জ্বীনবর৩,পর্বঃ০৯,১০
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
আমি বললাম, তো কি হইসে?
— এটা আমার রুম। আমি চুলে বান করতে করতে বললাম,
— তাহলে তো ঠিক ই আছে। এখন আমার আপনার রুমেই থাকার কথা। আপনি এখানে কেন এসেছেন? এভাবে চিৎকার করার ই বা কি হল বুঝলাম না!
উনি রুমের ভেতরে ঢুকে হাতের কিছু প্যাকেট বিছানার উপর রেখে বলল,
— আপনি আমার শার্ট-প্যান্ট পড়ে আছেন কেন? আগে যেমন শার্ট-গেঞ্জি পরে ঘুরতেন, এখনো কি তাই করবেন নাকি? ভুলে যাচ্ছেন কেন, এখন আপনি এই বাড়ির বউ। বাসায় বয়স্ক রা আছে, দেখলে কি ভাববে?
গুন্ডি সারাজীবন গুন্ডিই থাকবেন।
— অই ব্যাটা! আবার গুন্ডি বলস? আমি কি ইচ্ছে করে শার্ট-প্যান্টে হাত দিসি নাকি? আমার শাড়ি ভিজে গিয়েছিল, আমার আবার অল্পতে ঠান্ডা লেগে যায়। তাই পরেছি। বলতে বলতে একটা হাচ্চু দিয়ে দিলাম।
— অহ বুঝেছি। আর এসব কি ভাষা! বার বার বলছি এসব ছাড়ুন, নাহলে যেখান থেকে এনেছি সেখানে রেখে আসব। আর প্যাকেটতে আপাতত কিছু শাড়ি আর রেডিমেড ব্লাউজ এনেছি। পরে নিন, আর ভুলেও আমার কোনো কাপড়ে হাত দিবেননা। আমার প্রিয় শার্টের হাতায় ভাজ ফেলে কি করেছে!?
যত তাড়াতাড়ি পারেন ধুয়ে ইস্ত্রি করে আলমারিতে রেখে দিবেন।
আমি মুখ বেকিয়ে বললাম, হুহ, রেখে দিব। খেয়ে ফেলছি না এই কচুর শার্ট। শার্ট লাগলে আমাকে বলবেন, আমার বাসায় আমার ছেড়া শার্টের টুকরো গুলো পড়ে আছে। নিয়ে আসব আপনি পরার জন্য।
— গুন্ডি একটা। বলে উনি আবার বেরিয়ে গেলেন। হুহ, এই ছিচকে ব্যাটাকে নাকি আমার সারাজীবন সহ্য করতে হবে। আমাকে দেখলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে, আল্লাহ কি বুঝে এডার লগে আমারে মিলাইলা! রুপ টুকু ছাড়া আর কোনো কচুও নাই ব্যাটার। শার্ট-প্যান্ট গুলো খুলে ইচ্ছেমত ঝেড়ে দিসি, কাপড় ধোয়ার মত জোরে জোরে আছাড়লাম। বজ্জাতটাকে তো কিছু করতে পারবনা, এইগুলো রাগ ঝাড়ার উপায়।
সন্ধ্যার দিকে উনি আবার রুমে আসলেন। ঢুকে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলল, সেই ঘন্টাখানেক আগে আপনাকে শাড়ি দিয়ে গেলাম। আপনি কিনা শাড়ি না পরে আবার আমার নতুন শার্ট-প্যান্টে হাত দিয়েছেন। আগের গুলো কি করেছেন? মেঝেতে ফেলে রেখেছেন কেন? এটুকু আক্কেলবোধ টুকু নেই আপনার। তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নিন, আপনাকে নিচে ডাকছে। এখন কেউ চলে এসে এভাবে দেখলে আমার মুখ থাকবে?
আমি সোফা থেকে উঠে বসে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চুলকোতে চুলকোতে বললাম,
— এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি শাড়ি পরতে পারিনা, কখনো নিজে নিজে পড়িনি। ঘন্টাখানেক ধরে চেষ্টা করলাম পারিনা। তো কি করব!
— শুধু অভদ্রতা আর গুন্ডামিটাই শিখলেন। আর তো কিছুই জানেন না।
— মুখ সামলে কথা বলুন।আমি এই অবস্থায় ই নিচে যাব।
— দাড়ান এখানে। বলে উনি কিছু একটা ভেবে নিলেন, তারপর বললেন ব্লাউজ-ছায়া পরে আসুন ওয়াশরুম থেকে।
— শাড়ি পরাবে কে?
— এত কথা কেন বলছেন? তাড়াতাড়ি যান, কেউ এসে আপনাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলার আগেই।
— দেখলে কি হবে?
— সবাই জেনে যাবে, আমি একটা অকালকুষ্মান্ড গুন্ডিকে বিয়ে করেছি। সেটা আপনার জন্য সম্মানের হবে?
শুনে মুখ কালো করে ওইসব নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। পরে এসে উনার সামনে দাড়ালাম। উনি আমার দিকে না তাকিয়ে শাড়ি হাতে নিয়ে বলল,
— হাত উপরে তুলুন। আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।
— আপনি পরাবেন মানে কি? বাসায় তো ফুপি আছে, উনাকে ডেকে দিন।
— হ্যা উনি এসে দেখুক, আমার বিয়ে করা গুন্ডি একটা সামান্য শাড়ি পরতে পারেনা। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকুন।
ভাবলাম, এই সুযোগে ব্যাটাকে একটু জ্বালানো যাক। শাড়ি পরাতেই পারছেন না আমার অতিরিক্ত নড়াচড়া আর সুড়সুড়ি পাওয়ার ভান করার কারনে। ১০মিনিট আমার সাথে যুদ্ধ করে আর না পেরে শাড়ি হাতে ক্লান্ত হয়ে বেডে বসে পড়লেন।
আমার এখন প্রচুর হাসি পাচ্ছে, আটকে রাখতে না পেরে হেসে দিলাম।
উনি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন। জানিনা বুকের ভিতরে কেমন জানি একটা ভয় উথলে উঠল। হাসি থামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে দিলেন।
আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন জানি একটা ভালোলাগা কাজ করছে, তার চোখের অতলে হারিয়ে যাচ্ছি মনে হল। উনি চোখ সরিয়ে বললেন, এভাবে ঘোমটা দিয়ে সবাইকে আবার সালাম করবেন গিয়ে। আর কিছু সাজগোজ বাকি থাকলে সেরে তাড়াতাড়ি নিচে আসুন। আমার ক্ষিধেতে পেট ফেটে যাচ্ছে, আপনার জন্য এখনো খেতে পারছিনা।
দোয়া করে, তাড়াতাড়ি নিচে এসে আমাকে বাচিয়ে দিন।
বলে মূহুর্তে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আয়নার সামনে এসে আয়নার দিকে তাকালাম। কচি কলাপাতা রঙ্গের শাড়িতে বেশ মানিয়েছে আমাকে, ঘোমটা দেওয়ায় যেমন বউ বউ ফিল হচ্ছে তেমন পবিত্র লাগছে নিজেকে। কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে প্যাকেট থেকে কাজলটা বের করে একটু লাগিয়ে নিলাম। ব্যাস! সাজ কম্পলিট।
চুপচাপ নিচে চলে এলাম। সবাই দেখি টেবিলে বসে আছে। দাদু আমাকে দেখে বললেন, আয় তোর জন্য ই অপেক্ষা করছিলাম। দাদুর কাছে এসে সালাম দিয়ে টেবিলের দিকে তাকালাম। মুরগী মাংস দিয়ে বিরিয়ানি, চিংড়ি মাছ ভাজা, কয়েকপ্রকার মিষ্টি টেবিলে সাজানো আছে। দাদুর পাশের চেয়ার টেনে বসব, এমন সময় দেখি ফুপি আমার দিকে কেমন একটা লুক দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আমি কোনো অভদ্রতামি করে ফেলেছি।
কিছু না বুঝতে পেরে উনার দিকে তাকালাম। উনি ইশারা করে বললেন সবাইকে যেন পরিবেশন করে দিই।
এতক্ষণে বুঝলাম ফুপির এমন লুক দেওয়ার কারণ। উনাকে আর মেয়েটিকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে আমি পরিবেশন করে দিলাম। দাদু আমার প্রশংসা করে বলল,
— দেখেছিস, আসতে না আসতে কেমন নিজের দায়িত্বটা বুঝে নিয়েছে আমার জান্নাতি হুর টা। দোয়া করি, সুখে থাকো।
এই প্রথম কারো মুখে নিজের প্রশংসা শুনে কেমন একটা লজ্জা ভর করে বসল। এত পছন্দের খাবার হওয়া সত্ত্বেও মনমত খেতে পারলামনা। মিষ্টির কথা আর বলব, এত্ত এত্ত ভাল্লাগছে যে মনে হল সব খেয়ে ফেলি।
কিন্তু একটার বেশি কপালে জুটলনা।
খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পর উনি দাদুসহ আসলেন রুমে। আমি বসা থেকে উঠে দাড়ালাম। দাদু আমাকে একটা ছোট হার উপহার দিয়ে বললেন, এটা আমার নাতির বউয়ের জন্য। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। এই বাসররাত থেকে তোমার সংসার আগলে রাখার দায়িত্ব একান্ত ই তোমার।
আমি চমকে উঠলাম, কিসের বাসর রাত? আমি কে? আমি কোথায়?
এই কেমন বাজে স্বপ্ন দেখছি আমি। এই ছিচকে ব্যাটার সাথে নাকি আমার বাসর রাত আজ! অসম্ভব, এটা রে আমি কোনোমতেই সহ্য করতে পারিনাহ। বর ভাবা তো দূরের কথা। আজ কোনো অভদ্রতামি করতে আসলে ব্যাটাকে ধরে ছেচা দিব।
দাদু বেরিয়ে গেলে উনি দরজা লক করে বেডের পাশে এসে দাড়ালেন। আমি বেডটেবিলে রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে ফল কাটার ছুরি টা নিয়ে উচিয়ে বললাম,
— খবরদার, কাছে আসলেই কোপ দিব। ছিচকে ব্যাটা একটা!
— অইটা ছুরি, দা নয় যে কোপ দিবেন। আর আমি আপনার কাছে আসতে যাব কেন? শুনুন, আপনাকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে বা আগ্রহ আমার ছিলনা। দাদু শুনেছে, আমাকে নিয়ে আপনার বদনাম রটেছে তাই আমাকে বলল আপনাকে বিয়ে করতে। আমার নিজের কাছেও নিজে অপরাধী মনে হয়েছে তাই করেছি।
নাহলে আপনার মত গুন্ডিকে বিয়ে করব আমি অসম্ভব।
— যান, ভাগেন। আমারো শখ নাই ছিচকে চোরের বউ হব।
— বিছানা ছাড়ুন, আমি ঘুমাব।
— আমি কেন ছাড়ব? আমি বিছানায় ই ঘুমাব।
আপনি অন্য কোথাও ঘুমান।
— আমি বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারিনা। অন্য কোথাও ঘুমালে আমি নাক ডাকি।
আমার চিরশত্রুর নাম বলল? আমার নাকডাকা একদমি সহ্য হয়না। মা ডাকে, তাই মায়ের সাথে ঘুমাইনা।
— ডাকতে হবেনা নাক। আমি কোথায় ঘুমাব?
— সোফা আছে, নিচে ফ্লোর আছে। যেখানে ইচ্ছে ঘুমান।
মনে মনে একশ একটা গালি দিতে দিতে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। উনি আমার দিকে একটা বালিশ ছুড়ে দিলেন। এই ব্যাটারে জব্দ করতে হবে।
উনার চোখ লেগে আসামাত্রই পেট ব্যথার অভিনয় করতে লাগলাম, ব্যথার স্বরে আওয়াজ করতে লাগলাম।
উনি হুড়মুড়িয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— কি হয়েছে? এভাবে পেচার মত ডাক শুরু করলেন কেন?
— আমার পেটে ব্যথা করছে।?
— কেন??
— ক্ষুধা লাগছে তাই। আমার জন্য খাবার নিয়ে আসুন।
— এত রাতে কিসের খাবার আনব আমি? আপনি নিজে গিয়ে নিয়ে আসুন। এমন ডাক পেরে ঘুমের ডিস্টার্ব করবেননা।
যেই শুয়ে পড়লাম, আমি আরো জোরে আওয়াজ করলাম
— কি ব্যাপার? এত জোরে চিৎকার করছেন কেন?
— ক্ষুধা বেশি লাগসে। উঠতে পারছিনা, যান না নিয়ে আসুন। নাহলে চিৎকার করব।
— উফফ! চুপ করুন। বাসায় বয়স্ক রা ঘুমাচ্ছেন, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। ফিরে এলেন বিরিয়ানি নিয়ে, আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন গিলুন। আর বিরক্ত করবেননা।
— মিষ্টি কই? শুনে বিরক্ত হয়ে আবার নিচে গেলেন। এক বাটি মিষ্টি নিয়ে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
— এই যে শুনছেন? আমার না ডিম ওমলেট খেতে ইচ্ছে করছে।
একটু বানিয়ে নিয়ে আসুননা।
— কি পেয়েছেন টা কি আমাকে? আমি আর কিছু করতে পারবনা।
আমি মিথ্যে কান্নার অভিনয় করতে লাগলাম। উনি বিব্রত হয়ে বললেন, অপেক্ষা করুন, ভেজে নিয়ে আসছি।
— শুনুন, পেয়াজ আর মরিচ বেশি করে দিয়ে ভাজবেন। ঘন হলুদ রঙ্গ ধরলেই হবে। শুনে উনি আবার নিচে গেলেন। আমি বিরিয়ানির প্লেট হাতে নিয়ে খেতে খেতে উনার পিছু পিছু রান্নাঘরে এলাম।
উনি পেয়াজ কাটতে বসলেন। আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছি। বেচারার চোখ থেকে পানি পড়ছে। আহারে!
–আরো একটু কুচি করে কাটুন।
— কাটছি?
প্রচুর জ্বালানি সহ্য করে ডিম ভেজে আনল। খেয়ে উনার হাতে খালি প্লেটগুলো দিয়ে বললাম, ধুয়ে রেখে আসবেন। আমার ঘুম পাচ্ছে ঘুমাব।
আর হ্যা ধন্যবাদ ডিম ভাজিটা মজা ছিল যদিও ঘন হলুদ হয়নি। সমস্যা নাই, নেক্সট টাইম থেকে। অকে?
উনি রেগেমেগে কিছু বলার আগেই পাশ ফিরে ঘুমানোর ভান করলাম। বেচারা একা একা ফুসতে ফুসতে বের হয়ে যায়।
আচ্ছা জব্দ করেছি ব্যাটাকে। আহ! ভীষণ শান্তি লাগসে।?
(চলবে)
জ্বীনবর৩
পর্বঃ১০
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
সকাল সকাল কারো কুরআন তিলওয়াতের আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙ্গল। কি মিষ্টিস্বরে তিলওয়াত করছে! শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। উঠে বসে ব্যালকুনির জানালায় উকি দিয়ে দেখি এখনো ভোরের আলো ফুটেনি। এইসময় আবার কে কুরআন তিলওয়াত করছে। উঠে নামাযঘরে উকি দিতে দেখি ছিচকে ব্যাটা কুরআন পড়ছে। চুপচাপ দরজার কোণে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তিলওয়াত শুনছি। এমন সময় আযান দিল, উনি কুরআন শরীফে চুমু খেয়ে রেখে দিয়ে মুনাজাত ধরলেন।
আমি ভাবতে লাগলাম, মাত্রই তো আযান দিল। তাহলে উনি কিসের মুনাজাত ধরছেন? মোনাজাত শেষে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বললেন, নামায পড়বেন না? আমি হকচকিয়ে উঠে মাথা নিচু করে বললাম,
— আমি তো নামায পড়তে পারিনা।
উনি মুচকি হেসে বললাম, আমি শিখালে পড়বেন?
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। উনি বললেন, ওযু করে আসুন। একসাথে নামায পড়ব।
— আমি ওযু করতে পারিনা সহীহভাবে।
— আচ্ছা, আসুন আমার সাথে। আমি ওযু করিয়ে দিব।
আমি কিছু না বলে উনাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। মানুষটাকে ঠিক বুঝতে পারছিনা। এত জ্বালানোর পর ও আমার সাথে শান্ত গলায় কথা বলছে। আমিও তার উপর আর রাগ করতে পারছিনা।
উনি এক বালতি পানি আমার সামনে নিয়ে এসে বলল,
— আপনাকে স্পর্শ করতে পারি?
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি আমার হাত ধরে পানি দিয়ে ধুয়ে দিলেন, আর বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কিভাবে কি করতে হয়! হাতের কোষে পানি নিয়ে আমাকে কুলি করিয়ে দিলেন, ওযু শেষ করে তার সাথে নামাযে দাড়ালাম। মনে হল ভীষণ ভালোলাগায় ডুবে আছি। মনটা অনেক ফ্রেশ আছি। দোয়া-সূরা কিছুই পারিনা, মন দিয়ে উনাকে অনুসরণ করে নামায পড়লাম।
উনি কিছু যিকির শিখিয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো সবসময় পড়বেন।
চোখ বন্ধ করে কয়েকবার যিকির পড়ার পর চোখ খুলে দেখলাম উনি আমার পাশে নেই। এত তাড়াতাড়ি উনি কোথায় উধাও হলেন!
উঠে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে ব্যালকুনিতে এসে দাড়ালাম। সূর্য তার লালচে আভা নিয়ে পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে। পাখিগুলো কিচিরমিচির শুরু করেছে। ভীষণ ভালোলাগছে।
কখনোই এত সুন্দর সকাল দেখিনি আমি। ঘড়ির দিকে তাকালাম রুমে এসে, এতক্ষণে বোধহয় সবাই উঠে পড়েছে। আজ সবার জন্য নিজের হাতে চা-নাস্তা বানালে মন্দ হবেনা। এই ভেবেই শাড়ি পালটে বড় ঘোমটা টেনে নিচে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।
কিন্তু বানাব টা কি? আমি তো কোনো রান্না ই জানিনাহ। চা টাই বানাই তাহলে। একটু-আধটু জানি কিভাবে বানায়! করিম চাচা যখন চা বানাত, চোখ বড় বড় করে দেখতাম।
পানিতে চা-পাতা দিয়ে চুলার উপর বসালাম। রঙ ধরছে না দেখে রাগ উঠে গেল, চুলা থেকে নামিয়ে আরো পানি ঢেলে আবার বসালাম কিন্তু হচ্ছেনা। রেগে যেই পানি বাহিরের দিকে ছুড়ে ফেললাম। সবটা গিয়ে উনার গায়ে পড়ল।
মুখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন উনি। আমি জিভ কেটে বললাম,
— স্যরি।
— এভাবে কেউ চা বানায়? চা ও বানাতে জানেন না?
— শিখিনি। মা ও শিখায়নি।
— গুন্ডামিটা তো কেউ শিখিয়ে দেয়নি।
— বেশি বলে ফেলছেন কিন্তু।
— পানি গরম করুন।
— কিহ?
— বলেছি পানি গরম করতে। সেটাই করুন চুপচাপ।
উনার কথামত আবার পানি চুলায় বসালাম। এক এক করে সব বলে দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে। সব করে দেখি চা তো পুরো কমপ্লিট।
উনার দিকে তাকিয়ে বিজয়সূচক হাসি দিলাম। উনি তার তোয়াক্কা না করে বিড়বিড় করতে করতে উপরে চলে গেলেন। আমিও মুখ ভেঙ্গিয়ে দিলাম বেশ করে।
চা ঢেলে কাপ নিয়ে দাদুর রুমে আসলাম। দাদু তখন তসবীহ গুনতে গুনতে জানালায় মুখ রেখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, আরেহ আমার জান্নাতী হুর যে!
— শুভ সকাল দাদু। এই নাও তোমার চা।
— আহ! আমার জন্য চা করে এনেছো।
চুমুক দিতে দিতে বললেন, বাহ, বেশ ভাল হয়েছে। তুমি কি করে জানলে আমার কড়া লিকারের চা খুব পছন্দ?
কি বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, উনি বলেছেন।
— আমার নাতীটা তাহলে তোমার সাথে ভালোই মিলে গেছে।
ও তো আবার মানুষদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বুঝলাম না। মানুষদের সাথে মিশতে মানে?
দাদু আমার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলেন। কিছুটা সময় চুপ থেকে বললেন,
— অনেকে আছেনা, যারা বাহিরের মানুষদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করে। ও ও এমন। বাহিরের কারো সাথে তেমন মিশে নাহ।
আমি মনে মনে বললাম, অস্বস্তিবোধ করেনা ছাই। সুযোগ পেলে ঠিকিই গলায় ওরনা,ছুরি ধরে ভয় দেখাতে পারে। ছিচকে ব্যাটা একটা।
আমি উত্তরে মুচকি হেসে বললাম, জ্বি বুঝেছি।
এমনসময় ফুপি দাদুর রুমে ঢুকে বলল, বাবা, তোমার চা দিতে দেরী হল। আজ দেরী হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। দাড়াও আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি।
— ব্যস্ত হস না রোকেয়া। আমার নাতবউ আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে।
— আহা! আসামাত্রই তুমি আবার রান্নাঘরে ঢুকতে গেল কেন?
আমি বিনয়ের স্বরে বললাম, খুব ইচ্ছে হল সবাইকে নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াব তাই ঢুকেছিলাম। দাদু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— আজ থেকে এই সংসার তোমার। তোমার যা ইচ্ছে হয় করবে। নিজের মত করে আগলে রাখবে।
সবচেয়ে বড় জিনিসটা হল আমার নাতী। ওকে সবসময় আগলে রেখো। এতদিন ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার উপর ছিল, আজ থেকে সেই দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। আমি আর কয়দিন এই দুনিয়ায় আছি বলো!
বলতে বলতে কান্না শুরু করলেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগল।
আমি উনার হাত জড়িয়ে বললাম,
— এসব বলোনা দাদু। তুমি যা চাও, তাই হবে।
আমাকে যখন দায়িত্ব দিয়েছো, সেটা আমি পালন করব।
ফুপি শান্ত গলায় বলল, এভাবে বলছো কেন বাবা? আমরা কি মরে গেছি নাকি! তোমাত মুহিবকে আমরা দেখে রাখব। তুমি এভাবে বলোনা তো, বেচারি ঘাবড়ে যাবে।
দাদু চোখ মুছে বলল, মুহিবের কোনো কথায় কষ্ট পেয়োনা ওয়াফাহ। ওর সবার মত না, একটু অন্যরকম। রাগী ঠিক ই, তবে মনটা অনেক ভালো।
একদিন ঠিকিই বুঝবা।
ও ভালোবাসার কাঙ্গাল, একটু ভালোবেসো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে বুঝে নেওয়াটাও সহজ হবে।
আমি চুপ করে মাথা নাড়লাম। ভালোবাসা সেটা আবার আমাকে দিয়ে, কল্পনার বাহিরে আমার। বুঝতে পারছিনা কি করব। ভাবনা কাটিয়ে বললাম,
— ফুপি চা দিব?
— হ্যা দাও। চা ছাড়া আমার সকাল হয়না।
আর শোনো, মুহিবকে উপরে চা পাঠিয়ে দিও।
আমি মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। উনার জন্য চা নিয়ে গেলাম। দেখলাম ব্যালকুনিতে বসে কি নিয়ে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললাম, আপনার চা।
— রেখে যান।
— পারবনা, হাতে নিন।
— পাশে রেখে যেতে বললামনা।
— বললাম না পারবনা। হাতে নিন।
বিরক্তমাখা মুখ নিয়ে হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে বললেন,
— শান্তি? এবার আসুন আপনি।
— নাহ শান্তি হয়নি। চা টা কেমন হয়েছে খেয়ে বলুন।
— ভালো হয়েছে।
— না খেয়েই বলে দিলেন।
— রেসিপিটা যেহেতু আমার, সবকিছু হাতে হাতে করে দিয়েছে খারাপ হবার প্রশ্ন উঠেনা।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ” এই শুরু হল খোচা মারা। একটু না হয় দেখিয়ে দিলি, তার জন্য এত খোচাবে! এই ব্যাটার দ্বারাই সম্ভব এসব।”
আমার বিড়বিড় করা দেখে বললেন, বেশি খোচা সহ্য করতে না চাইলে তাড়াতাড়ি ফুপির থেকে এসব শিখে নিন। আপনার জন্য ই ভালো।
আমি আর এক মূহুর্ত ও দাড়ালাম না সেখানে। এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছি আজ। যে আমি নিজের হাতে পানি নিয়ে খেতামনা কখনোও, সে আমি সবার জন্য চা বানাচ্ছি। নিজেকে বাড়ির বউ হিসাবে উপস্থাপন করছি। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। সত্যিই কি গুন্ডিরুপ ছেড়ে আমি এখন সংসারী হচ্ছি? নিজেকে অই ব্যাটার বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি!
ছোট পুকুরের ধারে বসে এসব ভাবছিলাম। এমনসময় মনে হল, পাশে কেউ এসে বসল। তাকিয়ে দেখি সে মেয়েটা যাকে কাল দরজা খুলতে দেখেছি।
এর পর আর আলাদা করে কথা হয়নি।
সে পাশে বসে বলল,
— ভাবি কি ভাবছো?
— তেমন কিছুনা। শুধু ভাবছি আপনার সাথে পরিচয় হলনা ঠিকমত।
— আমি মুহিবের ফুফাতো বোন রুকাইয়া। একসাথেই বড় হয়েছি দুজন। আমার সাথেই তো মুহিবের বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
মাঝখানে এখন সব এলোমেলো।
তবে আমি এখনো মুহিবকে খুব ভালোবাসি।
এসব বলার সময় আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। কি অনর্গলে বলে যাচ্ছে এসব! মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এসব খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
আমি উত্তরে মুচকি হেসে বললাম, ওহ।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেমন জানি খারাপ লাগছে ভাবতে ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। নিজেকে ঠিক বুঝতে পারছিনা কেন এমন হচ্ছে আমার।
প্রতিদিনের মত উনার সাথে মনমত ঝগড়া বাধিয়ে সোফায় ঘুমাচ্ছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রথমে ভুল শুনেছি বলে পাত্তা দিলামনা। কিন্তু কান্নার শব্দ টা তীব্র হতেই উঠে বসলাম। ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখলাম উনি বিছানায় নেই।
এইদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি ব্যালকুনির রঙ বেরঙ্গের আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। উঠে ব্যালকুনিতে এলাম। এসে দেখি উনি দোলনায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, এত রাতে উনি এভাবে কাদছেন কেন? ডাকার সাহস হচ্ছেনা আমার।
ডাকব কি ডাকব না ভাবতে ভাবতে উনার পাশে গিয়ে বসে উনার কাধে আলতো করে হাত রাখলাম। উনি টের পেয়ে আমার দিকে তাকালেন।
আলোতে দেখতে পেলাম কান্নাভেজা চোখগুলো হালকা ফুলে লাল হয়ে আছে। নাক-মুখ ও টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আপনার?
উনি কোনো কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলেন। আমার খুব কান্না পাচ্ছে উনার এই অবস্থা দেখে।
বেশ কিছুক্ষণ পর উনি আমার থেকে নিজের ছাড়িয়ে নিলেন। চোখ-মুখ মুছে কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিছন থেকে অনেকবার ডাকলাম কিন্তু ফিরেও তাকালেননা।
আমি হতাশ হয়ে দোলনায় বসে পড়লাম। নিজের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। উনার আসলে কি হয়েছে না জানা অবধি শান্তি পাচ্ছিনা। এভাবে এত রাতে হুট করস কোথায় চলে গেলেন উনি।
সারারাত ব্যালকুনিতে বসে রইলাম, কিন্তু উনি আর ফিরলেন না।
.
(চলবে)