জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ০৯

0
2287

জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ০৯
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

“নাহ এভাবে আর চুপ করে বসে থেকে লাভ হবেনা! আমাকে পুরোনো মসজিদটা খুজে বের করতে হবে, কিন্তু আর কতটা যেতে হবে সেটাও জানিনা। সকালে কিছু খেয়েও বের হইনি, খুব ক্ষিদে পাচ্ছে। ব্যাগে কিছু বিস্কুট আছেনা! চেক করে দেখি।”
হাতের ব্যাগ চেক করতেই দুইপ্যাকেট বিস্কুট পেল মুনতাহা। সেটা খেয়ে উঠে দাড়াল আবার হাটার উদ্দেশ্যে। যত হাটছে মনে হচ্ছে গাছপালা আর ঝোপঝাড় বেড়ে যাচ্ছে, অন্ধকার লাগছে। হঠাৎ শুকনো পাতায় কারো হাটার শব্দ কানে এল মুনতাহার। মুনতাহা ভয়ে পিছিয়ে গেল, তক্ষুনি দেখল একটা বাঘ ধীরপায়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এখন কি সে বাঘের খাদ্য হয়ে যাবে? জঙ্গলটা এমনিতেই জনমানবশূন্য, চিৎকার করলেও কেউ আসবে না তাকে বাচাতে।কি করা যায় এখন!
শয়তানের যুদ্ধ করার আগেই তার সমাধি হয়ে যাবে। “আল্লাহ, আমাকে রক্ষা করো!” মুনতাহা মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করতে লাগল। বাঘটা তার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। দৌড়তে যাবে তখনি পাথরের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে গেল মুনতাহা।
পাটা বোধহয় মচকেই গেল, ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল মুনতাহা। বাঘটা তার শরীরের কাছে এসে গন্ধ শুকতে লাগল। মুনতাহার পুরো শরীর কাপছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার শেষ নিঃশ্বাস। বাঘটা ভয়ানক গর্জন করে মুনতাহার গালে সজোড়ে একটা থাবা বসাল। শেষ বারের মত ব্যথায় ভীষণ চিৎকার করে মুনতাহা জ্ঞান হারাল।
হাসনাত ধড়পড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসল। দুঃস্বপ্ন দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে, এমন ভরসন্ধ্যা বেলা দুঃস্বপ্ন দেখল কেন? ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নওশিন।ভীষণ সুন্দর বাতাস ছাদে, অনেক ফ্রেশ লাগছে তার। ফোনে হালকা মিউজিক বাজছে, তার তালে তালে বাতাসে তার খোলা চুলগুলো উড়ে উড়ে খেলা করছে।
হঠাৎ তার পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেল নওশিন। কেউ তার কাধে রাখতেই প্রচন্ড চিৎকার করে উঠল সে। হাসনাত তাড়াতাড়ি নওশিনের মুখটা চেপে ধরল।
নওশিন ভালো করে তাকিয়ে দেখল এটা আর কেউ নাহ, হাসনাত।
নিজেকে হাসনাতের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, এভাবে নিশ্চুপে কেউ ছাদে আসে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
— আসলে আমি বুঝতে পারিনি আপনি ছাদে আছেন, আর আমাকে অন্ধকারে দেখে এভাবে চিৎকার করে উঠবেন। ভাগ্যিস মুখ চেপে ধরেছিলাম, নাহলে আপনার চিৎকার শুনে সবাই ছাদে এসে আমাকে চোর ভেবে কেলানি দিত।
নওশিন খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল,
— সন্ধ্যা বেলা ছাদে এসেছেন কেন? আপনি তো অসুস্থ, রেস্ট নেওয়া উচিত আপনার। হাসনাত একপলক তাকিয়ে বলল,
— না আসলে যে এত সুন্দর হাসিটা মিস করতাম। নওশিন শুনে অস্বস্তি বোধ করল, তাও না শুনার ভান করে বলল, “কিছু বললেন?”
— নাহ বললাম, সারাদিন রুমে বসে থাকতে ভালোলাগে কার! কেউ নেই ও যে একটু গল্প করে সময় কাটাব।
— আপনার স্ত্রী এখনো ফেরেনি?
শুনে হাসনাতের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। এই মেয়েটার কথা শুনলেই তার ভীষণ গা-জ্বালা করে। পুরাই একটা ন্যাকামার্কা মেয়ে। মুখ বেজার করে বলল,
— আমি জানিনা। প্লীজ ওর কথা আমাকে বলবেননা, ভেবেছিলাম আপনার সাথে একটু গল্প করে মুড ভালো করব। কিন্তু আপনি মুডটা আরো বাজে করে দিলেন।
আচ্ছা আমি নিচে যাচ্ছি।
— রাগ করলেন বুঝি?
— তাই করার কি কথা নাহ!
— দেখুন আপনার সাময়িক স্মৃতিভ্রম হয়েছে। তাই আপনি আপনার প্রিয় স্ত্রীকে চিনতে পারছেননা। কিছুদিন পর আপনার সব মনে পড়ে যাবে, তাকেও আপনি আবার আপন করে নিবেন। আপাতত অইসব থাক।
হাসনাত নওশিনের হাতের বাহু শক্ত করে চেপে একদম কাছে টেনে এনে বলল,
— আমি কাউকে মনে করতে চাইনাহ। আমি জাস্ট একজনকেই চাই, আর সেটা আপনি। এখন আপনার যদি আপত্তি থাকে, তবে আমার আর কিছু বলার নেই।
আপনাকে বিরক্ত করবনা তাও এভাবে আমাকে খোচাবেননা।
— আমার হাতে খুব লাগছে।
হাসনাত নওশিনকে ছেড়ে আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে নিচে নেমে এল।
নওশিন হাতের বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, “কি অদ্ভুত!”
নওশিন নিষ্পাপকে দরজার সামনে চিন্তিতমুখে পায়চারি করতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার মাম্মা, তুমি এত রাতে এভাবে দরজার সামনে হাটাহাটি করছো কেন? নিষ্পাপ সোফায় বসে পড়ে বলল,
— নূরজাহান এখনো ফিরেনি, মেয়েটার জন্য বড্ড টেনশন হচ্ছে! কোন সকালে বেরিয়েছে তাও খালি মুখে। এত রাত অবধি বাহিরে থাকার মেয়ে ও নয়।
নওশিন নিষ্পাপের কাধে হাত রেখে বলল, ” ও কি তোমাদের কথা ভাবছে বলো? তোমার কথা না হয় বাদ ই দিলাম কিন্তু নিজের স্বামীর কথা তোহ ভাব্বে তাইনা! অসুস্থ স্বামী কে এভাবে ফেলে বাহিরে ঘুরতে লজ্জা ও করছেনা!”
— দেখ নওশিন, ওকে আমি খুব ভালো করে চিনি। কোনো দরকারী কাজ ছাড়া ও এই পরিস্থিতিতে বের হওয়ার মেয়ে নাহ। তুই যাহ এখান থেকে!
— হুম সবই বুঝি। এখন তোমার সবটা জুড়েই নূরজাহান, আমি আর কেউ না।
— নওশিন বাজে কথা বলোনা। ও তোমার বড় বোনের মত।
— আমার বোন এমন নিচু টাইপের হতে পারেনা। না জানি স্বামীকে ছেড়ে এখন কোন পুরুষের সাথে রাত কাটাতে ব্যস্ত। জাস্ট এ প্রোস্টিউড।
নিষ্পাপ প্রচন্ড রেগে নওশিনের গালে একটা চড় মারল।
— তোর মুখ থেকে নূরজাহানের নামে আর একটা বাজে কথাও শুনতে চাইনা।

নওশিন গালে হাত দিল, প্রচন্ড ব্যথা লেগেছে তার। দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
— একটা জ্বীনের মেয়ের জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে পারলা?
— তুই কি করে জানলি?
— এটা তো সত্যি তাইনা! ও আমাদের মত কেউ না, অন্য জগত থেকে আসা একটা মেয়ে। ওর জন্য তুমি নিজের মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পারলা!
— তাহলে সেদিন তুই ই আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিলি।
— হ্যাঁ, সেদিন আমিই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তোমাদের কথা শুনেছি। তুমি এই মেয়ে কে কি করে নিজের মেয়ে ভাবতে পারো মাম্মা!
— ও আমার ই মেয়ে। ওকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকিই কিন্তু ও কোনো অংশে আমার নিজের মেয়ের চেয়ে কম নয়। নওশিন নিষ্পাপের হাত চেপে ধরে বলল,
— আর তোমার পেটের মেয়ের কোনো দামই নেই তোমার কাছে? নিষ্পাপ নিজের হাত নওশিনের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
— তুই নিজেও আমার পালিতা মেয়ে, নূরজাহানের কষ্ট ভোলার জন্য তোকে আমি এডপ্ট নিয়েছিলাম। তিনবার মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার পর আমি মা হওয়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই নূরজাহানকে নিজের মেয়ে মনে করতাম। সে চলে গিয়ে তোকে সুযোগটা দিয়েছে, নাহলে সারাজীবন অনাথের পরিচয় নিয়ে বেচে থাকতি তুই। তোর যোগ্যতা ও নেই নূরজাহানের সাথে নিজেকে তুলনা করার।
নওশিন স্তব্ধ হয়ে নিষ্পাপের দিকে তাকিয়ে রইল। দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
— মাম্মা…
— তুই যদি আর কখনো নূরজাহানের নামে বাজে কথা বলতে আসিস, আমি তোকে ত্যাজ্য করব। নেক্সটটাইম এসব বলার আগে ২বার ভেবে নিস।
নওশিন কাদতে কাদতে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। নিষ্পাপ রাগে ফুসতে ফুসতে বলতে থাকে, “নূরজাহান কে চিনতে তোর অনেক সময় লাগবে নওশিন। আমার নূরজাহানের মত মেয়ে হয়না, তাকে নিয়ে এত নিচু কথা আমি অন্তত সহ্য করব না।”
নওশীন ইচ্ছেমত কেদে নিল। সে এতদিন এদেরকেই নিজের মা-বাবা ভেবে আসছিল, আজ সামান্য কথা নিয়ে এরা ওকে এভাবে পর করে দিল। টেবিলের উপর রাখা সব জিনিস ফেলে দিয়ে বলতে লাগল, “চাইনা আমার কারো ভালোবাসা। অনাথ মেয়েকে তোমরা অনেক করুণা করেছো, এটাও বেশী।”
কিছু একটা ভেবে চোখের পানি মুছে নওশীন নিজের রুম থেকে বেরিয়ে হাসনাতের রুমে ঢুকল। হাসনাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিল। সোজা ছুটে এসে নওশীন হাসনাতকে জড়িয়ে ধরে । হাসনাত চমকে উঠে বলল,
— কি হয়েছে নওশীন? নওশীন হাসনাতকে আরো জাপতে ধরে বলল,
— হাসনাত আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন তোহ? বলুননা। হাসনাত নওশীন কে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
— বুঝে নাও, কতটা ভালোবাসি।

মুনতাহা আস্তে আস্তে চোখ খুলল। খুলে দেখল সে একটা পুরোনো ভাঙ্গা ঘরে শুয়ে আছে। চারপাশে মশালের আলো জ্বলছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলনা। গালের পাশটা কিছুটা ব্যথা করছে, নিজেকে নিজে একটা চিমটি কেটে দেখল। সত্যিই সে বেচে আছে, বাঘটা কেবল তাকে আঘাত করেছে কিন্তু খায়না।
মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল মুনতাহা। কিন্তু ওকে এখানে কে আনল? আর এই ঘন জঙ্গলে এ ঘরটাই বা এলো কি করে!
উঠে দাড়াতেই কটকট করে দরজা খোলার শব্দ পেল মুনতাহা। কেউ আসছে নিশ্চয়ই, আসুক তবে। তার থেকেই জানা যাবে আমি এইখানে কি করে এলাম আর জ্বীনহুজুরের মসজিদটা কোথায়!
দুজন লম্বা সাদা জোব্বা পড়া হালকা দাড়িওয়ালা লোক ঘরে ঢুকল। মুনতাহাকে দেখে একজন বলল, “মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে তাহলে।” সাথে সাথে সাথের জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই লোকটা আবার বলতে লাগল,
— এই মূর্খ কন্যা, এই গভীর জঙ্গলে কেন এসেছো?
— আমি বড় জ্বীনহুজুর কে খুজতে এসেছি। উনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। আপনি বলতে পারবেন উনাকে কোথায় পাব আমি?
লোকটি যেন অবাক হল। তারপর বলল, এসো আমার সাথে।
মুনতাহা ভয়ে ভয়ে লোকটি অনুসরণ করে ঘরের বাহিরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here