জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ১০
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা
সাদা বিশাল জোব্বা পড়া এক ফর্সা বৃদ্ধ অনেক পুরোনো মসজিদের ভেতর বসে তাসবীহ পড়ছে। বয়স ১০০ এর কাছাকাছি হবে কিন্তু দেখে মনে হয় এখনো অনায়সে বালকদের মত সব করতে পারেন। সাদা বড় বড় দাড়ি গুলো বুক পর্যন্ত এসে ছুয়েছে, ঠোটটা খুব দ্রুত বুলি আওড়াচ্ছে।মাথায় মস্ত বড় একটা সাদা পাগড়ি, চোখগুলো দেখতে ভয়ংকর । রেগে গেলে নিশ্চয়ই ওই চোখজোড়ায় আগুন জ্বলে।
সেই লোকটার সাথে পুরোনো মসজিদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে মনে মনে এসব ভাবছিল মুনতাহা। জ্বীনহুজুর মোনাজাত শেষ করা অবধি অইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেক লম্বা একটা মোনাজাত ধরেছিলেন। মোনাজাত শেষ করে ফিরে তাকালেন মুনতাহার দিকে। মুনতাহার সাথের লোকটা নিচুকন্ঠে বলল,
— হুজুর এই সেই মেয়েটি যে একা একাই এই জঙ্গলে আপনার খোজে এসেছে। আমরা তাকে কোনো দুশমন ভেবে বাঘের রুপ ধরে পরখ করি। কিন্তু এই মেয়েটি সাধারণ মানুষের মতই ভয় পেল এবং কোনো শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে পারেনি।
জ্বীনহুজুর লোকটির কথা শুনতে শুনতে একটা আসনে গিয়ে বসলেন। দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে চোখ ছোট ছোট করে বললেন,
— এইটুকুর উপর ভিত্তি করে তুমি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছো? তুমি জানোনা, আমি কোনো মানুষের সাথে দেখা করিনা সেটাই যতই দরকারী ই হোক।
লোকটি হাত জোড় করে বলল, “বুঝতে পারিনি হুজুর। দেখে মনে হল বড্ড বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছে। তাই নিয়ে এলাম!”
— মানুষের উপর তোমার মায়া কি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছেনা! যাও একে জঙ্গল থেকে বের করে দাও। মেয়েটার খুব বেশী সাহস, আজ কোনো শাস্তির বিধান দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলে ওকে ওর অতিরিক্ত সাহস দেখানোর পরেও শাস্তি না দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি আর এমন ভুল দ্বিতীয় বার করবেনা।
লোকটি মাথা নিচু করে আচ্ছা বলে সায় দিল। অতঃপর মুনতাহার দিকে তাকিয়ে বলল, চল বালিকা। আর কখনোই এখানে আসবেনা, আমি তোমাকে জঙ্গল পার করে দিয়ে আসব চল।
মুনতাহা হতভম্ব হয়ে বলল, “উনাকে বলুন আমার উনার সাথে বিশেষ প্রয়োজন আছে। আমি নিরুপায় হয়ে উনার সহায় হয়েছি, এখন উনি যদি আমাকে সাহায্য না করে তবে আমার সব আশা ভেঙ্গে যাবে।”
লোকটি মুখ গোমড়া করে বলল, উনি একবার যেহেতু না বলেছেন উনাকে আর রাজি করানো যাবেনা। এখানে থাকলে তোমার বিপদ, চল তুমি।
মুনতাহা জ্বীনহুজুরের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল,
— আমাকে তাড়িয়ে দিবেননা হুজুর। বড্ড বিপদে পড়ে আপনার নিকট এসেছি, আপনি ই আমার বিপদের দিনে অন্যতম সহায়। এভাবে আমাকে বিপদগ্রস্থ অবস্থায় অবজ্ঞা করবেন না হুজুর। আপনার কাছে আমার আকুল নিবেদন একটিবার আমার কথা শুনুন, এরপর যদি আপনার মনে হয় আপনি আমাকে সাহায্য করবেননা। আমি আর কিছু না বলে আপনার সব আদেশ মাথা পেতে নিব।
জ্বীনহুজুর ঠোটের কোণে অবজ্ঞার হাসি ফুটিয়ে বললেন,
— আচ্ছা মেয়ে তো তুমি। তুমি কি ভেবেছো আমার মন গলবে? গলাতে পারবেনা এবং আমি তোমাকে কোনো প্রকার সাহায্য ই করবনা। এখনো সময় আছে এই স্থান ত্যাগ করো।
— আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন হুজুর। আমার সবটা জানার পর আপনি আমাকে সাহায্য করুন বা না করুন আমার কষ্টে আপনিও সমব্যথিত হবেন। এটুকু আমার আত্মবিশ্বাস।
— তুমি নিজের ভালো বুঝোনা তাইনা? বেশ এত আত্মবিশ্বাস যখন তোমার আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিলাম। যদি তোমার কথা শুনে আমার কোনো কিছু অনুভূত না হয় তবে আমার সময় নষ্ট করার জন্য তোমাকে আমি কঠোর শাস্তি প্রদান করব।
— অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে হুজুর।
— বেশ বলো, কে তুমি? তোমার সম্পূর্ণ পরিচয় কি!
মুনতাহা মেঝে তে পা গুটিয়ে বসে হুজুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমি মুনতাহা, একজন জ্বীনকন্যা। এই কথা শুনে হুজুরের চেলাগুলো রেগে ফেপে উঠল, আক্রমণ করতে ছুটে আসল। মুনতাহা ভীষণ ঘাবড়ে গেল, জ্বীনহুজুর হাত উচিয়ে তাদেরকে শান্ত হতে ইশারা করলেন। হুজুর কপাল কুচকে বলল,
— তুমি কি জানো, আমার কাছে জ্বীনজাতির কেউ আসলে তার কি পরিণতি হয়?
মুনতাহ ভয়ার্ত হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, জ্বী জানি!
— তাও কেন এলে? ভয় করল নাহ।
— আপনার সাহায্য আমার জীবনের চেয়ে আমার কাছে বেশী প্রয়োজন।
— কার মেয়ে তুমি? জ্বীনকন্যা তুমি, তাহলে সামান্য একটা বাঘের সাথে লড়াই করতে পারলেনা কেন? নাকি আমার সাথে মিথ্যাচার করছো!
— নাহ আমি মিথ্যাচার করছিনা। আমি জ্বীন মুস্তফা আর মনুষ্যকন্যা মুশায়রার সন্তান।
— তুমি মুস্তফার কন্যা? সে কোথায়! তোমার কথা আমি জানি, জ্বীনজাতিকে বদজ্বীনির হাত থেকে বাচানোর জন্য তোমার আগমন হয়েছিল। তুমি তাকে শেষ করে তোমার মা-বাবাকে নিয়ে জ্বীনজগতেও ফিরে গিয়েছিলে। তাহলে এখন তুমি পৃথিবীতে কেন? যেখানে তুমি এত শক্তিশালী একটা জ্বীনিকন্যা, সেখানে আমার সাহায্যের কি প্রয়োজন তোমার?
— কপালটা আমার খুব খারাপ। জ্বীনজগতে ফিরে যাওয়ার কিছুমাস পর জ্বীনজগতে একটা শয়তানের আক্রমণ ঘটে। সে নাকি ওই বদজ্বীনির বহুবছরের সাধনার ফল। ডাইনীটা বুঝতে পেরেছিল আমার হাতে তার মৃত্য নিশ্চিত । তাই সে নিজের সাম্রাজ্য আর প্রতিশোধ নিশ্চিত করতে একটা শয়তান বানিয়ে রেখেছিল যাতে তার মৃত্যুর পর সে শয়তান জ্বীনজগত দখল করে জ্বীনহত্যায় লিপ্ত হয়। ঠিক সেটাই হল, আমার চোখের সামনে শয়তানটা আমার মা-বাবাকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। বলেই মুনতাহা প্রচন্ড কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। জ্বীনহুজুর কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন, “মুস্তফা তার ছেলে ছিল, ছোটবেলায় কত শত আবদার করত তার কাছে। কোলে-পিঠে মানুষও করেছিল মুস্তফাকে। আজ তার সেই প্রাণপ্রিয় মুস্তফার নৃশংস মৃত্যুর কথা শুনে তার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। জ্বীনজগত থেকদ বিতাড়িত হওয়ার পর এতগুলো বছর রাগের বশে মুস্তফার সাথে দেখা না করলেও মনে মনে একটা আশা ছিল মুস্তফা একদিন তার বড় জ্বীনবাবার সাথে দেখা করতে আসবে। আশাটা দপ করে নিভে গেল মুহুর্তে।”
চোখের পানি আড়াল করে নিলেন জ্বীনহুজুর। মুনতাহা কেদে কেদে বলল,
— বিশ্বাস করুন তাদের সেই আর্তনাদ এখনো আমার কানে বাজে। আমাকে অধের্ক পাথর করে রাখায় আমি কিছুতেই ওদেরকে বাচাতে পারলাম। নিজের চোখে মা-বাবার আর দাদুর মৃত্যু দেখতে হয়েছিল আমাকে। আমাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে শেষ করবে বলে শয়তানটা আমাকে বাচিয়ে রাখল।আমি কোনোরকমে পালিয়ে ওকে শেষ করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসি। তখন আমার নতুন পরিচয়ের প্রয়োজন ছিল, তাই ছদ্মবেশ নিয়ে সেই হাসনাতকেই বিয়ে করি। কেননা, অবিবাহিত থাকলে সে নিশ্চিত আমাকে খুজে বের করতে পারত। বিবাহিত হলে বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে আমাকে খুজবেনা। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বিয়ের পরেই ও আমাকে খুজে বের করে। হাসনাতকে আমার দুর্বলতা ভেবে যে কোনো সময় ওর উপর আক্রমণ করে আমাকে বন্দি করতে পারে ভেবেই আমি হাসনাতের সাথে খারাপ বিহেভ করে তার থেকে দূরে থাকি।
কপালটা আবার খারাপ হল আমার। ঘটনাক্রমে আমার আর হাসনাতের মিলন হয়, ফলে আমি আমার সব শক্তি হারিয়ে ফেলি। শয়তানগুলোর কারণে হাসনাত ও তার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলে, আমাকে চিনতে পারেনা এখন। কাছে গেলে বাজেভাবে অপমান করে করে আমাকে।
মুনতাহার এমন কান্না দেখে জ্বীনহুজুরের চোখেও পানি চলে আসে। প্রতিনিয়ত কত লড়াই করছে মেয়েটা, তাও একবিন্দু সুখ পাচ্ছেনা। কেন আল্লাহ তুমি এই ভালো মেয়েটাকে এত কষ্ট দিচ্ছো! চোখের পানি মুছে বলল,
— এখন আমি তোমাকে কি করে সাহায্য করতে পারি মুনতাহা?
— আমি ওই শয়তানটাকে শেষ করতে চাই হুজুর, এতে আমার জীবন ও চলে যাক আমি পরোয়া করব না। আপনি আমাকে বলে দিন কি করে আমি তাকে শেষ করব? এখন তো আমি সম্পূর্ণ শক্তিহীন, একজন সাধারিণ মেয়ের মত।
— শেষ করতে পারবে তুমি। চিন্তা করোনা, আমি তোমাকে পুরো শক্তি না দিতে পারলে খানিকটা শক্তি দিতে পারব যাতে তুমি তার সাথে মোকাবেলা করতে পারো। কিন্তু মনে রেখো শয়তান টা মারা যাওয়ার সাথে সাথে তুমি আবার শক্তিহীন হয়ে যাবে।
তোমার সেই তলোয়ার দিয়েই ওকে মারতে হবে, যেটা দিয়ে তুমি বদজ্বীনিকে হত্যা করেছিলে। খুজে বের করো সেই তলোয়ার। তার মুখোমুখি হওয়ার সময় খুব নিকটে আছে।
— ধন্যবাদ জ্বীনহুজুর। আপনার এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবনা, তবে এইটুকু কথা দিচ্ছি এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আপনি জ্বীনজগতে পুনরায় রাজত্ব করার অধিকার পাবেন।
জ্বীনহুজুর অবাক হলো এই মেয়েটির কথা শুনে, একদম মুস্তফার মত হয়েছে। সে আবার জ্বীনজগতে ফিরে যেতে পারবে তার ফ্যামিলির কাছে এর থেকে খুশির সংবাদ আর কি হতে পারে!
— শোনো মুনতাহা, এই যুদ্ধে তুমি কারো সাহায্য নিতে পারবেনা! তবে আমি তোমার সাথে সবসময় আছি। একটা কথা মাথায় রেখো মা, প্রিয়জনদের বেশি প্রশ্রয় দিওনা। তারাই তোমাকে সত্যিকারের আঘাত করতে পারে। আর সাবধানে থেকো মা।
মুনতাহা দাদু বলে জ্বীনহুজুর কে জড়িয়ে কিছুক্ষণ কাদলো। তার জ্বীনদাদু ও একসময় তাকে এইভাবে বলেছিল, এখন হুজুরের মুখে এভাবে কথাগুলো শুনে মুনতাহা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলনা।
জ্বীনহুজুর মুনতাহার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন,
— যাও দাদু, ফিরে যাও। আমার সঙ্গীরা তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে।
মুনতাহা জ্বীনহুজুরকে সালাম দিয়ে পুরোনো মসজিদ থেকে বেরিয়ে এল।
নিষ্পাপ এখনো দরজার সামনে পায়চারি করছে, সকাল হয়ে গেল মেয়েটা এখনো ফিরল নাহ। মেয়েটার কোনো বিপদ হলোনা তো! আল্লাহ তুমি আমার নূরজাহানকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।
এসব বিড়বিড় করতে করতে দরজার কলিংবেল বেজে উঠল। নিষ্পাপ দরজা খুলতেই মুনতাহা ভেতরে ঢুকল। নিষ্পাপ মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চুমু খেয়ে বলল, “সারারাত কোথায় ছিলি মাম্মা? আমার কি টেনশন হয়না বল!”
মুনতাহা নিষ্পাপের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, সব বলব তোমায় মাম্মা। এখন তোমার নূরজাহানকে খেতে দাও তো। জানোই তো তোমার নুরজাহান ক্ষিদে একদম সহ্য করতে পারে।” নিষ্পাপ মুনতাহাকে এমন স্বাভাবিক দেখে খুব খুশি হয়ে বলল,
— তুই ফ্রেশ হয়ে নে, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
আচ্ছা বলে মুনতাহা একবার হাসনাতের রুমের দিকে উকি মারতে গেল। পুরো একদিন হাসনাতকে দেখেনি, মনটা খুব ছটফট করছিল। এখন ও কেমন আছে একটু দেখে আসি ভেবেই হাসনাতের রুমের দরজা টা একটু ফাক করতেই যা দেখল তার জন্য মুনতাহা কখনোই প্রস্তুত ছিলনা। আপনা আপনি চোখের জল গাল বেয়ে পড়তে লাগল।
.
(চলবে)