জ্বীনবর৩,পর্বঃ১৫,১৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
তাওহীদ মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকায়। চেহারা দেখে মনে হচ্ছেনা এ কোনো সাধারণ ঘরের মেয়ে। নীল ডাগর চোখ, সুশ্রী চেহারা যেন জ্যোতি ছড়াচ্ছে নূরের মত, মাথায় পুরনো ওড়না দিয়ে একহাত লম্বা ঘোমটা দেওয়ায় চুল দেখতে পেলনা সে। আসলেই মেয়েটা একটা ফুটফুটে পরী, উচ্চবংশীয় পরিবারে জন্ম নিলে এতদিনে ছেলের লাইন পড়ে যেত। মেয়েটি অনবরত মাথা নিচু রেখে পা দিয়ে মেঝে খুটছে, অস্বস্তিবোধ করছে বোধহয়।
গলা ঝেড়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, সব কাজ করতে পারবেন তো?
— জ্বি।
— আমার সব কাজ রুটিন মেনে করতে হয়। রুটিনে হেরফের করলে আর কাজে রাখিনা। তাই এসব দিক একটু নজরে রাখবেন।
— জ্বি আচ্ছা।
— কেয়ারটেকার চাচার থেকে সব কাজ বুঝে নিয়ে যাওয়ার সময় আগাম কিছু টাকা নিয়ে যাবেন। এখন এক কাপ চা পাঠিয়ে দিন আমার রুমে, চিনি জাস্ট ২চামচ।
— আচ্ছা। বলে মেয়েটি চলে যাচ্ছিল।
— এই যে, আপনার নামটা কি?
— সিমরান। তাওহীদের কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটি খুবই চটপটে, কিন্তু কোনো কারণে তার চাঞ্চল্যে ভাটা পড়ে গেছে। অবিবাহিত মেয়েকে সে কাজে রাখতে চায়না, কারণ সে মেয়েদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায়। আগের জনের বাচ্চা হওয়ায় কাজে আসতে পারেনা, কেয়ারটেকার চাচা ই বা আর কত দিক সামলাবে। প্রাইভেট কোম্পানীর সিইও সে, বাসায় তার দেখাশুনা করার জন্য কাউকে লাগে। মা-বাবা বিদেশে থাকে, অবশ্য যোগাযোগ নেই। দুজনেই পরকিয়া করে আলাদা হয়ে গেছেন। তাই সে নিজের জীবন নিজে গুছিয়ে নিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি চা নিয়ে আসে। বাহ বেশ চালু আছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম চিনি পরিমাণের বেশি দিয়ে ফেলেছে।
— কয় চামচ চিনি দিয়েছেন?
— চার চামচ।
— আমি কয় চামচ দিতে বলেছি?
— উমম, মনে হয় ২চামচ।
— তাহলে?
— মনের ভুলে দিয়ে ফেলেছি।
— এত ভুল করলে আপনাকে কাজে রাখব কি করে?
— এমনটা আর হবেনা স্যার। এরপর থেকে মন দিয়ে কাজ করব।
আশ্বাস পেলেও ভরসা পেলামনা। মেয়েটা পরে না আবার আমার চুল ছিড়তে বসে যায়। সিমরান কাজ শেষ করে বাজারের দিকে আসে। চায়ের দোকান গুলো না পের হতেই পিছন থেকে শিসের আওয়াজ আসে। এটা নতুন কিছু নয়, বস্তির বখাটে ছেলে রাতিম রোজ তাকে উত্ত্যক্ত করে। প্রতিবার ই সিমরান সালাম দিয়ে সুন্দরভাবে বোঝায়। কিন্তু কিছুতেই লাভ হয়নাহ। তাই কানে না নিয়ে সোজা হাটতে থাকে। রাতিম পথ আগলে বলে,
— তোকে যে ডাকছি শুনতে পাস না?
— জ্বী শুনেছি। ডাকছেন কেন?
— শুনেও সাড়া দিলিনা কেন? দেমাগ বাড়ছে তোর তাইনা?
— আমার তাড়া আছে। আমেনা বু ঘরে অসুস্থ।
— কি আমেনা বু কে নিয়ে পড়ে থাকিস? কতবার বলি আমায় বিয়ে কর। তোকে রাজরাণী করে রেখে দিব। মানুষের বাসায় খেটে কাজ করতে হবেনা।
— তা আপনি কি করেন?
— যা করি তাতে শুয়ে-বসে খেতে পারবি।
— ছিনতাই, নেতাদের পা চাটা এটাই তো পেশা তাইনা?
— সিমরান!
— উত্তেজিত হবেননা। আল্লাহ তাকেই সাহায্য করে, যে নিজেকে সাহায্য করে। আপনি তো নিজেকেই সাহায্য করেননা, অন্যকে কি করে করবেন।
আসি, আসসালামু আলাইকুম।
পাশ কাটিয়ে চলে আসে সিমরান। রাতিম ফুসতে ফুসতে দোকানের আড্ডায় ফিরে যায়। তার এক বন্ধু হেসে হেসে বলল,
— আজ ও রিজেক্টেড হলি?
— আমারে হাদিস শুনায়, সৎচরিত্র দেখায় নিজের। কিন্তু কতদিন আর! খুব তাড়াতাড়ি এই দেমাগীরে আমার ঘরে তুলমু। সেদিন ওর সব ছুটামু আমি।
বাজার এনে রান্না চড়িয়ে দেয় সিমরান। আমেনা বেগম শুয়ে শুয়ে হাক ডাকে,
— তুই এসেছিস?
— হ্যা, বু। তোমার জন্য ওষুধ এনেছি।
উঠে বসোতো।
— আবার শুধু শুধু টাকা নষ্ট করতে গেলি ক্যান? সামান্য অসুখ, সেরে যাবে।
— আহা, আর কথা বলো না তো।
বলে সিমরান আমেনার বুর হাতে দুটো ওষুধ আর পানির জগ টা ধরিয়ে দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে খাইয়ে তবে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
আমেনা বেগমের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। কত সুন্দর আর ভালো মেয়ে সিমরান! নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে কখনো নিজের প্রয়োজন মিটাবেনা। নিজের ভালোলাগা পূরণ করবেনা, তোর ভাগ্য যে কত খারাপ ভাগ্যের ফেরে এক ভিখারিনীর ঘরে এসে জুটলি।
ভালো ঘরে পড়লে তোর কোনোকিছুর কমতি হতনা। ভেবে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আগুনটাকে বড্ড ভাললাগে সিমরানের। রান্না করতে এসে নিষ্পলক আগুনের দিকে চেয়ে থাকা ওর অভ্যাস। তখন মনে মনে একটা প্রশান্তির ছোয়া পায় সে।
ইদানিং তার যেন কি একটা হয়েছে, নিজের মধ্যে পরিবর্তন খুজে পায় সে।
এসব স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক বুঝে উঠতে পারেনা।
শুধু অনুভব করে তার কিছু একটা হয়েছে।
ও ঘর থেকে আমেনা বুবুর ডাক আসে, তাড়াহুড়োয় চুলায় লাকড়ি ঠেলতে গিয়ে আগুনের আচ লাগে হাতে। কিন্তু যন্ত্রণা অনুভব করে না সে।
ইচ্ছে করছে পুরো হাতটা আগুনে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু পরেরবার আবার ডাক পড়ায় উঠতে বাধ্য হয় সিমরান।
আমি উঠোনে রোদে বসে পুইশাক কুটতে ব্যস্ত। কাজের মধ্যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। মুহিব আমাকে ছেড়ে গেছে আজ মাসখানেক হয়েছে। যে জায়গাটায় ওর সাথে প্রথম দেখা হয়েছে, সেটা চোখে পড়লেই কলিজায় কেমন একটা টান পড়ে, চোখগুলো ছলছল করে উঠে।
বিধবার বেশটা এখনো আমার শরীর থেকে সরাতে পারিনি। মা বার বার বলে, ৪মাস ১১দিন বিধবার বেশ গা থেকে মুছে ফেলতে নেই, স্বামীর কবরে আযাব হয়। যদিও আমি মনপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমার মুহিব মারা যায়নি। তবুও ওর কষ্ট হবে ভেবে পড়ে থাকি। মনের বিশ্বাসটাই বড় যেখানে আজ অবধি কেউ আচড় কাটতে পারেনি। সেখানে শরীর বেশ দিয়ে কি হবে!
এমনসময় রাফির বাবা আমাদের উঠোনে এসে দাড়ালেন। আমি বড় করে ঘোমটা টেনে নিলাম। মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন, ঝাড়ু গেলে গদগদ হয়ে তার দিকে মোড়া এগিয়ে বললেন, গরীবের দুয়ারে হাতির পা। কি সৌভাগ্য আমার!
— কেমন আছো?
— আল্লাহর রহমতে আর আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি।
— কাল তোমাদের জন্য যে চালের বস্তা, কিছু সদাইপাতি পাঠিয়েছি তা ঠিকঠাক মত পেয়েছো তো?
— হ্যা, পেয়েছি। আপনি দয়া করে কত কিছু পাঠিয়েছেন এই অসহায়ের জন্য।
— আরেহ দয়া বলছো কেন? এসব দয়া-ফয়া কিছুনাহ।
কাজ করতে করতে আমি হাত থেমে যায়। কাল এত কিছু আসতে দেখে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে, এসব কোথা থেকে আসল।
উনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন, পরে জোরাজুরি করাতে বললেন,
— জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি।
মা আমাকে মিথ্যা বলল কেন? তাদের কথার দিকে আবার মনোযোগ দিলাম।
রাফির বাবা বিনয়ের সাথে বলল,
— আমি আপনাদের সাথে আত্মীয়ের সম্পর্ক করতে চাই।
— মানে বুঝলামনা। আমাদের মত নিঃস্বের সাথে কিসের আত্মীয়তা করবেন।
— আপনি তো জানেন, আমার একমাত্র ছেলে রাফি এখন রাজনীতির বড় পদে আছে। ইনকাম ও সেই লেভেলের করে। বয়স তো হয়েছে ওর, চাচ্ছি বিয়ে করাতে।
ওর নাকি একটা মেয়েকে ইদানিং খুব মনে ধরেছে। আর ও তাকেই বিয়ে করবে। জানেন ই তো ছেলের থেকে বড় আমার কাছে কিছু নেই। তাই ওর মনের ভাব বুঝে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বিনা যৌতুকে, বিনা দাবিতে ওই মেয়েকে যেকোনো মূল্যে ঘরের বউ করব।
— এ তো খুব ভাল কথা। তা মেয়েটা কে আফজাল সাহেব?
— তোমার মেয়ে ওয়াফাহ। আমার রাফির সাথে একসময় দ্বন্দ ছিল ঠিকিই। কিন্তু রাফি এখন ওকে ভালোবাসে, ওকে বিনা শর্তে ঘরের বউ করতে চায়।
মা খুশিতে নেচে উঠে বললেন,
— এ তো আমার কাছে স্বপ্ন। আপনাদের মন আসলেই অনেক বড়।
আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই।
আমি আর স্থির থাকতে পারলামনা। হাতের বটিটা নিয়ে উনার দিকে ধেয়ে এসে উনার গলায় চেপে ধরলাম,
— কি ভাবিস ব্যাটা! আগের মত গুন্ডামি করিনা বলে ওয়াফাহকে নিয়ে যা খুশি তাই করবি। তোদের এক একটাকে চেনা হয়ে গেছে শুয়োর।
আর কোনোদিন যদি এই বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখি ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিব। যা ভাগ শালা।
উনি কোনোরকম জান নিয়ে পালালেন। মা তার বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে গালে সজোড়ে চারটা চড় মারলেন। রেগে বললেন,
— হতভাগী, তুই আমাকে আর শান্তি দিবিনা।
জামাইয়ের বাড়ী তো গিয়েছিস, সেই টা ও তো ধরে রাখতে পারলিনা। উস্টা খেয়ে মায়ের কাছে ফিরে এলি। তাও তোর এত বড় বড় কথা আসে কোথা থেকে।
এই লোকটা দিচ্ছে বলে এখনো ইজ্জত ঠিক রেখে দুবেলা গিলতে পারছিস।
আগের মত সেলাই করতে পারিনা, বাজারে নতুন দোকান হওয়ায় অর্ডার আসা ও বন্ধ হয়ে গেছে। না খেয়ে মরার অবস্থা।
হতভাগী তুই মরতে পারিসনা।
বলে মা ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে দেয়।
মা কিছু মিথ্যে বলেনি। ইদানিং একবেলা খাবার জুটানোর সামর্থ্য নেই তাদের। আমি এত অভাগী কেন? আল্লাহকে এই প্রশ্ন টা ভীষণ করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। সব কেড়ে নিয়ে একটা সুন্দর সংসার দিয়েছিল, স্বামীসুখ দিয়েছিল।
কি পাপ করেছিলাম? সেটাও আমার থেকে কেড়ে নিয়ে গেল।
আর বাচতে ইচ্ছে করছেনা। আমিও আমার মুহিবের কাছে চলে যাব।
মাটি থেকে উঠে বসে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। কেরাসিনের বোতল হাতে নিলাম। খুলে গায়ে ঢেলে দিলাম।
অনেক খুজে দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা পেলাম।
ঠুকে দিয়ে আগুনটা জ্বালিয়ে নিলাম। মৃত্যুকে খুব কাছে দেখতে পাচ্ছি। আর কিছু সময়ের অপেক্ষা। তারপর আমার আর মুহিবের মাঝখানে কোনো দূরত্ব থাকবেনা।
এক হয়ে যাব আমরা। কালেমা পড়ে নিলাম।
.
(চলবে)
জ্বীনবর৩
পর্বঃ১৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
তাওহীদ আড়চোখে সিমরানের দিকে তাকায়। মেয়েটি মন দিয়ে সবকিছু নিপুনভাবে গোছগাছ করছে। মাঝে মাঝে সব ঘুলিয়ে ফেলে, চায়ে প্রায়ই ৪চামচ চিনি দিয়ে ফেলে, এর জন্য তার কাছে বকাও খায়। তবে ব্রেইন অনেক ক্লিয়ার। অনেককিছুই মূহুর্তে ভেবে ফেলতে পারে। ল্যাপটপে কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করেছি,
— পড়ালেখা কিছু জানো?
— হ্যা কিছুটা করেছি।
চোখ না তুলেই উত্তর দেয় সিমরান।
— আমার বিছানাটার চাদর চেঞ্জ করে দিও। ড্রায়ারে লাল রঙ্গের চাদর আছে।
ভুলে যেও না আবার।
— আচ্ছা।
এর মধ্যেই তাওহীদের ফোনে কল আসে। সে ফোন কানে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কেমন জানি লোকটা, সারাদিন ল্যাপটপ আর ফোনে মুখ গুজে বসে থাকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শরীর অবশ হয়ে যায় সিমরানের। সারা শরীরে সুচ ফোটানোর ব্যথা অনুভব করতে থাকে। সহ্য করতে না পেরে বিছানায় বসে পড়ে। কেউ যেন তাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিচ্ছে। ছটফট করতে থাকে বিছানায়। তাওহীদ রুমে ঢুকে দেখে সিমরান বিছানায় ছটফট করছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করতে থাকে বারবার। কিন্তু সিমরান কিছু বলছেনা, একসময় তার শরীর নেতিয়ে পড়ে আর জ্ঞান হারায়।
তাওহীদ সিমরানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা মায়াজড়ানো ওর চোখে-মুখে। বেচারী ওকে বড্ড ভয় পায়, সারাদিন বকাঝকার উপর রাখে। সে আর কি করবে! এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছে, যেখানে মায়া-মমতার স্থান নেই।
সিমরানের জ্ঞান ফিরতেই সে দেখে তাওহীদ তার মুখের দিকে ঝুকে তাকিয়ে আছে। ধড়পড়িয়ে উঠে ওড়না ঠিক করে। তাওহীদ ওকে অভয় দিয়ে বলল,
— তুমি ঠিক আছো তো?
— জ্বী আমি ঠিক আছি। আমি বাড়ি যাব।
— চলো তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।
— আমি একা যেতে পারব।
— তুমি অসুস্থ, একা যেতে পারবেনা।
— নাহ, আমি ঠিকি পারব।
তাওহীদ একটা ধমক দিয়ে বলল, বললামনা, আমি ড্রপ করে দিয়ে আসব।
সিমরান চুপ করে মাথা ঝাকায়। আস্তে আস্তে গিয়ে গাড়িতে বসে। বাহিরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, আমি আসলে কি হয়েছে! কেন এত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি নিজের মধ্যে। তাওহীদ ড্রাইভ করতে করতে বলে,
— সিমরান তোমার শরীর সত্যি ঠিক আছে তো?
— জ্বী স্যার।
— তোমার বাসায় কে কে আছে?
— আমেনা বু ছাড়া আর কেউ নেই।
— তোমার মা-বাবা? প্রশ্নটা শুনে সিমরান চমকে যায়। সে নিজেও তো জানেনা তার মা-বাবা কোথায়? কখনো দেখেওনি। অবশ্য আমেনা বু বলেছে ওরা সে ছোট থাকতেই মারা গেছে।
— কি হল? চুপ করে আছো যে?
— নেই। তাওহীদ আর প্রশ্ন বাড়ায় না। গলির দোকান থেকে কিছু ফল কিনে তাকে বাড়ি অব্ধি পৌছে দিল। সিমরান অস্ফুটস্বরে বলল,
— রান্না করে ফ্রিজে রেখে এসেছি। কেয়ারটেকার চাচাকে বলবেন গরম করে দিতে।
— আমাকে নিয়ে ভেবোনা। তুমি নিজের খেয়াল রাখো অকে!
শরীর বেশি খারাপ থাকলে কাজে আসতে হবেনা। রেস্ট নাও।
যাওয়ার আগে সিমরানের কপালে একবার হাত ছুয়ে গেল তাওহীদ। না জ্বর নেই ভেবে নিশ্চিন্তে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। সিমরান তাওহীদের যাওয়ার পানে অপলক তাকিয়ে রইল। মানুষ টা একটু মেজাজী, কিন্তু খুব ভাল।
কপালে হাত ছুয়ে দিতেই কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করছিল সিমরানের।
শরীরটা ওর খারাপ হয়নি, কিন্তু অদৃশ্য যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছিল সে।
রাতের আধারে কাদতে কাদতে বেরিয়ে পড়লাম আমি। জানিনা কোথায় যাব। আত্মহত্যা করতে গেলাম বাতাসে দিয়াশলাই নিভে গেল। মনে হল মুহিব কানের কাছে এসে বলছে, আমি ফিরে আসব ওয়াফাহ।
আল্লাহ যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্য করেন।
পারিনি আত্মহত্যা করতে। অগাধ বিশ্বাস জন্ম দিয়ে বেচে আছি ওর অপেক্ষায়। মুহিব ঠিকিই ফিরবে আমার কাছে।
মা আমার সাথে রাফির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। মা ইদানিং কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেছে। মায়ের দোষ ই বা কি করে দেই। উনিও তার মেয়েকে এভাবে দেখতে পারছেননা। আমি মুহিবের স্ত্রী, তাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
তাই ঘর ছেড়ে পথে দাঁড়ানো ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলনা। আচ্ছা আমি যে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মুহিব ফিরলে আমাকে খুজে পাবে কি করে? খুজে না পেয়ে যদি ফ্যালফ্যাল করে কেদে ফেলে।
ভেবে পা থমকে যায় পথের মাঝখানে।
মুহিব আমার জ্বীনবর। ও তো সাধারণ ৫-১০টা ছেলের মত নয়, ও ওর বউ কে ঠিক খুজে বের করবে। আল্লাহ তুমি ওর সহায় হয়ো। আমার যত পরীক্ষা নেওয়ার নাও, তবুও আমার জ্বীনবর কে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।
দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। ভোর হওয়ার আগেই এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে আমাকে। কেননা, ভোরের শেষেই আমার বিয়ের আয়োজন শুরু হবে। হাত দিয়ে গায়ের চাদরটা কে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে পা চালালাম অজানার উদ্দেশ্যে। জানিনা আল্লাহ ভাগ্যে আর কি কি লিখে রেখেন।
তার সবকিছু ভালোর জন্য ভেবেই ভরসা করে আছি।
সিমরান কফির মগটা নিয়ে তাওহীদের দরজায় নক করে। তাওহীদ চুপচাপ ব্যালকুনিতে বসে আছে। নক করেও কোনো সাড়া না পেয়ে ধীরপায়ে ব্যালকুনিতে আসে সিমরান। তাওহীদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। সিমরান নিচু গলায় বলল, আপনার কফি।
কিন্তু তাওহীদ কোনো সাড়া দিলনা। সিমরান আরো একটু উচু গলায় বলল,
— স্যার, আপনার কফিটা?
তাওহীদ মুখ তুলে সিমরানের দিকে তাকাল। সিমরান দেখে তাওহীদের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। কাদো কাদো চেহারা নিয়ে সিমরানকে কিছু না বলে বেডরুমে চলে এলেন। সিমরানের ভীষণ খারাপ লাগছে, এমন মেজাজী, রাগী মানুষটার চোখে পানি কেন। তাওহীদ বিছানার উপর বসে বলল,
— সিমরান। সিমরান চমকে উঠে বলল,
— জ্বী স্যার।
— কফিটা রেখে আমার পাশে বসো। সিমরান অবাক হলেও চুপচাপ তার কথামত বিছানার পাশে এসে বসে। তাওহীদ সিমরানের চোখ চোখ রেখে বলল,
— তোমার কোলে একটু মাথা রাখি।
সিমরানের অবাকতা আরো মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তাওহীদ এমন ভাবে বলল যে সে না করতে পারলনা। তাওহীদ সিমরানের কোলে মাথা রাখে।
— আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে একটু।
সিমরানের কোনো প্রশ্ন ছাড়াই দ্বিধা নিয়ে তাওহীদের মাথায় পরমযত্নে হাত বুলাতে লাগল। তাওহীদ একটু চুপ থেকে বলল,
— জানো, সিমরান। আমারও না একটা সুন্দর ছোট পরিবার ছিল। মা-বাবা আর আমি। স্বপ্নের মত সুন্দর ছিল দিনগুলো। মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলাম আমরা। প্রতিদিন বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসতেন।
আমিও খুশি হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম।
প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম বাবার জন্য। বাবা আসলে সবাই একসাথে খাব। বাবাও কখনো দেরী করতেননা। ঠিক ৯টা বাজে বাসায় ফিরতেন। ছুটির দিনে বাবা-মা দুজন মিলে রান্না করতেন, বিকালে ঘুরতে যেতাম, রাতে মায়ের গল্প শুনতে শুনতে বাবা আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। সুখের কোনো অভাব ছিলনা আমার পরিবারে।
বলে তাওহীদ একটু থামল। হাত দিয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে নিল। নাকটা টেনে আবার বলতে শুরু করল,
— হঠাৎ অফিসে বাবার প্রমোশন হল। ৯টা গিয়ে ১০টায় থামল। তাও সবমিলিয়ে ঠিকঠাক চলছিল। একটা সময় দিন দিন বাবা রাত করে বাড়ি ফিরত। আগের মত তার পকেট হাতরিয়ে চকলেট পেতামনা, যেটা পেতাম সেটা হল বকা, তাচ্ছিল্য। অফিস থেকে ফিরলে তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিল। নিষেধ অমান্য করলে বকা খেতে হত।
বাবার উপর বড্ড অভিমান হত। রোজ রাতেই মা-বাবার ঝগড়া হত। ঝগড়া করা ছাড়া একটা রাত কাটত না। আমাকেও অন্য রুমে শিফট করে দেয় উনারা। মায়ের গল্প শুনতে শুনতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর ঘুমানো হতনা। সবকিছুই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগল।
ইদানিং বাবার সাদা শার্টে লাল লাল ছোপ পেতাম। মাকে বলতে শুনতাম বাবার গায়ে নাকি মেয়েদের পারফিউমের ঘ্রাণ পাওয়া যেত, কোটের বোতামে লম্বা চুল, সাদা শার্টে ঠোটের ছাপ।
সিমরান দেখল তাওহীদের চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে। তারও ভীষণ খারাপ লাগছে মা-বাবা না থাকায় অনাদর পাওয়া আর মা-বাবা থেকেও অনাদরে থাকাটা কত কষ্টের।
তাওহীদ মুচকি হেসে বলল,
— তারপর কি হয়েছে জানো? প্রায়ই সময় ই আমাদের বাসায় অচেনা লোক আসত। কিছুক্ষণ থেকে তারপর ফিরে যেত। মাকে জিজ্ঞেস করলে বলত,
ও তোমার মামা হয় বাবুহ।
নিজের জগত নিয়ে পড়ে থাকতাম, এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তারপর একদিন আমার ভীষণ জ্বর ছিল, সেদিন প্রচুর বৃষ্টি ছিল। আমি ব্রজপাত ভীষণ ভয় পেতাম তাই সেদিন মায়ের সাথে শুয়েছিলাম।
বাবা তখনো ফেরেননি। আজকাল তার তেমন বাড়ি ফেরা হয়না। এমনসময় কলিংবেল বাজলে মা দরজা খুলেন। সেই মামাটা এসে ঢুকে বাসায়।
মা একপ্রকার জোর করে আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে মামা সহ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি আমার রুমে এক কোণে বসে ভয়ে কাপছিলাম।
ততক্ষণে বাবাও ফিরে এলেন।
তাদের রুম থেকে অনেক হট্টগোলের আওয়াজ পেলাম। একসময় দেখলাম মা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আমার কাছে এসে বলল,
— চল তাওহীদ, আমরা অন্য বাসায় থাকব।
বাবা এসে আমাকে কোলে নিয়ে বললেন,
— তুমি চলে যাও। আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে। আমাকে নিয়ে বিরোধ চলতে চলতে একসময় ঠিক হল আমাকে বোর্ডিং দিয়ে দিবে।
জানো সেখানে প্রতি সপ্তাহে সবার মা-বাবা আসত কত মজার মজার খাবার-খেলনা নিয়ে। কিন্তু আমার মা-বাবা ই শুধু আসতনা।
৬-৭মাসে এসে একবার দেখা করে যেত, আর বোর্ডিং এর পেমেন্ট করে যেত। এই ছিল আমার জীবন।
এসব শুনে সিমরানের চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে লাগল। অনুভব করতে লাগল তাওহীদের কষ্টটা। ছেলেটার আসলেই কষ্টের সীমা নেই।
অনেকক্ষণ সিমরান অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল তাওহীদ চুপ করে আছে। তাওহীদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে সিমরানের কোলে ঘুমাচ্ছে, তার ওড়না আঙ্গুলে পেচিয়ে। ঠিক ছোট্ট বাচ্চাদের মত।
সীমরানের খুব মায়া লাগছিল তাওহীদকে দেখে। নিজের চোখের পানি কিছুতেই থামাতে পারছেনা।
.
(চলবে)