষ্পাপ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে নুরজাহানকে প্রশ্ন করে,
— তুই কি আমার সেই ছোট্ট নূরজাহান? যে কথা দিয়েছিলি একদিন ঠিক তুই তোর মাম্মার কাছে ফিরবি। নূরজাহান নিষ্পাপকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— হ্যাঁ মাম্মা, আমি তোমার সেই ছোট্ট নূরজাহান। তোমার আমাকে মনে আছে মাম্মা?
— তোকে মনে থাকবেনা, তুই তো আমার মেয়ে। পেটে না ধরতে পারি, ৬টি বছর বুকে ধরে মানুষ তো করেছি। কত্ত বড় হয়ে গেছিস তুই! হাসনাত না বললে তো আমি চিনতেই পারতামনা। তুই ফিরে আসবি এই অপেক্ষায় এখনো দিন গুনি।
হাসনাত অবাক হয়ে মুনতাহা আর নিষ্পাপের জড়িয়ে ধরে কান্না দৃশ্য দেখছে। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, “খালামনি তুমি মুনতাহাকে কি করে চিনো?”
নিষ্পাপ চোখ মুছে সবটা খুলে বলল। হাসনাত চুপ করে ভাবতে লাগল, এত্তটা কাকতালীয় কি করে হতে পারে?” নিষ্পাপ মুনতাহাকে পাশে বসিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “এতদিন পর তোর মাম্মার কথা মনে পড়ল? তুই জানিসনা তোর মাম্মা তোকে কত ভালোবাসে?” মুনতাহা নিষ্পাপের হাত জড়িয়ে বলল, “হুম পড়েছে তো।”
নিষ্পাপ গম্ভীর হয়ে বলল, “আসল মাম্মা-পাপাকে পেয়ে আমাদেরকেই ভুলে গেলি। আমাদের ভালোবাসার কোনো দামই রইলনা তোর কাছে।”
— এসব বলছো কেন মাম্মা! বিশেষ কারণে তোমার কাছে আসতে পারিনি। কিন্তু তোমাকে খুব মিস করেছি। খুব ভালোবাসি তোমাদেরকে।
হাসনাত হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসল, “তুমি ছদ্মবেশে কেন এলে?” প্রশ্ন শুনে মুনতাহা চমকে উঠল। হাসনাতকে এক নজর দেখে বলল, “সবাই মনে রেখেছে কিনা তা দেখতে!” হাসনাত লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আসলে মুনতাহা ওকে ভুল বুঝারই কথা। যে কারণেই হোক ও তো মুনতাহার ছদ্মবেশকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু এটা ভেবেই খুশী লাগছে, এখন থেকে মুনতাহা ওর বিয়ে করা বউ। কেউ ওকে আর কেড়ে নিতে পারবেনা।এইবার মুনতাহাকে নিজের কাছে সারাজীবনের জন্য বন্দি করে রাখতে পারবে। সে যে খুব ভালোবাসে মুনতাহাকে।
মুনতাহা রাতে ব্যালকুনিতে একা ঠায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। হাসনাত পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— কি ব্যাপার আমার বউটা? কি করা হচ্ছে শুনি। মুনতাহা হাসনাত কে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কিছুনা।” হাসনাত মুনতাহার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো যে? খালামনির বাসা থেকে আসার পর থেকে দেখি তোমার মন খুব খারাপ।কিছু হয়েছে বলো?
— নাহ তেমন কিছুনা। হাসনাত মুনতাহার হাত ধরে বলল,
— এখনো আমার উপর রাগ করে আছো? বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছাড়া অন্য মেয়ের কথা ভাবতেই পারিনা। যা হয়েছে তার জন্য ভীষন স্যরি। বলে মুনতাহার ঠোটের দিকে এগিয়ে এলো। মুনতাহা ওকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
— একদম আমার কাছে আসবেনা তুমি। আমি তোমাকে ভালোবাসিনা।
হাসনাত হাতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে পড়ে গিয়ে। হাতটা বুলাতে বুলাতে বলল,
— এসব কেন বলছো মুনতাহা? আমি তো তোমার স্বামী।
— কিসের স্বামী? আমি এই বিয়েটা জাস্ট একটা কারণে করেছি, তার মানে এই না যে আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি। চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে, প্লীজ। হাসনাতের গাল বেয়ে চোখের পানির গড়িয়ে পড়ল।
— মুনতাহা! তুমি কি সত্যিই….
— প্লীজ আমাকে একা থাকতে দাও। যাও এখান থেকে। হাসনাত কিছু না বলে নিঃশব্দে ব্যালকুনি থেকে চলে গেল। ধপ করে মুনতাহার চোখগুলোতে লাল আলো জ্বলে উঠল। হিংস্রতায় ওর কোমল মুখটা কঠিন হয়ে গেল।
হাসনাত কাদতে কাদতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আয়নার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ঝরণাটা ছেড়ে দিল। ছেলেদের নাকি কাদতে নেই কখনো, কিন্তু হাসনাত আজ কান্না থামাতে পারছেনা। ঝরণার ঠান্ডা পানির আড়ালে আর কান্নাও মুছে যাচ্ছে।
কেন ওর সাথে এমন হচ্ছে সে? ওর কি দোষ! কিসের জন্য এত শাস্তি পাচ্ছে ও!
মুনতাহা ব্যালকুনি থেকে রুমে আসল। তার গালের একপাশে লাল রক্তের ছাপ লেগে আছে।হাসনাত দেখে তার কাছে ছুটে এসে বলল,
— মুনতাহা তোমার গালে কি হয়েছে?
— কিছুনাহ। বলে মুনতাহা সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। হাসনাত ব্যালকুনিতে এসে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মেঝেতে কিছু রক্ত আর ছেড়া কিছু পালক পড়ে আছে। এইগুলো তো বাজপাখির পালক। তার মানে কি আবার মুনতাহা আর বাজের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কে এ বাজপাখি! বার বার কেন মুনতাহার উপর এভাবে আক্রমণ করছে? একটা পালক তুলে নিয়ে হাসনাত রুমে চলে এল। মুনতাহা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই হাসনাত জিজ্ঞেস করল,
— বাজপাখিটা আসলে কে? তোমার উপর বার বার এভাবে আক্রমন ই বা কেন করছে? মুনতাহা আমার হাত থেকে পালক কেড়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর নিচে বিছানা করে তাতে শুয়ে বলল,
— আমার কোন ব্যাপারে নাক গলাবা না তুমি। আর কখনোই আমাকে এত প্রশ্ন করবেনা।
— ঠিক আছে কিন্তু তুমি উপরে বেডে এসে ঘুমাও। নিচে শুয়েছো কেন?
— তোমাকে কি বললাম শুনোনি? আমাকে এভাবে বিরক্ত করতে থাকলে আমি এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হব।
— প্লীজ যেয়োনা। স্যরি তোমাকে আমি আর বিরক্ত করবনা, তুমি যা বলবে তাই হবে।
হাসনাত আর কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। মুনতাহা চলে গেলে আর ফিরবেনা। ওকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলব। তার চেয়ে ও আমার চোখের সামনে থাকুক, আমি ওকে আর বিরক্ত করবনা। তাও ও আমার কাছেই থাকুক।

হাসনাত সকাল সকাল অফিসে চলে গেল মুনতাহার ঘুম ভাঙ্গার আগে। যতটা সম্ভব মুনতাহাকে বিরক্ত না করার চেষ্টা করছে। কালকে রাতের কথাগুলো এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে হাসনাত রুমে এসে দেখল মুনতাহা রুমে নেই। সারা বাসা ভালো করে খুজেও মুনতাহাকে পেলনা। মুনতাহা কি সত্যি ওর উপর রাগ করে চলে গেছে? আর কখনোই ফিরবেনা আমার কাছে! এত্ত ভালোবেসেও আটকে রাখতে পারলামনা ওকে। ভেবেই হাসনাতের প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মত এইদিক সেদিক ঘুরতে লাগল, মরে যাওয়ার বড্ড শখ হচ্ছে। এশার আযানের পর রুমে ঢুকল সে। এসে দেখে মুনতাহা মোনাজাত ধরে কাদছে।
এমন দৃশ্য দেখে হাসনাত আর রুমে ঢুকল না। দরজার আড়ালে দাড়িয়ে মুনতাহাকে দেখতে লাগল। মুনতাহা মোনাজাতে কেদে কেদে বলছে,
” আল্লাহ, তুমি আমাকে পথ দেখাও। এই অসহায়ের শেষ সম্বল তুমি। আমি আর পারছিনা আল্লাহ। এসব কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছেনা। আল্লাহ তুমি পারোনা, আমাকে আমার মা-বাবার কাছে নিয়ে যেতে। নিয়ে যাওনা আমায়, আমি আর পারছিনা এভাবে থাকতে। কতদিন মাকে জড়িয়ে ধরিনি, বাবার আদর পাইনি। আমাকে উনাদের কাছে নিয়ে যাওনা।”
মুনতাহা ফিরে যেতে চাইছে শুনে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। মুনতাহাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবনা ঠিকি কিন্তু ওকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারছিনা। যেহেতু ও এখানে অসুখী, তাহলে তো ওকে আমার মুক্তি দেওয়া উচিত।
হয়তো আমার খুব কষ্ট হবে, কিন্তু আমার মুনতাহা তো ভালো থাকবে।
মুনতাহা নামায শেষ করে উঠতেই আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। চোখের পানি মুছে বললাম, “তোমাকে কিছু বলার ছিল।”
— হুম বলো।
— আমি জানি এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি আমার কাছে মোটেও সুখী নও, তাই তুমি চাইলে তোমার মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পারো। আমার কষ্ট হলেও আমি তোমাকে আটকাবনা। তুমি ফিরে যাও। তোমাকে এখানে আটকে রেখে কষ্ট দিতে থাকলে তোমার মা-বাবাও আমাকে ক্ষমা করবেনা।
মুনতাহা এসব শুনে চুপ করে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর সজোড়ে আমাকে একটা থাপ্পড় দিল। অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট।
বলেই হুড়হুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
হাসনাত বুঝতে পারলনা তার অপরাধ টা কি! কেন মুনতাহা তার সাথে এমন ব্যবহার করছে!
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here