জ্বীনবর,পর্বঃ ০৭
Writer: Asstha Rahman
রাতে খুব ছটফট করছি, ঘুম আসছেনা। আমার পাশের মানুষটা কি নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছে। উনি পাশে শোয়ায় খুব অস্বস্তি লাগছে। কিছুক্ষণ এই পাশ ওই পাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম আসছেনা। কেন জানি মনে হচ্ছে জ্বীনসাহেব আমার আশে পাশেই কোথাও আছে। বিছানা থেকে নেমে অন্ধকারে হাতড়ে রুমের জানালা খুলে দিতেই এক ফালি জ্যোৎস্না এসে আমার গায়ে পড়ল।
এমনি এক জ্যোৎস্নায় সে আমার পাশে ছিল। খুব মনে পড়ছে তার কথা। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে অতীতের স্মৃতিচারণ করছি। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় একটা কন্ঠ ভেসে এল, ” আমাকে কি খুব মনে পড়ে?”
চমকে উঠে রুমের এইদিক ওইদিক তাকাতে থাকি। ভুল শুনিনি, সত্যি আমার জ্বীনসাহেব ফিরে এসেছেন। জানালার অপরপাশে অন্ধকারে একটা আবছা প্রতিমুর্তি দেখে বুঝলাম এতদিনের ব্যর্থ আশা বাস্তবতায় পরিণতি পেয়েছে।
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম, “আপনি কি জানেননা?”
— হুম জানি তো। কেমন আছো?
— আপনাকে ছাড়া যেমন থাকা যায়। আপনি তো খুব ভালো আছেন। একটু হেসে বলল,
— অবশ্যই। আমি কি খারাপ থাকতে পারি এত মিষ্টি বউ থাকতে। কথাটা নিমিষে গিয়ে কলিজায় লাগল।
— আপনার বউ মানে? আপনি বিয়ে করে নিয়েছেন?
— তা তো আপনিও করেছেন।
— বাধ্য হয়ে করেছি। মনে শুধুই আপনার রাজত্ব এখনো। কিন্তু আপনি এটা কি করে করতে পারলেন?
— কেন? আমার যাকে পছন্দ তাকে কি বিয়ে করতে পারিনা? টের পেলাম আমার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সেটা উনার চোখে পড়ার আগে মুছে নিয়ে বললাম, ” তা আপনি অবশ্যই পারেন। ভালো থাকবেন!” বলে জানালার কাছ থেকে সরে আসতে চাইলাম। উনি নরমকন্ঠে বললেন,
— আমায় দেখতে চাননা বুঝি?
— অন্যের স্বামীকে দেখে কি করব!
— তাও দেখে নিজের মনকে শান্ত করুন। বলেই জানালার চাঁদের আলোয় এসে দাড়ালেন। আমি পাথরের মত দাড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম।
নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, “একি আপনি?”
সে মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমি আপনার বর”
— এটা কি করে সম্ভব হল?
— মনের টান টা শক্ত থাকলে সবি সম্ভব!
— এটা কোনো মায়া নয় তো?
— একদমই না। আমি মুস্তফা, আপনার বাবার বিশ্বস্ত পালিত জ্বীন। ছোট থেকেই আপনার বাবার কাছেই বড় হয়েছি, উনার আদেশেই আপনাকে বিয়ে করেছি।
— বাবা রাজি হলেন?
— আপনার বাবার মনের আশা ছিল তার পুত্র সমতুল্য জ্বীনের সাথে আপনার বিয়ে দেওয়ার। এর পিছনে আরেকটা কারণ ও আছে। সেটা সময় আসলে জানতে পারবেন। এইটুকু বুঝলেন আল্লাহ আপনার আমার ভরসা টাকে মিথ্যে করেননি।
— শুকরিয়া আল্লাহর কাছে। আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু আপনি এটা কেন আমাকে আগে জানাননি?
— আপনার ধের্য্য দেখতে চেয়েছি। যাকে বিয়ে করেছি তাকে একটু যাচাই করবনা। অবশ্য এর জন্য মনে মনে নিশ্চয় আপনার কম বকা খাইনি।
আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আপনি আসলেই অনেক পচা। এত কষ্ট কি করে দিতে পারলেন!
উনি কিছু না বলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা বিশেষ মূহুর্তে প্রবেশ করার সময় হঠাৎ ঘরে একটা বিকট শব্দ হল। উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। উনাকে ডাকলাম কয়েকবার কিন্তু সাড়া পড়লাম না। কিছুক্ষন পর ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনলাম। মনে হল কেউ যুদ্ধ করে ঘরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে।আমার জ্বীনবরের গোঙানি শুনে আমি আর বসে থাকতে পারলামনা। হাতড়ে রুমের লাইটটা অন করলাম।
লাইট অন করতেই দেখি ঘরটা এলোমেলো হয়ে আছে, মুস্তফা মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার নাকমুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। তার এই অবস্থা দেখে আমার প্রচন্ড কান্না চলে এল। সেবাযত্ন করে উনার জ্ঞান ফেরালাম।
বিকেলের দিকে উনি অনেকটা সুস্থ হলেন।তখনি হুট করে বললেন, “চল বাবার বাসা থেকে ঘুরে আসি।”
— কিন্তু আপনি তো অসুস্থ।
— আমি এখন অনেকটা সুস্থবোধ করছি। চল, তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমি আর কথা না বাড়িয়ে উনার কথামত প্রস্তুত হয়ে গাড়িতে উঠে বসল।
উনি চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করছেন। আমার মনটা বড্ড খুতখুত করছে। একে তো উনার উপর আক্রমন হয়েছে কেন,কি কারণে, কার দ্বারা হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। এর উপর অসুস্থতা নিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। কিছুই বুঝতে পারছিনা।
নীরবতা ভেঙে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কাল রাতে কে আপনাকে আঘাত করেছে?”
— যে চায় না আমরা একসাথে থাকি। কথাটা মাথায় ঢুকে গেল। ভাবতে লাগলাম, কে চায়না? তবে উনার জগতের কেউ চাচ্ছেনা উনি মানুষের সাথে সংসার করুক। তাই উনাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছে।
বাবার বাসায় ঢুকতেই বাবাকে সামনে পেলাম।সালাম কুশলাদি সেরে মুমিনের ঘরের দিকে গেলাম। অনেকদিন দেখিনা ভাইটাকে। মুমিনের সাথে দেখা করে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানালাম। চা নিয়ে বাবার ঘরের সামনে আসতেই শুনলাম। উনি বাবাকে বলছেন,
— বাবা আপনি আমাকে উপায় বলুন। আমি চাইনা মুশায়রাকে ওরা আঘাত করুক, আমাদের সংসারটা নষ্ট করে দিক।
— শান্ত হও মুস্তফা ।এমন বিপদের আশংকা আমিও করেছিলাম। কিন্তু ভেবোনা খুব তাড়াতাড়ি আমি কিছু একটা চেষ্টা করব। তোমরা এইখানে কিছুদিন থাকো
আমার এই বাসাটা বন দেওয়া আছে, কোনো খারাপ শক্তি প্রবেশ করতে পারবেনা।
এটা শুনে আমার হাত পা কাপতে শুরু করল। তার মানে আমি যা ভাবছি তাই হচ্ছে। মুস্তফা আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ভেতরে আসুন।
আমি হাসিমুখে কোনোরকম চা টা রেখে রুমে চলে এলাম। মাথার ভেতর হাজারটা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। মুস্তফার থেকে সব না জানা অবধি শান্তি পাচ্ছিনা।
রাতে ওর বুকে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলাম,” আমাকে দয়া করে বলুন কে আমাদের ক্ষতি চাইছে?”
— এমন একজন আছে। এসব ভেবোনা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। তিনি ঠিকিই আমাদের রক্ষা করবেন।
এই বলে তিনি আমাকে পরমযত্নে বুকের মাঝে টেনে নিলেন। কিছুদিন বাবার বাসায় থাকার পর বাসায় ফেরার জন্য রওনা হলাম। যাওয়ার সময় বাবা আমাদের দুজনকে দুটো আল্লাহর কালামের তাবিজ দিলেন এবং বললেন, “এটা কাছ ছাড়া করোনা তোমরা। আর মন দিয়ে আল্লাহ ডাকো, তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।”
(চলবে)