জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ৫
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা
মুনতাহা ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে। বড্ড মন খারাপ তার, তার জীবনটা কেন স্বাভাবিক নয়! লড়াইয়ে, হানাহানিতেই পুরো জীবনটা কেটে যাচ্ছে। না পারল মা-বাবার কাছে শান্তি তে থাকতে আর না পারল……
হঠাৎ শাড়ির আঁচলের গিট্টু থেকে একটা ছোট পাথর বের করল। এটাই তার নিশানা, ও জানেনা ও কতদিন এভাবে থাকতে পারবে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তাকে তার অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করতে হবে। চোখটা কিচ্ছুক্ষণের জন্য বুজল। ” কিরে মা, ডাকছিস যে?” কন্ঠ শুনে চোখ খুলল মুনতাহা। সামনে জোব্বা পড়া সেই হুজুরটাই দাঁড়িয়ে আছে। সালাম করে মুনতাহা বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমি তাকে পেয়ে গেছি। এখন শুধু অপেক্ষা সামনে আসার।”
— সে তোনার সামনে আসতে চাইবেনা মুনতাহা।
— তাহলে কি করে হবে? লোকটি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— সে তোমাকে সবসময় পিছন থেকে আঘাত হানতে থাকবে, কিন্তু সামনে আসবেনা। সে তখনি কেবল সামনে আসবে যখন তুমি পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়বে। মুনতাহা তুমি বড্ড ভেঙ্গে পড়েছো মা। এভাবে হলেতো হবেনা, তোমার সামনে বিরাট লড়াই।
— দোয়া করবেন। এখনো অবধি বেচে থাকার কারণটাই তো তার মুখোমুখি হওয়া। তাই এত সহজে হার আমি মানবনা। জোব্বা পড়া লোকটা মুচকি হেসে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। মুনতাহা এক প্রচন্ডে ক্রোধে ফেপে উঠল, তারপর এক লাফে ব্যালকুনি থেকে নেমে বাগানের গাছের ডালে বসা সাপটার গলা শক্ত হাতে চেপে ধরল। জ্বলজ্বল করা চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার কথা লুকিয়ে শুনে অন্যকে পাচার করার মতলব করছিস। এত্ত বড় সাহস দিয়ে দিয়েছে তোদের ওস্তাদ। তবে এটাও শুনে রাখ মুনতাহার কোনো ক্ষতি করতে আসলে তোরা একটাও জ্যান্ত ফিরবিনা। তুই তো এখান থেকে আর ফিরবিনা।” বলেই সাপের গলাটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল। সাপের রুপ ছেড়ে ভয়ংকর শয়তানের রুপে পরিবর্তন হল সাপটি। হিংস্র গলায় বলতে লাগল, “আমাকে ছেড়ে দে, নাহলে তুইও রেহাই পাবিনা। তোর ধবংসের দিন ঘনিয়ে এসেছে জ্বীনকন্যা।”
— আমার ধবংসের চিন্তা করার আগে আমি তোকে শেষ করে দিব। বলেই শয়তানটার ঘাড়ে দাত বসিয়ে দিল মুনতাহা। শয়তানটা মুহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মরা সাপ হয়ে যায়। মুনতাহার ইশারায় তাতে আগুন ধরে ছাই হয়ে যায়।
রাগটা কমে আসে, তবুও শান্ত হতে পারছেনা। রুমে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল। কিন্তু হাসনাতটা কোথায় গেল! রুমে উঁকি ঝুকি মেরে চেক করেও পেলনা।
” কাউকে খুজছো?” শুনে সামনে তাকাল মুনতাহা। হাসনাত খাবারের ট্র্বে মুনতাহার সামনে রেখে মুখোমুখি বসল। মুনতাহা মাথা নিচু করে বলল,
— কাউকে নাহ। কোথায় ছিলে?
— কিচেনে, আজ আমি তোমার জন্য নিজে রান্না করেছি। আচ্ছা আমার একটা কথা রাখবা বলো? মুনতাহা অবাক হয়ে বলল, হুম বলো।
— আমি যদি তোমাকে খাইয়ে দেই তাতে কি তোমার কোনো আপত্তি হবে? মানে যদি তুমি চাও। মুনতাহা চোখ বড় বড় করে তাকায় হাসনাতের দিকে। হাসনাত গলার ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, “নাহ মানে যদি তুমি না চাও, তাহলে থাক। তুমি নিজেই খাও। স্যরি আর বলবনা, ভুল হয়ে গেছে।” মুনতাহা মুচকি হেসে হা করল।
হাসনাত খুশি হয়ে প্লেটে ভাত মাখল। যত্ন করে মুনতাহাকে খাইয়ে দিল।
মুনতাহা অবাকচোখে হাসনাত কে দেখতে লাগল। হঠাৎ হাসনাতকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে নিজেও সরে গেল। একটা বড় পাথর এসে সোজা ওদের বরাবর এসে আয়নায় লাগল। আয়না সশব্দে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মুনতাহা মেঝে থেকে উঠে জানালার কাছে উঁকি ঝুকি মারল, তারপর ফিরে এসে পাথরটা হাতে নিয়ে চুপে চুপে জানালার বাহিরে জোরে ছুড়ে ফেলল। একটা আর্তনাদের শব্দ ভেসে এল।
হাসনাত ও ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুনতাহা হাসনাতের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। হাসনাত কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলনা।
ফের যদি মুনতাহা রেগে গিয়ে আরেকটা চড় মেরে দেয়, মুখের এই পাশ টা এখনো ঠনঠন করছে। হাত নাকি লোহা কে জানে! বিয়ের পর সব পুরুষরা পায় বউয়ের আদর-ভালোবাসা, পোড়া কপালে অবহেলা আর চড় ছাড়া কিছু পড়লনা।
বিকেলে শুয়ে শুয়ে হাসনাত ভাবতে লাগল, “এই আমার মুনতাহা তো? মুনতাহা তো আগে কখনোই এমন ছিলনা। এখন কেন এত্ত ইগ্নোর,অবহেলা! মুখ ফুটে ও কিছু বলেনা, জিজ্ঞেস করার কথা তোহ মনেই আনতে পারিনা।”
ততক্ষনে মুনতাহা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাধছে। হাসনাত উঠে বসে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, “এটা তো সেই হলুদ শাড়িটা যেটা আমি ওকে প্রথমবার ওকে পড়তে দিয়েছিলাম। আজ ও তাকে সেইদিনের মত মিষ্টি দেখাচ্ছে।” হাসনাত গলা কেশে বলল,
— আচ্ছা মুনতাহা তুমি না আগে আমাকে মি. পারফেক্ট ডাকতে? মুনতাহা হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “মোটেওনাহ। মি. ছ্যাচঁড়া ডাকতাম। ছ্যাচঁড়া ই তো ছিলা অনেকটা, কতবার আমার রুমের সামনে ঘুরাঘুরি করছিলে এই শাড়িটা পরার কথা বলে। এইজন্যই তোমাকে এই নামটা দিয়েছিলাম আমি!” বলে হাসতে লাগল মুনতাহা। একটু হাসার পর আগের মত গম্ভীর হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
হাসনাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার দিকে তাকায়। শুধু শুধু ভাবছিল এটা ওর মুনতাহা নাহ। কিন্তু এখন আর সন্দেহ নেই, কিন্তু ও এভাবে গম্ভীর হয়ে গেল কেন!
ও কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেনা, স্বামী হিসেবে মানেনা।
মুনতাহা আবার রুমে এসে বলল, “এই যে মি. ছ্যাচঁড়া আমাকে কি দয়া করে বাজার থেকে কিছু জিনিসপত্র এনে দিতে পারবেন? সন্ধ্যার জন্য নাস্তা বানাব।”
হাসনাত খুশিতে মনে মনে নাচতে লাগল। তাও চুপ করে মাথা নেড়ে সায় দিল।
রাতে বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, ঘনঘন বজ্রপাত ও হচ্ছে। এদিকে লোডশেডিং ও হলো।রুমটা কিছুক্ষণ পর পর সাদা আলোয় আলোকিত হয়েছে উঠছে। মুনতাহা এইসময়টায় জানালার পাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছে ওর গায়ে, কিন্তু ও ঠায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকবার ডাকার পরও জবাব দিলনা। বেড থেকে নেমে মুনতাহার পাশে এসে দাড়ালাম। বজ্রপাতের আলোয় দেখলাম ও গাল বেয়ে মুক্তার ধারা বেয়ে নামছে। আমি ওর মুখের নিচের হাত রাখলাম।
এক ফোটা অশ্রু আমার হাতের তালুতে পড়ল। ও সেটা বুঝতে পেরে আমার দিকে তাকালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কাদছো কেন মুনতাহা?”
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাদতে লাগল। আমি ওকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “কি হয়েছে মুনতাহা? বলো আমায়!”
— হাসনাত আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা। শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
যে মুনতাহা এতদিন আমাকে কেবল অবহেলা করে এসেছে সে আজ আমাকে এসব বলছে। আমার হাতের বাধন আলগা হয়ে গেল। ও আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “প্লীজ আমাকে ছেড়োনা, আমি নাহলে হারিয়ে যাব। আমাকে তোমার কাছেই ধরে রাখো। খুব ভালোবাসি তোমায়।”
আমি ওর কপালে একটা চুম্বন দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কখনোই তোমাকে ছাড়বনা মুনতাহা। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই আমাদের আলাদা করে দিবে। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।” বলে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। ও আমার পায়ের পর পা রেখে আমার কপালে একটা স্পর্শ দিল। তারপর আমার ঠোটে ডুবিয়ে দিল তার ঠোট।আমরা নিজেদেরকে একদম গভীরভাবে জড়িয়ে নিলাম। আমাদের রাত টা হয়ে উঠল অন্য স্বামী-স্ত্রীদের মত স্বাভাবিক মধুর রাত।
নিজের করে নিলাম মুনতাহাকে। নিজেকে বড্ড সুখী মনে হচ্ছে, এতদিনে আমরা ভালোবেসে অনেক কাছে এসেছি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মুনতাহা আমার বুকে মাথা রেখে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। বেশ মায়াবী দেখাচ্ছে আমার জ্বীনবউটাকে। এক গোছা চুল ওর মুখের সামনে এসে পড়েছে। সরাতে গিয়ে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধড়পড়িয়ে উঠে বসল।
নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করল,
— আমার সবকিছু অগোছালো কেন হাসনাত?
— রাতে তোমার অগোছালো স্বামী তোমাকে অগোছালো করে দিয়েছে।
— তার মানে রাতে আমরা….
— এর মধ্যে সব ভুলে গেলে!
মুনতাহা এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লক করে দিল। অনেকক্ষণ পর বের হল গম্ভীরমুখে। আমি নেমে ওকে জড়িয়ে ধরতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
ওর এমন আচরণে আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। তাকিয়ে দেখলাম ওর ফর্সা মুখ খুব লাল হয়ে গেছে, চোখটাও ফোলা আর লালচে দেখাচ্ছে। আমি ওর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তোমার?
.
(চলবে)