জ্বীনবর,পর্ব: ০১

0
6290

জ্বীনবর,পর্ব: ০১
Writer: Asstha Rahman

আনমনে বসে বাগানের দোলনায় দুলছি। হালকা বাতাসে চুল এলোমেলো হচ্ছে বারবার।তখনি বাবার ডাক, “এই মুশায়রা, এদিকে আসোতো মা!”
বাবার ডাকে অগত্যা উঠে বাসায় ঢুকে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালাম।বাবা মাথায় টুপিটা চড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন। একটু রাগমিশ্রিত স্বরে বললেন, তোমাকে বারণ করেছি না চুল খোলা করে বাহিরে যাবেনা! নামায পড়েছো? তাড়াতাড়ি মাথায় ওড়না দিয়ে
আমি মাথা নিচু করে আস্তে মাথা নাড়ালাম। বাবা হাতের ঘড়ি দেখে বললেন, “হাতে আরো ১০মিনিট আছে, যাও নামায পড়ে নাও.” আমি মাথা নাড়িয়ে চলে এলাম আমার রুমে।
.
আমার বাবাটা অনেক ধার্মিক। ধর্মের সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। এইজন্য গ্রামের মানুষরা বাবাকে খুব মেনে চলে এবং যে কোনো সমস্যায় বাবার কাছে ছুটে আসে। আমি মুশায়রা,বাবার একমাত্র মেয়ে, এইবার মাদ্রাসায় দাখিল পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছি। বাসায় আমি, ছোটভাই, বাবাই থাকি। মা কোথায় আছে তা জানিনা, খুব ছোটকালে দেখেছিলাম। চেহারাটাও ঠিক করে মনে পড়েনা। বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করা একদমই বারণ। এই ব্যাপারে কথা উঠলেই রেগে যান। বাবার এক বিশ্বস্ত বুয়াখালাই আমাদের দেখাশুনা করেন।
অজু করে নামায পড়ে নিলাম। আমার ধর্মের এসব নিয়ম কানুন মানতে ভালোলাগেনা। বাবা রাগ করবেন বলে বাধ্য হয়ে করি। বাবার কথা হচ্ছে উনি যে পথ সারাজীবন অনুসরণ করে এসেছেন, আমাদেরকেও অক্ষরে অক্ষরে তা করাবেন ইনশাল্লাহ।
মাঝে মাঝে বাবার এসব আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়। কত নিষেধ, কত নিয়ম পালন করতে করতে বিরক্ত লাগে।
.
এমনি ভাবনার সময় আবার বাবার ডাক এলো। চা নিয়ে বাবার রুমে প্রবেশ করে বললাম,
— ডাকছো বাবা?
— নামায পড়ছো?
–হুম আব্বাহুজুর। এই নাও তোমার চা।
— মুমিন ফিরেছে?
— এখনো তো ফিরেনি।
ধমকের সুরে বললেন,
— এখনো কি মাঠে খেলছে? কত বার বলেছি বিকালের সময়টা একটু হাদিস শিক্ষা নে। আজ আসুক হচ্ছে ওর।
.
মনে মনে ভয় পেলাম।আজ ভাইয়ের কপালে মাইর আছে। মুমিন ই আমার ছোট ভাই।বয়স ১১বছর। মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেনীতে পড়ে।
বাবা চায়ের কাপটা ফেরত দিয়ে বলল, “যাও তুমি ভেতরে যাও। কিছু মানুষ আসবে জরুরী কথা বলতে।”
বাবা কখনোই বাহিরের মানুষের সামনে আমাকে আসতে দেয়না। সবসময় পর্দায় থাকতে বলে।
চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম।
.
সন্ধ্যার পর বাবা নামাযঘরে থাকেন অনেকরাত অবধি। অই ঘরে আমাদের যাওয়া বারণ। আমি মাঝে মাঝে উকি মেরে দেখি বাবা অন্ধকারে অইখানে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। জিজ্ঞেস করার কথা ভাবতে পারিনা। কেননা, বাবা যা আমাদেরকে নিজে থেকে বলতে চাননা তা জিজ্ঞেস করলে তার বকুনি খেতে হয়।
এই সময়টা আমার ভয় ভয় লাগে। ঘরের সব বাতিগুলো নিভু নিভু করে। হালকা ঠান্ডা বাতাস পুরো ঘরে বিরাজ করে। ছোট ভাই পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করে আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে, “বুবু, বাবা কোথায়?” আমি হাতের কাজ করতে করতে বলি, “নামায ঘরে আছে। যা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বস।” মুমিন হাসিমুখে চলে যায় তার রুমে।
.
আমার বান্ধবীদের অনেকে বলে আমার বাবা নাকি জ্বিন পালে। তাদের সাথে কথা বলে। আমি ওদেরকে বুঝাতে পারিনা এসব বাবা করেননা। আমি কখনোই দেখিনি এসব।
অনেকে উপহাসের সুরে বলে, তোকে জানিয়ে করবে নাকি? তাছাড়া তোর বাবা এত বড় আলেম, তার বুঝি এসব থাকবেনা। ওদের কথায় আমি পাত্তা দেইনা।
তবে মাঝে মাঝে এইসব ভাবি, “ইস সত্যি যদি বাবার পোষা জ্বীন থাকত, তাদের একবার দেখতে পারতাম।” ছোটভাই শুনেই হাসতে হাসতে শেষ। আমার গলা জড়িয়ে বলে, বুবু আপনি এমনিতে যে ভীতু। সামান্য তেলাপোকা দেখে চিৎকার করেন, আপনি নাকি দেখবেন জ্বীন!
রাগ লাগে এসব শুনে।তাই ওকে আর আমার ভাবনাগুলো বলিনা।
প্রায় রাত ১০টায় বাবা নামাযঘর থেকে বের হলেন। আমি তখন টেবিলে খাবার এনে দিচ্ছিলাম। বাবা এসেই চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। পানির জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে এক নিমিষে ঢকঢক করে গিলে নিলেন। আমি একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা তুমি কি ক্লান্ত?” বাবা না বলে মুমিনকে খেতে ডাকলেন।
খাওয়ার পুরোটা সময় বাবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিলাম। কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ছে, চোখে মুখেও উউদ্বিগ্নতা।
জিজ্ঞেস করে লাভ হবেনা জেনেও বললাম, “বাবা, তুমি কি চিন্তিত?” বাবা চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন, “খাওয়ার সময় কথা বলতে বারণ করেছিনা?”
বকুনি খেয়ে একটু অভিমান জাগল। অস্ফুটস্বরে বললাম, আর বলবনা বাবা!
বাবা আর কিছু বললেননা। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমি সব গুছিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে বাবার ঘরে একবার উকি মারতে গেলাম। দেখলাম বাবা অন্ধকারে বসে তসবিহ পড়ছেন।
বিরক্ত না করে ওখান থেকে মুমিনের ঘরে ঢুকলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছে ও। ওর গায়ে হালকা কাথা দিয়ে ফ্যানের স্পিড কমিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলাম।
লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছেনা কিছুতেই।
বাবার চিন্তিত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেন যে বাবা কিছুতেই কোনো কথা বলতে চায়না।
আমার বাবাটা এমন কেন? সবার বাবারা কত ভালো হয়। ঘুরতে নিয়ে যায়, সবসময় আদর করে। মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। এসব কিছুই আমি পাইনা।
সব ভাবনা ঝেড়ে যেই ঘুমাব তখনি দেখি আমার ঘরের মেঝেতে একটা ছায়া পড়েছে। ছায়াটা অনেক লম্বা। আমার রুমের দিকে এগিয়ে আসছে। ভয় পেয়ে গেলাম। এটা অন্য কিছু নয়তো? চিৎকার করব নাকি ভাবতেই টের পেলাম ছায়াটা আমার ঘরে ঢুকে গেছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে মনে মনে সূরা পড়া শুরু করলাম।
অনুভব করছি কেউ আমার দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। অনেক কাছে এসে গেছে আমার।
মুশায়রা আজ তুই শেষ! জ্বীন তোর সামনে এলে এসেছে বলে বিড়বিড় করতে লাগলাম।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here