জ্বীনবর,পর্বঃ ০৫
Writer: Asstha Rahman
একটুপর অনুভব করলাম উনি আমার পাশে বসল এবং নরমকন্ঠে বললেন, “একি আবার কান্না শুরু করলেন!” চোখ মুছতে মুছতে বললাম,
— এভাবে হুট করে চলে গেলেন কেন?
— আমি চলে গেলে আপনার কি! যতটা জানি জ্বীন দের মানুষ কখনোই কাছে আসতে দিতে চায়না। ভয় পায়, ঘৃণা করে তাদের।
— আমি জানিনা। এইটুকু জানি আপনাকে খুব মিস করি, নিজেকে এখন একা মনে হয়না। আশেপাশেই আপনার অস্তিত্ব টের পাই।
আপনার কন্ঠ শোনার অপেক্ষা করি। উনি গম্ভীরকন্ঠে বললেন,
— আপনি এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত নন.
— পরিণতি, ভবিষ্যত কি হবে আমি জানিনা। জানতেও চাইনা। দয়া করে আপনি এমন করবেননা।
— আমি দেখতে খুবই ভয়ানক।
— দেখে তো আর আপনাকে অনুভব করছিনা। কন্ঠটা তো আপনারই। কন্ঠটাই আমাকে আপনার আগমনি বার্তা দেয়।
প্রথম বারের মত উনি আমার হাতদুটো স্পর্শ করলেন। আমি কেপে উঠলাম, এত্ত ঠান্ডা কেন উনার হাত! হাতদুটো জড়িয়ে বললেন, ” আল্লাহর আর নিজের উপর সবসময় ভরসা রাখবেন। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তবে কখনোই আল্লাহর পথ থেকে বিমুখ হবেননা। গুরুজনের অবাধ্য হবেননা।
জানিনা আপনার সাথে আর দেখা হবে কিনা! তবে আপনি সবসময় আমার মনে থাকবেন। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলছেন এসব উনি! উনি কোথায় যাবেন? আর কি আমার সাথে দেখা দিবেননা।
আমি উনার হাত শক্ত করে বললাম, “আপনি কি আর আসবেননা? আপনার ভীতুনিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?”
মুর্হূতের মধ্যে আমার হাতটা শূণ্য হয়ে গেল। উনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। খুব কষ্ট হচ্ছে, কেন উনি এমন করলেন। রুমের আলো ও জ্বলে উঠেছে। কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারলামনা। কাদতে কাদতে ভাবলাম, “উনি কি আমার অনূভূতিগুলো পছন্দ করেননি? এমন করবেন জানলে কখনোই বলতামনা। আমার সব আশা উনি ভেঙে দিলেন। এমন না করলেও পারতেননা।
যাবেনই যখন তবে মায়া জাগাতে এলেন কেন?”
মনটা খুব খারাপ এই কয়েকদিন। উনি যাবার পর থেকে একটা আশায় ছিলাম। উনি উনার কথা ভুল প্রমাণ করে আবার আসবেন আমার কাছে। কিন্তু আর ফিরে এলেননা। বাবা তখনি আমার রুমে এসে দরজায় টোকা দিলেন। আমি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে মাথায় ওড়না দিয়ে বাবার সামনে এসে দাড়ালাম । বাবা আমার মুখে হাত দিয়ে বললেন,
— তোমার কি মন খারাপ মা?
— নাতো বাবা। কিছু বলবা?
— হুম মা। একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন, ” তৈরী হয়ে নাও।” অবাক হয়ে বললাম,
— কেন বাবা?
— এখুনি তোমার বিয়ে পড়াব।
— কি বলছো বাবা? হঠাৎ বিয়ে!
— হঠাৎ নয় মা, অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম এই ব্যাপারটা। আজই ঠিক করলাম তোমায় বিয়ে দিব। খুব সাধারণভাবে সম্পন্ন করব।
— বাবা আমায় না জানিয়ে তুমি বিয়েও ঠিক করে নিলে?
— তুই আমার মতের উপর কথা বলবিনা, এই ভরসা আমার আছে।
— বাবা আমি এই বিয়ে….ওঘর থেকে বাবার ডাক এলো। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বলল, তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। বাদ যোহর তোমার কাবিননামা হবে।
বাবা চলে গেলেন। আমি উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। কি করব আমি! বাবার কথা ফেলব নাকি রাখব? না রাখলে বাবা কষ্ট পাবেন।সেই ছোট থেকে আদরযত্নে এত বড় করেছেন, তার মনে কষ্ট দিলে কি আল্লাহ আমায় ক্ষমা করবেন?
প্যাকেট খুলে দেখি অনেক সুন্দর একটা বোরকা। পরে মুখটাও ঢেকে নিলাম। বিয়ের কনে বোরকা পড়ে এটা জানা ছিলনা। বাবা হয়তো এমন কারো সাথেই বিয়ে দিচ্ছেন যে বাবার মত একজন আলেম।
যোহর নামায শেষ করে বাবা আমার ঘরে এলেন। দোয়া পড়ে কবুল বলতে বললেন। মুখ দিয়ে কবুল শব্দটা বের হচ্ছিলনা।তাও কোনোরকম তিনবার কবুল বলতে গিয়ে হু হু করে কেদে দিলাম। মনে মনে উনাকে ডাকছি, উনি যদি সাড়া দিয়ে তার ভীতুনিকে এই বিপদ থেকে সাহায্য করেন। কিন্তু কিছু হলোনা। বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল। যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে এখনো দেখলামনা।
কোথায় বসে আছে তাও জানিনা।
কাদতে কাদতে বাবা ভাইকে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। পাশে বসে যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন তিনিই আমার স্বামী বুঝতে কষ্ট হলোনা। কেননা, আমাদের সাথে আর কেউই নেই। তাকালামনা তার দিকে, বড্ড অভিমান ভর করেছে আমার উপর। এই মানুষটা আর বাবার উপর। গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। জ্বীনসাহেবকে খুব মিস করছি, তার কথা মনে পড়তেই চোখ থেকে দু’ফোটা জল চেহারায় গড়িয়ে পড়ল।
এমন একজনকে নিজের আপন করে পেতে চেয়েছি, যে আমার ব্যাপারে সম্পূর্ন উদাস। আমার চাওয়ার দামটুকুও সে দিলনা। খুব ঘৃণা হয় তাকে। ভাগ্যটা আমার প্রচন্ড খারাপ।নাহলে কি সবসময় আমার সাথে এমন অন্যায় হয়। ফিরে তাকাতে দেখি আমার স্বামী আমার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার দিকে মুখ না ফিরিয়ে টিস্যু নিয়ে নিলাম।এমন একটা মানুষের পাশে বসে থাকতেও ইচ্ছে হচ্ছেনা যে কনের মতামত ছাড়াই তাকে বিয়ে করে নেয়।
বিকেলে এসে শ্বশুড়বাড়িতে পৌঁছালাম। অনেক বড় এবং সুন্দর বাড়ী তাদের। কিন্তু পুরো বাড়িতে তিনজন মেয়ে ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়লনা। তারা আমাকে একটি ঘরে বসিয়ে রেখে গেল। খুব ক্লান্ত লাগছিল, চোখে কেমন জানি ঘুম নেমে আসছে। বোরকাটা খুলে গা টা বিছানায় এলিয়ে দিতে ঘুম চলে এল।
.
(চলবে)