জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ০৮

0
2210

জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ০৮
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

নিষ্পাপ মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেল। এত্ত কষ্ট মেয়েটার, তাও কাউকে বুঝতে দেয়নাহ। কেন এমন হয় মেয়েটার সাথে! মাথার মধ্যে হাজার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, হাসনাতের রুমে ঢুকতেই দেখে হাসনাত ঘুমিয়ে পড়েছে, নওশিন হাসনাতের গায়ে চাদর টেনে দিল। মাকে দেখে নওশিন আস্তে করে বলল, “আমি উনাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। তুমি চল, উনাকে ঘুমাক। তোমার সাথে কিছু কথা আছে, এসো।”
নওশিন নিষ্পাপকে টেনে ছাদে নিয়ে চলে এল। নিষ্পাপ বলল,
— কি ব্যাপার এত রাতে ছাদে নিয়ে এলি কেন?
— কিছু জানার ছিল তোমার থেকে!
— কি জানতে চাস?
— মেয়েটা আসলে কে? এমন কথা শুনে নিষ্পাপ ঘাবড়ে গেল।
— কে মানে কি? ও হাসনাতের বিয়ে করা বউ। হাসনাত ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, আমিই ওদের বিয়ে দিয়েছি। তখন তো তুই হোস্টেলে থাকতি, বাসায় বছরে একবার আসতি।তাই হাসনাতের কথা তুই জানিসনা।
— সেটা আমিও বুঝতে পারছিনা। কিন্তু মেয়েটা তোমার কে হয়? তোমাকে মাম্মা কেন ডাকে? কি সম্পর্ক ওর তোমাদের সাথে?
— তোর কি হিংসে হচ্ছে নওশিন?
— ছিহ মাম্মা এসব কি বলছো? আমি শুধু জানতে চাচ্ছি মেয়েটা তোমাকে মাম্মা কেন ডাকে? হাসনাত ভাইয়ার ওয়াইফ হলে তো তুমি ওর খালাশ্বাশুড়ি হও।
নিষ্পাপ কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নওশিনকে যদি পুরো ঘটনা টা বলি তাহলে ও নিজেও জেনে যাবে ওকে আমি এডপ্ট নিয়েছি। তাতে ওর নিজের কাছেই ব্যাপার বড্ড আঘাতজনক হয়ে যাবে।
আর নূরজাহান যে জ্বীনকন্যা সেটা জানলে ও ভয় পেয়ে যাবে, কাহিনী অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। ওকে সবটা না বলাই ভালো।
— কি ভাবছো মাম্মা? দেখো আমাকে মিথ্যে বলোনাহ।
— নুরজাহানকে আমি এডপ্ট নিয়েছিলাম তোর জন্মের আগে। পরে ও মাম্মা-পাপার সন্ধান পেয়েছিল, তাদের কাছেই ফিরে গিয়েছিল।
— ও ফিরে এসেছে যে!
— ও জানতোনা হাসনাত আমার বোনের ছেলে। ইন ফ্যাক্ট আমি আর হাসনাত ও জানতামনা। আমার বোন মারা যাওয়ার পর হাসনাতের বাবা ওকে নিয়ে কোথাও চলে গিয়েছিল কিছু মাস আগেই ঘটনাক্রমে আমি হাসনাতকে পাই।
— হুম বুঝলাম। কিন্তু…
— আর কোনো কথা নাহ। দেখ অনেক রাত হয়ে গেছে, চল খেয়ে শুয়ে পড়বি। আয়।
বলে নিষ্পাপ কোনো রকমে সেখান থেকে পালিয়ে এল। নওশিন আরো কিচ্ছুক্ষণ চিন্তিত মুখে ছাদে পায়চারি করে নিচে নেমে গেল।
মুনতাহার চোখে ঘুম নেই, পুরো ঘরে পায়চারি করছে, কখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এমন থাকার পর রুম থেকে বেরিয়ে এসে হাসনাতের রুমের দিকে এল মুনতাহা। আস্তে আস্তে দরজা খুলে দেখে হাসনাত গভীরঘুমে আচ্ছন্ন। ধীরপায়ে এসে হাসনাতের মাথার কাছে বসল, মাথায় হাত বুলাতে লাগল। পুরোনো কথা ভেবেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগল অনবরত।
” এতদিন কত কাছে ছিল হাসনাত ওর, অনিচ্ছাকৃত ভাবে তার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছি । সেসব তোহ ওর ভালোর জন্যই করেছিলাম। এখন বুঝি এভাবে তার শোধ নিচ্ছো মি. ছ্যাচঁড়া?” ভাবতে ভাবতে গাল বেয়ে মুনতাহার চোখের পানি হাসনাতের মুখে পড়ল। হাসনাতের শরীর নাড়া দিয়ে উঠল, চোখ খুলে দেখে মুনতাহা তার মুখের খুব কাছে বসে কাদছে। ধড়পড়িয়ে উঠে বসল হাসনাত, তাতে হাতে একটু ব্যথা পেল। “আউচ” করে শব্দ করে উঠল হাসনাত। মুনতাহা চোখের পানি মুছে হাসনাতের হাত ধরে বলল, “খুব লেগেছে?”
হাসনাত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আপনি এইখানে কেন এসেছেন?”
— তোমাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছিল তাই এলাম।
— আপনার কি সামান্য কমনসেন্স বা লজ্জা নেই? এতবার বারণ করলাম আপনি আমার সামনে আসবেননাহ। আপনাকে দেখলে আমার মাথা প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছিড়ে যায়। আমার যদি ভালো চান, দয়া করে আমার সামনে আসবেননা।
আর এই মূহুর্তে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।
— হাসনাত আমি চাইনা তোমার কষ্ট হোক। তোমার সব কষ্টের কারণ ও আমি সেটা আমি জানি। কিন্তু আমার একটা কথা শোনো।
— আপনি কি ভদ্রভাষায় রুম থেকে বের হবেন নাকি সবাইকে ডেকে আপনার কীর্তিকলাপ দেখাব? দেখতে তোহ ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হয়, কিন্তু চরিত্র এত বাজে কেন আপনার?
মুনতাহা এসব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ঠোঁট কাপতে থাকে ওর, কিন্তু কিছু বলার মত অবস্থা ওর নেই। ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের খাটে শুয়ে হু হু করে কাদতে থাকে। নওশিন নূরজাহানকে এভাবে ছুটে বেরিয়ে যেতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার মানে হাসনাতের উচ্চস্বরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। নওশিন দরজা ঠেলে হাসনাতের রুমে ঢুকে, হাসনাত বিরক্তিমুখে বসে আছে।
— কি হয়েছে আপনার? ওভাবে আউচ করে শব্দ করলেন যে?
— মেয়েটিকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম, তাড়াহুড়া করে উঠে বসতে গিয়ে হাতে লেগেছে। জাস্ট ননসেন্স গার্ল!
— এভাবে বলছেন কেন? উনি তো আপনার স্ত্রী।
— উনি আমার স্ত্রী? উনাকে তো আমি চিনিও নাহ, কোনোদিন দেখেছি বলে মনে হয়নাহ। কিন্তু উনাকে দেখলে আমার মাথায় সুচ ফুটানোর যন্ত্রণা হয়।
— আচ্ছা ওসব থাক। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি যাচ্ছি, শুভ রাত্রি।
হাসনাত নওশিনের হাত চেপে ধরল। নওশিন অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই হাসনাত কোমল স্বরে বলল, “আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবেন? না হলে ঘুম আসবেনা বোধহয়! আসলে আর তো কেউ নেই এইসময়, তাই আপনাকে একটু কষ্ট দিচ্ছি” নওশিন না করতে গিয়েও বললাম, আচ্ছা শুয়ে পড়ুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। নওশিন আলতোভাবে হাসনাতের মাথা ম্যাসাজ করে দিল, খানিকটা পরে হাসনাত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

সকালে নূরজাহান রেডি হতে দেখে নিষ্পাপ প্রশ্ন করল, “কোথাও যাচ্ছিস মাম্মা?”
নূরজাহান নিকাবটা বেধে নিয়ে বলল, “একটু কাজ আছে মাম্মা! আর হাসনাতের জন্য একটা ডা. নিয়ে আসব মাম্মা। এভাবে যে আমি আর থাকতে পারছিনা।”
— তুই কেন যাচ্ছিস! আমি তোর পাপাকে বলে দিই, ও ই নিয়ে আসবে।
— না মাম্মা আমার সত্যি ই কাজ আছে। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব, তুমি হাসনাতের দিকে খেয়াল রেখো।
— তাড়াতাড়ি ফিরিস মাম্মা। কিন্তু ব্রেকফাস্ট করবিনা?
— নাহ মাম্মা, পরে করে নিব। টেনশন করোনাহ।
যাওয়ার সময় নওশিনের সামনে পড়ল মুনতাহা। নওশিন একপলক তাকিয়ে বলল,
— কোথাও যাচ্ছো আপু?
— হুম একটু কাজ ছিল।
— এভাবে অসুস্থ স্বামীকে একা ফেলে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে আপি?
— তা ঠিক হচ্ছেনা। কিন্তু কাজটা আমার খুব জরুরী। আসি আপি।
নওশিনের পাশ কাটিয়ে মুনতাহা বেরিয়ে গেল।নওশিন এক দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখল। মেয়েটা কেমন জানি, অনেকটা আলাদা। এত্ত কেয়ারলেস মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। কাল সারাদিন স্বামী স্বামী করে শোক করছিল আজ কোনো প্রকার ফর্মালিটি ছাড়া স্বামী কে রেখে চলে গেল।এসব উটকো মেয়েদের জন্যই মেয়ে জাতির এত বদনাম, জাস্ট বোরেড। এসব ভাবতে ভাবতে নওশিন হাসনাতের রুমে গেল। হাসনাত আনমনে বসে কি ভাবছিল।
— এখন কেমন বোধ করছেন? হাসনাত চমকে উঠে বলল,
— জ্বী ভালো। আপনি কেমন আছেন?
— আমিও ভালো আছেন। তা আপনার কিছু মনে পড়ল?
— নাহ, কিছুই ভালো করে মনে পড়ছেনা। ভাবতে গেলেই মাথা পেইন হচ্ছে
— এত প্রেশার নিবেননা! আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে যাবে।
— আপনার স্ত্রী কি আপনার সাথে দেখা করে গেছেন?
— নাহ তো। কোথায় গেছেন তিনি?
— দেখলাম বেশ তাড়া নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে গেছেন। হাসনাত উপহাসের হাসি হেসে বলল,
— আমাকে কেন দেখে যাবেন! আর উনাকে স্ত্রী হিসেবে মানিও নাহ। শুধু তার অভিনয় গুলো দেখে নিলাম, বোরিং একটা মেয়ে।
— শত হলেও আপনার স্ত্রী।
— ন্যাকা টাইপের মেয়ে আমার খুব অপছন্দ। আর উনি এই ক্যারেক্টারে পড়েন।
— কেমন টাইপের মেয়ে পছন্দ আপনার?
— টু মাচ কেয়ারিং, ডিসেপ্লেন্ড এবং অনেক ভালো ঠিক আপনার মত।
নওশিন একটু অস্বস্তি বোধ করল। মুচকি হেসে বলল, আচ্ছা আমি আসছি।

মুনতাহা জঙ্গলের খানিকটা ভেতরে চলে এল হাটতে হাটতে। এই জঙ্গলের কোথাও না কোথাও বড় জ্বীন হুজুর আছেন, জোব্বা পড়া হুজুর তো তাই বললেন। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে হেটেই চলেছে।কিন্তু কোনো পুরোনো মসজিদ তো তাদ চোখে পড়ল না। গাছের নিচে বসে চোখ বুজে আরেকবার জোব্বা পড়া হুজুরের সেইকথা মনে করার চেষ্টা করল।
“মা, তোর লক্ষ্যে পৌছানোর একটা পথ অবশ্য আছে।সেটা বড়ই কঠিন। উত্তরের পাহাড়ি জঙ্গলে এক পুরোনো মসজিদে বড় জ্বীনহুজুর থাকেন, যে তোকে কিছু না কিছু একটা উপায় ঠিক বাতলে দিতে পারবেন। জ্বীনজগত থেকে একটা কারণে বহিষ্কৃত হওয়ায় নিজের জ্বীনজাতি দের উপর তার ভীষণ ক্ষোভ। উনি হয়তো তোকে এত সহজে সাহায্য করতে চাইবেননা, অনেক কঠিনভাবে তোকে পরীক্ষা করবে। কিন্তু উনি ই তোর শেষ অবলম্বন ।”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here