জ্বীনবর৩,পর্বঃ১৭,১৮

0
1753

জ্বীনবর৩,পর্বঃ১৭,১৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

সিমরান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০টা ১৭ বেজে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। একবার তাওহীদের মুখের দিকে তাকায় সে। তাওহীদ এখনো তার কোলে আরামে ঘুমোচ্ছে। আস্তে করে তাওহীদের মাথাটা কোল থেকে সরিয়ে বালিশে রেখে দেয়। যেই বিছানা থেকে নেমে চলে যাবে, ওড়নায় টান পড়ল সিমরানের। পিছু তাকিয়ে দেখে তাওহীদ তার আঙ্গুলে সিমরানের ওড়না পেচিয়ে রেখেছে।
সিমরান কাছে এসে আলতো করে ওড়না খুলে নিচ্ছে তখন তাওহীদের নিঃশ্বাস সিমরানের গায়ে লাগছে।
অস্বস্তিটা শিহরণ জাগানো ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে। আর দেরী করলে চলবেনা, এক্ষুনি না বের হলে ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। কেয়ারটেকার চাচাকে তাওহীদের খেয়াল রাখতে বলে আল্লাহর নাম নিয়ে সিমরানের বাড়ির দিকে হাটা দিল। ওড়না দিয়ে মুখটা বেধে নিল। দ্রুত হাটলে ১০ মিনিটেই বস্তিতে পৌছে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি পা চালালো সে। বস্তির গলিতে ঢুকে পড়ল, গলিটা এমনিতেই অন্ধকারাছন্ন। সবসময়ই নির্জন থাকে। এই গলি দিয়ে শর্টকার্টে যাওয়া যায়। গলির মাঝখানে আসতেই দেখে রাতিম আর তার চেলাগুলো একটা মেয়েকে ঘিরে ধরে মজা করছে। মেয়েটার হাত-পা আর মুখ বেধে রেখেছে।
সিমরানের রাগ উঠে গেল এসব দেখে। চিৎকার করে বলল,
— তোরা কি করছিস মেয়েটার সাথে? ওকে ছেড়ে দে।
রাতিম এগিয়ে এসে বলল, ছাড়বনা। তোকেও ধরে রেখে দিব। আমাকে ছেড়ে কোন নাগরকে ধরেছিস? গলি অবধি গাড়ি করে ছেড়ে দেয়। নতুন মাল নাকি! কত করে দেয় তোকে? কতবার বলেছি এর থেকে বেশি আমি তোকে দেব।
আমার কাছে চলে আয়। কিন্তু তুই আসলিনা, তাই ঠিক করেছি জোর করে আদায় করে নিব। এত রাতে সেই সুযোগটাই করে দিলি।
মাম্মা, আজ খেলা হবে।
বলে সে সিমরানের ওড়না ধরল। সিমরানের চোখ রাগে লাল হয়ে গেল। থরথর কাপছে সে। রাতিমের হাতটা বেকিয়ে টেনে নিয়ে উলটো করে ঘাড়ের কাছে নিয়ে এল। হাড় ভাঙ্গার মত কটমট শব্দ হল। রাতিম জোরে চিৎকার করে উঠল। এবার সিমরান রাতিমের ঘাড়টা ধরে মটকে দিল। ব্যথা পেয়ে আরো জোরে চিৎকার করে নিচে পড়ে যায় রাতিম। ওর চেলাগুলো ওর এই অবস্থা দেখে আর সিমরানের দিকে এগোয় না। সিমরানের রক্তলাল চোখ দেখে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সিমরান শান্ত হয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসে। বাধন খুলে দিলে মেয়েটি তাকে শুকরিয়া জানায়। সিমরান মুচকি হেসে বলল,
— আপনি এতরাতে কোথায় যাচ্ছেন বুবু?
— এই বস্তিতে বৈশাখী নামের কেউ থাকে?
— উমম, হ্যা থাকে। আপনি কি তার কাছস এসেছেন?
— হ্যা।
— আসুন আপনাকে পৌছে দেই।
— না বোন, এমনিতেও তোমাকে কষ্ট দিলাম।
— কি যে বলেন, বোন যখন ডেকেছেন এই টুকু তো করতেই পারি।
সিমরান মেয়েটির হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে সামনে সামনে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চলল। সিমরান বলে উঠল,
— আপনার নাম কি বুবু? কোথায় থাকেন?
— আমার নাম ওয়াফাহ। তোমার নাম কি বোন?
— সিমরান। এটাই বৈশাখী বুর ঘর। আপনি যান, উনি ভিতরেই আছে বোধহয়।
বুবু, আমি আসি? বাসায় আমার বু একা আছে।
— যাও বোন। আল্লাহ হাফেজ।
স্থিরদৃষ্টিতে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখে ওয়াফাহ। আজ ওই ছেলেগুলো ওকে কাবু করে ফেলেছিল অজ্ঞাননাশক ওষুধ স্প্রে করে। জ্ঞান ফিরে দেখে ওকে এভাবে বেধে রেখেছে। আশ্রয়ের আশায় প্রাণের সই বৈশাখীর ভরসায় তার কাছে এসেছে ওয়াফাহ।
মনে মনে মেয়েটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকল ওয়াফাহ।
ঘরের ভাঙ্গা বেড়ার ফাক দিয়ে চাদ দেখছে সিমরান। এত রাত হয়ে গেল তবুও ঘুম আসছেনা তার। এখনো তাওহীদের জন্য খারাপ লাগছে, ছেলেটার সাথে এতবড় কিছু হয়ে গেল যা যে কারো পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর।
হয়তো এভাবে অবহেলা পেতে পেতে ছেলেটা এমন রূঢ হয়ে গেছে। পাশ ফিরে শুতেই আরেকটা চিন্তা তার মাথায় এসে জট বাধল। রাতিমকে মারার মত এত শক্তি তার কাছে কি করে এল? রাতিম প্রচুর শক্তিশালী, ওর সাথে দু-চারজন মেয়ে লড়লেও তাকে কাবু করতে পারবেনা। সবচেয়ে বড় কথা হল,
সিমরান কখনো এসব করতে পারতনা, তাহলে এটা কি করে সম্ভব হল?
ভাবনাটা থেকে থেকে মাথার মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠছে।

আমি একটা দর্জি দোকানে কাজ নিয়েছি। যা রোজগার হয় তাতে খেয়ে-পড়ে চলে যাবে আমার। এই বিপদের সময় যদি বৈশাখী আশ্রয় না দিত, না জানি আমার অবস্থা কি হত। মুহিবকে খুব মনে পড়ছে।
অনেকদিন ওকে দেখিনা, ওকে জড়িয়ে ধরিনা। বৈশাখী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, জানালার ধারে বসে কি ভাবছিস?
— তোর অবদানের কথা। তোর ঋণ আমি যে কি করে শোধ করব?
— দূর কি যে বলিস! তুই হলি আমার জানের দোস্ত। তোর বিপদে আমি পাশে না থাকলে কে থাকবে?
এই নে, সিগারেট খা।
— তুই তো জানিস আমি এসব খাইনা।
— আজ খা, টেনশান কমে যাবে।
— নারে।
— তুই এত চেঞ্জ হলি কি করে? যে মেয়ে সারাদিন গুন্ডামি করত, যাকে তাকে গালি দিত, শার্ট-প্যান্ট ছাড়া অন্যকিছু পরতে পারতনা। সে তুই আজ পর্দা করিস, নামায পড়িস, অপ্রয়োজনে কথা বলিসনা।
— এই পরিবর্তন আমার স্বামী করে দিয়েছে। মানুষ টা আমার জীবনে না আসলে জানতামনা এসবে এত শান্তি।
— তো কোথায় উনি?
আমি চুপ করে রইলাম। আমি নিজেও জানিনা উনি কোথায়। মৃত তো বলতে পারবনা, আমি সেটা বিশ্বাস করিনা। সব ঘটনা বললে আমার জ্বীনবরের কথা ও বিশ্বাস করবেনা।
— হারিয়ে গেছে। একদিন ঠিক ফিরে আসবে কথা দিয়ে গেছে।
— কি যে বলিস, হারিয়ে যাওয়া মানুষ কখনো ফিরে নাকি!
— আমার স্বামী ফিরবে, দেখে নিস।
— তোর বিশ্বাস যেন সত্যি হয়।
— ইনশাআল্লাহ। তুই এখন কোথায় বের হচ্ছিস?
— একটু বাজারে যাব, শাক-সবজি ফুরিয়ে এসেছে।
— আমি যাচ্ছি। আমায় দে।
— আহা, তুই কেন যাবি?
— সমস্যা নেই, দে।
— আচ্ছা, এই নে টাকা।
— লাগবেনা, আজ আমি বাজার করে খাওয়াব। বলে বেরিয়ে বাজারে এলাম। সবকিছু দর-দাম করে দেখে দেখে কিনছি। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মুখের দিকে। অবিকল আমার মুহিবের মত দেখতে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তার কাছে ছুটে যাব, সে মুখটা ভীড়ের মাঝে মিশে গেল। কত খুজলাম আর পেলামনা।
তবে কি আমার চোখের ভুল? ওটা অন্য কেউ ই ছিল। কিন্তু এতটা ভুল আমি কি করে করতে পারি।

সিমরান তাওহীদের বিছানায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। তাওহীদ যে কি বলবে সে নিজেও বুঝতে পারছেনা। বাধা দিচ্ছেনা, কাদুক কিছুক্ষণ। কাদলে মন হালকা হয়। একসময় তাওহীদ সিমরানের হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বলল,
— কেদোনা। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে।
এতে আমার তোমার হাত নেই। বরং আমেনা বুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসীব করেন। এভাবে কাদলে উনার রুহ কষ্ট পাবে।
সিমরান তাওহীদের হাতের উপর মাথা রেখে বলল,
— আমার যে আর কেউ রইল না দুনিয়ায়।
— পাগলী মেয়ে, এসব ভাবছো কেন? আমি আছি না!
চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল, কেদোনা। আজ থেকে তুমি এই বাসায় থাকবে। বস্তিতে তো তোমার আর কেউ ই নেই। সেখানে আর একা থাকতে হবেনা কারো টানে।
— না আমি এখানে থাকতে পারবনা।
তাওহীদ চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, বললামনা এখানে থাকবা। যাও অন্য রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।
সিমরানের কাছে আজ বকাটা খারাপ লাগলনা, কেয়ারিং মনে হল। চুপচাপ অন্য রুমে চলে গেল সে।

আমার খুব অস্থির লাগছে। রান্না করছি কিন্তু রান্নায় মন নেই। আনমনে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত আমি। বৈশাখী দ্রুত আমার পাশে ঘেষে বসে চুলার আগুন কমিয়ে দিয়ে বলল, আরেহ কি করছিস কি! পুড়ে যাবে তো।
আমি ব্যস্ত হয়ে তরকারী নামাতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা লাগে। বৈশাখী হাতটা দেকগে বলল, ইস! কতটা পুড়ে গেছে। দাড়া টুথপেস্ট লাগিয়ে দেই জ্বালা কমে যাবে।
— ব্যস্ত হস না। ঠিক হয়ে যাবে।
— চুপ করে বসে থাক। ও আমার হাতে পেস্ট লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
— কি এত ভাবছিস বল তো? এসবে মন ই নেই।
— একটা কিছুর হিসাব মিলাতে পারছিনা।
— কিসের?
— জানিস, আমি বাজারে আমি একটা মুখ দেখলাম। অনেকটা মুহিবের মত। যখন মুখটা কে খুজতে গেলাম পেলামনা।
— তুই কি বলছিস মুহিব ফিরে এসেছে আর সে এই বস্তিতেই আছে?
— আমি জানিনা। নিজের চোখকে ভুল ও বলতে পারছিনা।
এতটা ভুল কি আমার হতে পারে বল!
— আমার মনে হয়, তুই মুহিবকে নিয়ে অনেক বেশি ভাবিস। তাই সব জায়গায় ওকে দেখিস।
— আরেহ না দোস্ত। এমন হলে আরো আগেও দেখতাম।
— মুহিবের কোনো ছবি আছে তোর কাছে?
— না, ও খুব ধার্মিক। এসব ছবি তুলেনা।
— তাহলে খোজ করব কি করে?
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আদৌ কি মুহিব নাকি অন্য কেউ ছিল?
কাকে বিশ্বাস করব? নিজের চোখকে নাকি মনের ভুলকে?
.

(চলবে)

জ্বীনবর৩
পর্বঃ ১৮
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

তাওহীদ এসে সিমরানের মাথার পাশে বসে। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা, চোখটা এখনো ভেজা ভেজা। ল্যাম্পের লালবর্ণের আলো তার মুখে পড়ায় কবির মায়াবতীর মত লাগছে। আলতো করে মাথায় হাত রাখে তাওহীদ। আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকে, ভাবতে থাকে মেয়েটার মুখ দেখলে কেমন একটা শান্তি কাজ করে ভিতরে। বকাবকি করলে নিজেরও খারাপ লাগে।
সবাই বলে, ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে নেই, সেটা নীরবে থাকাই শ্রেয়। তাই বকাবকিই করি বেশি। ভালোবাসা বুঝতে পেরে যদি দূরে চলে যায়। মা-বাবার পর এই প্রথম কাউকে প্রিয়োরিটি দিচ্ছে সে। কাউকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে।
তাকে হারালে চিরদিনের মত অন্ধকারে হারিয়ে যাবে সে।
ভাবতে ভাবতে চোখের পানি ছেড়ে দেয় তাওহীদ। শক্ত করে সিমরানের হাতটা চেপে ধরে, তারপর হাত ছেড়ে উঠে যায় পাশ থেকে। এখন তার একা থাকাটা খুব দরকার। মন খুলে একটু কাদার ইচ্ছে। উঠে যেতেই কেউ তার হাত টেনে ধরে।
পিছু ফিরে দেখে সিমরান তার হাতটা ধরে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
তাড়াতাড়ি চোখের পানি আড়াল করে ফেলল তাওহীদ। হাত ছাড়িয়ে পাশে বসে বলল, ঘুমাওনি কেন এখনো?
সিমরান চুপ করে তাকিয়ে আছে। তারপর চোখ নামিয়ে বলল,
— আপনি কাদছেন কেন?
— কই কাদছি নাতো! ঘুমাচ্ছোনা কেন?
— আপনি এত ভাবছেন কেন আমাকে নিয়ে?
— তোমার ভাল-খারাপ দায়িত্ব আমি নিয়েছি তাই ভাবছি। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়। আমি যাচ্ছি।
— শুনুন।
— হ্যা বলো।
— আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি এবং তাকে বিয়ে করতে চাই।
শুনে তাওহীদ প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— কে সে?
— আমাদের বস্তির। আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারবেন? আপনি তো আমার দায়িত্ব নিয়েছেন বললেন। তাই আমার ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব ও তো আপনার।
— হুম করব। ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তার ঠিকানাটা আমায় দিও।
আমি নিজ দায়িত্বে তোমাদের বিয়ে দিব। আসছি।
তাওহীদ তাড়াহুড়ো করে সিমরানের রুম থেকে বের হয়ে গেল। নিজের রুমে বসে ইচ্ছেমত কাদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দরজার চোখ যেতে দেখে সিমরান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। চোখের পানি মুছতে লাগল তাড়াতাড়ি।
— আপনি কাদছেন কেন? প্রশ্নটা সিমরান তাওহীদের দিকে ছুড়ে দিল।
— এমনি?
— আমার বিয়ের কথায় আপনি কেন কষ্ট পাচ্ছেন? আপনার কি এসে যায়?
তাওহীদের চেহারা পালটে গেল এইটা শুনে। কান্নারত চেহারা মূহুর্তেই রাগান্বিত চেহারায় পরিণত হল। উঠে এসে সে শক্ত করে সিমরানের বাহু চেপে ধরে বলল,
— আমার এসে-যায়। কারণ, মা-বাবার পর তুমি ই একজন যাকে ভালোবেসেছি। যাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমি পারবনা এটা মেনে নিতে।
সিমরান একবার তাওহীদের শক্ত করে চেপে হাতের দিকে তাকিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ওড়নাটা মাথায় টেনে বলল,
— বিবাহের ব্যবস্থা করুন।
শুনে তাওহীদ হাত আলগা হয়ে গেল। এসব শুনার পর ও সিমরানের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভেবেছিল সিমরান অন্তত একটু হলেও ওর কষ্ট টা বুঝবে। সিমরানের হাত ছেড়ে দিয়ে তাওহীদ জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।
সিমরান পিছু এসে বলল,
— আপনি জানেন না, বিয়ের আগের প্রেম অবৈধপথে তাড়না করে। আর আমি চাইনা আমাদের পবিত্র ভালোবাসাটা অবৈধ হয়ে যাক। এর জন্য খুব তাড়াতাড়ি আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে কবুল করে নিতে চাচ্ছি।
এতে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?
তাওহীদের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা কি ঠিক শুনল সে? মূহুর্তে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। চোখের পানি মুছে বলল,
— আমি কাল ই তোমাকে বিয়ে করব সিমরান।
আর এক দিন দেরী করে ভালোবাসাটাকে অবৈধে পরিণত করবনা।

সিমরান লজ্জা পেয়ে গেল। তাওহীদ তাকে বুকে টেনে নিল। সাথে সাথে সিমরানের শরীরে শক লাগে। দূরে ছিটকে পড়ে। নিজেই ভয় পেয়ে যায় এমন হল কেন? তাওহীদের শরীরের সাথে নিজের শরীরের স্পর্শ লাগতেই এমন শক লাগল কেন? তাওহীদ অবাক হয়ে বলল,
— কি হল? দূরে চলে গেলে কেন?
— বিয়ের আগে আমরা দুজন দুজনকে স্পর্শ করবনা। সহীহ্ ভাবে স্পর্শ করব।
আমি রুমে যাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
সিমরান কোনোরকম পালিয়ে রুমে চলে আসল। কি হচ্ছে এসব তার সাথে? তাওহীদকে স্পর্শ করতেই এভাবে ছিটকে পড়ল কেন সে? আল্লাহ এসব তোমার কিসের ইংগিত? মাথা থেকে ঝাড়তে গিয়েও ঝাড়তে পারলনা সিমরান।
তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।

বৈশাখীকে নিয়ে পুরো বস্তিতে চক্কর দিল ওয়াফাহ। কিন্তু সেই মুখের সন্ধান আর পেলনা। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে তার। ঘরের দাওয়ায় বসে পড়ল ক্লান্ত হয়ে। বৈশাখী খাবার নিয়ে এসে বলল,
— দুটো খেয়ে নে ওয়াফাহ। সারাদিন তো কিছুই খেলিনা।
— আমার কিছু ভাললাগছেনা।
ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। নিজের মনের সাথে, সমাজের সাথে লড়াই করতে করতে। বৈশাখী ওয়াফাহকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
— ওয়াফাহ, সত্যিটা মেনে নে। তোর মুহিব আর বেচে নেই।
যে বেচে নেই তাকে তুই কিভাবে খুজে পাবি?
— ও আমাকে কথা দিয়েছে ও আমার কাছে ফিরবে।
— আল্লাহ তোদের মিলন এই দুনিয়ায় লিখে রাখেনি। আখিরাতে তোরা দুজন দুজনকে পাবি। আল্লাহ চায়নি মুহিব তোর কাছে ফিরে আসুক, তাই নিজের কাছে নিয়ে গেছেন ওকে।
ওয়াফাহ পাগলের মত কাঁদতে শুরু করল। বৈশাখী মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— এসব ভুলে যা ওয়াফাহ। অতীত মুছে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে থাক।
তুই তোর মায়ের কাছে ফিরে যা, আর রাফি কে বিয়ে কর।
— তুই এসব কি বলছিস? আমি শুধু মুহিবের স্ত্রী। আর কারো হতে পারবনা।
— সারাজীবন এভাবে থাকতে পারবিনা। মেয়েদের জন্য এই দুনিয়া বড্ড কঠিন। বুঝতে চেষ্টা কর। এখন যদি তুই আত্মহত্যার চেষ্টা করস, ওখানে মুহিব কষ্ট পাবে। ওর রুহ কষ্ট পাবে, নতুন করে নিজেকে গড়ে নিলে। ও খুশি ই হবে।
তোদের ভালোবাসা নিখাদ হলে জান্নাতে তোরা একসাথেই থাকবি।
এভাবে তুই আর বাচতে পারবিনা। সমাজ তোকে প্রতিনিয়ত পিষে মারবে।
ওয়াফাহ একদম মৃতের মত পাথরদৃষ্টিতে বৈশাখীর দিকে চেয়ে রইল।
একসময় বৈশাখীর গায়ের উপর ঢলে পড়ে।
বৈশাখী তাকে নাড়া দিতে লাগল, ওয়াফাহর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিশ্বাস-পালস কিছুই পাচ্ছেনা।
তবে কি ওয়াফাহ এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল?

সিমরানকে সাজানো হচ্ছে। তাওহীদ একজন মহিলাকে নিয়ে এসেছে, উনি তাকে যত্ন করে বউ সাজাচ্ছেন। নিজের কাছে ভীষণ খুশি লাগছে, আজ সে একটা পরিচয় পাবে। আজ থেকে সে হবে তাওহীদ মাহমুদের স্ত্রী। মহিলাটা হেসে বলল, দেখুন, আপনাকে কেমন সুন্দর লাগছে? আপনার রুপ কেমন ফুটে ওঠেছে?
সিমরান চোখ মেলে আয়নার দিকে তাকাল। লাল লেহেঙ্গা, ভারী গয়না, মেকাপ, চুলে ফুলের খোপা সবমিলিয়ে নিজেকে সত্যি বউ বউ লাগছে। লজ্জাসূচক একটা হাসি দেয় সিমরান। মহিলাটি বলল,
— আল্লাহ আপনাদেরকে সুখে রাখুক। আমি আসি।
সিমরান মিষ্টি হেসে বলল, আমাদের শুভ মূহুর্তে আমাদের কে দোয়া না করে যাবেননা। মহিলা সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেল।
আর কিছুসময়ের অপেক্ষা তারপর কাজী তাদের বিয়ে পরাবে। সিমরান তাওহীদকে সারাজীবনের জন্য কবুল করে নিবে। সিমরানের ইচ্ছেতে ছোট ঘরোয়াভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। বস্তির খাদেজা খালা, বৈশাখী বু আর অই ওয়াফাহ বোনকে দাওয়াত পাঠিয়েছিল। ওরা কখন আসবে?
বাদ যোহর কাবিননামা হবে।
তাওহীদ সিমরানেরর কাছে এল তাকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য। একটু পরেই তাদের বিয়ে হবে। রুমে ঢুকতেই তাওহীদের মুখ কালো হয়ে গেল। কোথাও সিমরান নেই। সব ঠিক আছে শুধু সিমরানকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। চারিদিকে খোজ চালানো হল, সিমরান কোথাও নেই। তবে সিমরান ওকে বিয়ে করতে চায়না বলে পালিয়ে গেছে।
এমনটা কি করে করতে পারল সিমরান?
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here