জ্বীনবর৩,পর্বঃ২৪,২৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
তারপর ছায়াটার পিছু পিছু আবার হাটতে লাগলাম। যতো সামনে এগোচ্ছি তাওহীদের সেই নিষ্পাপ ঘুমিয়ে থাকা চেহারার কথা মনে পড়তেছে। ইচ্ছে করছে ছুটে যাই তার কাছে কিন্তু না তা তো সম্ভব না এখন। সামনে এগিয়ে যাওয়াটা যতটা দুঃসাধ্য ভয়ংকর ঠিক তেমনি এখান থেকে পিছপা হওয়াটা আরও বেশী ভয়ংকর। কিছুটা যেতেই একটা বিরাট জলাশয় পড়ল। ছায়াটা থমকে গিয়ে বলল, এই জলাশয়ের ওপারে রয়েছে জ্বীনরাজ্যের গুপ্ত সদরদরজা।
এই ধাপটা ভীষণ কঠিন। হয়ত মরতে হবে নয়ত মারতে হবে। এই জলাশয়ের পানি অনেক বেশি ঠান্ডা। বরফগলা পানি বলতে পারো। ১৫মিনিটের বেশি থাকলে দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে। তাছাড়া এই জলাশয়ে জোক আর কুমিররুপী জ্বীন রয়েছে। এরা অনেকদিনের অভিশপ্ত আর প্রচন্ড হিংস্র। তুমি পানিতে নামার সাথে সাথেই এরা তোমাকে আক্রমণ করবে।
শুনে ঢোক গিলে একবার জলাশয়ের দিকে তাকালাম। দেখতে ভীষণ শান্ত এবং সুন্দর। কিন্তু এর পিছনে এটার এত ভয়ানক রুপ। ছায়াটা আমাকে বলল,
— এই পুরোটাই তোমাকে সাতরে পার হতে হবে। আর সেটা ১৫মিনিটের মধ্যেই। জলাশয় টা যত বড় তাতে খুব বেশী জোরে সাতরে গেলে ৪৫মিনিট লাগবে। যা থাকে কপালে। প্রস্তুত হয়ে নিলাম। কোমড়ের আচলে একটা ছোট ছুড়ি ছিল। সেটা বের করে হাতে নিলাম। জানিনা এটা দিয়ে ওদের সাথে মোকাবেলা করতে পারব কিনা! তবে মৃত্যুর আগ অব্ধি লড়াই করে যাব। ভেবে আল্লাহর নাম নিয়ে জলাশয়ে ঝাপ দিলাম। ছায়াটা যা বলেছিল একদম সত্যি। পানি এতটাই ঠান্ডা যে ৫মিনিটে কেউ দম আটকে মরে যেতে পারে। সাতরাতে লাগলাম অনেক জোরে জোরে। একটু পর দেখলাম আমার চারপাশে অগণিত জোক আর কুমির।
এক এক করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। হাতের ছুরি দিয়ে কয়েকটা মারলাম। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ! পারছিনা আর, একদিকে হাত-পা অবশ হতে শুরু করেছে। এদিকে যত মারছি তত এরা এগিয়ে আসছে। একটা কুমির আমার হাতে সজোরে কামড় বসাল। ব্যথায় হাত থেকে ছুরিটা পড়ে অতল পানিতে তলিয়ে গেল। এবার কি হবে ভাবছি! মূহুর্তে ডুব দিলাম। এরাও ঢুব দিয়ে আমাকে খুজতে লাগল। পানির একটুনিচে থাকলে এরা আমাকে ধরে ফেলবে। তাই পানির একদম গভীরে নেমে গেলাম। এভাবে ডুব সাতার দিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আর পারছিনা, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এভাবে আর কয়েক মূহুর্ত থাকলে মরে যাব। তাড়াতাড়ি পানির উপরে মাথা তুললাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি ডাঙ্গার কাছেই আছি। দেরী না করে সাতরে উঠে পড়ল। শরীর এখনো থরথর করে কাপছে। নিশ্চিত নিউমোনিয়া ই হবে। তাও আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি।
জ্বীনকন্যা হওয়ার শাস্তি এত জানা ছিলনা। ছায়াটা কোথা থেকে আবার ফিরে এল। একটা মোটা চাদরের মত কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে নিতে বলল। তার কথামত পেচিয়ে নিলাম। সে খোশমেজাজে বলল,
— তুমি পেরেছো।
— আল্লাহ সহায় ছিলেন।
— শোকরান।
সামনেই জ্বীনজগতের সদরদরজা। সেটা পের হলেই জ্বীনজগতের দুনিয়ায় যাবে তুমি। খুব সাবধানে থেকো। আমি তোমার সাথে আর যেতে পারবনা। তবে এটা মনে রেখো, সেখানে পদে পদে তোমার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।
আর হ্যা, তুমি পোশাক পালটে খাদিমার সেজে নাও। যাতে কেউ তোমাকে দেখে একজন দাসী ছাড়া আর কিছুই না ভাবে। তোমার ব্যাগে পোশাক রয়েছে। সুযোগমত পালটে নিও।
এগিয়ে যাও। আমি আসি। আল্লাহ তোমার সহায় হন।
— জ্বি। ফি-আমানিল্লাহ।
তাওহীদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। উঠে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নিল। আজ এতবেলা হওয়ার পর ও সিমরান আমাকে ডেকে দিলনা। সে জানে আমাকে না ডেকে দিলে আমার ঘুম ভাঙ্গবেনা।
ওহ, কাল রাতের ঘটনার পর আমার তার কাছে এসব আশা করা বৃথা। ভাবতে ভাবতে তাওহীদ ফ্রেশ হয়ে নিল। এতক্ষণ হয়ে গেল রান্নাঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছেনা কেন! সিমরানের কি হল আজ?
ধীরপায়ে তাওহীদ রান্নাঘরে আসল। কোথাও তো সিমরান নেই।
তাওহীদের মন অজানা আশংকায় কেপে উঠল। পাগলের মত পুরো বাড়ি সিমরানকে খুজল। কোথাও সিমরান নেই। তবে কি সত্যি সিমরান আমাকে ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেছে? আমার পবিত্র ভালবাসা তাকে আটকে রাখতে পারেনি।
বিছানায় উপর হতাশ হয়ে বসে পড়ল। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। সিমরানকে একটাবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কি দোষ ছিল আমার? আমার ভালবাসায় তো কোনো খাদ ছিলনা? কেন এমন হল আমার সাথে?
হঠাৎ বিছানার উপর রাখা খামটা চোখে পড়ল আমার। এটা নিশ্চয়ই সিমরান ই রেখে গেছে। খামটা ছিড়ে সাদা ভাজ করা কাগজটা বের করলাম।
সেখানে সিমরানের কাচা হাতের কিছু লেখা ছিলঃ
প্রিয় স্বামী,
আমার সালাম নিও। মনে মনে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাকে ভীষণ অপরাধী ভেবে নিয়েছো। অনেক বেশী কষ্ট ও পেয়েছো। আমি সত্যি ই তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। আমি চাইনা তুমি সারাজীবন আমাকে অপরাধী ভেবে নিজেই কষ্ট পাও। তাই আসার আগে তোমাকে সবটা জানানো উচিৎ মনে হয়েছে। মুখে বলার মত সাহস আমার নেই, তাই চিঠিই শেষ ভরসা।
তোমাকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম আর এখনো ভালবাসি। আমার জীবন কিংবা অতীত সম্পর্কে তুমি অবগত নও যেমনটা তোমার আমার বিয়ের আগ অবধি আমি ছিলামনা। সেদিন হঠাৎ করে আমার উধাও হওয়ার কারণ এটাই আমার আসল জীবনের সম্পর্কে জানার জন্য কেউ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য এক জগতে।
তুমি হয়ত ৫-১০টা মানুষের মত বিশ্বাস করবেনা কিন্তু এটাই সত্যি আমি তোমার মত রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ নয়। আমি জ্বীনকন্যা মুসকান। জ্বীন এর সন্তান আমি। যদিও পুরো সঠিক পরিচয় আমি জানিনা। একজন জ্বীনকন্যা হিসাবে আমার উপর একটা দায়িত্ব ছিল একজন অসহায় জ্বীনকে উদ্ধার করা। যেটা করতে গেলে আমার শক্তি আর সামর্থ্য প্রয়োজন। তোমার আমার মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে উঠলে সেটা আমার এসব নষ্ট করে দিত। তাই আমাকে নিষেধ করা হয়েছিল। আর সেজন্য বাধ্য হয়ে আমি তোমার সাথে এসব করেছি।
বিশ্বাস হচ্ছেনা, তাহলে সেদিন রাতের কথা ভেবে দেখো যেদিন আমাদের উপর আক্রমণ হয়েছিল।
এসবের সাথে লড়াই করতে গিয়ে আমার সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই আমি জ্বীনরাজ্যে যাচ্ছি নিজের শক্তি আর দায়িত্ব পালন করতে। জানিনা কোন পদে আমার মৃত্যু লেখা আছে। তবে হয়ত আমাদের আর দেখা হবেনা।
তুমি আমার আশায় থেকোনা।
ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করো। নিজের খেয়াল রেখো, নিজেকে কষ্ট দিওনা।
আল্লাহ হাফেজ। ফি-আমানিল্লাহ।
চিঠিটা পড়ে তাওহীদ হতভম্ব হয়ে গেছে। কি বলবে বুঝতে পারছেনা! একটু নীরব থেকে বলল, তুমি সিমরান হও কিংবা মুসকান। আমি তোমাকেই ভালবাসি। নতুন জীবন তোমার সাথেই শুরু হয়ে গেছে।
তোমার জন্যই অপেক্ষা করব সারাটা জীবন।
আল্লাহ তুমি ওর সহায় হও।
মুসকান পোশাক পালটে নিল। ছোট আয়নায় দেখে নিল তাকে একজন খাদিমার মতই লাগছে। তার দুকদম সামনে বিশাল স্বর্ণের শক্ত দরজা, দরজার উপরে আরবিতে লেখা, “এই জগত তারই জন্য, যে আগুনের তৈরী। আল্লাহ জ্বীনকে নিশ্চয়ই আগুন দিয়ে তৈরী করেছেন।”
“শোকর করুন তার দরবারে।”
.
(চলবে)
জ্বীনবর৩
পর্বঃ২৫
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
সদরদরজায় কোনো পাহারা নেই দেখে অবাক হলাম। অবশ্য এর আগে যত কঠিন ধাপ আছে তাতে সাধারণ কারো পক্ষে তা অতিক্রম করা অসম্ভব। এইজন্যই হয়ত নিশ্চিন্তে আছে তারা, কোনো পাহারা ও নেই। আয়নাটা ব্যাগে ঢুকাতেই আয়নায় ভীষণ জোরে আচড় কাটার শব্দ এল। আয়নাটা আবার হাতে নিলাম। জ্বীনদাদুর প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। আমি সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, অভিনন্দন এত কঠিন ধাপগুলো পার হয়ে লক্ষ্যের মুখে প্রবেশ করছো। কিন্তু এতেই ভেবোনা তোমার বিপদ শেষ।
— তবে কি আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে?
— তোমার জন্য প্রতিটা পদক্ষেপেই বিপদ। যা পার করেছো তার চেয়ে বেশী ভয়ংকর। এই সদরদরজায় কোনো পাহারা নেই তাই ভেবেছো খুব সহজে ঢুকতে পারবে। এটাও একটা নিপুন ফাদ। দরজায় খুলে তার ভিতরে প্রবেশ করলেই অনেকগুলো বরফি তলোয়ার তোমার দিকে ছুটে আসবে ঝাকে ঝাকে। তাও চোখের পলকে। সেগুলোর একটা না একটা তোমাকে আঘাত করবেই যতই যা করো তুমি। যেহেতু তুমিও আগুনে তৈরী, সেই বরফি তলোয়ার তোমার শরীরে লাগলেই তুমি মাটিতে মিশে যাবে। তোমার শরীরের অস্তিত্বই থাকবেনা, আর রুহ আটকে যাবে জলাশয়ে মরে থাকা কোনো জোক-কুমিরের শরীরে।
যতদিন না মারা যাচ্ছো, ততদিন ওই জলাশয়েই তোমাকে বন্দি হয়ে জীবন কাটাতে হবে। আমার বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, এক একেকটা ধাপ আমার কাছে মৃত্যুর কাছাকাছি সীমানা মনে হচ্ছে।
— তাহলে আমি প্রবেশ করব কি করে?
— সেই উপায় তোমাকেই বের করতে হবে। আসি।
আল্লাহ তোমার সহায় হন।
— আমিন। আয়নাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ভাবতে লাগলাম কিভাবে তলোয়ারের হাত থেকে নিজেকে বাচাব। জ্বীনদাদু বলেছে শরীরে স্পর্শ করলেই আমি মাটিতে মিশে যাব। তার মানে এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে তলোয়ার আমার শরীর স্পর্শ না করতে পারে। কিন্তু আমি তো সাথে করে এমন কিছু আনিনি যা দ্বারা শরীর আবৃত করতে পারি।
হঠাৎ চোখে পড়লাম মস্ত বড় এক পাথর। ওটা বহুকষ্টে সদরদরজার ভিতরে ঢুকালাম, তারপর আমি ঢুকলাম। পাথরটা আমার চেয়ে চারগুন বড়। তার জন্য আমি সামনের কিছুই দেখতে পারছিনা। এইটুকু পথ ঠেলে এনেই আমার দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ করে পাথরটা নড়তে লাগল আর কড়কড় শব্দ হল। নিশ্চয়ই তলোয়ার গুলো আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি পাথরটাকে সর্বশক্তি দিয়ে আবারো ঠেলতে লাগলাম। ওটা গড়িয়ে যেতে লাগল। সরে এসে দেখি তলোয়ার ছোড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমার চারদিকে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া তলোয়ার পড়ে আছে। সামনে এত শক্ত বড় পাথর থাকায় ওরা আমার শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। নিরাপদে জ্বীনরাজ্যে ঢুকে গেছি আমি।
হাটতে হাটতে চারিদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। উন্মুক্ত প্রান্তর, চারিদিকে আঙ্গুর-খেজুর সহ বিভিন্ন ফলের বাগান, গাছে গাছে থোকা থোকা ফল ঝুলছে। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির, প্রজাপতিও উড়ছে। ভীষণ মনোরম দৃশ্য, ফলগুলো দেখে ক্ষিদে পেয়ে গেল। কিন্তু ওইগুলোর দিকে হাত বাড়ালামনা।
কে জানে ওসবে কোন বিপদ আমার জন্য ওত পেতে আছে!
তাই সোজা হাটতে লাগলাম। কিছুটা হাটার পর একটা বাজার দেখতে পেলাম। ওখানে মানুষের মতই দেখতে অনেক জ্বীনের আনাগোনা। কি অদ্ভুত লাগছে! পুরো মানুষদের মতই ওদের নিজস্ব একটা দুনিয়া আছে। তবুও ওরা এই দুনিয়া ফেলে রেখে মানুষের দুনিয়ায় কেন যায়? এই প্রশ্নটা মনে খোচখোচ করছে।
অনেক জ্বীনমহিলাও দেখতে পাচ্ছি। অনেকে পর্দা করে আছেন, অনেকে কিছুটা খোলামেলা। কিছু উৎসুক চোখ আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
কে জানি সন্দেহ করছে কিনা! এদিকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ক্ষুধা ও লেগেছে কিছুটা। বাজারের একটা ফাকা জায়গায় বসে পড়লাম। যা পরিস্থিতি বুঝলাম, একদিনে ঘুরে ঘুরে আমার কার্যসাধন করা সম্ভব না।
আমাকে এখানে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। কিন্তু কার কাছে আশ্রয় নিব? না আমাকে কেউ চিনে না আমি কাউকে!
এমনসময় দেখি ৪-৫ বছরের একটা বাচ্চা আমার পাশে বসে কাদছে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাচ্চাটা শুভ্রসাদা, দেখতে ভীষণ কিউট। গাল টা ফোলাফোলা, চোখের মণিটা অন্যরকম। দেখেই মানুষের থেকে আলাদা মনে হয়। এ নিশ্চয়ই জ্বীনের বাচ্চা। জিজ্ঞেস করব কি করব না ভাবতে ভাবতে করেই ফেললাম,
— কাঁদছো কেন বাবুহ?
সে কান্না থামিয়ে আমার দিকে চোখ বড়বড় করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
সেটা খেয়াল করে বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। এ বাচ্চা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
— এভাবে তাকিয়ে আছো কেন বাবুহ?
— তুমি আমাকে বাবুহ বললা কেন? আমি কি বাবুহ নাকি! আম্মাহুজুর বলেছে আমি বড় হয়ে গেছি। তুমি আর আমাকে বাবুহ ডাকবানা।
এর কথা শুনে হাসব না কাদব বুঝতে পারছিনা। পায়ে দিয়ে সালাম করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, আচ্ছা দাদু তোমার বয়স কত?
দেখেই মনে হচ্ছে এ খুব রাগী আর ত্যাড়া টাইপের। হিসেব করে কথা বলতে হবে এর সাথে।
— আমি তো জানতামনা।
— কি জানতে না? আমাকে বাচ্চা মনে হয় তোমার পিচ্চি মেয়ে!
এবার আমার অবাকতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। এক বাচ্চা ছেলে আমাকে পিচ্চি বলছে। জ্বীনের বাচ্চা বলে কথা, এমন তো হবেই।
— আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তো তোমার নাম জানিনা তাই বলে ফেললাম।
— ওহ। আমার নাম আবদুল্লাহ আল সাজ্জাদ বিন তাশফীকুর জুহানী।
এত বড় নাম শুনে আমি হতভম্ব। ডাকনাম জিজ্ঞেস করেছি সে আমাকে নামের লিস্ট ধরিয়ে দিল। পারেও বটে।
— শুনো, আবদুল্লাহ।
— আবদুল্লাহ আল সাজ্জাদ বিন তাশফীকুর জুহানী। পুরোটা বলে ডাকো। এভাবে ডেকে আমার নাম পরিহাস করবানা। আম্মাহুজুর কত্ত সুন্দর নাম রেখেছে এইটুকু ডাকার জন্য না।
— আমার তো পুরো নাম মনে থাকেনা। তোমার ডাকনাম নেই?
— আছে তো। আম্মাহুজুর ডাকে সোনামানিক, আব্বাহুজুর ডাকে আব্বুজান, বন্ধুরা ডাকে বন্ধু, ভাইয়া ডাকে আমার কলিজার ভাইটা, প্রতিবেশী ফুফু আম্মা ডাকে আমার বাবাটা….
শুনে আমি হতাশ। এই কি ছেলে না আগুনের ফুলন্ত ছটা! বলেই যাচ্ছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। তাকে চুপ করানোর প্রচেষ্টা চালালাম,
— আমি তোমাকে কি ডাকব?
সে আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে বলল, জুহানী ডাকবা। তোমার জন্য নাম ছোট করলাম, সুন্দর করে ডাকবা বুঝছো!
— আচ্ছা জুহানী, তুমি কাদছিলে কেন?
— আমি ভীড়ের মধ্যে আম্মাহুজুরকে হারিয়ে ফেলেছি।
এখন খুজে পাচ্ছিনা।
আমি এদিক সেদিক তাকালাম একবার। আসলেই বাজারে এখন ভীষণ ভীড়। কিন্তু কোনো মহিলাকে এদিকে আসতে দেখছিনা।
— তুমি তোমার আম্মাহুজুরকে নিয়ে কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
— ওই যে বলে একটা মস্ত বড় শামিয়ানার দোকান দেখাল। সেখানে এখনো উপচে পড়া ভীড় মহিলাদের।
— তুমি তোমার আম্মাহুজুরের কাছে যাবে?
— হ্যা যাব। তবে একটু পর।
— একটু পর কেন?
— তোমাকে যে নাম ছোট করে দিলাম তার জন্য উসুল নিব না।
— কি উসুল নিবে তুমি?
— তোমার পরিচয় নিব। তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো?
— আমি মুসকান, একজন খাদিমা। অনেক দূরের গ্রাম থেকে এসেছি।
— তোমাকে দেখে তো খাদিমা মনে হয়না।
— কেন?
— সেটা পরে বলব।
বাচ্চাটার কথা শুনে এবার আমার মনে ভয় ঢুকে গেল। এটাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরিয়ে নিজের পথ ধরতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
— তোমার আম্মাহুজুরের কাছে যাবেনা?
— যাব, একটু পর। উনি বেরিয়ে আসুক ওখান থেকে।
— এতক্ষণ কাদছিলে তার জন্য! এখন পরে যাবে কেন?
— তোমার সাথে গল্প করতে ভালোলাগছে। আমি চুপ হয়ে গেলাম। বাচ্চাটাকে কি করে সরাব সেটা ভাবছি। এমন সময় দেখি এক মহিলা ছুটে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। বাচ্চাটা এগিয়ে এসে মহিলাটার কোলে উঠে গেল।
মহিলাটা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মাহুজুর কে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে সোনামানিক?
— হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে এই বুবুটার কাছে চলে এসেছি। গল্প করেছি উনার সাথে।
— ধন্যবাদ মা। এতক্ষণ তুমি ওকে দেখে না রাখলে হয়ত হারিয়ে যেত।
— শুকরিয়া।
— কে তুমি? আগে তো কখনো দেখিনি!
— আমি খাদিমার কাজ করি। অনেক দূর থেকে এসেছি কাজের সন্ধানে।
ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিধে পেল তাই এখানে বসে পড়লাম।
— আহারে। কাজ পেয়েছো?
— না পাইনি।আরেকটু খুজতে হবে হয়ত।
— আমার একজন খাদিমার প্রয়োজন আমার সন্তানকে দেখাশুনা করার জন্য। তোমার যদি আপত্তি না থাকে এই কাজটা করতে পারো।
— আমার কোনো আপত্তি নেই খালা। খুশিমনে কাজটা করতে রাজি আমি।
— আমারো তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। কত দিনার নিবে?
— লাগবেনা খালা। শুধু আশ্রয় আর দুবেলা খেতে দিলেই হবে।
— ঠিক আছে। চলো আমার সাথে।
বাচ্চাটা মায়ের কোল ছেড়ে আমার কোলে উঠতে চাইল। কোলে নিলাম, পুরো পথ পাকা পাকা কথা বলে জ্বালাল।
মহিলার বাড়িতে ঢুকলাম। ভীষণ সুন্দর বাড়িটা। গুছানো সংসার, আল্লাহ ভক্ত ও খুব। ব্যবহার ও মাশা আল্লাহ। স্বামী, উনি আর দু ছেলেকে নিয়ে ছোট সংসার। সবাই ই আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলল। উনার বড়ছেলে আমার দিকে কেমন জানি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। হয়ত তার ও বিশ্বাস হলনা আমি একজন সাধারণ খাদিমা। এদের একটু বাকাদৃষ্টি আমার ভয়ের কারণ। নিজের জান মালের ভয় নয়, ভয় এটাই যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে যাই তবে আমার কার্যসাধন হবেনা কিছুতেই।
জুহানীর সাথে আমার গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল। ভীষণ মিষ্টি ছেলে। সারাক্ষণ বুবু বুবু বলে পিছু লেগে থাকে। তাওহীদের কথা ভেবে মনটা বেশিক্ষণ খারাপ থাকতে পারেনা পিচ্চিটার জন্য। আমার কাছে ঘুমায়, খাওয়া-দাওয়া করে সবমিলিয়ে ওর দেখাশোনা আমিই করি। পরিবারটাও ভীষণ ভাল, এই কিছুদিনে আমাকে অনেক আপন করে নিয়েছে।
অনেক বিশ্বাস করে। এদেরকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই খারাপ লাগে।
সেদিন জুহানীর সাথে ঘুরতে বেরিয়ে বড় সুরম্যপ্রাসাদটা দেখলাম। পুরো ছবিতে দেখানো রাজপ্রাসাদের মত। ফটকের বাহিরেই এত সৈন্যসামন্ত পাহারায় রাখা, ভেতরে না জানি কত কঠোর নিরাপত্তা। সুযোগের অপেক্ষায় আছি, সুযোগ পেলেই প্রাসাদে ঢুকব।
খুজে নিব জ্বীনি তলোয়ারটা।
আজ জ্বীনমহিলাটা আমাকে একান্তে তার কক্ষে ডাকল। কিছুদিন ধরে উনি আমাকে কেমন একটা দৃষ্টিতে দেখছেন। বুঝলামনা একা কেন আমাকে ডাকলেন। এভাবে তো কখনোই ডাকেন না।
তবে কি উনি বুঝে নিয়েছেন আমি সাধারণ কেউ না…..
.
(চলবে)