জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ ০১

1
3801

জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ ০১
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

সব রিচুয়্যাল শেষ করে বাসরঘরে ঢুকলাম। যে রুমটা এতদিন একাই আমার দখলে ছিল আজ তাতে অন্য কারোও ভাগ আছে ভাবতেই বিরক্ত ফিল হচ্ছে। ঢুকে দেখি রুমটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমার জানামতে অধিকাংশ মেয়ে অন্ধকারে থাকতে ভয় পায়। এই মেয়েটা যে কি করে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ভাবতে ভাবতেই লাইট অন করলাম।মেয়েটা যেন চমকে নড়েচড়ে বসল, ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মুখের সামনে ১হাত ঘোমটা টেনে খাটের এক কোণে পা দুলিয়ে বসে আছে।
আমি গলা কেশে পাশে এসে বসতেই সে উঠে দাড়াল, আবার আমি উঠে দাড়াতেই সে আবার বসে পড়ল। আমি আবার বসতেই সে আবার এমনটা করল।
রেগে একটা ধমক দিয়ে বললাম, “প্রোবলেম কি আপনার?” ভাবলাম একটু হলেও ভয় পাবে। তা না পেয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিল, “ভাববেন না মাথায় প্রোবলেম নেই” এমন উত্তরে হতবাক হলাম। একটু নীরব থেকে বললাম,
— তাহলে এমন করছেন কেন?
— আসলে আমার নানু বলছে আপনার সামনে লইজ্জা পেতে। আমার লইজ্জা আসছিল না, তাই উঠবস করে পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
শুনেই হুমড়ি খেলাম। এসব কি বলে মেয়েটা! শেষমেশ একটা মাথায় গন্ডগোলওয়ালা মেয়ে বিয়ে করতে হলো। মেয়েটা আমার পাশে বসে বলে,
— আচ্ছা স্বামী আপনি গল্প পারেন? আমার না গল্প শোনা ছাড়া ঘুম আসেনা। একটা ভুতের গল্প ধরেন তোহ। আমি শুয়ে শুয়ে শুনি।
— এই আমি গল্প-টল্প পারিনা। সরুন আমার কোলের কাছে থেকে। বলেই উঠে পড়লাম। মেয়েটা কান্না জুড়ে দিয়ে বলল, “স্বামীগো, গল্প না শুনলে আমার ঘুম আসেনা। আমি কি সারারাত জেগে থাকমু? আমার তো চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে!”
এইবার মেজাজ প্রচুর খারাপ হয়ে গেল, একটা ধমক দিয়ে বললাম,
— ঘুমাও তো। বিরক্ত করোনা আমাকে। বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে চলে আসলাম। এই মেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে মারবে সাথে থাকলে। বারান্দায় এসে বসে পড়লাম, চোখের সামনে প্রিয় মুখ টা ভাসছে। যার জন্য এতদিন অব্দি অপেক্ষা করছিলাম, যাকে ভালোবেসে সারাটাজীবন কাছে পাওয়ার আশা করেছিলাম।
সে কি আর কখনোই ফিরবেনা আমার কাছে? সে সত্যিই বুঝলো না কেউ একজন তাকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। হয়তো সে কখনোই আমাকে ভালোবাসেনি, চায়নি আমাকে। তাই অযুহাতে ছেড়ে চলে গেল।
ককর্শ গলায় গান শুনে চোখ মেলে তাকালাম। কালরাতে বারান্দায়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আরেহ এই মেয়েটা এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে বুজে জোরে জোরে গান গাইছে।
— এই চুপ করুন। এভাবে গান গাইছেন কেন?
— স্বামী আপনাকে এত ডাকার পরো যে আপনার ঘুম ভাঙল না। তাই আমি গান গেয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছি। আমার গায়ের লোকেরা বলে গো আমার কন্ঠ নাকি খুব সুন্দর। একবার যদি গান গাই, সবাই পাগল হয়ে শুনতেই থাকবে।
— অ্যাঁ, এটা সুন্দর কন্ঠ! অই আপনি আর আমার সামনে গান গাইবেননা।
— কেন গো স্বামী? আপনার কি এই গান পছন্দ হয়নি। আচ্ছা দাড়ান আমি আরেকটা বগির গান ধরছি।
— যাও এখান থেকে। মাথা খারাপ করে দিওনা আমার।
— আইচ্ছা স্বামী। আপনাকে রাতে বগির গান শুনাবো। আপনি তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে নিন, আমি আপনার জন্য ভালো নাস্তা বানিয়েছি গো। আসেন কেমন!
— আল্লাহ, আমি এই আমি কাকে বিয়ে করেছি!
বিড়বিড় কর‍তে করতে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। নাস্তা করতে বসতে ওই মেয়ের বকবকানি শুরু হয়ে গেল। “স্বামীগো, আপনি আরো ২টো রুটি খান। আমাদের গেরামের রহিম চাচা বেশী বেশী রুটি খায়, তার স্বাস্থ্য ও মাশা আল্লাহ একদম হিরোদের মত।”
— এই তুমি চুপ করবে। এত রুটি দিচ্ছো কেন? আমাকে কি রাক্ষস মনে হয়। একদম ওভার কিছু করতে যাবা না আমার জন্য।
— আপনার জন্য করব না তো কার জন্য করব স্বামী? আরো ২টো নিন।
— ড্যামেজ।? বলেই উঠে চলে আসলাম। প্রচন্ড গেয়ো আর বাচাল একটা মেয়ে। কিন্তু প্রচন্ড ধর্মনুরাগী। তবে খুব মায়াবী চেহারা একদম আমার ওর মত। নামটা ও একটু পুরোনো টাইপের, মনেই থাকেনা। খালামণি যে কোন গ্রহ থেকে ওকে যোগাড় করে এনেছেন কে জানে!
হাজার বলেও বিয়েটা আটকাতে পারলামনা, খালামণি তো আর জানেনা আমার বউ হিসেবে একজনের পরিচিতি আছে। অবশ্য সেসব এখন অতীত।
কিন্তু অপেক্ষা আজীবন ই করব তার ফিরে আসার।

অফিসের কাজ সেরে বাসায় ঢুকতেই ওই মেয়েটা খাটের উপর পা তুলে বসে অপরপাশে ফিরে আছে। উঁকি দিয়ে দেখি মেয়েটার সামনে একটা বড় সাপ ফণা তুলে বসে আছে। আমি আতকে উঠলাম অথচ মেয়েটার এত কাছে সাপ বসে আছে ওর কোনো রিয়েকশান নেই। অপলক সাপের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার পিছনে রাখা লাঠি নিয়ে যেই সাপটাকে আঘাত করতে উদ্যত হলাম, ও উঠে আমার হাত ধরে ফেলল। সাপটা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সুড়সুড় করে দ্রুত জানালা দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি ওকে রেগে বললাম, “তুমি কি পাগল?”
— সব প্রানী বিষাক্ত হয়না, কিছু প্রানী তার বাহিরেও হয়। হতেও তো পারে এটা তার ছদ্মবেশ। তাই সবসময় সব প্রানী আঘাত করবেননা। তাদের অস্তিত্ব শুধু শরীরের রুপে নয়।
— এসব কি বলছো? ওইটা তো সাপ ই ছিল। ও কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। আমি ধপাস করে রেকিং চেয়ারে বসে পড়লাম। মেয়েটার কথার কিছুই আমি বুঝলামনা। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। এভাবে কেউ সাপের সামনে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে, সাপটাও ওকে কিছু করল না। মেয়েটা কি বেদেনী নাকি অন্য কিছু? আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। এমনসময় ও খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ঢুকল।
আমার দিকে বাড়িয়ে দিল বলল, “খেয়ে নিন।”
— ক্ষিদে নেই, খাবোনা। নিয়ে যাও।
— মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপনি ক্ষুধার্ত । জেদ না করে খেয়ে নিন তো।
— খাবোনা বললাম না। প্লীজ এইগুলা নিয়ে যাও।
— খাবেন না তোহ?
— না খাবোনা। যাও। মেয়েটি আবার রুম থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। আমি ক্লান্তিতে চোখ বুজলাম। খানিকবাদে টের পেলাম কেউ আমার হাত চেয়ারের সাথে বাধছে।
— এই মেয়ে, হাত বাধছো কেন? খুলো বলছি।
— খুলবোনা।
— এত সাহস কেন তোমার! তাড়াতাড়ি বাধন খুলো বলছি।
— না খেলে খুলবোনা। আগে খেতে হবে নতুবা সারারাত এভাবেই বেধে রেখে দিব। নিন হা করুন বড় করে।
— জোর করছো? চোখ বড় করে বলল,
— বেশ করছি। নিন খেয়ে নিন। অনিচ্ছায় ওর হাতে খেয়ে নিলাম। রাগ করব নাকি ঝাড়ি দিব সেটাই বুঝতে পারলামনা। খাওয়া শেষে আচল দিয়ে আমার মুখটা মুছে দিয়ে বাধন খুলে দিল। খাটের উপর আধশোয়া হতেই আমার পায়ের কাছে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?”
— কেন? সেটা জেনে তোমার কি কাজ?
— বলুন, জানতে ইচ্ছে করছে।
— হুম বাসি।
— কে সে? কোথায় আছে?
— সে আমার মুনতাহা। আমি জানিনা এখন ও কোথায় আছে। ও মানুষ নয় একজন জ্বীনকন্যা। তাসত্ত্বেও আমি ওকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু ও আমার ভালোবাসা প্রত্যাখান করে ওর নিজের জগতে ফিরে গেছে। হয়তো জ্বীন রা মানুষের ভালোবাসা বুঝেনা, তাই হাসনাতের ভালোবাসা উপেক্ষা করে চলে গেছে।
— তাহলে ভুলে যাননি কেন?
— সম্ভব হয়নি। আশা আছে, ও একদিন ঠিক আমার কাছে ফিরবে। তার হাসনাতের ভালোবাসা একদিন তাকে ঠিক ফিরিয়ে আনবে।
— যদি সত্যিই সে ফিরে আসে কি করবেন?
আমি চমকে তার দিকে তাকালাম। এর উত্তর আমার জানা নেই। কিছু বলার আগেই ঘরে প্রচন্ড দমকা হাওয়া ঢুকল। রুমের লাইট নিভু নিভু হয়ে একদম নিভে গেল। ভীষণ আওয়াজ হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ ঘরটাতে ধস্তাধস্তি করছে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। বাতাসের বেগে কি একটা উড়ে এসে আমার কপালে লাগল। টের পেলাম তরল কিছু আমার কপাল বেয়ে নেমে আসছে। অন্ধকারেই কয়েকবার এই মেয়ে বলে ডাকলাম। কিন্তু ওর কোনো সাড়াশব্দ নেই। এক জোড়া জ্বলজ্বল করা লাল চোখ আমার দিকে এগিয়ে আসছে, ভয় পেয়ে গেলাম। ওইটা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তেই আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম। একটা গোঙানির শব্দ কানে আসল তখনি পরিবেশ শান্ত হয়ে এল। লাইট ও জ্বলে উঠল। তাকিয়ে দেখি পুরো রুমের জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। রুমের কোথাও সে মেয়েকে দেখলামনা। মেঝেতে অনেকটা রক্ত ছিটিয়ে আছে।

কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়? কপালটা কেমন জ্বালা করে উঠল। মাথাটা ঘুরঘুর করছে, চোখের সামনে সবটা ঝাপসা হয়ে এল।
.
(চলবে)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here