জ্বীনবর,পর্বঃ ০৬
Writer: Asstha Rahman
কারো রুমে ঢুকে দরজা লক করার শব্দে ঘুম ভাঙল। উঠে বসে দেখি আমার স্বামী নামক প্রানীটি ঘরে এসেছে। হাতে আবার ভারী খাবার সাজানো ট্রে। ট্রে টা বেডটেবিলে রেখে আলমারী থেকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি বের করে হাতে দিয়ে ইশারা করলেন ফ্রেশ হয়ে নিতে। আমি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ভাবলাম, উনি কি বোবা নাকি? ইশারা দিয়ে বুঝালো কেন? বাবা শেষমেষ আমাকে একটা বোবা ছেলের সাথে বিয়ে দিল। আল্লাহ! কি জানে কি হবে?
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি উনি বিছানার উপর বসে খাবার হাতে বসে আছেন। আমি আসতে ইশারায় পাশে বসতে বললেন। লক্ষী মেয়ের মত পাশে বসলাম। উনি খাবার আমার মুখের সামনে ধরলেন, খাইয়ে দিতে চাইছেন হয়তো। আমি বললাম, আমি খেয়ে নিতে পারব। উনি তাও হাতটা মুখের সামনে ধরে রাখলেন। আজিব তো! জোর করে খাইয়ে দিয়ে ছাড়বে নাকি। এমনিতেই অনেক ক্ষুধা লেগেছে, তাই বাড়াবাড়ি না করে উনার হাতে খেয়ে নিচ্ছি। এতক্ষণ ভালো করে উনার দিকে না তাকালেও এখন তাকালাম। টকটকে ফর্সা, লম্বা চওড়া। চেহারায় এক একটা মায়া মায়া ভাব আছে। নাকের উপর মোটা ফ্রেমের চশমা থাকায় আরো বেশি ভালোলাগছে দেখতে। মোটামুটি পুরাই কিউটের ডিব্বা। শুধু আফসুস এত সুন্দর এবং ধনী হওয়া সত্ত্বেও বোবা। আল্লাহর কি নিয়ামত!
এমন ভাবে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে যেন আমি অসুস্থ রোগী। পানিটাও নিজের হাতে খেতে দিলনা। খাওয়া শেষে উনি এসব রাখতে নিচে গেলেন। আমি আর কি করব বসে বসে রুমটা দেখছি। ভদ্রলোকের দেখি বেশ রুচি আছে। অনেক সুন্দর করে রুমটা সাজিয়েছেন। আমি তো ভুলেই গেছি আজ আমাদের বাসররাত।
আজ কি উনি আমার সাথে থাকবেন নাকি? ভেবেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। আল্লাহ কি হবে আমার! এমনি ভাবনার সময় উনি ঘরে ঢুকলেন। ইশারায় একটা লম্বা সালাম দিলেন। আমিও সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, “কিছু বলবেন?” ভেতরে ভেতরে লজ্জায় মরে যাচ্ছি। যা আমার করার কথা সেটা উনি করছেন। কি ভাব্বেন কি জানি! উনি মাথা নাড়িয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে ডাকলেন। বুঝলাম উনি নামায পড়তে ডাকছেন। বাসররাতে স্বামী স্ত্রী মিলে যে নামায আদায় করতে হয় ওযু করে আমরা দুজন মিলে সেটাই আদায় করলাম। নামায শেষে একলাফে উনার আগে বিছানায় উঠে এক কোনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমোনোর ভান করলাম। জানি এই পদ্ধতি কাজে দিবে নাকি তাও করলাম। উনাকে আমি মন থেকে স্বামী হিসেবে মানিনি এখনো তাই তার সাথে স্ত্রীর মত আচরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুটা সময় পার হয়ে গেল আধ চোখ মেলে দেখলাম উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আল্লাহ তুমি বাচাও আমারে। প্রস্তুত হয়ে নিলাম আমাকে স্পর্শ করলে কড়া কথা শুনিয়ে দিব ঘুম ভাঙানোর জন্য। উনি এসে আমার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে চলে গেলেন। যাক বাবা হাফ ছেড়ে বাচলাম। রুমের লাইট অফ করে হালকা পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে দিলেম। আমি বিছানা হাতড়াতে লাগলাম উনি পাশে আছেন কিনা বুঝতে। পুরো বিছানায় আমি একা। উনি কই? ঘুমের মধ্যে খাটের নিচে পড়ে গেলেন নাকি! খাটের নিচটায় একবার উঁকি দিলাম। পুরো ঘরেই উনি নেই। অন্য ঘরে ঘুমিয়েছেন ভেবে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে গেলাম।
ফজরের আযান দেওয়ার সময় ঘুম ভেঙে গেল। দেখি কেউ ঝুকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আতকে উঠে বসল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। বিরক্ত বোধ করলাম, এভাবে কেউ ভয় লাগিয়ে আবার হাসে। কচুর স্বামী। উনি ঘড়ির দিকে ইশারা করলেন। আমি কিছু না বলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়লাম। নামায পড়ে উনাকে রুমে দেখলামনা । এই আবার কেমন মানুষ। এই দেখি আবার এই নাই! উনাকে খুজতে রুম থেকে বের হলাম। পরে কি ভেবে উনাকে না খুজে সোজা বাসার বাহিরে আসলাম। উনার বাসার সামনেও অনেক বড় বাগান। মৃদু মন্দ বাতাস বয়ছে, চারদিকে পাখির কলরব। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে ভালোলাগা অনুভব করছি। চোখ খুলে দেখি উনি আমার সামনে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়েছে আছেন। আমাকে চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে পাশে থাকা দোলনায় বসার ইশারা করলেন। কি যে হচ্ছে বুঝতেই পারছিনা! এত্ত কেয়ার করে কেন? এই কেয়ারিংটা আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে যাচ্ছে। আমি চা টা খেয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। এই বাড়িতে মানুষ একজন কিন্তু রুম অনেকগুলা। রান্নাঘর খুজে পেতে বেগ পেতে হল। ঢুকে দেখি মেয়ে ২টা নাস্তা প্রস্তুত করছে। আমাকে দেখে সবিনয়ে সালাম দিল। একজন হাসিমুখে বলল, ” আপনি আবার কস্ট করে রান্নাঘরে আসতে গেলেন কেন ভাবী?”
— সব কাজ কি তোমরা একা করবা নাকি বোন? আমিও একটু হাত লাগাই। অপরজন বলল,
— আপনি নতুন বউ। কিছুদিন না করলে কিচ্ছু হবেনা। সংসারটা তো আপনারই। এই কয়েকদিন বরঙ আমাদের ভাইয়ার সেবা করুন। বলেই দুজন খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। আমার এসব কথা শুনে লজ্জা লাগছে। তবে মিশুক টাইপের মেয়েগুলোর সাথে কথা বলে অস্বস্তিটা অনেকটাই কাটিয়ে নিলাম।
একসাথে বসে দুজন নাস্তা করার পর উনাকে আর বাকিটা সময় বাসায় দেখলামনা। কোথায় গেছে বলেও যায়নি। এইদিকে আমি গোসল করতে যাব, পরার মত শাড়ি পাচ্ছিনা। বাসা থেকে কিচ্ছু আনিনি, এইবার পড়বটা কি! মনে পড়ল কাল রাতে উনি আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে দিয়েছেন।
সেই ভেবেই আলমারি খুলে দেখি অনেক শাড়ি-গয়না সাজিয়ে রেখেছেন উনি। বাহ! বিয়ের আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। এমন স্বামী পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করার কথা কিন্তু আমার সেসব মনে হচ্ছেনা। আমি এমনটা চাইনি ঠিক তা নয়, তবে যাকে খুব করে চেয়েছি এই সে নয়। পুরোনো কথা মনে উঠতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। খুব জানতে করছেন উনি কেমন আছেন?
আমাকে কি একবারো মনে পড়েনা! স্বার্থপররা বুঝি এমনই হয়।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বিকেলের দিকে স্বামী কোন রাজকার্য সেরে বাসায় ফিরলেন। উনাকে ছাড়া আমার দুপুরের খাবার খেতে কেমন জানি লজ্জা করছিল। তাই মেয়েগুলো বার বার বলা সত্ত্বেও খেলামনা। পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে ডায়নোসর দৌড়াচ্ছে তাও পেট চেপে বসে আছি উনার অপেক্ষায়। শত হলেও নতুন বউ আমি, একটু আধটু তো এসব করাই লাগবে।
উনি রুমে ঢোকার সাথে চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকালাম আর মনে মনে যত ভদ্র গালি আছে একটাও দিতে বাদ রাখলামনা। উনি আমার এই রুপ দেখে থতমত খেয়ে গেলেন। কি যেন ভেবে রুম থেকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন।
আচ্ছা পচা লোক তো একটা মেয়ে তার জন্য সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছে আর তিনি গায়ে হাওয়া লাগাতে আবার বেরিয়ে গেলেন। নিজের কষ্ট নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝেনা। হায় কপাল, এমন একটা স্বামী ও ভাগ্যে ছিল।
মিনিট কয়েকের মধ্যে উনি আবার খাবার নিয়ে হাজির। খাবার দেখেই নিয়ে খেতে শুরু করলাম। একটু খাওয়ার পর উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি ড্যাপড্যাপ করে আমার খাওয়া দেখছেন। বিষম খেয়ে গেলাম, উনি তাড়াতাড়ি উঠে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে মাথায় ফু দিয়ে দিলেন।স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি খাবেননা?” উনি কিছু না বলে বড় করে হা করলেন।
এমা এই দামড়া ছেলেটাকে কি এখন খাইয়ে দিতে হবে নাকি! হা যখন করে আছেন, না খাইয়ে দিয়ে উপায় কি!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাইয়ে দিলাম।
.
(চলবে)