জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ০৭
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা
মুনতাহা মাটিতে লুটিয়ে কাদতে লাগল। এমনটা হতে পারে সে কল্পনাও করতে পারেনি, তার অসহায়ত্বের সুযোগ এভাবে নিচ্ছে ও! কান্না থামিয়ে চোখমুখ কঠিন করে বলল, “একবার যদি আমি তোকে পাই, এমনভাবে শাস্তি দিব যে কেউ শুনলেই কেপে উঠবে। তুই আমার সব শেষ করে দিচ্ছিস। আমার আল্লাহর কসম তোকে আমি কিছুতেই ছাড়বনা। আমার হাতেই তুই শেষ হবি।” এমন সময় একটা নেকড়ে তার সামনে এসে দাড়াল। তার রুপ বদলে একটা শয়তানের বেশ নিল। মুনতাহা রাগে ফেটে ওঠে বলল,
— এসব তোরই কাজ তাইনা? তুই ই আমার হাসনাতকে ফেলে দিয়েছিস।
— তোর সর্বনাশ তো সবে শুরু জ্বীনকন্যা। আমাদের ওস্তাদকে শেষ করার কথা ভাবিস। দেখ তোকে কি করে তিলে তিলে শেষ করে সে!
বলেই শয়তানটা অট্টহাসি তে ফেটে পড়ল। মুনতাহাকে যে করে হোক এই শয়তানটাকে মেরে ফেলতে হবে। নাহলে সে বুঝে যাবে আমার নিকট এখন কোনো শক্তিই নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে পাশে পড়ে থাকা জ্বলন্ত মোমবাতিটা চোখে পড়ল। ওইটা নিয়ে “আল্লাহু আকবর” বলে শয়তানটার দিকে ছুড়ে মারলাম। আল্লাহ আমার সহায় হয়েছে, মুহুর্তেই শয়তানটা ভস্ম হয়ে গেল।
সামান্য আগুনে এমন হওয়ার কথা ছিলনা, কারণ ওরা সবচেয়ে দুর্বলজ্বীনদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে পাহাড়ের বুকে। চারিদিকে ঝি ঝি পোকার একটানা ডাক, তাতে মুনতাহার আর্তনাদ গুলো ক্রমশ ছোট হয়ে পড়েছে।
চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে একটা সুন্দর রুমে আবিষ্কার করলাম। রুমটা চেনা চেনা লাগছে। উফফ! মাথাটা কেমন যেন চিনচিন করে উঠল। পুরো শরীরে অনেক ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কষ্ট করে উঠে বসতেই দরজা খুলে একটা মেয়ে ঢুকলো।
পাশে বসে বলল, “কেমন আছেন এখন?”
— জ্বী কিছুটা ভালো। কিন্তু আপনি কে? আমি এইখানেই বা কি করে!
— সেসব কথা পরে হবে, আপনি এখন ওষুধটা খেয়ে নিন। আচ্ছা আপনার বাসা কোথায়? বলুন আমি পৌঁছে দেব। এমনসময় নিষ্পাপ আহমেদ রুমে ঢুকল।
” নওশিন, তুমি যে বললে কাল রাতে কাকে যেন পেয়ে হাসপাতালে এনেছো। সে কোথায়?” বলেই যে মুখ তুলল, অবাক হয়ে বলল, “হাসনাত তুই?” নওশিনের দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ বলল, তুই হাসনাতকে কোথায় পেলি?
— মাম্মা, তুমি ওকে চিনো?
— ও আমার বোনের ছেলে। কাল বিকেলে ওর এইখানে আসার কথা ছিল। তুই ওকে কোথায় পেলি? কি হয়েছে ওর! আমার নুরজাহান ই বা কোথায়?
— মাম্মা, রাতে যখন আমি বাসার দিকে আসছিলাম তখন পাহাড়ি রাস্তায় আমি উনাকে একটা গাছের সাথে আটকে থাকতে দেখি। পরে কাছে গিয়ে দেখি উনি বেচে আছেন তবে মাথায় খুব চোট পেয়েছেন। তাই আমি এট ফাস্ট হাসপাতালে এনেছি।
ডাক্তার বলেছেন চোট সারতে সময় লাগবে। আর আমি উনার সাথে কাউকে দেখিনি, কিন্তু…. নিষ্পাপ হাসনাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— তোর কি হয়েছিল বাবা? দাড়া আমি নূরজাহানকে একটা খবর দেই। বেচারীকেও তো কাল থেকে ফোনে পাচ্ছিনা। তুই বিশ্রাম নে, নওশিন ওর খেয়াল রাখ। আমি পরে আসছি।
বিকেলে নওশিন হাসনাতকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে নিজের বাসায় নিয়ে এল। বাসায় নিষ্পাপকে কোথাও দেখলনা, কোথায় গেল মাম্মা! হাসনাতকে রুমে নিয়ে বসাতেই রুমের একটা সুশ্রী মেয়ে ঢুকল। হাসনাতকে জড়িয়ে কাদতে লাগল,
— কি হয়েছে তোমার হাসনাত? আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন, তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাননি। এখন তুমি কেমন আছো? জানো আমি তো বাচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাম্মা আমাকে বাসায় গিয়েই যেই বলল, তুমি বেচে আছো। আমি দেরী না করে তোমার কাছে ছুটে এসেছি।
হাসনাত অবাক হয়ে বলল, “কে আপনি? আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরছেন কেন! প্লীজ ছাড়ুন আমার অস্বস্তি লাগছে।”
— হাসনাত তুমি আমাকে চিনতে পারছোনা? আমি মুনতাহা, তোমার বিবাহিত স্ত্রী।
হাসনাত মাথা চেপে ধরে নওশিনকে বলল, আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, প্লীজ আপনি উনাকে এখান থেকে নিয়ে যান।” নওশিন এতক্ষণ অবাক হয়ে এসব দেখছিল। হাসনাতের কথা শুনে মুনতাহাকে বলল, “আপি চলুন আমরা বাহিরে যাই, উনি এখনো অসুস্থ। বিশ্রাম করুক।”
নিষ্পাপ মুনতাহার কাধে হাত রাখতেই মুনতাহা চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিষ্পাপের দিকে তাকাল। নিষ্পাপ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
— ঘর অন্ধকার করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
— মনটা খুব খারাপ মাম্মা!
নিষ্পাপ মুনতাহাকে বুকে টেনে বলল, চিন্তা করিসনা। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। অত উচু থেকে পড়ে মাথায় খুব জোর চোট পেয়েছে তাই সাময়িক স্মৃতি ভ্রম হয়েছে। তুই যদি ভেঙ্গে পড়িস, তাহলে কি করে হবে? তুই তো সাধারণ মেয়ে নস, তুই তো জ্বীনকন্যা। মুনতাহা সরে পড়ে কেদে কেদে বলল,
— সেটাই আমার সব থেকে বড় অপরাধ মাম্মা। কেন সাধারণ মেয়ে হলামনা, তাহলে এত লড়াই আসত না আমার জীবনে। বড্ড কষ্ট হয় মাম্মা অন্য মেয়েদেরকে দেখলে কেমন স্বামীর সাথে সুখে সংসার করছে, ফুটফুটে বাচ্চা সামলাচ্ছে।
আর আমার কপালে না জুটছে স্বামীসুখ, না নিজের……
— কাদিস না মাম্মা। তুই কি চাইলে মানুষের মত টিকে থাকতে পারবিনা!
— না মাম্মা, সেটা হয়তো আদৌ কখনো সম্ভব না। আমি জানিনা আমার পরিণতি কি হবে! এই দুনিয়াটা আমার জন্য সেটা আমি বুঝে গেছি।
আমি শুধু চাই আমার জন্য হাসনাত বা তোমাদের জীবনে কোনো বিপত্তি না নেমে আসুক। এখন আমার নিজের বলতে শুধু তোমরাই আছো।
— তোর আসল মাম্মা-পাপা! ওরা কোথায়? তুই কেন ই বা ওদেরকে ফেলে এই বিপদের দুনিয়ায় আসতে গেলি? নিজের শান্তি তো নিজেই নষ্ট করলি, একটা ভালো জ্বীন কে বিয়ে করে কতই না সুখে সংসার করতি।
— সেটা আমার কপালে ছিলনাহ মাম্মা। আর এটাও সত্যি যে, আমিও হাসনাত কে ভালোবেসে ফেলেছিলাম
— আমার সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে, কি হবে তোর জীবনে!
— যা হওয়ার তা হবে। তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার এখনো বেচে থাকার একটাই কারণ সেটা হলো শত্রুকে শেষ করা।
— কে তোর শত্রু? সেই বদজ্বীনের সর্দারনী!
মুনতাহা কিছু বলার আগে দরজার সামনে কারো ছায়া দেখে । “কে ওখানে” বলতেই ছায়াটা সরে যায়। নিষ্পাপ বলল, কি হয়েছে নূরজাহান?
— মাম্মা, ওখানে কেউ ছিল। কেউ লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিল।
— কই কাউকে তো দেখছিনা।
— সরে গেছে আমার গলার আওয়াজ পেয়ে। ছাড়ো ওসব, তুমি বরং হাসনাতকে খাইয়ে দিয়ে এসো। আমাকে তো ও আলাউ করছে না, তুমিই যাও।
নিষ্পাপ মুনতাহার কপালে চুমু খেয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
.
(চলবে)