জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ১২

0
2266

জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ১২
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

হাসনাত ঘুম থেকে উঠে রুমের কোথাও মুনতাহাকে দেখতে পেলনা। পুরোবাসা খুজেও কোথাও মুনতাহাকে পেলনা। না জানিয়ে সকাল সকাল কোথায় চলে গেল মুনতাহা? বসে বসে টেনশান করছে হাসনাত। এমনসময় দরজায় টোকা পড়ার শব্দ শুনে মাথা তুলে দেখে নওশিন এসেছে। অবাক হয়ে বলল, “আপনি?”
নওশিন হাসনাতের সামনে নাস্তা রেখে বলল, আপনি তো নাস্তা করেননি, তাই আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে এলাম। খেয়ে নিন।
— আমি খাবনা, আপনি এইগুলো নিয়ে চলে যান প্লীজ।
— কেন খাবেননা?
— আপনি বুঝতে পারছেননা, আমার স্ত্রী নিখোঁজ। এমতাবস্থায় আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে! প্লীজ এসব নিয়ে চলে যান।
— না খেলে আপনার শরীর খারাপ করবে। তাছাড়া যে আপনাকে কোনো ইনফো করা ছাড়া নিজের ইচ্ছেতে বেরিয়ে গেছে তার জন্য কেন আপনি কষ্ট করবেন!
— এনাফ বলেছেন। আপনার থেকে কিছু শুনতে আমি আগ্রহী নই। আর আপনি কে আমার ব্যাপারে এত ভাবার! কাজিন আছেন কাজিনের মত থাকুন।
— আপনার আর আমার সম্পর্ক টা শুধু কাজিনে সীমাবদ্ধ নয় হাসনাত। স্মৃতি হারিয়ে ফেলা অবস্থায় আপনার সবটুকু জুড়েই আমি ছিলাম। আপনি আমাকে কথা ও দিয়েছিলেন আমাকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করবেন।
— ওয়াট! কিসব আবোলতাবোল বকছেন আপনি! আপনি জাস্ট আমার কাজিন, এর বাহিরে আমি আপনাকে কিছুই ভাবিনা। আর ওসব কিছু যদি বলেও থাকি, তা শুধুমাত্র নিজের অজান্তে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বলেছি। মনে রাখবেননা।
নওশিন হাসনাতের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
— কেন এমন করছো তুমি? আমি তোমায় খুব ভালোবাসি বিশ্বাস করো। আমি মুনতাহার চেয়ে কম সুন্দরী নই, কম ও ভালোবাসি না তোমায়। ও একটা জ্বীনকন্যা, ওর সাথে তুমি কোনোদিনই সুখে সংসার করতে পারবানা। প্লীজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা, চলোনা নতুন একটা জীবন শুরু করি।
হাসনাত নওশিনের হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
— আমার জীবনে মুনতাহা ই ছিল আর সেই থাকবে। অন্যকাউকে কখনো আমি সেই স্থান দিতে পারবনা। আপনি যদি আমাকে বেশি বিরক্ত করেন, তবে আমি খালামণিকে জানিয়ে এই বাসা থেকে বিদায় নিব। সো, কিপ এওয়ে।
নওশিন আর কিছু না বলে নিশ্চুপে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। হাসনাত এখন কেবল মুনতাহার জন্য পাগল, এমন পাগল একদিন আমার জন্যও ছিল। আমি কি করে ভুলে যাব সেইদিন গুলো। খুব ভালোবেসে ফেলেছি ওকে। কি করব আমি! অনাথ মেয়ে আমি, আর কেউই নেই আমার। মাম্মাও আগের মত আমার সাথে কথা বলেনা, পাপাও আর আদর করে ডেকে কথা বলেনা, হাসনাতকে ভালোবাসলাম, সেও কখনোই আমার হবেনা! তোমরা কোথায় মা-বাবা? কেন আমাকে অনাথের পরিচয়ে দুনিয়ায় রেখে গেলে! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে , আমাকে নিয়ে যাও।
ভাবতে ভাবতে নওশিন চোখের পানি টপটপ করে ছেড়ে দিল।

মুনতাহা একটা মনোরম কক্ষে প্রবেশ করল। এই কক্ষ টা মা-বাবার ছিল, কত্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর আনাচে-কানাচে। এই সুন্দর পালঙ্কে বসে কত গল্প জুড়ত বাবা-মায়ের সাথে, মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেত। সেই কক্ষটা আজ শুন্য, এই কক্ষ থেকে আর মুনতাহার ডাক আসেনা, চোখ দুটো টলমল করে উঠল মুনতাহার। ধীরপায়ে গিয়ে এক কোণে রাখা সিন্দুক টা খুলল মুনতাহা।
এইতো তলোয়ারটা! এখনো চকচক করেছে। শেষবার মুশায়রা এটা যত্ন করে মুছে রেখে বলেছিল, “আমার নাতনীর হাতে একদিন তুলে দিব আমি, আমার মুনতাহার মেয়েও লড়াই শিখবে। মায়ের মত যুদ্ধ করে শত্রু নিধন করবেন।”
তখন মুস্তফা হেসে উত্তর দিয়েছিল, “হুম আর আমার দাদুভাইকে আমি শিখাবো তলোয়ার চালানো। দেখবে সেও আমার মুনতাহা মায়ের মত সাহসী আর মিষ্টি হবে। তার নানুর মত ভীতুনী নাহ।” মুশায়রা রেগে উত্তর দিত,
— তুমি আবার আমাকে ভীতুনী বললা? যাও আজ থেকে তোমার প্রিয় চা খাওয়া বন্ধ। মুস্তফা মুনতাহাকে জিজ্ঞেস করত, “আমার মুনতাহা মা বানিয়ে দিবে, তাইনা?”
মুনতাহা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলত, “খুব পারব, বাবা।”
এভাবে ঝগড়া-খুনসুটি চলতেই থাকত। সব সুখ শেষ হয়ে গেল। মুনতাহা চোখ মুছে তরবারীটা ঝোলায় ঢুকিয়ে নিল। তাড়াতাড়ি জ্বীনরাজ্য থেকে বাসায় ফিরতে হবে, হাসনাত এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে, না দেখলে তো প্রচুর চিন্তা করবে।
কক্ষ থেকে বের হতেই জোব্বা পড়া হুজুরের সাথে দেখা হল। মুনতাহা সালাম দিয়ে বলল, “দোয়া করো হুজুর, আমি যেন জয়ী হতে পারি।”
— আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে আছে মা।
— একটা কথা ছিল হুজুর।
— হ্যাঁ মা ,বল।
— বাবা আর দাদুর অনুপস্থিতিতে এই জ্বীনরাজ্য আমার উপর অর্পিত হয়েছে। এখন রাজত্বের দায়িত্ব আমার। কিন্তু আমি দায়িত্ব নিতে চাইনা হুজুর।
— কি বলছো এসব? তুমি ছাড়া উত্তরসূরী কে আছে! তোমাকেই তো এই রাজ্যের দায়ভার নিতে হবে। তুমিই বংশ পরম্পরায় এই রাজ্যের মালকীন, রাজকন্যা।
— এই দায়িত্ব আমি ঠিক মত পালন করতে পারছি কই! কিছুদিন পর আমার লড়াই, যা কিছু হয়ে যেতে পারে এই লড়াইয়ে। আমি মত্যু ও বরণ করতে পারি। তাই আমি চাই এই রাজ্য বড় জ্বীনহুজুরকে দিয়ে দিতে। তুমি ই তো বলেছিলে উনি আমার বাবার বড়বাবা, চাচ্চু। তাহলে তো উনি ও এর উত্তরসূরী । উনাকে বাদ দিয়ে আমি এসব দায়িত্ব কি করে নেই?
— তাহলে তুমি কি চাচ্ছো?
— আপনি উনাকে সসম্মানে জ্বীনরাজ্যে ফিরিয়ে আনুন এবং জ্বীনরাজ্য উনার হাতে তুলে দিন। আগে কি হয়েছে না হয়েছে সব ভুলে যান। আমার মনে হয় উনি খুব যোগ্যতার সাথে রাজ্য শাসন করতে পারবেন। না করোনা হুজুর। এটাই তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ। জানিনা এরপর তোমার সাথে কখনোই দেখা হবে কিনা! কখনোই তোমার কাছে অনুরোধ করতে পারব কিনা। আমাকে হতাশ করোনা।
হুজুর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তুই যা চাস তাই হবে!”

হাসনাত মুনতাহাকে সামনে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। কাদতে কাদতে বলল,
— এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? জানো কত টেনশান হচ্ছিল আমার।
— কেদোনা প্লীজ। আমি আমার জ্বীনরাজ্যে গিয়েছিলাম
হাসনাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “জ্বীনরাজ্যে কেন? তুমি কি আবার আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছো মুনতাহা!”
— আরেহ না, তলোয়ার আনতে গিয়েছিলাম। সামনে আমার বড় লড়াই হাসনাত, সেই শয়তানের সাথে যুদ্ধ যে আমার মা-বাবাকে মেরে ফেলেছে।
— তোমার মা-বাবা মারা গেছে?
— হ্যাঁ হাসনাত। আমার তোমাকে সবটা বলা উচিত। কেন আমি আবার ফিরে এসেছি, কেন তোমাকে বিয়ে করেছি আর কেন ই বা তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি!
সবটা তোমার আজই জানা দরকার। হয়তো আল্লাহ আমাকে পরে বলার সুযোগ নাও দিতে পারে।
সবটা শুনে হাসনাত মুনতাহাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
— এসব ভয়ানক লড়াইয়ে তুমি যেওনা, সামান্য শক্তি দিয়ে তুমি তার সাথে টিকতে পারবেনা।
— তুমি আমার মায়ের মত কথা বলছো! আমার বাবা তোমার জায়গায় থাকলে বলত, “মুনতাহা মা, তোমার যা কিছু আছে তা নিয়ে নেমে পড়ো। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, তিনি তোমাকে নিরাশ করবেননা।”
— আমার যে তোমাকে হারানোর ভয় আছে মুনতাহা। একবার তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, আবার হারাতে পারবনা।
— কিচ্ছু হবেনা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো একটু, উনি যা করবেন ভালোর জন্যই করবেন। নিশ্চয়ই এখনো কিছু খাওনি, চল খেয়ে নিবে।
— নওশিন খাবার নিয়ে এসেছিল, কি সব বাজে কথা বলছিল। আমাকে ভালোবাসে, ওকে আমি বিয়ে করব। আমি ওকে জানিয়ে দিয়েছি, আমার জীবনে মুনতাহা ছাড়া আর কেউ আসবেনা। মুনতাহা নীরব থেকে বলল,
— আসলে এই কয়েকদিনে তুমি ওর সাথে গভীরভাবে মিশেছিলে তাই ওর মনে গেথে গেছো। চিন্তা করোনা, কিছুদিন পর ও বুঝতে পারবে ওর ভুলটা।
— সেটাই যেন হয়।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here