জ্বীনবর৩,পর্বঃ০৭,০৮

0
2400

জ্বীনবর৩,পর্বঃ০৭,০৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

মা কান্না বন্ধ করে অবাক হয়ে দোকানীর অর্থাৎ রহমত মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি চোখের পানি মুছে সুক্ষ্মদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। এত নিলর্জ্জ একটা মানুষ কি করে হয়? আমার হাতে এত কেলানী খেয়েও আমার বিপদের দিকে বেহায়ার মত বিয়ের কথা বলছে। একটা বিবাহিত বয়স্ক পুরুষ নিজের বউকে এত ভয় পায় তাসত্ত্বেও এমন কথা মুখে আনল কি করে! ছিঃ! পুরুষের জাতটাই আসলে খারাপ। রীতা এগিয়ে এসে বলল,
— এসব আপনি কি বলছেন রহমত কাকু? আপনার ঘরে একটা বউ থাকতেও আপনি বেহায়ার মত বিয়ের কথা বলছেন।
— একটা আছে ওই ব্যাটার মত তো ৩টা নাই। আর ওইটা তো আমার থেকেও বয়স্ক ছিল, আমার টাকা-পয়সা ও ওইটার থেকে কম নাই। আমারো যথেষ্ট সাধ্য আছে ওয়াফাহরে পায়ের উপর পা তুলে খাওয়াতে পারব। রাজরাণী করে রাখমু।
তাইলে তোমাগো আপত্তিটা কোনখানে?
ওইডার কাছে দিতে পারলে আমার কাছে দিতে পারবানা কেন?
জেঠিমা অনেকক্ষণ পর মুখ খুলে বলল,
— আপনার বউ রাজি হইব এটা মানতে?
— কেন হইব না! হে তো আমারে এখনো অবধি বংশপ্রদীপ দিতে পারলনা। বাজা হওয়া সত্ত্বেও আমার ঘাড়ের উপর পা তুলে রাজত্ব করতাছে। অন্য ব্যাটাদের মত এখনো বের করে দিই নাই বাজা বলে, এর চেয়ে বড় কপাল ওর আর কি হইতে পারে!
ওয়াফাহরে শুধু আমার বংশরক্ষার জন্য বিয়া করমু। আপনারাই বলেন, এসব ঘটনের পরও কি কেউ ওরে বিয়া করতে রাজি হইব? ও ওয়াফাহর মা তুমি কও, মনমত জামাই-ঘর খুজে পাইবা তো। মাইয়াগো কলঙ্ক এত সহজে মুছে নাহ। তাও আমি সব জেনে রাজি হইসি, এটা ওর কপাল।
ওর দরকার ভালা একটা ঘর, যেখানে ও আরাম-আয়েশে জীবন কাটাইতে পারব। আর আমার দরকার আমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এখন তোমরাই ভাইবা কও মাইয়ারে আমার কাছে বিয়া দিবা নাকি আজীবন ঘরে বসাইয়া মাইনষের কথা হুনবা! আমি এখানে বসলাম, তোমরা ভাইবা জানাও।
জেঠিমা মাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি উনার দিকে এগিয়ে এসে বললাম,
— এত লালা কিসের তোর? এত কেলানী খাওয়ার পরও কোন মুখে আমাকে বিয়ের কথা বলিস? বেহায়া হারামজাদা।
— হাহাহা, দে ইচ্ছেমত গালি দে। এসবের শোধ তুলমু শুধু একবার আমার উঠোনে পা রাখ। খুব দেমাগ বাড়ছিল তোর! তোর এসব আমি ছুটামু ওয়াফাহ। আজ তোরে আমার দ্বিতীয় বউ কইরা ঘরে তুলমু।
— তোর এ শখ জীবনেও পূরণ হইব না। বলে মাটি থেকে দা টা হাতে নিলাম।
উচিয়ে ধরে বললাম, ভালোই ভালোই বলছি এই মূহুর্তে আমার বাড়ী থেকে বের হ। নাহলে আজ তোর মাথা তোর মাথার জায়গায় থাকবেনা।
মা বেরিয়ে এসে বলল, রহমত মিয়া আপনার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নাই। আপনি এখনি বিয়ের কাজ শুরু করতে পারেন।
শুনে আমার হাত থেকে দা পড়ে গেল। রহমত মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে পৈশাচিক হাসি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি মায়ের কাছে ছুটে এসে বললাম, মা তুমি এসব কি বলছো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দেওয়ার সময় তুমি একবারো ভাবছো না?
মা কঠিনদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ঘরের মেয়ে যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন আর কিছু ভাবার থাকেন। নষ্টামির শেষ সীমানা পার করে ফেলেছিস, এখন যা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নে। আমি নষ্ট মেয়ে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারবনা। এই বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তুই ভুলেও আমার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবিনা।
আমি ভুলে যাব, তুই আমার মেয়ে ছিলি।
আর তুই ও ভুলে যাবি, তোর মা ছিল। বলে মা আবার ঘরে ঢুকে গেল। আমি ঘরের দাওয়ায় বসে পড়লাম। জেঠিমা আমাকে তুলে আবার স্টেজে বসাল।
কাজী বিয়ে পড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। আল্লাহ এ তোমার বিচার? এ তোমার ভালো করা! আমি তো তোমার উপর ভরসা রেখেছি, তাও কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে!

কাজী বার বার তাগাদা দিচ্ছে কবুল বলার জন্য। কিন্তু আমার পাথর হয়ে যাওয়া মুখ দিয়ে টু শব্দ টিও বের হচ্ছেনা। জেঠিমা আমার গায়ে জোরে একটা গুতো মেরে বললেন, কিরে বেশ্যা, এখন কবুল বলতে পারস না কেন?
রাত বিরাতে তো ঠিকিই নাগরের লগে নষ্টামি করতে পারিস। কবুল বল, আর পাপমুক্ত হ। তোর পাপের মুখ আমার আর সহ্য হচ্ছেনা।
নিঃশেষ হওয়ার অন্তিম সময় বোধহয় ঘনিয়ে এসেছে। আর কোনো উপায় নেই এই বিয়েটা করা ছাড়া। ভিতর থেকে না আসলেও বাহির থেকে আমাকে কবুল বলতে হবে।
কবুল বলতে যাব এই মূহুর্তে কেউ একজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
— ওয়াফাহ, আপনি কবুল বলবেননা।
মুখ তুলে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে দেখলাম, একটা ভীষণ টকটকে লাল ফর্সা, লম্বা, সাদা পাঞ্জাবি পড়া সুদর্শন ছেলে তার প্রচন্ড মায়াভরা ডাগর ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক চিনতে পারলামনা উনাকে। রহমত মিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলল, ওই মিয়া, তুমি কেডা? ও কবুল বলবে কি বলবেনা সেটা তুমি ঠিক করে দেওয়ার কে!
ছেলেটা মূহুর্তে বলল, ওয়াফাহ আমার জন্য কবুল বলবে। আমি তাকে নিকা করব।
— অই মিয়া, মগের মুল্লুক পাইসো? আমার কেনা মাল নিজের বইলা নিয়া যাইবা। এত সাহস হয় কেমনে! ভালা চাইলে এখান থেইক্কা চইলা যাও।
— হ্যা যাব তো বটেই। কিন্তু একা নয়, আমার বউ ওয়াফাহকে সঙ্গে নিয়ে।
তার মুখে বউ শব্দটা শুনে ভেতরটা কেপে উঠল। আমি আবার তার বউ হলাম কবে? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা, এই ছেলেটাই বা কে?
চুপ করে তার কান্ড দেখতে লাগলাম আমি, আসলে সে কি করতে চায় তা বুঝতে। রহমত মিয়া আরো ক্ষেপে গিয়ে বলল, তুই কি যাবি এখান থেকে?
— আমি নয় আপনি যাবেন। দেখুন আপনার স্ত্রী আপনাকে নিতে এসেছে। তার কথা শুনে বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাকীমা ঝাটা হাতে দাঁড়িয়ে রাগে ফুসছে। বিশ্রী টাইপের গালি দিতে দিতে রহমত মিয়ার দিকে ছুটে আসলেন। এসে আচ্ছামত ঝাটা পিটা করতে লাগল আর বলতে লাগল,
— হালার পো, আমারে ২সপ্তাহের জন্য বাপের বাড়ী পাঠিয়ে তুই নিজের মেয়ের বয়সী কচি একটা মাইয়ারে বিয়ে করতে আইসোস। এই জন্য ই তো বলি কাল রাত থেকে এত গদগদ ভাব কেন? সকাল না হতে গাড়ী ডেকে আমি পাঠিয়ে দেওয়া। চল তুই বাড়ীতে, তোর বংশরক্ষা আমি ছুটামু হালা।
রহমত মিয়ার অবস্থা ছিল পুরো দেখার মত। ঝাটার পেটা খেতে খেতে বাড়িতে গেল লুইচ্চাটা। এই ঘটনায় সবাই নীরব হয়ে গেল, তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখতে লাগল। আমি নিজেও ভাবছি এই অচেনা আগন্তুক কে?

এইবার আর দ্বিমত না করে ছেলেটাকে বিয়ে করে নিলাম। শেষমূহুর্তে যে ফেরশতার মত আমাকে বাচালেন, তাকে বিয়ে করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। জেঠিমা তার পরিচয় জানার জন্য খুটখুট করছিলেন কিন্তু কি ভেবে যেন রাজি হয়ে গেলেন। ভাব টা এমন যেন পরিচয়-কেয়ামত সব পরে আগে আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে তাড়ানোর ব্যবস্থাটা করতে হবে।
২বার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে ৩য় বার ভাঙ্গলে হয়ত তার ঘাড়ে গিয়ে পড়তে পারি, তাই চুপচাপ বিয়ের কাজ টা সেরে যেতে চাচ্ছেন। কবুল বলার সময় তার চোখে চোখ রাখলাম। উনি নিষ্পাপ চাহনীতে আশ্বাস দিলেন আমি ভুল করছিনা।
কবুল পড়ে মোনাজাত শেষ করে মায়ের কাছে গেলাম।
মা দরজা বন্ধ করে রুমের মধ্যে বসে আছে। বাইরে থেকে এতবার ডাকলাম, সাড়া দিলনা। শেষমূহুর্তে বলল,
— তোর জন্য আমার উচু মাথা হেট হয়ে গেল, স্বামীর নাম খারাপ হয়ে গেল। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাইনাহ। বিদায় হয়ে যা এখান থেকে।
কেদে কেদে বললাম,
— মা আমি চলে যাচ্ছি, একটাবার সালাম করতে দিবানা?
— নাহ। কোনো নষ্ট মেয়ের জন্য আমার দোয়া আসবেনা।
ছেলেটা এসে আমার পাশে দাড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে, চলুন। মায়ের অভিমান ভাঙ্গলে উনি নিশ্চয়ই আপনাকে আবার ডেকে নিবে। এখন তাকে একা থাকতে দিন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম তাও বার বার পিছন ফিরে তাকালাম এই আশায় হয়ত মা একবার দরজা খুলবেন। কিন্তু খুলল না।
কাদতে কাদতে রীতা আর মীনাকে বিদায় দিয়ে তার ডেকে আনা রিকশায় উঠলাম। উনি আমার পাশে বসল তাও এমন ভাবে যাতে গায়ের সাথে গা না ঘেষে। কান্না করছিলাম দেখে একটা টিস্যু দিয়ে বললেন,
— চোখ মুছে নিন। কাজল লেপ্টে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে।
মন খারাপ তাই কিছু বলতে নিয়েও বললাম না। একটু পরে নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, রিকশায় করে নতুন বউকে শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে যাবেন?
— কেন ট্রাক ভাড়া করা উচিত ছিল বুঝি!
রেগে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম, কি ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর তার! এই ছেলের সাথে সংসার করব কি করে! আল্লাহ, তুমি কপালে আর কি কি লিখে রাখছো!
নিজে নিজে রাগ ভেঙ্গে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি কে সেটাই তো জানলামনা।
— কেন নিজের স্বামী ভাবতে কষ্ট হচ্ছে??
কথাটা শুনে মনে হল আমি গাল উজে উজে পেতে দিচ্ছি। আর উনি চট করে থাপড় মারছেন। আর কিছু জিজ্ঞেস করলামনা রাগে।
.

(চলবে)

জ্বীনবর ৩
পর্বঃ০৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

রিকশা মোটামুটি একটা নির্জন রাস্তায় এসে থামল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নামুন। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কই আশেপাশে তো বাড়ী দেখছি না। গলিও দেখছি না যে গলির ভিতর রিকশা ঢুকবেনা বলে আমাকে হেটে যেতে হবে। তবে কি উনি আমাকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাবেন?
চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে নামব কেন? আপনি কি আমাকে এই মাঝরাস্তায় নামিয়ে চলে যাবেন, তাহলে বিয়েটা করলেন কেন?
উনি হালকা রাগ দেখিয়ে বললেন, আপনার বেশী বোঝার স্বভাব টা কি কখনো যাবেনা?? নামতে বললাম নেমে একপাশে গিয়ে দাড়ান। আমি চুপচাপ রিকশা থেকে নেমে রাস্তার একপাশে গিয়ে দাড়ালাম।
উনি ভাড়া মিটিয়ে আমার পাশে এসে দাড়ালেন। এইদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম। মুখ হালকা লালবর্ণ ধারণ করায় তাকে বেশ কিউট লাগছে। আমার দিকে তাকাতে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। হঠাৎ সামনে একটা ভ্যানগাড়ি দেখে থামালেন। আমাকে বললেন,
— উঠে বসুন, বাকিটা পথ ভ্যানে যাবেন।
আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। নতুন বউকে ভ্যানে করে শ্বশুড়বাড়ি নিবে এই বরব্যাটা। ইচ্ছে করছে ভ্যানটা ওকে দিয়ে চালিয়ে নিই। এই দুপুরের রোদে ব্যাটা আমাকে ভ্যানে করে নিবে। কিচ্ছু বললামনা, বিশ্বাস নেই আবার মুখে উপর বলে বসবে, “এবার কি বাস ভাড়া করতে হবে?”
রাগে ফুসতে ফুসতে ভ্যানে চেপে বসলাম। এটুকু কান্ডজ্ঞান নেই, আসছে আবার বিয়ে করতে। ব্যাটা শয়তান। উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— মনে মনে গালিগালাজ করে কি হবে? ইচ্ছে হলে সামনাসামনি করুন, তাতে রাগ টা কমবে আপনার।
চমকে উঠলাম। ব্যাটা দেখি মনের কথা ও পড়তে পারে। এর সাথে সাবধানে চলতে হবে। আস্ত চালাক। ভ্যানগাড়ির চালক আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। জিদ চেপে গেল, আর চুপ থাকতে পারলামনা। চেচিয়ে বললাম,
— ওই ব্যাটা তুই হাসিস কেন? জোরে চালা। আর একবার খালি হেসে দেখ, হাসার জন্য মুখ থাকবেনা। ভ্যানওয়ালা ভয়ে চুপসে গেল, জোরে প্যাডেল মারতে লাগল। উনার মুখের দিকে তাকালাম আড়চোখে। মুখটায় কিছুটা রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি চোখ নামিয়ে ফেলতেই বলল,
— এসব গুন্ডামি ছাড়ুন। বড়দেরকে সম্মান দিতে শিখুন।
আমি উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। অন্যের জন্য আমি নিজেকে কখনোও চেঞ্জ করতে পারবনা। তাতে ছেড়ে গেলে, চলে যাক। বদনামি হবে, সেটাও হোক। যখন আমার পাশে কেউ ছিলনা, তখন এই গুন্ডামিই আমার ঢাল হয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু ছেলেটা জানল কি করে এসব? উনি তাহলে আমাকে আগে থেকে চিনেন।
— সত্যি করে একটা কথা বলুন তো কে আপনি??
— কে বললে খুশি হবেন?
— আসল পরিচয় বললে খুশি হব।
— এত জ্বালাচ্ছেন কেন তখন থেকে? জানতে তো পারবেন ই। আগে বাসায় চলুন তারপর। আর হ্যা যদি পারেন গুন্ডামিটা সেখানে দেখাবেন না, একান্ত অনুরোধ আপনার কাছে।
লজ্জা পেয়ে আর কিছু বললামনা। অনেকক্ষণ পরে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামল। ভ্যান থেকে নেমে বাড়ির গেইটের সামনে দাড়ালাম। মন ছুয়ে যাওয়ার মত একটা বাড়ি। যদিও অতকিছুই নেই, তবুও ভীষণ ভালোলাগছে।গেইটের পাশে বাগানবিলাসের গাছ, সেটার ডালপালা ছাড়িয়ে গেছে গেটের উপর, তাতে ফুটে আছে রাশিরাশি গোলাপী ফুল, বাড়ির চারপাশে বাউন্ডারি করা, নির্জন একটা পরিবেশ, চারিদিকে খুব বাতাস। উনি গেইট ঠেলে ঢুকলেন, আপনমনেও হাটতে লাগলেন। সাথে করে যে একজন কে এনেছেন সেটা ভাব দেখেই মনে হচ্ছেনা, একবারো বললেন না, “আমার সাথে ভেতরে আসুন, এটাই আপনার শ্বশুড়বাড়ি।”
আমি মেজাজ খারাপ করে আস্তে আস্তে হাটতে লাগলাম। উনি থেমে পিছনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আলাদা করে আসতে বলতে হবে? এত আস্তে হাটছেন কেন? আসুন তাড়াতাড়ি।
কথাটা শুনে মুখ বাকালাম। এই ছেলেকে মনে হয় জন্মের সময় মধুর বদলে করলার রস খাইয়ে ছিল। তাই মুখ দিয়ে মিষ্টি কথা বের হয়না, তিতা কথাই বলে। হাটতে হাটতে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। বাসার সামনে একটা ছোটখাট বাগান, তাতে কত প্রজাতির ফুল। এ্যালোভেরা গাছ, ক্যাকটাস, পাথরকুচি কি নেই! বাগানের মাঝখানে আবার বাধাই করা ছোট একটা কুয়োর মত পুকুর, তাতে ফুটে আছে নীলপদ্ম। সিড়িও আছে বসার জন্য, সবমিলিয়ে বাহিরের পরিবেশটা আমার মনে ধরেছে।

উনি বাসার দরজায় নক করলেন। ততক্ষণে আমি তার পাশে এসে দাড়ালাম, মাথার ওড়নাটা টেনে নিলাম, শাড়ি, চুড়ি সব ঠিকঠাক আছে কিনা একবার চেক করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল আমার বয়সী সুন্দরী মেয়ে। বকতে বকতে দরজা খুলতে লাগল। দরজা খুলে উনার উপর ঝাপিয়ে পড়ল,
— তোর ফিরতে এতক্ষণ লাগে? সেই ভোরে বেরিয়েছিস, একবার বলে যাওয়ার ও প্রয়োজনবোধ করিসনা। বলতে বলতে আমার দিকে চোখ পড়ল। হা করে তাকিয়ে থেকে বলল, এই মেয়েটি কে? কাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছিস তুই? ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ওসব পরে বলব। আগে তুই সবাইকে ডেকে দে। মেয়েটি গোমড়ামুখে ভিতরে চলে গেল। আমি ভাবতে বসলাম, এখন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ছেলেটির মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই আমাকে চেপে ধরবে। বাসা দেখে তো মনে হচ্ছে এখানে কম মানুষ থাকেনা। নিজেকে ভেতর থেকে প্রস্তুত করে নিলাম।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ফিরে এসে বলল, তোদেরকে ভিতরে ডাকছে।আয়।
ছেলেটি মেয়েটার পিছুপিছু ঢুকে গেল। আমি বিসমিল্লাহ পড়ে আল্লাহর নাম জপ্তে জপতে ঢুকলাম।
ভিতরে ঢুকে আরো অবাক হলাম। বাহিরে থেকে দেখে মনে হয়না ভেতর টা এত সুন্দর করে সাজানো। পরিপাটি ঘর-দোর দেখে বুঝলাম এরা অনেকটা স্বচ্ছল পরিবার। যাই হোক, তার পিছু পিছু একটা রুমে ঢুকলাম। সেখানে বেডে একজন লোক বসে বই পড়ছে আর পাশে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে পান চিবুচ্ছে। আমাকে দেখে উনি চিবুনো বন্ধ করে ভ্রু কুচকে তাকালেন। ঠাহর করতে পারলামনা উনি আমার শ্বাশুড়ি কিনা!
মুখে সালাম দিলাম উনাকে। উনি সালামের উত্তর নিলেন সহজভাবে। তারপর ছেলেটি লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— দাদাভাই, আমি এসেছি।
শুনে উনি বইটা নামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। দেখে আমি পুরাই হতবাক। একবার লোকটার দিকে আরেকবার উনার দিকে পরপর তাকাতে লাগলাম। এই তো সেই দাদুটা, যাকে আমি সেরাতে পানি খাইয়েছিলাম।
তার মানে আমার বর আর কেউ নয়, সেই ছিচকে চোরটা। এতক্ষণ পাশে থাকার পরও আমি বুঝতে পারলামনা। এইটা জানার পর আমি কাদব না হাসব সেটাও বুঝতে পারছিনা।
উনি পাশ থেকে ফিসফিস করে বললেন,
— অবাকতার ঘোর কাটলে দাদুকে সালাম দিন। উনার কথা শুনে চুপচাপ দাদুর কাছে এগিয়ে এসে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। উনি খুশি হয়ে বললেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমার বেহেশতী হুর আমার ঘরে চলে এসেছে। আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুক।

তারপর মহিলা আর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললে, ও আমার মুহিবের বউ। আমার ঘরের জান্নাতী হুর। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। দাদু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদু তোমার নাম টা কি?
— ওয়াসিফা বিনতে শাহনাম। সবাই ওয়াফাহ ডাকে।
— মাশা আল্লাহ। যেমন নাম, তেমনি গুন। তোমরা ওকে নিয়ে যত্নাত্তি করো। অনেক দূর থেকে এসেছে, ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দাদুভাই তুই আমার কাছে থাক।
মহিলাটা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সিড়ি বেয়ে উপরের রুমে ঢুকলাম। বেশ বড় রুম, একপাশে বেড আর বেডটেবিল। তার বিপরীত পাশে ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, একসেট সোফা আরো কিছু তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো। ভালোই লাগল। তার পাশে এটাচড ওয়াশরুম আর নামাযের ঘর। সেখানে কুর আন, তসবীহ, জায়নামায রাখা আছে সুন্দরভাবে। দেয়ালে মক্কা শরীফসহ কিছু কালামের ওয়ালমেট। সবমিলিয়ে আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে।
রুমের শেষমাথায় বারান্দা আছে। সেখানে নকল ঘাসের কার্পেট বিছানো, ঝুলানো ফুলের টব, বসার জন্য একটা দোলনা আর রঙবেরঙ্গের লতানো লাইটগুলো।
মহিলাটি বলল, তুমি কি সাথে করে জামাকাপড় কিছু এনেছো?
আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম, না। উনি মুচকি হেসে বলল,
— তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি তোমার জন্য শাড়ি পাঠাচ্ছি।
— আপনাকে কি বলে ডাকব?
— ফুপি বলে ডেকো। আমি মুহিবের ফুপি হই। তুমি ওয়াশরুমে যাও।
বলে উনি রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিতে দিতে ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত কিনা একটা ছিচকে চোরের বউ হলাম। যাকে আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা, দেখলেই কেলাতে মন চায়। আল্লাহ যে কোথায় এনে ফেলল আমাকে।

ফ্রেশ হতে গিয়ে শাড়ি ভিজিয়ে ফেললাম। ভেজা শাড়ি নিয়ে বের হয়ে বসে রইলাম, এখনো কেউ শাড়ি বা কোনো কাপড় নিয়ে রুমে আসলনা। আমিও লজ্জায় বের হলামনা। আমার অল্পতে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার অভ্যাস। বেশিক্ষণ ভিজে শাড়ি পড়ে থাকতে পারবনা। তাই শাড়ি খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ছিচকে চোর নক না করে রুমে ঢুকে পড়ে আর আমাকে দেখামাত্র আতকে চিৎকার করে উঠে। তার চিৎকার শুনে ডাকাত পড়েছে ভেবে আমিও চিৎকার করে উঠি।
পরে তাকিয়ে দেখি আমার রুমে ডাকাত পড়েনি, ছিচকে চোর ঢুকেছে।
আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
— আপনি এখানে, এই অবস্থায় কেন?
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here